ডাক
ভিজে যাব জেনেও, তুমি ডাক দিলেই ছুটে যাই
দুরন্ত বালকের মতো
বৃষ্টির ঘনঘটা, রিমঝিম শব্দের ধ্বনি
বিদ্যুতের চমক
আজকাল বড়ো বেশি মায়াময় মনে হয়
যে-কথা বলার ছিল না তবু আমি অনর্গল
তোমাকেই বলে যাই
বাচালের ফেনাতোলা মুখের আদলে
ফিরে যাবার কথা ছিল
এইবার ফিরে যাব নিশ্চিত জানি
তবু আমি উদ্ভ্রান্ত যুবকের মতো
অহর্নিশ ছুটে চলি অজানা গন্তব্যের দিকেই
সাজঘরে ফিরে যেতে দ্বিধা নেই
এইবার শুধু
তোমার ডাকের অপেক্ষা
অকারণে কেটে যায় বিনিদ্র রজনি
তুমি যদি ডাক দাও
আমি তো দুরন্ত বালকের মতো ছুটে যাই
ভিজে যাব জেনেও
কাঙাল
কেবলই বেলা বাড়ে, আর
শীতের আমেজটা লেপ্টে থাকে সারা গায়
তুমি তো বেহুদাই
গরম জামার ঘোরতর বিরোধী
পাল্টাতে চাও পোশাকের আদল।
আমার উষ্ণ চাদরটাও আজকাল, এই বসন্তে
বড়ো বেশি প্রয়োজন।
বৈরি সময়ের কাছে হেরে যেতে যেতে
যে-যুবক লেপকাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে অন্তত নিদ্রায়
শীতের রুক্ষ্মতাকে ঠেলে দেয় পায়ের ধুলোয়
তারচেয়েও, অর্ধশতাব্দীর এই মানববৃক্ষ
উষ্ণ আবেশের বড়ো বেশি কাঙাল।
তুমি কি জানতে?
ওম ওম হাওয়া, গরম পোশাক
আজ বড়ো বেশি প্রয়োজন।
হাতছানি
কেবল সবুজই হাতছানি দিয়ে ডাকে
নিদারুণ খরার দিনেও
আমি শুনতে পাই সবুজের আবাহন।
আজ কোথাও মিছিল নেই
নেই মিটিং-হরতাল
তবু বেহুদাই আমি বসে থাকি
তোমার দুয়ার ঘেঁষে।
আজ যদি ভালোবাসা আদায়ের সংগ্রামে
মিছিল হয় — হোক
যদি হরতাল-ভাঙচুর হয়
তাতেও মানা নেই —
মানুষের দাবি
ভালোবাসার দাবি আদায়ের সংগ্রামে
আমিও তো এক সংগ্রামী যোদ্ধা।
অসময়ের গান
মৃত্যুই যেখানে অবধারিত সত্য
সেখানেও দাঁড়িয়ে আমি বেছে বেছে তুলে নিলাম
কিছুটা ঘাস আর মৃত ফড়িং।
তুমি বেহুদাই কেন
অসময়ে গেয়ে ওঠো ভালোবাসার গান
যেখানে অনিবার্য নিয়তির মতোই
আমরা শেষ শ্লোক শোনার জন্য
প্রতীক্ষার প্রহর গুনছি।
একা
ক্রমশ একা হয়ে যাচ্ছে সবকিছু
ক্রমশ একা হয়ে যাচ্ছি আমরা
তুমি এবং আমি
একা হয়ে যাচ্ছি ক্রমশ
মানুষ মূলতই একা
দূর বারান্দায়ও ফুলগুলো ঝুলে থাকে একা
শস্যের দানা, সবুজের হাতছানিও দেখি একা
চাঁদ-সুরুজেরও খবর রাখে কজন
আকাশে-পাতালে সবখানে দেখি তারা শুধু একা
সবাই একা
জলে-স্থলেও বসে থাকে সবাই একা একা
এই আমি, এই তুমি
তবু দেখি একা একা
একা একা সবকিছু
তুমি আর আমি
সবকিছু একা একা
স্বপ্নে, জনমে, মরণে সবখানে একা
মানুষ মূলতই একা
শিরোনামহীন
আগুন আগুন বলে ফিরে গেলে তুমি
আমি তো জোছনাকাতর তাই
আগুনের মাঝখানেও জোসনা পোহাই
২.
ফেরার অপেক্ষায় বৃথাই তুমি চেয়ে থাকো মাঝরাতে
অথচ যে ফেরার নয়
নিশ্চিত জানো
সে তো আর ফিরবে না কোনওদিনই
৩.
রাতজাগা পাখিগুলো নীড়ে যাবে একদিন
তারপর ভোর হবে
আলো এসে মুছে দেবে কষ্টের ছায়া
৪.
যে-প্রেম ছুঁয়ে দিলে মুছে যায়
তার থেকে দূরে থাকো
তারচে ঢের ভালো প্রেমহীন আস্ত জীবন
৫.
