রোদ্দুর রায়ের মোক্সা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই! বাঙালিপাড়ায় যখন তাঁকে নিয়ে সেভাবে হৈচৈ শুরু হয়নি এবং যখন রবিঠাকুরের গানের মোক্সা দিয়ে সুশীল সমাজের গাঁড় মারা শুরু সেই তখন থেকে তাকে চিনি। খিস্তির প্রলেপকে (*যদিও রোদ্দুরের জন্য ওটা ভীষণ দরকারি বটে! এছাড়া ঘাড় ধরে লোকজনকে কথাগুলো শোনানো যেত বলে মনে হয় না) পাত্তা না-দিলে যা থাকে সেটা ক্রুড রিয়েলিটি এবং তাকে অস্বীকার যাবে কোন শালা! এ-প্রসঙ্গে মনে পড়ছে নয়ের দশকের পুরোটা জুড়ে বাঙালি লেখককুলে সুবিমল মিশ্র নিয়ে প্রতিক্রিয়া বেশ তীব্র ছিল। প্রচলিত ট্রেন্ডসেটের গোয়া মেরে নিজের সৃষ্ট ট্রেন্ডকে সাড়ম্বরে জাহির করার একটা ঘটনা ছিল সেখানে। যদিও না-বলে পারছি না, শাহরিক বাঙালির সাহিত্য-শিল্পকলার যত কসরত আর সেখানে ঘাপট-মেরে-থাকা সৃজনশীলতার দৈন্য, ভণ্ডামি ও স্ববিরোধ ইত্যাদির গোয়া মারতে যেয়ে সত্য উক্তি করলেও সুবিমল শেষাবধি প্রচলিত পথে নিজের দ্রোহ প্রকাশের পথ খুঁজে ফিরছিলেন।
যেমন ধরুন বাঙালির মানসচেতনায় রবীন্দ্রচর্চার প্রভাব ও পরিণতির দৃশ্যমান বন্ধ্যাত্ব আর ভণ্ডামিকে কামান দাগানোর সময় সুবিমল রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীলতাকে খারিজ করে বসেন, যেখানে রবিকে নতুন করে পাঠ যাওয়া ও বি-নির্মাণের সম্ভাবনা অথবা সে-রকম স্পেস তাঁর কাছে পাত্তা পায় না। তাঁর প্রতিবাদের ধরন এই অর্থে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার প্রচলিত অভ্যাসের দাসত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি। প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় জায়মান অসংগতিকে খিস্তি করার ক্ষণে সেই ব্যবস্থায় বিদ্যমান (*হয়তো প্রভাবহীন) আরেকটি ধারাকে বিকল্প বলে হাজির করা ও তাকে প্রতিষ্ঠার জন্য জানবাজি রাখার মাঝে বাঙালির বন্ধ্যাত্ব ঘোচানোর স্বপ্ন তাঁকে উতলা করেছিল। যে-কারণে রবীন্দ্রনাথ বা সত্যজিৎকে ঘিরে সৃষ্ট প্রতিমাকে খিস্তির তোড়ে খারিজ করলেও এর বিকল্প ভাবতে যেয়ে কমলকুমার, অমিয়ভূষণ, ঋত্বিক কিংবা গদারের প্রতিমা গড়া ও এর মহিমার গুণগানে নিজেকে তিনি নিঃস্ব করেন।
সুবিমলসৃষ্ট এই প্রতিমায়নে গদার কিংবা ঋত্বিককে অগত্যা আর প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ থাকে না। প্রশ্ন হলো, যে-দোষে রবি বা সত্যজিৎ সুবিমলের ‘প্রতিমাচূর্ণ’ মিশনে প্রশ্নবিদ্ধ ও খারিজ হতে থাকেন এবং বিকল্পরূপে (ধরা যাক) জয়েস, কমলকুমার, গদার বা ঋত্বিকের প্রতিমায়ন ঘটে, সেখানে উনাদের প্রশ্নবিদ্ধ করার স্পেস তিনি রাখেন কি? নাকি উনারা তাঁর কাছে সেই বিকল্প যা প্রশ্নের আওতায় কখনও দাঁড়িয়ে নেই? সুবিমল যে এমনটি ভাবেন না সে তাঁর লেখাপত্রে বহুবার ক্লিয়ার করার চেষ্টা করেছেন। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার নিয়মে প্রতিমা ভেঙে নতুন যে-প্রতিমা গড়ে ওঠে তাকে একসময় ভাঙনের কবলে পড়তে হয়, এবং এই বিবেচনা তাঁর রচনায় দুর্লভ নয়। যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কী হেন কারণে রবি বা সত্যজিৎকে ঘিরে তৈরি প্রতিমায় হিসি করার ক্ষণে গোটা রবি ও সত্যজিৎকে তিনি প্রস্রাবের ফেনায় ভাসান? কেনই-বা তাঁর একবারও মনে হয় না বাঙালিসৃষ্ট রবি বা সত্যজিতের প্রতিমায় মেদ থাকলেও ওই মেদটুকু ছেঁচে তুলতে পারলে প্রতিমারা স্বকীয়তায় ঝিলিক দিতেও পারে।
রবি কিংবা সত্যজিৎকে নতুনভাবে পাঠ ও বি-নির্মাণের সম্ভাবনা সুবিমলকে কদাপি ভাবিয়েছে বলে মনে হয়নি। কিংবদন্তিপ্রতিম মূর্তিগুলোর মস্তকছেদনকে তিনি জরুরি ভেবেছিলেন, নকশালরা যেমন বিপ্লবের প্রথম প্রহরে বিদ্যাসাগরের ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। এইসব একমুখী নির্ধারণের কারণে সুবিমলের ভিতরে আগুনরাঙা ক্রোধের ফুলকি থাকলেও সেই ক্রোধ তাঁকে প্রচলিত ব্যবস্থার বাইরে নিষ্ক্রমণ নিতে কোনও সহায়তা করেনি। তিনি একের পরিবর্তে বিদ্যমান অন্য প্রতিমার প্রতিষ্ঠায় নিজেরে দম বাজি রেখেছিলেন। রবিসাহিত্যে প্রাগ্রসর হওয়ার লক্ষণ তিনি খুঁজে পাননি, ওটাকে নির্ধারণবাদী ও স্থবির বলেই দেগেছেন। ভালো কথা, কমলকুমার-অমিয়ভূষণ কিংবা ঋত্বিক কি নির্ধারণবাদী ছকের বাইরের কোনও ঘটনা ছিলেন কিংবা সেখানে স্থবিরতার লক্ষণ কি বিলকুল নিখোঁজ? সুবিমলের ক্রাইসিসটা ছিল এখানেই, এক মানদণ্ড খারিজ করে তিনি অন্য মানদণ্ডের পিছু নিয়েছেন এবং একটাকে কামান দাগতে গিয়ে আরেকটি দিয়ে নিজের গোলাবারুদের বাকশো ভরে তুলেছিলেন।
মানবসংসারে যত ঘটনা তার কিছুই প্রশ্নের বাইরে নয়। সবকিছুই এখানে প্রতিমাপুজোয় নিঃস্ব হয় বিধায় কোনও প্রতিমাই কারও জন্য স্বস্তিকর বা অন্তিম হতে পারে না। আবার সকল প্রতিমার গায়ে জমা ধুলোবালি সফা করে সেখানে নতুন তুলি টানা ছাড়া কারও পক্ষে সত্যিকার প্রতিষ্ঠানবিরোধী হওয়া কঠিন। রোদ্দুর এই কনটেক্সটের বিচারে সুবিমলের ধারা থেকে ঢের এগিয়ে। প্রতিমারা ও তাদের ঘিরে জমে-ওঠা ভণ্ডামোকে তার মোক্সা খারিজ করে না আবার এর বিকল্প নিয়েও সেখানে হাজির হয় না, চোখা মশকরার বাণ মেরে অসংগতিগুলো শুধু ধরিয়ে দেয়। রবিগানের মোক্সা যেমন বাঙালি বাবুগণ রবিকে আজও পুনর্পাঠ ও বি-নির্মাণে অক্ষম সেই সত্যটি তুলে ধরে। রোদ্দুর বোকাচোদা নয় যে হেঁড়ে গলায় রবিগানের প্যারোডি কিংবা আরও বিচিত্র সব কীর্তিকে বাঙালির জন্য নতুন সৃষ্টি বা ট্রেন্ড বলে দাবি করবে। যারা এভাবে ভাবছেন ও বাঙলি কৃষ্টি-কালচারের জাত গেল বলে তার গোষ্ঠীউদ্ধারে নেমেছেন তারাই বরং গাণ্ডু এক্ষত্রে। সহজ বিষয়টি তারা ধরতে অক্ষম; এই লোকটি নিজের কোনও ট্রেন্ড সেট করার জন্য মোক্সায় মাতেনি, বরং বাঙালি জীবনে ঐতিহ্য ও ট্রেন্ড তৈরির ধারায় যেসব অসংগতি, ভণ্ডামি ও নিঃস্বতা রয়েছে সেগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর জন্য সে মোক্সা করে যায়।
এহেন কাজ করতে হ্যাডম লাগে এবং রোদ্দুরের সেই ক্ষমতাটি রয়েছে। সে কোনও মানদণ্ড দিয়ে নিজেকে মাপে না বরং সকল মানদণ্ডকে এককাতারে ফেলে তাদের গোয়া মেরে একশা করে ছাড়ে। মাথাখারাপ এই ছিটলামির মধ্যে একটি জাতির সুশীল-নাগরিক বাবুগণের সেই চেহারা ক্রমপ্রকাশ্য হয় যা সুদীর্ঘ কাল ধরে স্বমেহনে লিপ্ত এবং এখন নিঃস্ব। রোদ্দুর হয়তো এভাবে চ্যালেঞ্জটা ছুঁড়ে দেয়, তোমরা যখন বাঙালি কৃষ্টি-কালচার আর দাদুর (রবীন্দ্রনাথ) প্রতিমায় নতুন কিছু যোগ করতে পারছো না, হরেক কসরত শেষে নিজেকে নপুংসক প্রমাণ করে চলেছো এবং কভু তা স্বীকার যেতে চাইছো না, তবে ‘বাঁড়া চাঁদ উঠেছিল গগনে’ দিয়ে শুরু হোক এই মোক্সাগিরি। রোদ্দুর রায়ের বল্গাহারা খিস্তি এবং তার অন্তরালে বহমান হাহাকার ও ক্রোধ তাই বাঙালি জাতির জন্য ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট হয়েই আসে; সেইসব বাবুগণের জন্য যারা আজ বহুদিন হয়ে গেল ধ্রুপদি থেকে বাণিজ্যিক কোনোকিছুকে নিজের স্বকীয়তা দিয়ে অনুভব, প্রভেদ ও ভাঙচুর করে নতুন প্রতিমা গড়তে কিংবা পুরোনো প্রতিমাকে নতুন ভাষা দিতে অক্ষম।
প্রতিমা গড়ে ওঠার ধারা কখনও শেষ হয় না তবে তাকে ভাঙা ও নতুন করে গড়তে জানতে হয়। রোদ্দুরের বিটকেল খিস্তি হয়তো অবিরত সেই বার্তা দিয়ে যায়, যা বাঙালি পড়তে পারছে না। বাঙালির গলাপচা ‘কলাচারে’ ওর এই ‘কদাচার’ তাই সুবিমলের সাহিত্যকৃতির চেয়ে অধিক তাৎপর্য রাখে। এই প্রথম একজনকে পাওয়া গেল যে কিনা এক মানদণ্ড দিয়ে আরেক মানদণ্ডকে নির্ধারণ না-করেও রাষ্ট্র ও সমাজের জান পেহচান থেকে সৃষ্ট ব্যবস্থার অণ্ডকোষ ধরে মোচড় দিয়েই যাচ্ছে। নিজেকে স্বেচ্ছায় সস্তা করে বাঙালির সস্তাপনাকে এভাবে একহাত দেখে নেওয়ার এই মকারিকে কুর্নিশ জানাতেই হয়। জয় গুরু! রোদ্দুর তুমি যুগ যুগ জিয়ো!
দ্রষ্টব্য / রোদ্দুর নিয়ে আপনাদের কার কী মনোভাব তা জানি না। আমি ফান এবং পান্ দুই অর্থেই তাকে মাঝেমধ্যে সফর করি। ছিটলামির অন্তরালের সত্যকথন আরেকবার ঠাহর করতে এই লিঙ্কটি তাই দিয়ে রাখলাম, যা এই হঠাৎপ্রসঙ্গের উৎস :
[Bangla O Celeb | MoxaDopeComedy | By Roddur Roy]
… …
আহমদ মিনহাজ তাৎক্ষণিকামালা
গানপারে লেখকের অন্যান্য রচনা
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS