ফিডব্যাক একটা গান বেঁধেছিল বছর-তিরিশ আগে, সেই আমাদের কৈশোরক কড়কড়ে নোটের ন্যায় নিকষিত রৌদ্রোজ্জ্বল দিনগুলোতে, সেই গানটা আমরা আজও ভুলি নাই। কিংবা আমরা হয়তো ভুলে গেছি, কিন্তু সেই গান আমাদেরে ভুলে নাই, ফিডব্যাকের গানটা আমাদের পিছা ছাড়ে নাই। রিয়্যালিটির ন্যায় আছাড়িপিছাড়ি যায় সেই-সময়ের শোনা ব্যান্ডের গানগুলো। সুরের ভিতর দিয়াই ফিরিয়া পাই মিস্টিক্ সেই দিনরাতগুলোর টুপটুপ জোছনা আর ঝিরিঝিরি হাওয়া, তিরিতিরি পাখির অরণ্য আর ফিনফিনে ঘুড়ির আকাশ, গনগনে দুপুর আর হেলিকপ্টারসদৃশ গঙ্গাফড়িং। ফড়িং বললেই গঙ্গাফড়িং বোঝায়, এমন তো নয় নিশ্চয়; ঘাসফড়িং, ফুলফড়িং, ধানফড়িং, বাঘফড়িং, জলফড়িং, বনফড়িং ইত্যাদি বিচিত্র ফড়িঙে আর ফলপাকুড়ের পত্রপল্লবছায়ায় লেপ্টালেপ্টি ছিল গোটা সাংস্কৃতিক সংখ্যাশীর্ণ বয়ঃসন্ধিডিঙানো সময়টা আমাদের। ফিরে যাই সেই দিনগুলোর দীপাবলি উৎসবে, যেখানে একদঙ্গল বন্ধুহুল্লোড়, ব্যাপক চড়ুইভাতি আর অন্ত্যাক্ষরী ক্রীড়াময় দিনরাতগুলো ভরা গানে-গানে এবং গল্পনাটকের সংলাপে-সৌহার্দ্যে। সেই গান, ফিডব্যাকের সেই গান, মনে পড়ে : “একঝাঁক প্রজাপতি ছিলাম আমরা / একঝাঁক বুনোহাঁস ছিলাম আমরা / বাঁধনহারা পাগলপারা ছিলাম আমরা” — গানের মুখপাতে এই লাইনগুলো ছিল মনে পড়ে। সেইসঙ্গে এ-ও মনে পড়ে যে ব্যান্ডসংগীতের মোড়কে যেমনটা আমাদের তরুণ তুর্কি দিনগুলো প্রবাহিত রয়েছে, তেমনি রয়েছে টেলিভিশনের নাট্যধারাবাহিকে এবং ম্যুভি-অফ-দ্য-উইকে। একেকটা গানের সুর/কথা বা একেকটা নাটকের দৃশ্য/সংলাপ মনে-পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই বিস্তীর্ণ সময়ের সুরবর্ণগন্ধ উঠে আসে একটানে। সেই সময়ের প্রেম-অপ্রেম, সফলতা-নিষ্ফলতা, তরঙ্গ-নৈস্তরঙ্গ, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, শরীর ও হৃদয়ের শোভা আমরা ব্যান্ড ও অন্যান্য মাধ্যমিক গানের ভিতর দিয়াই ইন্-রেট্রোস্পেক্ট সমঝিয়া পাই। ফিডব্যাক নয় কেবল, গঙ্গাফড়িং ছাড়াও যেমন রয়েছে এন্তার লাইট-উইংড অরণ্যপরির ন্যায় ফিনফিনে ফড়িং, রয়েছে ব্যান্ডের দীর্ঘ ক্যারাভ্যান্। রয়েছে সেই আমাদের বাঁধনহারা-পাগলপারা রাত্রিদিনজোড়া নাটকের মহড়া। আমাদের বাটারফ্লাই ইয়ার্স! ম্যুভি-অফ-দ্য-উইক্ আর সাপ্তাহিক-পাক্ষিক বাংলার খণ্ড ও ধারাবাহিক নাটকে বেগবান ছিল প্রহরগুলো। মুখ্যত বোকাবাকশের অভিনয়শিল্পী আর ব্যান্ডমিউজিশিয়্যানদের তরফদারি করে কেটেছে আমাদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়বেলা।
