সময়প্রবাহে ব্যক্তিলেখকের বিক্ষিপ্ত ভাবনাকে সাক্ষাৎকারের বাইরে অন্য উপায়ে ধরে রাখার প্রচল অভ্যাসগুলো একপ্রকার উঠে যেতে বসেছে। সারা বিশ্বে লেখকরা একসময় দিনলিপি লিখতেন। তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, টমাস মান থেকে শুরু করে কাফকা সহ অনেকের দিনলিপি কালপ্রবাহে ধ্রুপদী গণ্য হয়েছ। তলস্তয়ের A Calendar of Wisdom নামক ছোট্ট বইটি আমার কাছে মজার লেগেছিল পড়ে। দিনলিপির আঙ্গিকে রচিত বইটিতে পঠিত গ্রন্থ থেকে টুকে নেওয়া উদ্ধৃতির লেজ ধরে নিজের মন্তব্য জুড়ে রেখেছেন তলস্তয়। আবার A Confession and other writings বইটি God Problem-কে নিয়ে দ্বিধা-সংশয়ের উত্তর অন্বেষণ এবং Class Contrast-এ জীর্ণ মানবসমাজে বিশ্বাসের মাটি খুঁজে পাওয়ার আত্মজৈবনিক বয়ান হলেও কোথায় যেন দিনলিপির সুর বাজে সেখানে।
আমাদের এখানে রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ, মানিক, তারাশঙ্কর, জীবনানন্দ দাশ থেকে শুরু করে পঞ্চাশ-ষাট-সত্তুর অবধি লেখকদের মধ্যে দিনলিপি লেখার ব্যাপক প্রচলন ছিল এবং পাঠকরা সেগুলো মুদ্রিত আকারে এখনও পড়ে চলেছেন। অথবা ধরুন, একে অন্যের সাথে পাল্লা দিয়ে ডাকবাক্সে লম্বা চিঠি চালাচালির অভ্যাস দীর্ঘ সময় ধরে দেশে-বিদেশে বহাল ছিল। পাথরে খোদিত ট্যাবলেট থেকে কাগজের খামে ভরে পাঠানো রাশি-রাশি কথামালার অনেকাংশই পরে পাঠককে পত্রলেখকের মনোজগতে হানা দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের নিরীক্ষাধর্মী রচনারীতির পেছনে লুকিয়ে-থাকা ভাবনার সঙ্গে সংযোগ নিবিড় হয় সেইসব পত্রগুচ্ছের কল্যাণে যেগুলো তিনি রাজনারায়াণ বসুকে একসময় অকাতরে লিখে গেছেন। রবীন্দ্রনাথও চিঠি চালাচালির কাজে ভীষণ দড় ছিলেন। জীবনব্যাপী এন্তার পত্র লিখেছেন এই ভদ্রলোক, যার জের ধরে ছিন্নপত্রাবলীর মতো সাহিত্যকৃতির জন্ম সম্ভব হয়েছিল।
ওপারে অর্থাৎ পশ্চিমে দিনলিপি ও চিঠিপত্র লেখার ধারায় এইচপি লাভক্রফটের নামটি বিশেষ মনে পড়ছে। ভৌতিক ঘরানার গল্প ও আখ্যান রচনায় লাভক্রফট নতুন রীতির সূচনা করেছিলেন। যদিও জীবদ্দশায় লোকের স্বীকৃতি তাঁর কপালে জোটেনি। না-জোটার কারণ লাভক্রফট তাঁর সময়ের লেখালেখির ধারা ও প্রবণতা থেকে অন্তত শতেক বছর সামনে পা রেখে লিখছিলেন। ভৌতিক ঘরানার রচনায় তিনি কেন অনন্য সেটি বুঝতে হলে হাল জামানার সেলিব্রেটি লেখক স্টিফেন কিংয়ের On Writing নামক গদ্যভাষ্যে সফর বেশ কাজে দেয়। যে-মাজেজার জোরে স্টিফেন কিং কাহিনি জমিয়ে তোলেন এবং তাঁর গল্পকাহিনির হলিউডি চিত্রায়নের কারণে দর্শকের শিরদাঁড়ায় ঝাঁকুনি-তোলা শিহরণের