কোনোকিছু ছায়া হয়
কিছু কিছু মায়া হয়
কেউ কেউ কায়া হয়
কারো কারো হায়া হয়
জীবনটা ছয়-নয়
কেউ কেউ রয়ে যায়
রয়ে রয়ে সয়ে যায়
তারপর মরে যায়
জীবনটা বৃথা হায়
৬.
প্রতীক্ষায় থাকি
প্রতিদিন প্রতিক্ষণ
না পুব, না পশ্চিম
কাতর কণ্ঠে কেবল তোমাকেই ডাকি
৭.
সুজনেরও সাথি থাকে
তবু আমি সাথিহারা স্বজন তোমার
৮.
এইবার নিশ্চিত
গোগ্রাসে গিলে নেব সমস্ত আকাশ
৯.
খোলস নেই
তবু আমি নিজের ভিতরে
নিজেরে লুকিয়ে রাখি প্রতিদিন
সন্ধের আয়নায় মুখচ্ছবি দেখি
মুখ নয়, যেন কেবলই মুখোশ
বহু পথ হেঁটে এসে
আমি তো ক্লান্ত পথিক
১০.
শেষমেশ বুঝে আসে
কিছুই হবার নয়
শেষ হবে আমাদের সমস্ত আরতি
বোধগুলো উবে গেছে পুবের দুয়ারে
তুমি আর আমি সন্ধের বাতি হব
তবু দেখো, ফুরায়ে গেছে আজ নুনের কদর
একটা দুয়ার শুধু
খোলা রেখে চলে গেছে বেয়াড়া বাতাস
১১.
আমাকেও দিয়ো সখি সুতোর বাঁধন
দিকহারা পাখির মতো যদি হারাই পথের শেষে
তবু যেন না-হারায় স্মৃতির মুকুট
কোথায় গিয়েছে বলো সূর্যের আলো
কোথায় গিয়েছে চাঁদের জোছনা
আমার ভাঁড়ারে দেখো কেবলই জমেছে আজ ঋণের পাহাড়
তবু একদিন সুতোর বাঁধন যদি খুলে যায়
দেখে নিয়ো
আমিও তো হয়ে যাব স্মৃতিহীন রাতের কপোত
১২.
আমাকেও ধুয়ে দিয়ো ধর্মের জলে
যেন পুণ্যস্নান শেষে আমিও অনায়াসে হতে পারি পুণ্যবান
প্রতিদিন গুনে গুনে আমিও তো শয়ে শয়ে জপে যাই ধর্মের বুলি
তবু শেষমেশ বিধ্বস্ত দেহ নিয়ে ফিরে যাই আরশিনগরে
এমন অযাচিত কথাগুলো বলে যাই শোনো —
ক্ষুধার রাজ্যে যে-পাখি ডেকে যায় প্রতিদিন করুণ সুরে
আমিও তো ও-রকম কেঁদে ফিরি দুয়ারে দুয়ারে
এবার আমাকেও না-হয় ধুয়ে দাও
অন্ধকুঠুরিতে বদ্ধজলে
তারপর অনায়াসে গিলে নেব
নিষিদ্ধ গন্দম
১৩.
অন্তরে সুরের ঝংকার, তবু আমি
অনর্থকই গেয়ে উঠি
পুরনো দিনের গান
কোথায় গিয়েছে নদী
সীমানার রেখাপাত আমার তো জানা নেই
তবু আমি গুনে গুনে লিখে রাখি
জন্মের সাল
বয়সের ধারাপাত।
১৪.
একদিন ফুরাবে সব লেনদেন
তুমিও তো চলে যাবে
আমি শুধু হয়ে যাব ফেরারি পাখি
শূন্যে পড়ে রবে
ঘরদোর, আলনা-বাসন
মায়ারাও চলে যাবে দূরে
তবু তোয়ালের চারকোণে কেবলই জমে রবে
আড়মোড়াস্মৃতি
এখন বেহুদা সময়
তবু আমি কারও কাছে রেখে যাব অনন্ত ঋণ
একদিন সবকিছু ভুলে যাবে
ভুলে যেয়ো
ঘরদোর ধুয়েমুছে রেখে দিয়ো
বিষণ্ন স্মৃতি
১৫.
সুরমার জলেভাসা দুঃখগুলো আমাকেও ছুঁয়ে যায় প্রতিদিন
আমি তো পাখির-পালক-ছুঁতে-আসা নব্যবালক
তবু আঙুলে গুনে গুনে হিসেব করেছি সময়
আমার পিতার খোঁজে এতটা বছর
অকারণে করেছি পার
তবু পিতৃহারা এক শূন্য-জাতির গল্প শোনাতে শোনাতে
আমিও তো সন্ধের বাতি হতে চলেছি আজ
কবিতার গানপার
নাজমুল হক নাজু ও তৎসংক্রান্ত রচনারাশি
- ডাক ও অন্যান্য কবিতা || নাজমুল হক নাজু - June 1, 2025
- তুমি বাংলাদেশ ও অন্যান্য কবিতা || ফজলুররহমান বাবুল - May 27, 2025
- মেঠোসুর কলরব : আবহমানের উৎসব || রূপকার - May 17, 2025
COMMENTS