প্যারা ৬ || শেখ লুৎফর

প্যারা ৬ || শেখ লুৎফর

আলিফ-দাল-মিমে আদম


দুপুরে খাওয়ার পর স্বপনের নাম্বার থেকে একটা কল এল। আলাপসালাপে জানা গেল সে তার উস্তাদজি মকদ্দস আলম উদাসী ভাইয়ের কাছে আছে। আমি চাইলে চলে আসতে পারি। রিংটোনের শব্দে বউ বোধকরি কান খাড়া করে রেখেছিল। কথা শেষ হতেই সে আমার রুমে এসে শান্ত গলায় বলে, — এই মাসে ভ্রমণবাবদ তোমার বাজেট শেষ।

তিনদিন আগে ছাতক থেকে ঘুরে এসেছি। তাই আমি হা-করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার চোখে বোবা-বোবা আমাকে দেখে তার কপাল কুঁচকে ওঠে।

জানি মানুষ তার স্বজাতিকে শাসনে রাখতে ভালোবাসে। কিন্তু আমার বউ শুধু আমাকে আগলে রাখতে পছন্দ করে। তার বিশ্বাস, আমি দুনিয়াটা ঠিক ঠিক চিনি না, সাংসারিক কোনো বিষয়েই আমার জ্ঞান যথেষ্ট না, তার বদলে আমি আবেগপ্রবণ ও অবুঝ। তার এই বিশ্বাসের গোড়ায় মরে যাবার আগে আমার মা একটা শক্ত খুঁটি পুঁতে গেছেন।

পরের গিবত ও নিজের গৌরব করা বউয়ের অভ্যাস না। তবু চেতে গেলে সে মাঝে মাঝে একটু চাপাগলায় বলে, — আম্মা মরে যাবার আগে বলে গেছেন, এরা বাপ-ঝি দুইডাই পাগল, এগোর উফরে তুমি রাগ কৈর‌্যা যাইও না গা। তাইলে এরা ফেনায় ভাইস্যা যাইব।

এর আগে এই কথা দুই-একবার শুনেছি তাই আমি তার ভাষাটা তেমন করে শুনি না। শুনি গলার স্বর, যেখানে আমার জন্য তার আশঙ্কা ও করুণামাখা দরদ ঝরে পড়ে।

আমি কম্পিউটারের কিবোর্ড ছেড়ে মাটির বিছানায় আরামসে শুয়ে বলি, — আসা-যাওয়ায় বাসভাড়া বিশটাকা হলেই চলবে।

সে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে ভেতরের রুমে চলে যায়। আমার জন্য রেখে যায় শুধু তার শরীরের পরিচিত সুঘ্রাণটুকু।

বাস থেকে নেমে ইজিবাইকভাড়া পাঁচটাকা বাঁচানোর জন্য আমি ছোট্ট একটা বিলের পাশ দিয়ে যাওয়া ফাঁড়িপথ ধরে হাঁটতে থাকি। দুপুর শেষের দিকে গড়ালেও চৈত মাসের রোদটা বেশ কড়া। চিকন আর আঁকাবাঁকা পথটা সিমেন্টে ঢালাই করা। এই পথটা একটু ঘুরে গিয়ে উদাসীভাইয়ের কলোনির সামনের পথটায় উঠেছে। বেশ নিরিবিলি রাস্তা। একপাশে সবুজ ঘাস ও আগাছা ভরা শুকনা বিল, অন্যপাশে ক-বছর আগে পত্তন নেওয়া নতুন গ্রাম। যানবাহনের প্যাঁ-পোঁ, মানুষের অনাহক কাবঝাপ কিচ্ছু নাই। নিরালা পথটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি ক্ষতবিক্ষত কিন্তু অদম্য প্রকৃতি দেখি, মানুষের অপরিণামদর্শিতার কথা ভাবি। কেন মানুষ সুন্দরকে নষ্ট করে? কেন তারা টাকা ছাড়া আর কিচ্ছু চায় না?

বিখ্যাত লোককবি রাধারমণ দত্ত-র পাড়ায় মরমি কবি উদাসীর বসতি। নিজের ঘর নাই। তাই ছ’শ টাকা ভাড়ায় একটা কলোনিতে থাকে। নানান রকম চরিত্রের বিস্তর মানুষ সেখানে বসত করে। এমন কোনো দিন নাই যে কলহ হয় না, আজব-আজব ঘটনা ঘটে না। তুচ্ছ কারণে ঝগড়া হয়। থেকে থেকে দিনভর গালিগালাজের তুফান ছোটে। বেশিরভাগই মেয়েদের গলা। অভাব আর পরিবেশ কী মানুষের মনটাকে অন্ধ করে দেয়?

