মুলাডুফির বন
মুলা শব্দটা কানে লাগতেই যে-কারো চোখের সামনে ভেসে উঠতে পারে শীতের সবজি মুলা-গাজরের চেহারা। কিন্তু ঝামেলা যত ডুফি আর বনের পয়গামে। সুনামগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষায় ডুফি মানে ঘুঘু আর বন শব্দটাতে বোঝায় দিগন্তজোড়া মাঠ।
শেষ বিকালের লাল রোদে ভাসা, সবুজ ঘাসে ঢাকা, মুলাডুফির বনের বাহার দেখতে আমি আর দীন (কবি মোস্তাক আহমাদ দীন) কত কত বৈকালে বেরিয়ে পড়েছি! আজকে যারা আয়োজন করে সিলেটের রাতারগুল দেখতে যান তাদেরকে বলছি, দীনভাইদের এই ইসহাকপুর গ্রামটা বর্ষাসকালে হয়ে উঠত ছোটখাটো একটা রাতারগুল। দীনের তখন একটু-একটু গোঁফ উঠছে। আমার গোঁফেও ছুরির মতো ঝলক মারে বাঁধভাঙা তারুণ্য।
রাত দুইটা কিংবা দিনের দুইটা যখনই দীনের বাড়ি গেছি, সে তার ছাদের চিলেকোঠায়। দামি আর মোটা কার্পেট বিছানো রুমটা রীতিমতো বইয়ের গুহা। চার দেওয়াল ঘিরে বইয়ের শেল্ফ ছাড়া ঘরে কোনো আসবাব নাই। তপস্বী ঋষির মতো দীন কার্পেটে আসন ভিড়িয়ে বসে আছে, সামনে খোলা বই কিংবা কবিতার খাতা। খুব কম কথা বলে, — যা-ও দুই-একটা বলে, শুনতে হলে কান পাততে হয়। কিন্তু তখনই বিখ্যাত সব লিটলম্যাগের কল্যাণে দীনের কবিতা দুই বাংলাতেই কথা বলছে হাজার মুখে।
আমার মতো একটা জীবন্ত বন্য প্রাণি দীনের চিলেকোঠায় ঢোকার পর হয়ে যেত অবোধ শিশু। দীন আমাকে দেখে একটু লাজুক হেসে, হাতে ঠেলা দিয়ে সামনে থেকে বইখাতা সরিয়ে দিয়ে বসতে দিত। আমার চারপাশের শেল্ফে শেল্ফে নীরবে বসে আছে দুনিয়া-কাঁপানো হাজার হাজার কবিসাহিত্যিক আর সামনে এক বিনয়ী সাধক। তাই আমি কথা বলা তো দূরে থাক হাত-পা নাড়াতেও ভয় পেতাম।
আমি লোভীর মতো দীনের কবিতার মোটা পাণ্ডুলিপির দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলতাম, — নতুন কবিতাগুলো একটু পড়তে পারি?
সে তার রোগা-রোগা কালো হাতে, নীরব আভিজাত্যে তার পাণ্ডুলিপি আমার হাতে তুলে দিত। আমার দুই হাত প্রেমিকার লজ্জারাঙা মুখ ছোঁয়ার আবেগে কেঁপে ওঠে। একটা ভালো কবিতা পড়তে পারা মানে জীবনের অনেকখানি স্বাদ চেখে ফেলা।
ছাপার অক্ষরের মতো হাতে-লেখা ঝকঝকে কবিতার লাইন আমাকে প্রথমেই মুগ্ধ করে ফেলে। কারণ যার হস্তলিপি শিল্পীর তুলির মতো এতটা দরদ দিয়ে লেখা তার কবিতায় জীবনের তানপুরা অবিনাশী কথা কইবেই।
আমি পড়ছি তো পড়ছিই। পরিচিত আরবি, ফারসি, উর্দু আর অপ্রচল কিন্তু তারুণ্যভরা আঞ্চলিক বাংলা শব্দ দিয়ে গড়া কবিতাগুলো একবার পড়ে মন ভরছে না দেখে সেই হীরা-মানিকের খনিতে আমাকে অন্তত পাঁচ-ছয়বার ডুবিয়ে ডুবিয়ে তার সবটুকু সার তুলে নিতে হয়। এই ফাঁকে প্যান্টের উপর পাঞ্জাবি চাপিয়ে দীন রেডি হয়ে বলত, — চলো…।
মায়ের বুকের মতো ছোট্ট এই গ্রামটা জোড়হাতের তালুর রেখার মতো অসংখ্য খাল-নালা দিয়ে চারপাশের হাওরগুলোতে অবিরত পানি চলাচল করে। গ্রামের পশ্চিমে বিশাল ডলুয়ার হাওর। উত্তরেও দিগন্ত ছুঁয়েছে ডলুয়া। পুবে মুলাডুফির বন অন্তত দীঘে-ফাড়ে চার মাইল। দক্ষিণে হাফাতির হাওরের বিশালতা চার মাইল ছাড়াবে নিশ্চিত। চারপাশ ঘেরা হাওরের মাঝে ঠাসবুনন হিজল, জারুল, করচ আর বিরাট বিরাট শিলকড়ুই গাছের নিবিড় আলিঙ্গনের মাঝে দাঁড়িয়ে-থাকা গ্রামটাকে বাইরে থেকে একটা বনের মতো লাগে।
কটকটা রোদের নিঝুম দুপুরে দীন আমাকে সাথে নিয়ে বাড়ির পাশের খালে বাঁধা ছোট ডিঙি নাওয়ে ওঠে। আমি শুকনা দেশের মানুষ তাই কাঁপা কাঁপা পায়ে ছোট্ট নাওয়ের আগা গলুইয়ে গিয়ে বসি। দীন বৈঠা হাতে বসে পেছনের গলুইয়ে। খালের পানির আয়নার মতো চকচকা বুকে দুইপাশের গাছগাছালির ঘন ছায়া, স্বর্গের মতো চারপাশের প্রকৃতির নীরব বৈভব দেখে দেখে হা হয়ে যাওয়া আমার মুখের আদল দীনের বৈঠার ঘায়ে পানিতে বারবার কেঁপে ওঠে, বারবার ভাঙে-গড়ে।
খালের স্রোতে নাও ছেড়ে বৈঠায় হাল ধরে দীন চুপচাপ বসে থাকে। দুইপাশে জানা-অজানা নানান জাতের গাছবৃক্ষ-লতাপাতার মাঝে মাঝে বুবি, জামরুল, করমচা আর লুকলুকি গাছের শরীরভরা পাকা পাকা ফল। মাঝে মাঝে বাড়ির ঘাটে বাঁধা ছোট ছোট ডিঙি কার অপেক্ষায় জানি পানির টানে বারবার দোল দিচ্ছে! আমরা নীরবে দেখতে দেখতে পানির স্রোতের টানে এ-খাল থেকে সে-খালে ভেসে যাই। ভেসে ভেসে জলমাটি-বৃক্ষলতার জগতে স্বর্গের মানিক কুড়াই।
দীনের নীরবতা দেখে মনে হয়, এখন কথা বলাও পাপ। পানির পাঁচ-সাত হাত গভীরে রোদের জেল্লায় চকচক করে সবুজ শ্যাওলা, পাতাঝাঁঝি, পানিমরিচ সহ নানান রকম জলজ উদ্ভিদের হরিৎ লাবণ্য। মাঝে মাঝে সেদিকে ঝলক দেয় ছোট ছোট রূপালি মাছের চঞ্চল শরীর। হঠাৎ হঠাৎ প্রিয়তমার মাথার এলোমেলো চুলের মতো চুম্বনের মতো আমাদের ঘাড়-মাথা, মুখ ছুঁয়ে যায় মাথার উপরের ডাল থেকে নেমে আসা হাজার হাজার হিজলফুলের ছড়া।
সবার পুবে মুলাডুফির বন। বৃত্তাকার গ্রহের মতো, প্রেমিকার হাসিমাখা মুখের মতো সবুজ আর সমতল মাঠটাই যেন একটা পৃথিবী। মাঝ দিয়ে একটা বড় খাল গেছে। কেউ কেউ বলে গাঙ। সারা তল্লাটের মাঝে এই মাঠটাই একটু উঁচু। তাই বর্ষার পানি আসে সবার পরে। আবার চলেও যায় আগেভাগে। এই কারণে বলতে গেলে মাঠটা সারা বছর সবুজ ঘাসে ঢাকা থাকে।
কোনো-কোনোবার রাত একটু গভীর হলে আমি আর দীন গিয়ে অন্ধকারে ঢাকা মুলাডুফির বন সামনে নিয়ে বসে থাকি ঘণ্টার ঘণ্টা। মহাকাশের মতো অসীম শূন্যতার অন্ধকারে ডুবে থাকা মাঠটা থেকে কত রকম নিশাচর পাখি আর প্রাণির শব্দ-যে ভেসে আসে! ছোট্ট আর তুচ্ছ এই জীবনের কলরব, কালিমাহীন মুলাডুফির বন যেন কিছুই না বলেও পলে পলে জীবন-জগতের সব কথাই আমাদের কানে কানে বলে যায়!
জীবনের ডাকে দীন আজ মুলাডুফি থেকে অনেক দূরে। তাই নিঃসঙ্গ আমি মাঝে মাঝে একাই সেদিকে চলে যাই। এখন ভবের বাজার থেকে পাটলি গ্রামের দিকে ছুটে গেছে চকচকে কালো পিচের সড়ক। তাই মুলাডুফি দ্বিখণ্ডিত। শুধু দ্বিখণ্ডিত না — অসংখ্য বসতবাড়ি, দালানকোঠা, পুকুর, শখের গাছগাছালির বাগান আর মাছের খামারে খামারে সে এখন ছিন্নভিন্নও। তাই কৌমার্যহারা নারীর মতো সে এখন আমাকে দেখলেই বিকালের লাল রোদের ছায়ায় ঘনঘন মুখ লুকায়।
তবু আমি পাকা সড়কে ব্রিজের রেলিঙে গিয়ে নাছোড়ের মতো চুপচাপ বসে থাকি। খুব কাছ থেকে লণ্ডভণ্ড মুলাডুফিকে দেখি আর দূর থেকে দেখি দীনের গ্রামটাকে। খালগুলোর চৌদ্দআনাই ভরাট করে পাকা সড়ক হয়েছে। এককালে যারা কাকচক্ষুর মতো চকচকে জলাশয় ছিল আজ তারা প্লাস্টি-পলিথিনের আস্তাকুঁড়। হিজল, জারুল, শিলকড়ুইয়ের জায়গায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে রেন্ট্রি, অ্যাকাশিয়া, ইউক্যালিপ্টাস। তাদের ফ্যাংলা ফ্যাংলা ছায়া ভেঙে পাকাসড়ক দিয়ে ভোম ভোম করে হোন্ডা ছুটিয়ে যাচ্ছে তরুণরা। হয়তো একদিন এই তরুণরা সববন্ধু মিলে রাতারগুল যাবে মনকাড়া সব সেল্ফির লোভে। কিন্তু এরা কেউই জানবে না, একদিন তাদের গ্রামটাই ছিল আস্ত একটা রাতারগুল।
অন্ধকার ঘনিয়ে এলে ব্রিজের রেলিং থেকে নেমে পড়ি। মুলাডুফির চারপাশের বাড়িতে বাড়িতে জ্বলে উঠেছে বিদ্যুতের শতশত বাতি। লেডবাল্বের ঝলমলা রোশনাইয়ে আমি মুলাডুফির বনকে আর খুঁজে পাই না। তখন চোখ বন্ধ করে মনের-মাঝে-ঘুমিয়ে-থাকা মুলাডুফিকে খুঁজতে হয় বলে সেই স্মৃতি এখন আমার বুকে শুধু হাড়ের বোঝার মতো অসহ্য যন্ত্রণার।
ইসহাকপুর / ০৬.০৫.২০২১
- ব্যবহৃত ফটোগ্রাফ লেখকের সৌজন্যে পাওয়া
- চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ ৯ || শেখ লুৎফর - July 8, 2022
- চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ৮ || শেখ লুৎফর - November 20, 2021
- চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ৭ || শেখ লুৎফর - October 30, 2021
COMMENTS