হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ

হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ

প্রিয় জাভেদ, হাসিনাপতনের জানা ও অনুমেয় কারণগুলোর বাইরে আরো কিছু বিষয় বোধহয় রয়েছে। গত ক’দিনের ঘটনাপ্রবাহ ও তার গতিরেখ সে-ইশারা দিচ্ছে মনে হলো। তো এই জায়গা থেকে বুলেটেডে কয়েকটি অনুসিদ্ধান্ত আপনাকে জানিয়ে রাখলাম। সময়ে এগুলো ভুল প্রমাণিত হবে হয়তো। আপাতভাবে মাথায় নিচ্ছি, কেননা পরিস্থিতি এখনো যথেষ্ট জটিল বা ধোঁয়াশায় ভরা হলেও এই ছাত্র-আন্দোলনের ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি আর পরিণতি ঠার করতে কাজে লাগতেও পারে। নিচে কেবল অনুসিদ্ধান্ত তুলে ধরছি, শুরুতে, ব্যাখ্যা তার পরে।

*অনুসিদ্ধান্ত*


ক.  এই আন্দোলনে হাসিনাবিরোধী রাজনৈতিক দল ও স্টেকহোল্ডারদের দৃশ্যত কোনো ভূমিকা নেই। এটি কোনোভাবেই তাদের পরিকল্পনা বা প্লটিং থেকে ঘটেনি। যদিও আন্দোলনের ভাও বুঝে তারা সেখানে পরে প্রবেশ করেছে এবং বেনিফিটেড হচ্ছে এখন।

খ. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থা এর ছক সাজায়নি মনে হচ্ছে। আন্দোলন সফল হওয়ার লগ্ন থেকে তারা সেখানে তৎপর হয়েছে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মতো বেনিফিশিয়ারি হিসেবে একে ব্যবহার করছে বা সামনে করতে যাচ্ছে।

গ. আন্দোলনটি জেন-জি নামে বিদিত প্রজন্মের গত পনেরো বছর ধরে গড়ে ওঠা রাজনীতিসচেতন বয়ানে দীক্ষাগ্রহণের জায়গা থেকে ভাষা পেয়েছে। যার পেছনে দেশের প্রধান তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষক ও সমাজমাধ্যমকেন্দ্রিক আওয়ামীবিরোধী, ভারতবিরোধী ও ইসলামানুগ ইনটেলেকচুয়াল অ্যাক্টিভিজমের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। জেন-জি প্রজন্মের ওপর উক্ত অ্যাক্টিভিজমের গভীর প্রভাব গোটা আন্দোলনকে কেবল হাসিনাপতনের দিকে নিয়ে যায়নি, এখনাবধি যা-কিছু ঘটছে, তার নেপথ্যেও সক্রিয় রয়েছে।

ঘ. আন্দোলনকে বিপ্লবী সরকার গঠনের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ফরহাদ মজহারের তাত্ত্বিক পরিকল্পনা ও প্রক্রিয়া আখেরে কাজে দিবে না। এটি ইতোমধ্যে বিফল হতে শুরু করেছে। এবং …

ঙ. অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি হাসিনাপতনের কারণে সংঘটিত ক্ষতি বা ড্যামেজ কন্ট্রোলে কুশলতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হন, সেক্ষেত্রে এই আন্দোলন আরব বসন্তের পরিণতি বরণ করার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। তড়িঘড়ি নির্বাচনে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনা, জামায়াত ও ইসলামিচক্র মিলে প্রতিবিপ্লব, অথবা আপাত সেনাশাসন… নাহয় চিন্তার অতীত কিছু ঘটতেও পারে।

আপাতত এইটুকু। ভাবনার বিস্তারিত নিচে রইল। আশা করি পড়ে উঠতে পারবেন সময়-সুযোগ করে।

সংযোজনী বিবরণ


প্রিয় জাভেদ, হাসিনাপতনের বাহ্যিক কার্যকারণ মোটাদাগে সকলে কমবেশি জানেন-বোঝেন। পতনের আগে থেকে জানতেন, পতন পরে আরো পরিষ্কার জানছেন সবাই। জানা কারণগুলো নিয়ে কাজেই আলাপ অপ্রাসঙ্গিক। এসবের আড়ালে বিগত পনেরো বছর ধরে একটি পটভূমি পরিকল্পিত ও স্বয়ংক্রিয় উভয় পথে তৈরি হয়েছিল। হাসিনার পতন ও দেশকে বিপাকে ফেলে পালানোর ঘটনায় যেটি অবদান রেখেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদকালে আরো ভালোভাবে অবদান রাখবে মনে করি। আবু সাঈদসহ টানা এক হপ্তার পুলিশি হত্যা-হুমকি-নির্যাতন ও ধরপাকড় আন্দোলনকে সর্বাত্মক রূপ নিতে বাধ্য করলেও তার স্পার্ক অন্যত্র নিহিত ছিল। দুইহাজার আটারোয় কোটা সংস্কার আন্দোলনের নিরীহ যৌক্তিক দাবি দুইহাজার চব্বিশে এসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বদলে যাওয়াটা ছিল আসল স্পার্ক। আন্দোলনের গতিপথকে এটি ভিন্নখাতে মোড় নিতে সহায়তা করেছে। রাষ্ট্রসংস্কার ও একদফায় অটল থাকার রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা সেখান থেকে মূলত শক্তি সঞ্চয় করেছিল। দেশের আমজনতাকে আন্দোলন অনুকূল করতে নামবদলের ঘটনাকে অগত্যা তাৎপর্যপূর্ণ মানতে হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত-হেফাজতসহ দেশের পলিটিক্যাল স্টেকহোল্ডারদের মূল আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি সহায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে এই নামবদল। নামবদলের বিষয়টি মাথায় রেখে আমার কিছু ধারণা ও অনুমান টুকে রাখতে চাইছি। সময়ের পটপরিবর্তনে ধারণাগুলো হয়তো ভুল প্রমাণিত হবে কিন্তু হাসিনাপতনের নেপথ্য কার্যকারণ ভাবতে বসে আপাতত বিবেচনায় রাখা উচিত মনে করছি। ভুল যদি হয়েই থাকে পরে নাহয় শুধরে নেওয়া যাবে।