স্রোত বহান, — বয়নের এই কুশলতার অনেকখানিই লাভক্রফটের সূত্রে পাওয়া। দার্শনিকতার খোলসে ‘আতঙ্ক’ নামক ব্যাপারখানাকে লাভক্রফট স্বকীয়তা দান করে গেছেন। এই স্বকীয়তা পরে স্টিফেন কিং কিংবা ফিলিপ কে ডিক-এর মতো সিনেপর্দাসফল লেখকদের প্রথানুগ ছক থেকে বেরিয়ে কাহিনি ফাঁদার প্রেরণা যুগিয়েছে। স্টিফেন কিং সহ হালের অনেকে তাই লাভক্রফটের কাছে নিজের ঋণ স্বীকারে কুণ্ঠা বোধ করেননি।
লাভক্রফটের Cosmic Ghost (Cthulhu) বা মহাবৈশ্বিক অশরীরী, যে কিনা মানবভাষায় উচ্চারণের উপযুক্ত নয় বলে তিনি মনে করছেন, যাকে ‘থলহু’, ‘কল্-ল হু’ নাকি ‘চল্-ল হু’ অথবা ‘থল্-ল হু’ ঠিক কীভাবে উচ্চারিলে শ্রবণের পক্ষে যুৎসই হবে সেটা এমনকি স্বয়ং লেখককে সন্দিহান রেখেছে, সেই মহাবৈশ্বিক Cthulhu-কে তিনি পৃথিবীর পরিসীমায় প্রাসঙ্গিক করেন। লাভক্রফটের কুশলী বয়ানে অজ্ঞাত থেকে উঠে-আসা Cthulhu-র সঙ্গে মানব-বিরচিত জগতের Inter-clash পাঠককে ক্রমশ জড়, আতঙ্কিত এবং সমরেখায় নিজের অস্তিত্বকে অজানার ক্রীড়নক ভাবার আবেশে দিশেহারা করে রাখে। নিজের দৃষ্টিকে সে তখন সন্দেহ করে চলে, পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে, এবং এভাবে নিজের অজান্তে Cthulhu-র হুকুম ও শাসন তাকে হতবিহ্বল করে তোলে। মহাশূন্যের ভৌতিক নীরবতা থেকে যেসব টঙ্কার মানুষের জগতে আছড়ে পড়ছে মনে হয়, সেই ফিসফাসঘন দ্রবণের ফেনায় কেউ যেন তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়!
সে যাকগে, লাভক্রফটের চিঠির প্রসঙ্গে এবার ফিরি। জীবদ্দশায় এই ভদ্রলোক একের-পর-এক নামী-বেনামী সামিয়িকীতে লেখা পাঠিয়েছেন এবং যথারীতি সম্পাদকগণের নীরবতা থেকে বুঝে নিয়েছেন তাঁর লেখা ছাপানোর ব্যাপারে কারও তিলেক সায় নেই। অসুস্থ শরীর ও ততোধিক উন্মূল মন নিয়ে মার্কিন দেশে বিচরণকারী লেখকটি তা-সত্ত্বেও চিঠি ডাকে পাঠানোর ব্যাপারে অক্লান্ত উদ্যমী ছিলেন। মানববিশ্বের ভূতায়ন থেকে রাজনীতিকায়ন, এমনকি বর্ণবাদের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য তাঁর সেইসব চিঠিপত্রে খইয়ের মতো ফুটেছে। মৃত্যুর পর যখন তাঁর নাম ফাটতে শুরু করে তখন সেই চিঠিপত্রের বহর হিসাব করতে বসে গবেষকরা ভিমরি খেয়েছিলেন বৈকি। জীবদ্দশায় প্রায় লাখের ওপর চিঠি চালাচালি করেছিলেন লাভক্রফট! এই পত্রসাহিত্য প্রকারান্তরে বাস্তবিক মানুষটি কেমন ছিলেন বা দুর্দান্ত বর্ণনাভঙ্গির আড়ালে লুকিয়ে থাকা লেখকসত্তা কেন প্রথাগত ছকে ভৌতিক কাহিনি বয়নের পরিবর্তে মহাবৈশ্বিক নিয়তিকে সঙ্গী করেছিল ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর পেতে সাহায্য করে। লাভক্রফট সম্ভবত ব্যতিক্রম যিনি ভৌতিক আবহের সাহিত্যিক ভাষাকে সরাসরি মহাবৈশ্বিক নিয়তির সঙ্গী করে তুলতে পেরেছিলেন।