নারী-পুরুষ অভিনয়শিল্পী মিলিয়ে দেখলে, টেলিভিশনস্ক্রিনে দেখা বাংলা-ইংরেজি সিরিয়্যাল্ গণনায় নিয়ে, একগাদা ছিলেন না আজকের ন্যায়। এরপরেও কম হবে না সংখ্যাটা। আমরা পঁচাশি থেকে নব্বইয়ের শেষাংশ অব্দি দৃষ্টি সীমায়িত রাখব সংগত কারণে। এই সময়েই খোলস ছেড়ে বের হচ্ছিলাম আমরা, বা যার যার পরিধানযোগ্য খোলসের তালাশ করে ফিরছিলাম অবচৈতন্য তলে তলে। সেই সময়টা, কাজেই, একান্ত আমাদেরই। ইয়্যে লিখালিখি কা বাত নেহি, ইয়ার, ইয়্যে দিখাদিখি কা বাত হ্যায়। সামাঝ নে কে কৌশিশ এইখানে বেকার। এ হচ্ছে একান্তভাবে প্রেমের পুকার।
অনেক অভিনয়শিল্পীর মধ্যে একজন তিনি, অন্তর্লীন ব্যক্তিত্বপূর্ণ অভিনয় করে গেছেন যিনি স্বল্পায়ু অভিনয়জীবনে, যাকে নিয়ে এই স্মৃতিনিবন্ধ রচনার চেষ্টা। খালেদ খান, যুবরাজ ডাকনাম যার, আমাদের মনে বেঁচে থাকবেন আরও অনেকদিন; — বিশেষত তাদের কাছে, আমরা যারা বিটিভিযুগে ধারাবাহিক নাটকের প্রতি-পনেরো-দিনে একেকটি পর্ব দেখে বেড়ে উঠেছি বহরে-গতরে। মঞ্চে তার অভিনয় দেখেছি, আতাউর রহমানের ‘রক্তকরবী’, বিশু পাগলা চরিত্রে তার অভিব্যক্তিগুলো মনে আমাদের রয়ে যাবে আরও বহুদিন। মফস্বলে এরচেয়ে বেশি তখনও নসিবে জোটেনি, এখনও তথৈবচ। তবে এইটা জানি যে আগাগোড়া তিনি থিয়েটারেই নিবেদিত ছিলেন। মঞ্চে অভিনয় করেছেন, অল্প কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ, নির্দেশনা দিয়েছেন একাগ্রমনে।
টেলিভিশনে ‘এইসব দিনরাত্রি’ দিয়েই শুরু হয়েছিল সম্ভবত, হুমায়ূন আহমেদের স্ক্রিপ্ট, দর্শকনন্দিত সেই টিভিফিকশনে ম্যাজিশিয়্যান ক্যারেক্টারে শিল্পী সরকার অপু নাম্নী তখনকার জনপ্রিয় অভিনেত্রীর সঙ্গে বিয়োগান্ত জুটির অভিনয় করেছিলেন মনে পড়ে। এবং, বলা বাহুল্য, ভালো করেছিলেন। পঁচাশি-ছিয়াশির ঘটনা। আমাদের মা-চাচিমা তখন তরুণী। বিয়োগান্ত জুটিটা তাদেরে স্পর্শ করেছিল। যদিও হুমায়ূনের নাটকে ছাদকোঠায়-ভাড়া-থাকা ম্যাজিশিয়্যান চরিত্রটি প্রধান ছিল না, কাহিনি আবর্তিত টুনি নামের একটি শিশুমেয়েকে কেন্দ্রে রেখে, কিংবা একটি পরিবারের হাসিকান্না-টানাপোড়েন, হুমায়ূনীয় ঢঙে একেবারেই ছোট্ট চরিত্রটিও তখন আখ্যানে নিপুণ তুলির আঁচড়ে আঁকা হতো এবং ফলত অপ্রধান চরিত্রও ঝলসে উঠত আপন জোরে। সেই হিশেবে ম্যাজিশিয়্যান্ চরিত্রটি যথেষ্ট শক্তিশালী ব্যপ্তি নিয়াই দর্শকের সামনে হাজির হয়েছিল।
গোটা দেশজোড়া খালেদ খানের ক্রেজ্ তৈরি হয় ইমদাদুল হক মিলনের একটা নাটক দিয়া। ধারাবাহিক সেইটাও, বটে। সেই নাটকে একটা খল চরিত্র করেছিলেন, ‘রূপনগর’ নাটকটার নাম, হেলাল নামে খুব মশহুর সেই ক্যারেক্টার, সেইখানে তার তেজস্বী ক্রোধবর্ণ চোখের গম্ভীর অভিনয় মনে পড়ছে। সেই নাটকে হেলালের সঙ্গে নায়ক শামীমের দ্বন্দ্ব-দ্বৈরথ অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। অন্তিমে ক্রেজ্ তৈরি