১.
প্রথম কথা, দুইহাজার চব্বিশের আন্দোলনটি দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক দল ও পলিটিক্যাল স্টেকহোল্ডারদের কোনোপ্রকার পূর্বপরিকল্পনার ফসল নয়। সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রও তাকে বলা যাচ্ছে না। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ হাসিনাচাপে কোণঠাসা ছিল। আন্দোলনে নিজেকে সংহত-সুগঠিত করার পরিবেশ পায়নি গত পনেরো বছর। ইতিউতি সুযোগ খুঁজে বেড়িয়েছে কেবল। বিটিং ইন দ্য বুশ  অবস্থায় যেখানে যা পেয়েছে তাকে আঁকড়ে ধরেছে তারা। ওগুলোর ওপর ভর করে সরকার ফেলে দিতে চেষ্টার ত্রুটি করেনি। কাজের কাজ কিছু হয়নি অবশ্য। অস্থিরতা-অরাজকতা-উসকানির অধিক কিছু ঘটাতে হলে কোমরে জোর থাকা লাগে। রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সেই জোর ছিল না। তাদের কোমর ভেঙে দিতে হাসিনা সরকার করতে কিছু বাকি রাখেনি। মোদ্দা কথা, হাসিনাকে গদি থেকে টেনে নামানোর জঙ্গে বিএনপি সহ রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা যথারীতি চরম গতানুগতিক আর শূন্যগর্ভ ছিল গত পনেরো বছর। সদ্য সফল আন্দোলনের প্লটিংয়ে তারা যে-কারণে গোনায় আসবে না। বাইরে থেকে ছাত্রদের উসকে দেওয়া ছাড়া কুশীলব পর্যায়ে তাদের ভূমিকা ছিল নগণ্য। আন্দোলনটি মূলত স্বয়ংক্রিয় প্রতিরোধের ভিতর দিয়ে সরকার পতনের একদফায় মোড় নিয়েছে। সরকার পড়ে যাচ্ছে বুঝে আমাদের বিটিং ইন দ্য বুশ-র দল দ্রুত সেখানে ঢোকে। পতনের তুঙ্গ মুহূর্তে তাদের এই অনুপ্রবেশ আন্দোলন সফল করতে কাজে দিয়েছে। তারা যদি ওইসময় না ঢুকত তাহলে পেশিশক্তি আর শতেক ছলবাহানায় হাসিনা সরকার ছাত্রদের নিষ্ক্রিয় করতে কালবিলম্ব করত না।

সরকার পতনের মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে সন্ত্রাস পয়দার যে-শক্তি বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মজ্জাগত, এখন তাকে সক্রিয় করা ছাড়া দ্রুত পতন ঘটানো সম্ভব ছিল না। আন্দোলন যে-কারণে নিজ থেকে তাদেরকে ভিতরে প্রবেশ করতে দিয়েছে। হাসিনাকে গদিছাড়া করতে রাজনৈতিক দলগুলোর স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা এই প্রথম বিফলে যায়নি। সহিংসতা কেবল বিএনপি-জামায়াত-জঙ্গিরা করেছে এমন নয়। দেশে সক্রিয় পলিটিক্যাল স্টেকহোল্ডার সেখানে শামিল ছিল। এখন একে ঠেকাতে ব্যস্ত সরকার সমন্বয়কদের ব্যাপারে মাথা ঘামানোর চান্স পায়নি। ডিবি হারুনসহ সরকারি গোয়েন্দাদের থ্রেট-থ্রেট খেলা আর হেলমেট লীগের অপদার্থ নেতাকর্মীর কমিক কাণ্ডকলাপ বাদ দিলে সমন্বয়করা কে বা কারা ইত্যাদি ঠার করতে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থ ছিল হাসিনার উচ্ছিষ্টভোগী আমলা ও শিক্ষকবাহিনী। হাওয়া বেগতিক দেখে তারা গর্তে ঢুকে পড়ে। প্রয়োজন পড়লে তুমি আমার ভাই, অন্যসময় তুমি কোন শালা;—দু-এক ছটাক হালুয়ারুটির লোভে লজ্জাস্কর ভূমিকা মেনে নেওয়া জোট শরিকরাও ব্যর্থ ছিলেন। কারফিউ জারির পরামর্শ ছাড়া আন্দোলন ঠেকানোর বিকল্প পথ উনারা হাসিনাকে দিতে পারেনি। কাউয়া কাদেরসহ দলের গণ্ডার সমতুল নেতারা টিভিপর্দায় গোয়েবোল’স লাই পয়দায় ব্যস্ত ছিল। এছাড়া কিছু ছিঁড়তে পারেনি। ছাত্রদের (এবং পরে জনতার) মুখপত্র সমন্বয়কদের নিষ্পাপ চেহারা আন্দোলনের সময়কাল জুড়ে যারপরনাই বহাল থাকতে পেরেছে।