লেখা হচ্ছে ভাষা এবং বিষয়কে দুমড়ে-মুচড়ে অবিরত নতুন অর্থের উপস্থাপন। অন্যথায় সেটা পুরাতন লেখার অনুলিপি বৈ অন্য ‘কেহ নহে’। এমনিতে নতুন অথবা মৌলিক বলে আদৌ কিছু হয় কি না সে-নিয়ে গুণীজনের মনে বিস্তর মতান্তর রয়েছে। যে-কারণে অনুলিপি ও অনুকৃতির ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তিতে ভরে থাকে মানুষের খুচরো থেকে ভার-ভারিক্কি কথার জগৎ। রোলাঁ বার্থ বোধহয় সবচেয়ে উদ্বিগ্ন ও ক্লান্ত হতেন এ-কথা ভেবে, — ‘নতুন’ কিছু লেখা সত্যি কঠিন! ‘নতুন’ ভেবে যা লিখতে চাইছেন সেটা হয়তো ইতোমধ্যে বহুবার বহুভাবে লেখা হয়ে গেছে। বছর-দুয়েক আগে কাব্য করে কয়েকছত্র ‘অনুপল’ লিখতে গিয়ে বার্থের উদ্বেগ কানে খট করে কড়া নেড়েছিল। চকিত লিখেছিলাম, — ‘তুমি যা লিখছ সেটা কি নতুন?’/ উত্তরে কবি হাসে— / ‘নতুন শব্দটি জেনো নিজেই পুরাতন।’
‘অনুপল’ লেখার সূত্রে মনে পড়েছিল একদা রোলাঁ বার্থের সঙ্গে স্বপ্নে ‘সংলাপিকা’-য় মন লিপ্ত হয়েছিল। যার ঝটিতি বিবরণ ‘সহচারী’ ব্লগে বার্থকে নিয়ে লেখা কাল্পনিক আলাপচারিতায় টুকে রেখেছিলাম। আলাপের সূত্রধর বার্থের পূর্বপরিচিত; যদিও লোকটি ইহজীবনে বার্থের লেখা এক অক্ষরও পড়েনি। বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে রেস্তোরাঁয় আড্ডা দেওয়ার সময় বার্থকে জানায়, গত রাতে তার ঘরে চোর ঢুকেছিল যখন স্বপ্নে বার্থের বই পড়ছিল সে। সেই সূত্র ধরে কথালাপ এগিয়ে চলে এবং একসময় আলাপে ইতি ঘটান দুজনে। বইপাঠ প্রসঙ্গে বার্থের মুখে যে-কথাগুলো সেদিন বসিয়েছিলাম সেটি মনে পড়ছিল। বার্থ সেখানে সূত্রধরকে যা বলছিলেন তার মর্মার্থটি ছিল এ-রকম :
পড়া এবং জানার উদ্দেশ্য নিয়ে বই খুলে বসে পড়াটা অর্থহীন। তুমি আসলে জ্ঞান আহরণের জন্য কোনও বই পড়ছ না। বই পাঠ করতে গিয়ে তোমার কল্পনাশক্তি ‘বহি’-লেখকের ব্যবহৃত শব্দ ও বাক্যে নতুন অর্থ আরোপ করছে। লেখকের ব্যবহৃত বাক্যগুলোকে দুমড়ে-মুচড়ে তোমার বোধের অনুকূলে তুমি গড়েপিটে নিচ্ছ; অথবা সে-কাজটি করা যাচ্ছে না দেখে বই ছেড়ে উঠে পড়েছ। বইয়ের মাঝারে নিহিত অর্থ (অর্থাৎ লেখক কী বলিতে চাহিয়াছেন?) আবিষ্কারের জন্য বইয়ের জন্ম হয় না। বইয়ে গ্রন্থিত কথামালার জন্ম হয় এতে নিহিত অর্থের ভাঙচুর থেকে সৃষ্ট নতুন অর্থ সৃজনের তাগিদে। অন্যথায় ‘অনুলিপি, অনুকৃতি, অনুকরণ’ ইত্যাদির পুনারাবৃত্তি ঠেকানো কঠিন। সেই অর্থে পাঠক মাত্রই (এককলম না লিখে অথবা কোনওকিছু না বলে) লেখক। বইয়ের সঙ্গে বইপাঠকের এই লিখনক্রিয়ার নাম হচ্ছে সৃষ্টি অথবা সেটাই হয়তো জেনেসিস।