হয় হেলালের, খল চরিত্রের, অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভিলেনের নতুন ফর্ম্যাট নিয়া খালেদ খানের নতুন রূপে এই জয়যাত্রা। তারপরবর্তী দীর্ঘদিন এই ভিলেন ফর্ম্যাট বাংলাদেশী টিভিনাটকে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে দেখা যাবে। এর আগে বাংলা ভিলেনের টিপিক্যাল্ ধাঁচা ভেঙেগুঁড়িয়ে এক্কেবারে আলাদা আদল হাজির করে ফেলেছেন হুমায়ুন ফরিদী। কিন্তু ফরিদী নিজস্ব শক্তির নিশান উড়িয়ে তদ্দিনে বাংলা সিনেমায় তুলকালাম ঘটাচ্ছিলেন। শুধু খলচরিত্রের বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ প্রক্ষেপণ দেখতে প্রেক্ষাগৃহগুলো তখন উপচে পড়ছিল হুমায়ুন ফরিদীর বিপ্লবে। সেই সময়েই খালেদ খান নতুন ম্যানারিজম্ নিয়া হাজির হলেন টেলিভিশনপর্দায়। একেবারেই ভিন্ন।
‘রূপনগর’ জনপ্রিয় হয়েছিল, তবে সেইটা নায়ক-নায়িকার কারণে নয়, যুবরাজের অভিনয়ে টিভিস্ক্রিন তখন থরথর করত। অথচ মোটেও লাউড ভোয়েসের কোনো অভিনয় নয়, আন্ডারটোন অভিনয় দিয়া বাংলায় ভিলেন সম্ভবত যুবরাজ প্রথম ও এখন অব্দি দ্বিতীয়রহিত। ‘রূপনগর’ নাটকের নায়ক চরিত্র বরং অতিঅভিনয়ে/মেলোড্রামায় বিরক্তির ব্যাপার হয়েছিল দর্শকের কাছে। এবং নায়িকারূপী বিপাশা হায়াতের গ্লিসারিনমাখা নাসিক্য ক্রন্দনে বিরক্ত হতে হতে অচিরে আমাদের হিক্কা উঠতে শুরু করে। এই নাটকে হেলাল ক্যারেক্টারটা এতই ক্লিক্ করেছিল যে হেলালের ডায়লগ তখন মুখে মুখে ফিরত মহল্লামোড়ে এবং শহর-গ্রাম নির্বিশেষে অলিগলিগুলোতে। এমনকি বাংলা গানেও খলচরিত্রটির উল্লেখ সংযোজিত হয়। যেমন হয়েছিল শহীদুল্লাহ কায়সারের ‘সংশপ্তক’ উপন্যাসের আব্দুল্লাহ আল মামুন কৃত টিভিনাট্যরূপটির রমজান ক্যারেক্টারটার ব্যাপারে। সেই সময় ‘ত্রিরত্নের ক্ষ্যাপা’ নামে একটা অ্যালবাম বেরোয়, এইটা বাংলায় এবং বাংলাদেশে প্রথম র্যাপ্ অ্যালবাম, যদিও সবগুলো টিউনই অ্যাপাচি ইন্ডিয়ানের কপি, কিন্তু অসম্ভব শ্রোতাপ্রিয় হতে পেরেছিল তা-সত্ত্বেও অ্যালবামটা পার্থ বড়ুয়া আর আশরাফ বাবু প্রমুখের আর্লি মিউজিশিয়্যানজীবনে। সেই অ্যালবামে একটা গানে, ‘চলছে’ শীর্ষক গানটায়, ‘হেলাল আর শামীমের ইঁদুর-বিড়াল খেলা / কেঁদে চলেছে বিপাশা’ ইত্যাদি লাইনে সেই দিনগুলোর উত্তেজনা লিপিবদ্ধ রয়েছে।
এরপর সম্ভবত মোহাম্মদ হোসেন জেমী নামের এক নতুন টিভিনাট্যকারের ‘লোহার চুড়ি’ শীর্ষক জনপ্রিয় সিরিজে খালেদ খান আবারও ঝড় তোলেন। ওই আন্ডারটোন ভোয়েস এবং লো-প্রোফাইল এক্সপ্রেশন দিয়াই যুবরাজকীয় ঝড়ো তাণ্ডব। তখন সদ্য শুরু হয়েছে প্যাকেজ্ নাটক অভিধায় একপ্রকার প্রোডাকশন, মূলত রামপুরা টেলিভিশন ভবনের অডিশনতালিকাভুক্তি ছাড়াও নতুন নির্মাতারা তাদের স্বাধীনভাবে-বানানো কাজ জমা দিতে সক্ষম হতে শুরু করেন এই সময়েই। ভিলেন চরিত্রের স্ত্রী অন্য-মানুষে আসক্ত, ধরা পড়ার পর ‘লোহার চুড়ি’ নাটকে মাফিয়াকোলাবোরেটর চরিত্রে রূপদানকারী যুবরাজের ক্রোধ প্রকাশের দৃশ্য আজও ভুলি নাই। এমনিতে কেবল ক্রোধ হইলে সেইটা এদ্দিন মনে থাকত না অবশ্য, খলনায়কের ক্রোধ তো অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু ওই ক্রোধগর্জা আচরণের সঙ্গে মেশানো ছিল অদ্ভুত অসহায়তা আর অপমানিতের একটা এক্সপ্রেশন, ওইসময় ভিলেন চরিত্রটিকে পুরো-নাটকের-মধ্যে পয়লাবার মানুষচরিত্র মনে হয়েছিল, ওই ক্রোধমুহূর্তে, ভুল-করা আমাদের মতো অসহায় নিয়ন্ত্রণাতীত নিয়তির মানুষ। এই নাটকটাও ‘রূপনগর’ নাটকের প্রায় কাছাকাছি প্রিয় হয়েছিল দর্শকমহলে কেবল খলচরিত্রে রূপদানকারী খালেদ খানের অভিনয়গুণে।
এই হেলাল চরিত্রটি আমাদের টিভিনাটক ও সিনেমার ভিলেন চরিত্র নির্মাণ ও রূপায়ণে একটা ভালো প্রভাব ফেলেছিল মনে পড়ে আমার। খলনায়ক রচনার ফর্ম্যাট বদল হয়েছিল ওইবার হেলাল চরিত্রের অভিঘাতে। এরই কিছুদিন আগে একটা চরিত্র পেয়েছিলাম আমরা হুমায়ূন আহমেদের হাত মারফত, ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে, অসম্ভব জনপ্রিয় সেই চরিত্র পর্দায় রূপ দিয়েছিলেন আসাদুজ্জামান নূর, বাকের ভাই ছিল সেই চরিত্রের নাম। বাকেরের অব্যবহিত পরেই আমরা পেয়েছি হেলালকে। দুই ক্যারেক্টার সমগোত্রীয় নয় নিশ্চয়, বেশকিছু বাহ্যিক মিল থাকলেও ছিল তারা মেরুদূরবর্তী স্বভাবের। বাকের ভাইয়ের কর্মকাণ্ডগুলো আপাতদৃষ্টিতে খল মনে হইলেও পরিণামে সেই কর্মকাণ্ডফল ছিল উল্টো, অর্থাৎ বাকের ভাই বাইরে-বাইরে অসৎ মনে হইলেও অন্তর্নিহিত গুণে সে ছিল সজ্জন ও সচ্চরিত্র। অন্যদিকে হেলাল ছিল ভেতরে-বাইরে অসৎ, তবু জনপ্রিয় হয়েছিল এই ক্যারেক্টার, এবং এই একটা ক্যারেক্টার সবার মনেই রয়ে গিয়েছে তখনকার দর্শকদের। খালেদ খানের অভিনয় ছাড়া এই জিনিশ সম্ভব ছিল বলে এখনও মনে হয় না। বাকের ভাইয়ের শিখরস্পর্শী জনপ্রিয়তার ক্রেজ বিরাজিত অবস্থায় এইরকম একটা ক্যারেক্টার করে সেইটি দিয়ে এমন ক্রেজ তৈরি করাটা ছিল অচিন্তনীয়, এই অভাবিত-অচিন্তনীয় সফলতাটা সম্ভব হয়েছে খালেদ খানের কারণে।
এরপর তো বিটিভির সমস্ত নাটকে একের পর এক খলচরিত্রগুলোতে এর ছাপ দেখা দিতে শুরু করে। একসময় এত টাইপড হয়ে পড়ে ব্যাপারটা যে ছেড়ে-দে-কেঁদে-বাঁচি করতে থাকি আমরা দর্শক-অবলারা। খোদ খালেদ খান এমন কয়েকটাতে অভিনয়ও করেছেন মনে পড়বে। এর মধ্যে ‘লোহার চুড়ি’ নাটকটা ভালো উৎরেছিল তখন। হেলাল চরিত্রের প্রভাবে কি না আমরা বলতে পারব না, আমরা দেখতে পাই, একসময় বিটিভির নাটকে খালেদ খানকে কেবল খলচরিত্রে কাস্ট করা হচ্ছে। এই কারণেই কি না, বা অন্য কোনো কারণে, তিতিবিরক্ত হয়ে একসময় টিভিপর্দায় হাজিরা কমিয়ে দেন খালেদ খান ওর্ফে যুবরাজ। মঞ্চে নিয়মিত হতে থাকেন, শুরু করেন নির্দেশনা, অভিনয় করেন অনবদ্য কিছু মঞ্চকাজে পুরোদমে গত দশকের পুরোভাগ জুড়ে। নাসরীন জাহানের স্ক্রিপ্ট নিয়ে একটা ভালো মঞ্চ-উৎপাদন আমরা পেয়েছি তার হাতবাহিত, ‘রূপবতী’। কিন্তু মঞ্চেও রইলেন না আর, অন্তিমের বছর-চার ধরে তাকে সেভাবে জনসমক্ষে দেখা যাচ্ছিল না, মোটর-নিউরন রোগে ভুগছিলেন বলে পত্রিকায় জানা গিয়েছিল। চলে গেলেন, অকালপ্রয়াণ, যবনিকা মাত্র পঞ্চান্নতে।
এইগুলোই নয় কেবল, খালেদ খানের অভিনয়ক্যারিয়ারের গ্র্যাফটা ঈর্ষণীয় সমৃদ্ধ। অল্প হলেও গুণপূর্ণ ক্যারিয়ারগ্র্যাফ। ব্যক্তিগতভাবে এগুলো হয়তো আপনি দেখেন নাই বা আমি তো না-ই, কিন্তু মঞ্চের এই প্রযোজনাগুলোর সঙ্গে কোনো-না-কোনোভাবে আপনি বা আমিও পরিচিত। মঞ্চে ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’, ‘অচলায়তন’, ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, ‘ঈর্ষা’, ‘গ্যালিলিও’, ‘দর্পণ’ এবং ‘রক্তকরবী’ নাটকে দাপিয়ে অভিনয় করেছেন। নির্দেশনা দিয়েছেন ঠাকুরের স্ক্রিপ্ট নিয়া ‘মুক্তধারা’, বুদ্ধদেব বসু রচিত ‘কালসন্ধ্যায়’, ইবসেনের ‘পুতুল খেলা’ এবং ‘মাস্টার বিল্ডার’, ঠাকুরেরই গল্পে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ এবং নাসরীন জাহানের ‘রূপবতী’। সিনেমায় দেখেছি তাকে ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ এবং ‘আহা!’ নামের দুইটাতেই শুধু। ‘রূপনগর’ বা ‘লোহার চুড়ি’ কিংবা ‘এইসব দিনরাত্রি’ ছাড়াও ‘সিঁড়িঘর’, ‘সকাল-সন্ধ্যা’, ‘হারায়ে খুঁজি’, ‘মানুষ নামের নদী’ ইত্যাদি টিভিড্রামায় খালেদ খানের অভিনয় মূর্ত হয়ে আছে।
এত ক্রোধ হয়, এত অসহায় খামোশ অস্বস্তি হয়, এত বিদঘুটে বিকট লাগে ঝকমারি এই দুনিয়াদারির নিরর্থকতা! খালেদ খান শুধু না, যারাই জীবনে একেকটা কাণ্ডে একেকভাবে সঙ্গী হয়েছেন আমাদের বেড়ে-ওঠায়, আমাদের অভিযানে সঙ্গ দিয়েছেন নানান কিসিমে, লেখায় কিংবা অভিনয়ে কিংবা খেলায়, এরা প্রত্যেকেই জীবনের অংশ আমাদের। এদের একেকজনের প্রস্থান হওয়া মাত্র রুদ্ধ হয়ে যায় একেকটা জানালা আমাদেরই জীবনের, জানালা অবারিত খুলেও যায় অবশ্য, খুলিয়া যায় স্মৃতির গবাক্ষ। মনে রাখছি তাকে, খালেদ খান যুবরাজকে, কামনা করছি তার দেহোত্তর স্মরণ ও শান্তি। ট্রিবিউট জানাই যুবরাজের প্রয়াণদিনে তার কাজগুলো স্মৃতির ক্যাল্যাইডোস্কোপে দেখতে দেখতে।
… …
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
- লঘুগুরু - November 8, 2024
COMMENTS