হাসিনা সরকার বড়ো ভুলটি সেখানেই করেছিল। রাজনৈতিক দল ও স্টেকহোল্ডারদের ওপর গতানুগতিক ঠেকাও পলিসি চাপাতে ব্যস্ত সরকার বুঝতে পারেনি খেলা অন্যত্র ঘনীভূত আকার নিচ্ছে। আপাতদৃষ্টে অরাজনৈতিক কিন্তু রাজনীতিসচেতন একটি আওয়ামী প্রতিপক্ষ বিগত পনেরো বছরে দেশে জন্ম নিয়েছে। নিজেকে সংহত-সংগঠিত করতে তারা ত্রুটি করেনি। হাসিনার হয়ে একশো অপকর্মে লিপ্ত ডিজিএফআই আর পাচাটা সুশীলরা এই প্রতিপক্ষকে নজরে নিতে পারত। হালুয়ারুটি সাপটানোর মৌজমাস্তি আর বিরোধী রাজনৈতিক দলকে দৌড়ের উপ্রে রাখার বাসী কৌশলে মশগুল থাকায় সেদিকপানে তাদের চোখ পড়েনি। ভারতীয় গোয়েন্দারা দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ঘুরান-টুরান দিলেও অরাজনৈতিক প্রজন্মের রাজনীতিসচেতন হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া বিস্ময়করভাবে তাদেরও চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল!

তরুণ প্রজন্ম কীভাবে সরকারকে পাঠ করছে, কোন পথে তারা রাজনীতিসচেতন হয়ে উঠছে বা এর সঙ্গে নিজেকে রিলেট করছে ইত্যাদি বোঝার জন্য যেসব বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতা প্রয়োজন, আওয়ামী শিবিরে তার কোনোটিই বিগত পনেরো বছরে পল্লবিত হওয়ার মাটি পায়নি। কথার কথা, সুলতানা কামাল বা মুনতাসির মামুনসহ আরো যাঁরা হাসিনাকে এই ব্যাপারে ইশারা দিতে পারতেন, পথ দেখাতে পারতেন হয়তো, চাটুকারবেষ্টিত ক্ষমতাদম্ভী সরকারে উনাদের ঠাঁই হয়নি। হাসিনার সঙ্গে বরফশীতল দূরত্বের কারণে উনারা তাঁকে ত্যাগ করেছিলেন। কর্তৃত্ববাদকে সংহত-সুগঠিত রাখতে হলে ইন্টেলেকচুয়াল অ্যাক্টভিজম-এর বিকল্প নেই। এছাড়া সরকারকে কে কোন চোখে দেখছে তার হদিশ পাওয়া কঠিন হয়। মহাগুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি লুটপাট আর টাকা পাচারে বেহুঁশ হাসিনা সরকার বেমালুম ভুলে গিয়েছিল।

খেয়াল করে দেখুন, পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন থেকে আরম্ভ করে স্পর্শকাতর যেসব সিদ্ধান্ত সরকার গত পনেরো বছরে নিয়েছিল সেগুলোকে বুদ্ধিদীপ্তভাবে কখনো ডিফেন্ড করতে পারেনি। বাজে বকতে ওস্তাদ একপাল মন্ত্রী, লুটপাটে দড় সাংসদ, গুন্ডামিতে সেরা হেলমেট লীগ, পাচাটা সাংবাদিক, আর টকশোয় হাজির মাথামোটা কতিপয় নেতা ও সুশীলদের আবোলতাবোল বকুনিই ছিল সার। ওসবে কাজ না হলে ডিজিএফআই দিয়ে থ্রেট আর গুমনাটক সাজিয়ে ধামাচাপ দিয়েছে সব। বঙ্গবন্ধুর মতো লড়াকু এক নেতা যে-দলটির বনেদ তৈরি করে দিলেন তার কী ভয়াবহ অধঃপতন! ভাবতে গা শিউরে উঠছে। হাসিনা কেবল নিজের পিতাকে আরেকবার নিহত করেনি, গণতান্ত্রিক পরিসরের জন্য জাতির জনকের মরণপণ লড়াইকে কবর দিয়েছে। বাকশাল গঠন করে শেখ মুজিব ভুল করেছিলেন কিনা সে-তর্কে আপাতত যাচ্ছি না। একাত্তর পরবর্তী প্রেক্ষাপট আর হাসিনকাল এক নয়। আপাতদৃষ্টে অগণতান্ত্রিক হওয়ার কারণে প্রশ্ন উঠবে, তথাপি কর্তৃত্ববাদকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে দেশ শাসন ও জনগণকে বোকা বানিয়ে সুস্থির রাখতে চাইলে ইন্টেলেকচুয়াল অ্যাক্টভিজমকে আমলে নিতে হয়। মেগা প্রজেক্টের গরম আর ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ঠেলায় হাসিনা সরকারের ওসব আমলে নেওয়ার টাইম ছিল না। ব্যর্থতাটি এইবেলা তার পতন দ্রুত করেছে। যদিও আজ নয়তো কাল পতন ঘটতই।