লাভক্রফট, বলতে দ্বিধা নেই, পাঠককে সে-রকম এক জেনেসিসের সম্মুখীন করার জন্যই লিখেন। পুরোনো অর্থরাশি দুমড়ে-মুচড়ে নতুন অর্থ প্রদানের এই খেলা তাঁর ছোটগল্প আর অযুত পত্ররাশির মধ্যে জারি রাখার চেষ্টায় উদ্যমী হওয়ার কারণে সমকালের পাঠক তাঁকে হয়তো পড়ে উঠতে পারেননি। পৃথিবীর বেশিরভাগ এ-রকম রচয়িতার কপালে এই না-পড়তে-পারার লিখন অমোঘ হওয়ার দোষে রচয়িতার রেখে-যাওয়া দিনলিপি ও চিঠিপত্র কিংবা টুকিটাকি বিক্ষিপ্ত মন্তব্যসূত্র সেইসব রচনার মেজাজ ধরতে পাঠক ও গবেষকের সহায় হয়। বঙ্গে জীবনানন্দ দাশ, কমলকুমার মজুমদার, লোকনাথ ভট্টাচার্য সহ আরও অনেকে সেই দুর্ঘটের শিকার। মোদ্দা কথা, জগতে ‘নতুন’ বলে কিছু নেই, সকলই ‘পুরাতন’; পরিবেশনভঙ্গির কারণে সেই পুরাতনকে পাঠকের কাছে ‘নতুন’ লাগে এবং সেই বোধ জাগিয়ে তোলাই রচয়িতার কাজ।
…
যা-ই হোক, ডাকবাক্সের আলাপে আবার ফেরা যাক। ই-মেইল প্রযুক্তির মধ্যে পত্রচালাচালির সেই সুযোগ বহাল থাকলেও কাগজের খামে ভরে পাঠানো এন্তার কথামালার মুড়ি-মুড়কির সেই আবেদন এখন আর নেই। ই-মেইলটা অনেকবেশি কেজো। কাজের কথাগুলো সারতেই যেন মানুষের সেখানে গমন! জীবনের চলার পথে হুটহাট এলোমেলো ভাবনাগুলোকে নোটবুকে টুকে রাখার খামখেয়ালটিও বোধহয় স্মৃতির ধুলায় চিরকালের জন্য চাপা পড়েছে। নিজের ও চারপাশের সঙ্গে কথা-চালাচালির পুরোনো অভ্যাসের অবক্ষয় ঘটেছে নতুনের আবির্ভাবে। নতুন যুগের প্রযুক্তির মাঝে পুরোনো দিনের অভ্যাস চালু রাখার সুবিধা থাকলেও লোকে কদাচিৎ সেটি ব্যবহার করে। যে-কারণে পুরোনো দিনের প্রযুক্তি অর্থাৎ কাগজের ডায়েরিতে দিনলিপি লেখার স্বাদ নতুন দিনের ফেসবুকের নোটাঙ্কে কেন যেন ঠিক জমে না। নোটাঙ্করা নিমিষের মধ্যে মুখ লুকায় সার্ভারে। ওগুলোকে উদ্ধারের হ্যাপা কে পোহাবে বলুন?
মুখোমুখি বসে দেদার আড্ডার মধ্যে রক্তমাংসের যে-উষ্ণ ঘ্রাণ একসময় পেয়েছে হৃদয়, ‘জুম’ বা ‘ফেসবুক লাইভ’-এ তার অভাব কি আর মেটে? প্রাণহীন খরখরে লাগে, যখন দেখি এন্তার কথার ভিড়ে নিজের কথাগুলোও কানে যুৎসই লাগে না। মনে হয় কে শোনে কার কথা; সকলে ব্যস্ত নিজেকে শোনাতে! পণ্যায়নের যুগে কথারা রকমারি পণ্য ছাড়া আর কী! মানুষের রক্ত-মাংস-অস্থির কোনওকিছুই পুঁজির বদবু ছাড়া অন্য কোনও ঘ্রাণের আবেশ নাসিকায় জাগিয়ে তোলে না। এত-এত কথারাশির ভিড়ে নিজের কথাকেও বদবু ছাড়া অন্য কিছু ভাবার সুযোগ নেই। মাঝেমধ্যে মনে হয় এরচেয়ে এটা বোধহয় সই : — To be cured, spewing what you’ve inhaled.