উদাসীভাই নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে থাকে। খেয়াল করে দেখেছি, একদম নড়চড়া না করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে পারে। বাহিরটা অনড় দেখেই আমি বুঝতে পারি তার ভেতরটাতে ভাঙচুর চলছে। তার চওড়া কপালে মোটা মোটা চারটা বলিরেখা। মোটা মোটা হাড়ের দেহটা এখনও বয়সের তুলনায় অনেক সতেজ। কোনো-কোনোদিন এককাপ চা আর একটা রুটিতে কেটে যায়। মন ভালো থাকলে কোনো-কোনোদিন নিজের হাতে রান্না করে। এই থেকে আমি বুঝেছি, তার দেহের চে মনটা বেশি খোরাক পায় বলে সে এখনও শক্ত-সমর্থ।

কলোনিতে পা দিয়েই বাসিন্দাদের গলার স্বরে টের পাই, ছাইচাপা একটা আগুন যে-কোনো সময় দপ করে জ্বলে উঠতে পারে। তাই আমরা একটু নিজেদের মতো করে বসার জন্য দরজাটা বন্ধ করে দেই। রুমের একমাত্র বাল্বটা জ্বলছে, মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। আমি বিছানার এক কোনার দিকে উঠে বসি। স্বপন চৌকির দক্ষিণ কোনায়, উদাসীভাই উত্তর কোনায়। কেন জানি আমার খালি মনে হয়, শতবছর-আগে-মরে-যাওয়া রাধারমণও চৌকির অবশিষ্ট কোনাটায় বসে আছেন। একটু দূরে হাছন রাজা একটা বেতের চেয়ারে বসে তার বিশাল গোঁফে তা দিচ্ছেন। শুনেছি, তিনি লেখার টেবিলে বসে সামনের দিকে উদাসচোখে তাকিয়ে তাকিয়ে গোঁফে তা দিতেন। তারপর হঠাৎ টেবিলের খাতার উপর ঝুঁকে এক-দুই লাইন লিখে আবার উদাস হয়ে যেতেন।

শাহ আবদুল করিমই থাকবেন না কেন! জীবিত থাকতে তাকে আমি করিমভাই বলে ডাকতাম। তিনি খুব হাস্যরসিক মানুষ ছিলেন। কোথাও গেলে সাথে দুই-চারজন থাকতই। তিনিই বলতেন বেশি। অন্যরা সব শ্রোতা। আজও তিনি যেন আমাদের মধ্যখানে বসে, রাজাসাহেবকে দেখেও না দেখার ভান করে বেশ আমুদে গলায় আলাপ জুড়ে দিয়েছেন।

তো চারপাশের বকবকানি, মনের চাপ কিংবা দুনিয়াবি যন্ত্রণা থেকে আসান পেতে উদাসীভাইকে জিজ্ঞেস করি, — বাউল সাধনাটা কোন ধারার?

অনেক বছর ধরে আমি উদাসীভাইয়ের সুখে-দুঃখে জড়িয়ে আছি। তাই আমাদের আড্ডাটা জমতে বেশি সময় লাগে না। আমার প্রশ্নের সাথে সাথে স্বপন নড়েচড়ে বসে। উদাসীভাইও ভাবনার অতল থেকে জেগে ওঠে, — বাউল সাধনা হইল গুরুমুখী বিদ্যা।

এই বলে সে লাইটার জ্বালিয়ে একটা বিড়ি ধরায়। তারপর বেশ আরামে একটা টান দিয়ে বলে, — এই লাইনে গুরুই সব। দীক্ষাগুরুর হাত ধরে আল্লার দর্শন লাভ করা যায়। কারণ এক ঘরেই তিনজনের বসত : আল্লা, রসুল আর গুরু। আলিফ, দাল, মিম অক্ষর খেলা করে তার ভিতরে। আলিফ-দাল-মিমে আদম। মুর্শিদ বা গুরু আছেন আদমসুরতে। উনাকে ভজলেই আমরা আল্লার দর্শন পাই।

বলতে বলতে উদাসীভাই একটু-একটু মাথা নাড়িয়ে গাইতে শুরু করে :

নামের লিঙ্গ, প্রেমের যোনি
সঙ্গমেতে হয় যে শুনি,
গায়েবে ইলমে লে যোনি …

মুর্শিদের মুখটা হলো নামের লিঙ্গ, শিষ্যের কর্ণ হলো যোনি। মুর্শিদের কথাটা যখন শিষ্য কর্ণ দিয়ে শুনবে তখন তারা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের জগতে …

উদাসীভাই কথাটা শেষ করতে পারে না। এর মাঝেই বাইরে একজনের মরণচিৎকার ওঠে, — আমি মৈর‌্যা যায়াম … মৈর‌্যা যায়াম …

উদাসীভাইয়ের কপালের বলিরেখাগুলো গম্ভীরভাবে কেঁপে ওঠে। স্বপন তো বসা থেকে উঠেই পড়েছে। আমিও বিছানা থেকে নেমে পড়ি। উদাসীভাই দরজা খুলে বাইরে পা রাখে, — ক্যাডা মৈরা যাইতাছে?

এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থা কারো নাই দেখে আমিও দরজা থেকে গলা বাড়াই, উঠানে কতকগুলো ভাঙাচোরা নারী, অটকাপটকা শিশুকিশোরদের ভিড়। তারা মাটিতে-পড়ে-থাকা একজনকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা উঠতি তরুণ। পরনে জিন্স। কোমরের উপরের অশংটা খালি তাই তার বুকের হাড়গুলো আমি এখান থেকেই দেখতে পারছি। সে মাটিতে চিত হয়ে পড়ে দুইহাতে মুঠি দিয়ে বুকে জোরে জোরে কিল মারছে আর বলছে, — আমি মৈর‌্যা যায়াম।

এইরকম কয়েকবারের পর সে খিঁচতে শুরু করে। মাটিতে জোরে জোরে মাথা আছড়ায়। তার চারপাশে অনেক মানুষ কিন্তু কেউ তাকে বাধা দেয় না। কিংবা কারো গলায় তার জন্য রোদন কিংবা মমতা ঝরে না দেখে আমি অবাক হই। নিশ্চয়ই এখানে তার মা কিংবা বোন আছে! এইভাবে মাটিতে মাথা আছড়াতে থাকলে তো ওর মগজটাই গলে যাবে!

একটু পরেই সে আজরাইলের-সাথে-লড়তে-থাকা মানুষের মতো গলায় একটা মরণগ্যাঙরানি তোলে। একজন মহিলা জোরে জোরে বলে ওঠে, — ইয়াবা খাইবার টাইম অইছে।
আরেকজন বলে, — ট্যাহা দিলেই সব ঠিক অইয়া যাইব।

আমরা আর দেখি না। আবার বিছানায় উঠে আগের জায়গায় যার যার মতো বসি। এখন আর আমি রাধারমণ, হাছন রাজা কিংবা করিমভাইয়ের নিঃশ্বাসের উষ্ণতা পাচ্ছি না। আমার শরীরে কেমন মরা-মরা একটা ভাব দেখে উদাসীভাই বলে, — দুনিয়াটা তো গোল, তাই এত গণ্ডগোল।

আর বসে থাকতে ইচ্ছা করে না। অনেক ঝক্কি সহ্য করে এসেছিলাম একটু সাধুসঙ্গের আশায়। এখন সব মাটি! বুকে চিনচিনে একটা কষ্ট নিয়ে আমি তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে পা বাড়াই। বিকালটা গাছের পাতা-লতায় জবাকুসুম ফুলের মতো রঙিন আর নরম হয়ে গেছে। আমি যে-পথে এসেছিলাম সেই হাঁটাপথেই নামি। এখন আর প্রকৃতি আমাকে টানে না। এই সমাজের বলী মাদকাসক্ত ছেলেটার মুখটাও কিছুতেই ভুলতে পারছি না।

আমার পাশ দিয়ে চলে যায় একদল ছোট ছোট ছেলে। সম্ভবত তারা কোনো খেলা থেকে ফিরছে। তাদের পরনের হাফপ্যান্ট-শার্ট সবই নোংরা। হাবভাবেই বোঝা যায় তারাও পেছনের কলোনিটার বাসিন্দা। তাদের মাঝে সবচে বড়টি জোরে জোরে বলছে, — মোদিরে মামুনুল হক গুলি কৈরা মারব।
আরেকজন বলে, — মোদিরে পাইব কৈ? হে থাহে লন্ডনে।
বুঝলাম হেফাজতে ইসলাম নামক বিষফোঁড়াটি বাংলাদেশের কলিজার মধ্যে গজিয়ে গেছে। এর থেকে আর সহজে নিস্তার মিলবে না।

মনের মাঝে কেমন একটা ওজনদার কষ্ট-কষ্ট অনুভব : আমাদের চারপাশে কত কত অসুখ! চতুর মানুষেরা প্রতিদিন আমাদের মনে কত কত রোগজীবাণু ছড়াচ্ছে! এর মাঝে আমরা কেমন করে বেঁচে থাকব? কোথায় আমার প্রিয় সন্তানকে রেখে যাব?

ইসহাকপুর : ০৩.০৪.২০২১


প্যারা ৫
গানপারে শেখ লুৎফর রচনারাশি

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you