২.
এখন আসেন আপাতদৃষ্টে অরাজনৈতিক কিন্তু রাজনীতিসচেতন আওয়ামী প্রতিপক্ষ বলতে আমরা আসলে কাদের বোঝাচ্ছি তার মীমাংসায়। তারা কে? কী তাদের পরিচয়? সোজাকথায় এর উত্তর কঠিন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সুবাদে রাজনীতিসচেতন পক্ষটিকে আমরা জেন-জি নামে পরিচিত হতে দেখেছি। প্রজন্মের খতিয়ানে বিগত শতকের মধ্য নব্বই ও বর্তমান শতকের প্রথম দশক (১৯৯৫-২০১০)-এ যারা জন্ম নিয়েছে ও বেড়ে উঠেছে তাদের গালভরা নাম হলো জেন-জি। বয়সের হিসাবে যারা ত্রিশ বছরের নিচে থেকে চৌদ্দ-পনেরোর ঘরে পড়ছে। একটি প্রজন্ম, যারা হাসিনাশাসনে জন্ম নিয়েছে। এই কালসীমায় তাদের অনেকে প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকে পরিণত হয়েছে বা হতে যাচ্ছে। সদ্য সমাপ্ত আন্দোলনে তারা ছিল চালিকাশক্তি। কেবল চালিকাশক্তি নয়, হাসিনারেজিমে সংঘটিত অন্যায়গুলোর ব্যাপারে সচেতন ও একে প্রত্যাখ্যান করতে অটল এক প্রজন্ম। খেয়াল করে দেখুন, গত পনেরো বছরে জেন-জি তিনটি বড়ো আন্দোলনে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল।

বড়ো তিনটি আন্দোলনের মধ্যে প্রথমটি ছিল শাহবাগকেন্দ্রিক গণজাগরণ। উক্ত আন্দোলনে তাদের প্রথম তরঙ্গ (যারা কেবল আটারোয় পা দিয়েছিল অথবা দিতে যাচ্ছিল) শরিক থেকেছে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীর বিচারকে কেন্দ্র করে সংগঠিত আন্দোলনে জেন-জিদের পূর্বপ্রজন্ম প্রধান ভূমিকায় ছিল। প্রজন্ম খতিয়ানে তারা জেন-এক্স। ষাট দশকের মধ্যপর্ব থেকে আশির সূচনালগ্নে (১৯৬৫-১৯৮১) পড়ছে তারা। আদিঅস্তক রাজনৈতিক এই আন্দোলনে সংগতকারণে রাজনৈতিক দলগুলো সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল। বিচারে সুবিধা হলো দেখে আওয়ামী লীগ আন্দোলনকে ম্যানিপুলেট করতে বাকি রাখেনি। সরকারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিরোধী শিবিরে থাকা দলগুলোও সেখানে ঢুকে পড়ে। গণজাগরণকে সাজানো প্রতিপন্ন করতে আন্দোলনকে সমানে ম্যানিপুলেট করেছে তারা। গণজাগরণের মূল স্পিরিট এর ফলে ক্ষুন্ন হয়েছিল। শুধু তাই নয়, আন্দোলনটি দ্রুত আওয়ামী বনাম আওয়ামী বিরোধী শিবিরে বিভক্ত হয়। উভয় পক্ষ থেকে একের-পর-এক সাংঘর্ষিক ন্যারেটিভ জন্ম নিয়েছে তখন। একাত্তরকে কেন্দ্র করে জাতি আগে থেকে বিভক্ত ছিল। গণজাগরণে পৌঁছে বিভক্তি অমোচনীয় হয়ে দাঁড়ায়। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু, ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা, চেতনা ও চেতনাব্যবসা, আস্তিক-নাস্তিক ইত্যাদি ঘিরে ক্যাচাল বা সেখান থেকে উৎপন্ন ন্যারেটিভ আন্দোলনকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলে। হেফাজতের প্রবল উত্থানের মধ্য দিয়ে করুণ পরিসমাপ্তি ঘটে তার।

গণজাগরণ আপাতভাবে হাসিনা সরকারকে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে ঝোলানো নিশ্চিত করলেও আখেরে বিরোধীপক্ষ লাভবান হয়। জেন-জি প্রজন্মের প্রথম তরঙ্গে যারা এই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল তারা গণজাগরণ মঞ্চ থেকে ঘোষিত ন্যারেটিভ প্রত্যাখ্যান করে বসে। বিরোধী শিবিরে তৈরি ন্যারেটিভ বরং তাদের কাছে সহি বলে মান্যতা পায়। একে তারা আপনা করে নেয়। জেন-এক্সরা গণজাগরণের সাক্ষাৎ কাণ্ডারি হলেও বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যের কারণে প্রতিপক্ষ শিবির থেকে উৎসারিত ন্যারেটিভের চাপ সামলাতে পারেনি। আটারোয় পা রাখা একটি প্রজন্ম স্বাধীনতার নির্জলা সত্য ইতিহাসকে মিথ্যা ও সাজানো ধরে নিচ্ছে জেনেও তাদেরকে কনভিন্সড করতে ও ফেরাতে ব্যর্থ হয়। আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চেতনাব্যবসা আর যুদ্ধাপরাধীদের সঠিক বিচার নিশ্চিত করতে চাপ প্রয়োগ এক জিনিস নয়;—গণজাগরণে সক্রিয় জেন-এক্সরা নবীন প্রজন্মের কাছে সেটি পরিষ্কার তুলে ধরতে পারেনি। আন্দোলনের অভিপ্রায় নিয়ে যে-সন্দেহ সচেতনভাবে পয়দা করে হয়েছিল, তাকে মোকাবিলায় গণজাগরণে সম্পৃক্তদের অনেকসময় অসহায় মনে হয়েছে। তাদের দাবির সঙ্গে আস্তিক-নাস্তিক বা ধর্মীয় অনুভূতির সম্পর্ক নেই;—মুখে বললেও বিষয়টি ডিফেন্ড করতে নেমে বিচিত্র স্ববিরোধ জন্ম নিয়েছিল। জেন-জি প্রজন্মের প্রথম তরঙ্গের কাছে যে-কারণে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস পায়। গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠকশক্তি ভাবতেই পারেনি বিরোধী শিবিরের প্রতিরোধ এতটা দুর্নিবার হবে। আওয়ামী কার্ড, ভারত কার্ড, ধর্ম কার্ড, গুজব কার্ড…সোজা কথায় যা-কিছু দরকার পড়েছে তার সবটা বিরোধীরা সফলভাবে প্রয়োগ করেছিল।

জেন-জিদের প্রথম তরঙ্গের ওপর এই ঘটনার ছাপ গভীর মানতে হবে। আজকের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তারাই রূপকার। জেন-জিদের দ্বিতীয় তরঙ্গকে যেখানে তারা সম্পৃক্ত করতে পেরেছে। হাসিনা সরকারের পরিস্থিতিতাড়িত উদ্দেশ্যমূলক রাজনীতি গোটা একটি প্রজন্মের প্রথম তরঙ্গকে নিজ-অনুকূলে নিয়ে আসতে পারেনি। আর দ্বিতীয় তরঙ্গকে তো সে দেখতেই পায়নি। স্মরণ করা প্রয়োজন, দ্বিতীয় তরঙ্গের ছেলেমেয়েরা (শিশু বলাটাই সংগত) নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল। আওয়ামী সরকার একে সফলভাবে নিরস্ত করলেও বাচ্চাদের মন জিততে পারেনি। তারা এটি মনে রেখেছে, মিষ্টিকথায় ভুলিয়ে-ভালিয়ে ঘরে ফেরত পাঠালেও সরকার কাজের কাজ কিছু করেনি। না সড়ক নিরাপদ করতে পেরেছে, না পেরেছে কেন তারা মুক্তিযুদ্ধকে মহান এবং এর রূপকার শেখ মুজিবকে মহার্ঘ ভাববে, তার সঠিক বয়ান হাজির করতে। এখানে বরং তাদের প্রজন্মের বড়ো ভাইদের কথা তারা আমলে নিয়েছিল।

সর্বনাশের সেখানেই শেষ নয় বরং শুরু বলা যেতে পারে। ভোটরঙ্গে সুইং ভোটার  হিসেবে বিবেচিত অংশ কিন্তু ভোটের ফলাফলে প্রায়শ নিয়ামক হিসেবে দেখা দিয়ে থাকেন। রাজনৈতিক দলগুলোকে সমর্থন দানের ব্যাপারে তাদের অবস্থান কখনো এক জায়গায় স্থির থাকে না। পরিস্থিতি বুঝে একদল থেকে অন্যদলে তারা গমনাগমন করেন। গণজাগরণ ও নিরাপদ সড়ক চাই-এ বিস্ফারিত দাবিকে হাসিনা সরকার যেভাবে ম্যানেজ করেছিল সেটি তারা মেনে নিতে পারেননি। সেইসঙ্গে দুর্নীতি ও সকল প্রকার গা-ঘিনঘিনে খাসলতে নৌকামাঝিদের বহাল থাকা সরকারের প্রতি তাদের মনকে বিষিয়ে তুলেছিল। ভোটের নামে সাজানো নাটক হাসিনা সরকারের ওপর তাদের তিক্ত মনোভাবকে আরো সুতীব্র করেছে। সুইংয়ে থাকা বয়স্ক প্রজন্ম নিজঘরে বাড়ন্ত জেন-জিদের হাসিনা সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তাই দিয়েছেন সবসময়। সুইংদের এমনধারা আচরণ দুইহাজার আটারোয় শুরু হওয়া কোটাসংস্কার আন্দোলনকে দুইহাজার চব্বিশে এসে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে মোড় নিতে ব্যাপক সহায়তা করেছে। সেইসঙ্গে কবর রচিত হয়েছে ওইসব প্রগতিসৈনিকের যারা কিনা নব্বই দশকে মানায় এমন চেতনায় ভর দিয়ে একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের মাহাত্ম্যকে অবিরাম পাঠ করে গেছেন! নতুন যুগচেতনায় তাকে যাচাই করে নেওয়া ও ব্যাখ্যার ঠেকা বোধ করেননি। হেফাজতসহ ইসলামি উগ্রবাদীর উত্থানকে তারা পাঠ করেছেন পুরাতন ছকে দাঁড়িয়ে। জেনারেশন গ্যাপ এখানে মর্মান্তিক অবদান রেখেছে। আওয়ামী শুধু নয়, বিরোধী রাজনৈতিক দলও গ্যাপটি আজোবধি ঠিকঠাক পড়তে পারছে না। বিষয়টি আমরা মাথায় রাখব। রাখা প্রয়োজন।

৩.
জেন-জি প্রজন্মের প্রথম তরঙ্গ কীভাবে সচেতন রাজনৈতিক শক্তিতে মোড় নিলো সেই আলাপে এবার আসা যাক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু শিক্ষক আছেন যারা ভাবাদর্শে বামচেতনা বহন করলেও সেখানে অটল না। উনাদের বামপন্থা তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে বিগত দুই দশক ধরে বিকল্প পথ খুঁজছে। প্রথমত, ঔপনিবেশিক দাসত্ব ও সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতাকে উত্তরআধুনিক ভাবাদর্শ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া বয়ান দিয়ে তারা বিচার করে থাকেন। এর ফলে দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে প্রত্যাখ্যানের মনোভাব তাদের মধ্যে তীব্র। আওয়ামী লীগের কোনো স্থান সেখানে নেই। তারা কমবেশি আওয়ামীবিরোধী। দ্বিতীয়ত, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিপক্ষে অবস্থান ছাপিয়ে ভারতের আঞ্চলিক আগ্রাসনকে অধিক গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন। তৃতীয়ত, বিপ্লবকে দেশে বিরাজমান পরিস্থিতির অনুকূলে নিতে ইসলামী জীবনবোধ ও সংস্কৃতি গভীর তাৎপর্য রাখে;—বিষয়টি আমলে নিয়ে নিজের প্রগতিশীল অবস্থানকে নতুন আদলে গড়েপিটে নিয়েছেন।

কট্টর বামপন্থী ভাবাদর্শ থেকে সরে এসে নমনীয় ও ইসলামানুগ এক স্থানিক বামপন্থা উনারা পয়দা করেছেন। বিপ্লব ও রাষ্ট্রসংস্কার যার বড়ো লক্ষ্য। সিপিবির মোজাহিদুল ইসলাম সেলিমকে আপাতভাবে যার বিচ্ছিরি ফলাফল ভাবা যেতে পারে। সদ্যগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তাঁকে সকলে হাজির থাকতে দেখেছেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে উনার ভূমিকা ও অংশগ্রহণ কোনোটাই সিগনিফিকেন্ট ছিল না। অথচ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে শুরু থেকে জিহাদে লিপ্ত আনু মুহাম্মদ বা জুনায়েদ সাকীরা বৈষ্যমবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জানবাজি রেখে লড়াই করলেও সেখানে জায়গা করে নিতে পারেননি। শপথ অনুষ্ঠানে উনারা কি আমন্ত্রিত ছিলেন? সরকার গঠনের তালিকায় ছাত্ররা কি তাদের নাম প্রস্তাব করেছিল? করে থাকলে তাঁরা কি সেটি রিফিউজ করেছেন? নাকি উনাদেরকে নিয়ে ছাত্রদের অন্য পরিকল্পনা রয়ছে? আপাতত এর কিছুই পরিষ্কার নয়। বর্তমান সরকার যে-ছক মেনে গঠিত হয়েছে সেখানে যদিও আনু মুহাম্মদ বা জুনায়েদ সাকীর শরিক থাকা কট্টর বামপন্থী ভাবাদর্শের জায়গা থেকে নিরিখ করলে বাস্তবানুগ নয়। সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির চিরাচরিত ঐতিহ্যে অটল কারো পক্ষে এনজিও মডেলে গঠিত সরকারকে কবুল করা সাংঘর্ষিক হতে বাধ্য। পরে যদি অংশ নেন তাহলে বুঝতে হবে হাসিনার সঙ্গে আপস না করলেও মার্কিন অনুকূল ও বিপ্লব পরিপন্থী সরকারব্যবস্থা নিয়ে তাদের মনে কোনো দ্বন্দ্ব নেই।

যা-ই হোক, বামপন্থা থেকে ইসলামানুগ বিকল্প নিষ্কাশনের তাত্ত্বিক বয়ান পয়দার পটপ্রবাহে আহমদ ছফা থেকে শুরু করে ফরহাদ মজহার, সলিমুল্লাহ খান সকলে কমবেশি খেটেছেন। ওপরে যে-তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আমরা নিয়েছি সেখানে শিক্ষকদের আপাত লঘু অংশ উক্ত বয়ানে নিজেদের একীভূত করতে দ্বিধা করেননি। শাহবাগ কেন্দ্রিক গণজাগরণের দিন থেকে একীভূতকরনের পালাটি চলছিল, যা অদ্য পরিষ্কার অবয়ব নিয়েছে। নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ নিতে থাকা জেন-জিদের বড়ো একটি অংশকে উনারা সফলভাবে প্রভাবিত করতে পেরেছেন। সমাজমাধ্যমের সুবাদে যেটি বাংলাদেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাকাঠামোয় সম্পৃক্তজনে ছড়িয়ে পড়তে বিলম্ব করেনি। ফেসবুক, ইউটিউব হচ্ছে এমন এক পরিসর যেটি জেন-জিদের একীভবন ঘটানোর প্রধান নিয়ামকশক্তি রূপে কাজ করছে। চব্বিশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সমাজমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে বিস্ফারিত হয়েছিল।

এক দশকের অধিক চলমান তৎপরতার নিট ফলাফল হচ্ছে ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। আপাতভাবে তাদের প্রত্যেকের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিচয় হয়তো রয়েছে। বিনএনপি, জামায়াত, হেফাজত…প্রচলিত ডিকশনগুলোয় পক্ষপাত বা সম্পৃক্ততা থাকতেও পারে, তবে এসব ছাপিয়ে প্রগতির সংজ্ঞাকে তারা নতুন ছকে গড়ে তুলেছে। সেখানে আপাতত তিনটি অনুষঙ্গ পরিষ্কার দৃশ্যমান : এক. ভারতকে তারা বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ জ্ঞান করেন। মোদিশাসনে আঞ্চলিক সুরক্ষা ও অন্যান্য বিনিময়ের ঘটনায় হাসিনা সরকারের ভূমিকায় যেটি আরো গভীর হয়েছে। মোদির পরিবর্তে কংগ্রেস থাকলে হয়তো প্রত্যক্ষ ভারতবিরোধিতা এতদূর গড়াত না। দুই. নিজ সাম্প্রদায়িক পরিচয়কে একইসঙ্গে বৈশ্বিক ও দেশিক পটপ্রবাহে তারা মূল্যবান ভাবেন, যেখানে ইসলামি সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শকে ডিনাই নয় বরং সেখানে নিজেকে একীভূত করার দিকে তাদের ঝোঁক প্রবল। তিন. মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে আওয়ামী বা নব্বই পর্যন্ত গতিশীল চেতনাপন্থা তাদের কাছে একপেশে ও উদ্দেশ্যমূলক গণ্য হচ্ছে। একে বানোয়াট ও প্রত্যাখ্যান করা প্রয়োজন বলে মানছেন, যার খাড়ায় স্বয়ং বঙ্গবন্ধুকে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে উনাদের আপত্তি নেই।

তো এই তিন মিলে যে-পিরামিড দেখতে পাচ্ছি সেখানে আওয়ামী লীগ পুরোপুরি ব্রাত্য। কোটা সংস্কার থেকে বৈষম্যবিরোধী একদফায় আন্দোলনের মোড়ফেরা যে-কারণে আকস্মিক নয়। সমন্বয়করা সকলে কমবেশি জেনেবুঝে এগিয়েছেন। আসিফ নজরুলসহ অন্যরা যেখানে পরামর্শকের ভূমিকায় তাদেরকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করছিলেন। গোটা আন্দোলন আমেরিকা বা কোনো রাজনৈতিক দলের সাজানো প্লট না। জেন-জি প্রজন্মের স্বতঃপ্রণোদিত জাগরণ। রাজনৈতিক দলগুলো এখন তাকে নিজউদ্দেশ্য হাসিলে ব্যবহার করতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে দেখলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন সেখানে রয়েছে কিন্তু জেন-জি প্রজন্মকে আওয়ামীবিরোধী প্রতিপক্ষ রূপে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা গভীর মনে হচ্ছে না। তারা কেবল অপেক্ষায় ছিল এমন এক পরিস্থিতির যেটি তাদেরকে এই দেশে খেলার সুবিধা করে দিবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে মার্কিন প্রশাসন ইতোমধ্যে সেই খেলায় ঢুকে পড়েছে।

এই জায়গা থেকে জেন-জিদের আন্দোলন (ফরহাদ মজহারের ভাষায় বিপ্লব) অলরেডি বেহাত হয়ে গিয়েছে। ভারতকে ঠেকাতে বসে মার্কিনকে জায়গা দিতে চলেছেন মজহার। আরেকটি বাম হঠকারিতা হয়তো দেখতে যাচ্ছে দেশ। যেটি অন্যদিক থেকে জামায়াত সহ ইসলামি শক্তিকে এই প্রথম প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে মসনদে বসার সুযোগ করে দিতেও পারে। যদি ধরে নেই, ফরহাদ মজহারের সেরকম কোনো মতলব ছিল না; যদি ভাবি, ছাত্রশক্তিকে বিপ্লবী রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করার ভাবনা থেকে তিনি খেটেছেন; তথাপি বলতেই হচ্ছে,—দেরি করে ফেলেছেন জনাব।

ছাত্ররা যারা মাঠে আছে, এবং যেভাবে আছে, সেটি কিছুদিন পরে আমজনতার সঙ্গে সংঘাতের জন্ম দিলে অবাক হবো না। টোটালি করাপ্ট সিস্টেম জনতা নিজেই করাপ্ট। নানামাত্রায় লুম্পেন। সুতরাং কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট  সামনে তীব্র হবে। রাষ্ট্রসংস্কারের চেয়ে অন্য ইস্যু বড়ো হয়ে দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। উপদেষ্টারা হাসিনা সরকারের আদলে কথা বলছেন মাঝেমধ্যে। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সেদিনতক দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ব্যাপারে মোটের ওপর নিরাশ-নেতিবাচক বক্তব্য রেখেছেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর দাতাসংস্থার সঙ্গে বেঠক শেষের সংবাদ সম্মলনে বলেছেন, অর্থনীতির গতি কিছুটা শ্লথ হলেও বাংলাদেশ ধার উধার করতে পারবে না এমন নয়। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা তার রয়েছে। সক্ষমতা যদি থাকে তাহলে তো হাসিনাকে কুর্নিশ ঠোকা উচিত। দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন লুটপাট সত্ত্বেও দেশকে ধার উধারের জায়গা থেকে উনি নামতে দেয়নি। যদিও এই টার্মে গদিতে আসার পর থেকে চীন ও আইএমএফ-এ তাঁকে সকলে দৌড়াতে দেখেছেন। সালেহউদ্দিন বিজ্ঞজন। সৎ ও দক্ষ গর্ভনর ছিলেন। প্রশ্ন হলো, উনি কি স্নায়বিক চাপ সামাল দিতে কথাটি বলেছেন? নাকি তাঁকেও চীন না হোক, মার্কিনের কাছে হাত পাততে দেখব অচিরে? তো এই ধরনের কনফ্লিক্ট সরকারকে ভোগাবে।

ছাত্রশক্তিকে নিয়ে গঠিত দলে বিপ্লবীচেতনার সঞ্চার ঘটানোর কাজটি মনে হচ্ছে ফরহাদ মজহারের জন্য সহজ হবে না। আপাতত এর কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। জেন-জি প্রজন্ম পাওয়ার ও মানি নিয়ে নোংরা খেলার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললেও বিপ্লব বোঝেন বলে একিন হয় না। দুই সমন্বয়ক ইতোমধ্যে বিএমডাব্লিউতে চড়ে মন্ত্রণালয়ে গমনাগমনের টোপ গিলে বসেছেন। পনেরো আগস্টের ছুটি বাতিল কিংবা নির্বাচন কমিশনারকে বিএমডাব্লিউ থেকে পাজেরোয় নামিয়ে আনতে উনারা একাট্টা হলেও নিজে বিলাসবহুল গাড়িতে চড়ছেন বটে! উপদেষ্টাদের জন্য সুবিধাটি বাতিলের প্রস্তাব স্বেচ্ছায় রাখতে পারেননি। পাপনের চেয়ারে বসা সমন্বয়ক ক্রিকেট বোর্ডের সিনিয়র খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে যেভাবে পরিচিত হলেন সে আর নাই বললাম! তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ সুবিধের ঠেকেনি। এ্যাথিক্যাল স্পিরিটে ঝামেলা আছে বোঝা যায়। তো এই খিচুড়িপার্টির ওপর ভর করে রাষ্ট্রসংস্কারে মজহার কী করে আগাবেন সেকথা ভেবে পেরেশান হচ্ছি। সলিমুল্লাহ খান হয়তো সে-কারণে সমকাল-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে খোলা থেকে আগুনে পড়ার ইশারা দিচ্ছেন।


হাসিনাপতন পাঠোত্তর প্রতিক্রিয়া ও তাৎক্ষণিক সংযোজন 
জুলাই জেনোসাইড : গানপার সংকলন
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

Support us with a click. Your click helps our cause. Thank you!

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you