এ হয়তো আমাদের সম্মিলিত আত্মহনন যে, অজস্র কথার ঢেউয়ে দরকারি কথারা ক্রমশ নিরাকারে তলিয়ে যাচ্ছে। সোজা করে অথবা প্যাঁচিয়ে যেভাবে বলুন-না-কেন সেই কথাগুলো শোনা ও শোনানোর মাধ্যমরা বিগত মাধ্যমগুলোর তুলনায় কম কার্যকরী। হতে পারে সবাই এত বেশি বলছি বলে হয়তো কারও কথাই সমাজে দরে বিকোচ্ছে না। আমরা হয়তো ‘ভাবার’ চেয়ে বলছি বেশি। লম্বা কথাকে খাটো করে বলার চর্চা যুগজটিলতার রকমফেরে কঠিন হয়ে উঠেছে। কতরকমের বইপত্র! কত রকমারি উপায়ে মানুষ নিজের বাখানি গাইছে! যত কথা তত উৎপাতের মতো বিমূতর্ততার বিশ্বে হাবুডুবু খাচ্ছে মানুষ। কথামালার এই বিমূর্তায়ন বা Abstraction-ই আজকের ভাষাবিশ্ব; যেখানে যৌক্তিক কিংবা অযৌক্তিক সকল দরের কথারাই মানুষের মন-মেজাজ ভেদে যৌক্তিক রূপে নন্দিত হয় এবং দ্বান্দ্বিক বা Dialectical হয়ে ওঠে। যদিও যৌক্তিকতা বা Rationality শব্দটি সকল কালের ভাষাবিশ্বের সাপেক্ষে এক প্রহেলিকা। অগত্যা মির্চা এলিয়াদ তাঁর The sacred and the profane বহির উপসংহারে পৌঁছে যখন মন্তব্য ঠোকেন, A purely rational man is an abstraction; he is never found in real life., — তখন সেই মন্তব্যকে এককথায় খারিজ করা মুশকিল হয়ে পড়ে। মানুষের ভাষাচর্চার এইসব বিবিধ প্রহেলিকার মধ্যে বসে সাহিত্য করাটা আমার কাছে তাই এভারেস্ট শৃঙ্গে আরোহনের মতো কঠিন মনে হয়।
এটা সেই সময় যখন আপনি চাইলেও স্রেফ মানুষের জগতে কেন্দ্রীভূত থেকে একটি লাইন লিখতে পারবেন না। মানুষকে অতিক্রমকারী জগৎ আপনাকে নানাভাবে শাসন করবে। যা-কিছু পেছনে ফেলে এসেছেন, যা-কিছু সহ্য করে অদ্য সহিসালামতে বিরাজ করার আয়েশ বোধ করছেন, এবং যা-কিছু সামনে ঘটতে চলেছে … তার সবখানি একত্রে গড় করতে না-পারলে সোজা কিংবা বাঁকা, স্পষ্ট কীবা সহজ, অথবা প্যাঁচমারানিয়া কোনও কথাই টিকবে না ভবে; লোকের কানের পাশ ঘেঁষে তারা হুশ করে ছিটকে বেরিয়ে যাবে।
কথার এইসব গুলাগুলি ও গোলযোগের মধ্যে দামি কথার সুলুক পেতে হলে গল্প-কবিতা-আখ্যান এবং প্রবন্ধ-নিবন্ধের ভাষাকাঠামোয় বসে যারা কথা কইছেন তাদের হয়তো নিজের বলা কথাগুলোকে সেট-থিয়োরির মতো ভেঙেচুরে রকমফের ঘটিয়ে সাজানো প্রয়োজন। যেমন ধরুন, জনৈক কথাকার কাহিনি ফেঁদে অথবা কাহিনিকে নাকচ করে যেভাবে লিখুন-না-কেন, যে-সময়ে বসে তিনি লিখছেন তার সঙ্গে ফেলে-আসা এবং আগত ও দূরবর্তী সময়ের তীরকে একত্রে জুড়ে নিতে ব্যর্থ হলে তার পক্ষে ভাষার বিমূর্তায়নে যাওয়া সম্ভব নহে। কাঠোমাবাদী সাহিত্যের ছকে লিখে যাওয়াকে আমি খাটো করে দেখছি না, তবে যুগ-যুগান্তর ধরে চর্চিত এই কাঠামোকে নতুন করে গড়েপিটে নেওয়ার তাড়না তীব্র হওয়া দরকার। যেটা, এই বঙ্গে এখনও সেভাবে জোরকদমে চলার শক্তি অর্জন করেছে বলে প্রত্যয় হয় না।
- লেখকের সঙ্গে গানপারসঞ্চালকের ইমেইল কনভার্সেশনের একাংশ এই তাৎক্ষণিকা। — গানপার
… …
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS