গানের আকৃতি, বিকৃতি, নির্মাণ, বিনির্মাণ…সেজুল হোসেনের ইউটিউবচ্যানেল ও অন্যান্য পণ্যপ্রতিষ্ঠান

গানের আকৃতি, বিকৃতি, নির্মাণ, বিনির্মাণ…সেজুল হোসেনের ইউটিউবচ্যানেল ও অন্যান্য পণ্যপ্রতিষ্ঠান

সেজুল হোসেনের কাজগুলা আসলেই ভালো। মনের টান থেকে করেন বোঝা যায়। বাড়তি ভিউ পাওয়ার আশা বা সেরকম কোনো মতলব নাই সেখানে। দরদ দিয়া গানটাও করেন বেশ। আমির উদ্দিনের বড়ো লজ্জা পাইমু রে বন্ধু  আর শাহজাহান মুন্সীর কণ্ঠে আলাউদ্দিনের এই কি প্রেমের প্রতিদান,—বহুশ্রুত এই দুইটা গান দরদ দিয়া তাঁকে গাইতে দেখসি। শুনে ভাল্লাগসে। ঢাকায় ডেরা পাতলেও ভাটিবাংলার জলহাওয়ায় চুবানো সত্তাটারে সেজুল খুন হইতে দেন নাই। নিজের মতো করে ধরে রাখসেন এখনো। তাঁর চ্যানেলে ঢুঁ মারলে বিষয়টা ঠাহর হয়। তারচাইতে বড়ো কথা,—সামারীন দেওয়ান, হামিদা বানু বা সেজুলের কাজগুলা বহুজাতিক খবিসির বাইরের জিনিস হওয়ার কারণে দেখতে এবং শুনতে ভাল্লাগে। চোখকানে আরাম দিয়া যায়। উনারা এইটা ধরে রাখতে পারলেই হয়। জামানা ভালো না। গানপার-এ সদ্য প্রকাশিত গ্রাসরুটসের গান-র ১৩ নাম্বার কবিতার তাঁবে সে চলে এখন। মনের টান হইতে করা কাজগুলাকে আপন ভাবার মানুষ খতম হওয়ার পথে, উপরন্তু শতবিধ খারাবির চক্করে অকৃত্রিম সহজকে কলুষিত হইতে দেখি আকসার। উনাদের ক্ষেত্রে সেইটা যেন না ঘটে এই প্রার্থনাটাই আমরা করতে পারি। তার বেশি কিছু করার ক্ষমতা আমাদের নাই।

কোক স্টুডিও বাংলাকে এই সুবাদে ইয়াদ করায় সাধুবাদ গানপারের প্রাপ্য। ব্যানার ও হেডিংয়ে বিষয়টাকে যেভাবে হাইলাইটস করা হইসে সেখানে ছুপা বিদ্রুপ পাঠকের টের পাওয়ার কথা। অর্ণবকে তো আমরা মেধাবী সংগীতকার বইলা চিনছিলাম একসময়। রাজীব আশরাফের লেখা ও অর্ণবকণ্ঠে গীত হোক কলরবকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারা শ্লোগানে পরিণত করলেন, তার বহু আগে থেকে দেশজুড়ে উনি পরিচিত ছিলেন। হোক কলরবকে আচমকা প্রতিবাদের বাহন করার  বেখাপ্পা দিক নিয়া যে-লেখাটা গানপারে ছাপা হয়েছিল সেখানে চোখা বাক্যবাণ ছিল মনে পড়ে। বাক্যবাণ থাকলেও দেশের নাগরিক শ্রোতাকুলের ওপর অর্ণব বা রাজীব আশরাফের ক্রমশ প্রভাববিস্তারী হওয়ার সম্ভাবনাকে ইগনোর করা হয় নাই। তরুণ দুই তুর্কিকে তাঁদের কাজের জন্য জায়গামতো সাধুবাদ বা অ্যাপ্রিসিয়েশনের সুর লেখায় ছিল, যৌক্তিক কারণেই ছিল। তো সেই অর্ণব কোকচক্করে কেন খেই হারাইতেসেন সেকথা ভেবে আফসোস হয়। সময়টা এমন, আফসোস ছাড়া কিছু করার নাই আসলে!

অল্টারনেটিভ, সাইকেডেলিক রকগানের মওসুম বাংলাদেশে প্রকট হওয়ার ক্ষণে অর্ণব এন্ড কোংয়ের পৃথক যাত্রা আমরা নজর করসি সেই সময়। দেশের মশহুর ব্যান্ডবাজরা এই সময়টায় নিজের পুঁজিপাত্তি নিয়া জাতির সমীপে একে-একে হাজির হইতেসিলেন। উনাদের কথা যদি বাদও দেই, সময়বিচারে চ্যাংড়া ব্ল্যাকর কথা যদি ধরি, ইমন জুবের-তাহসান-জন কবির মিলে যে-হাইপ তৈরি হইতেসিল তার মাঝখানে আনুশেহ্ আনাদিলের সাথে অর্ণবের জুড়িকে মন্দ বলার অবকাশ ছিল না। আরবান ইয়ুথের কানে চড়া বাদন ও হল্লাবাজির আবেদন তীব্র ছিল তখন। তার মধ্যেই আনুশেহ্, অর্ণব, বুনো উনারা মিলেঝুলে জুড়ি বাঁধসিলেন। বাংলা ব্যান্ডের ছাতার নিচে বসে গাইতে থাকা উনাদের ফোকআরবান  ধাঁচের গানগুলাকে ওয়েলকাম জানাইতে কেউ তখন বিমুখ বোধ করে নাই। বাংলা  ব্যান্ডের পাট সহসা অস্ত যাওয়ার দিনকালে আনুশেহকে আমরা ক্রমশ নিষ্প্রভ হইতে দেখসি আর ওদিকে সোলোজামানায় নিজের এন্ট্রি পাকা করলেন অর্ণব। কিছু ভালো গান ওইসময় তাঁর হাত দিয়া বাহির হইসে। আমরা তো গানগুলা এখনো শুনি। শান্তিনিকেতনী ধাঁচ, তাঁর ক্ষেত্রে যেইটা মার্কামারা বইলা অনেকে দাগান, ধাঁচটা ওইসব গানে কমবেশি প্রকটিত ছিল কিন্তু শ্রোতাকানে দিওয়ার হইয়া দাঁড়াইতে পারে নাই। হালত দেখে মনে হইতেসে, শান্তিনিকেতন থেকে কোনো-একভাবে বাহির হওয়ার ভাবনা বরং অদ্য ক্ষতি করতেসে উনার। ক্রিয়েটিভ হইতে গিয়া ওভার ক্রিয়েটিভ  হওয়ার চাপ ফেস করতেসেন অর্ণব।

ঠাকুরের গান তিনি ভালো করেন। ওইটা তাঁর কমফোর্ট জোন। সাহানা বাজপেয়ী বা সৌম্যদীপ মুর্শিদাবাদীর কবিরভজন জুড়ে যেসব গান করেছেন সেগুলায় ভারসাম্যটা নিখোঁজ ঠেকে না কানে। শিক্ষিত নাগরিক শ্রোতার জন্য যেমনটা হইলে মানায়, গানগুলা সেই দাবি যেহেতু মিটাইতে চায়, ফলত শুনতে ভালো লাগে। কোকফরমেট  এদিক হইতে তাঁর জন্য চ্যালেঞ্জিং। কোক যেইটা চায় বা যেভাবে ফোক ও আইকনিক ঘরানার গানকে শ্রোতার কানে অ্যাপিলিং  করার ধান্ধা খোঁজে, এর সাথে খাপ খাওয়ানোর ধকল মনে হইতেসে অর্ণবকে পেইন দিতেসে। কোকপাকিস্তানে রোহাইল হায়াত চাপটা লম্বা সময় ভালোভাবে সামলাইছেন। ছয় নাম্বার সিজনের (*সাতও হইতে পারে, ঠিক মনে নাই এখন) পর কোক হইতে ইস্তফা নেন। রিসেন্ট একটা সিজনে (*বারো নাম্বার হবে বোধহয়) কামব্যাক করলেও ওইটা সাময়িক ছিল। বোঝা যায়, পেইন উনাকেও ছাড়ে নাই।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন, যেখানে বিষম বিপরীত দুইটা ধারা একে অন্যকে ওভারল্যাপ না করে মসৃণছন্দে পাশাপাশি যাবে, প্রচুর বাদ্য বাজবে কিন্তু মনে হবে না আসুরিক কাণ্ড চলতেসে…, ইত্যাদির মধ্যে ক্রিয়েটিভিটির যে-চাপা শিহরণ ও উত্তেজনা, সময়বিশেষে ওইটা মারাত্মক চাপে মোড় নিতে থাকে। টানা ছয়-সাত সিজন চালানোর জেরে রোহাইল হায়াতের বিষয়টা টের পাইতে কিছু বাকি থাকে নাই। শেষের দিকে তাঁকে খেই হারাইতে দেখসি। কোক স্টুডিও ভারতের হিন্দি ভার্শন তো এখনাবধি দাঁড়াইতে পারে নাই ঠিকঠাক। এক-একটা সিজনে একের-পর-এক মিউজিশিয়ান সেখানে যাওয়া-আসা করেন কিন্তু কোকের যেইটা আসল লক্ষ্য বা উপলক্ষ্য, তার সাথে বনিবনা সলিড হয় না। ভারত জুড়ে ঝাঁকের কৈয়ের মতো মিউজিশিয়ানের বাড়বাড়ন্ত একটা কারণ। একটা কোক স্টুডিও উনাদের কাছে সিগনিফিকেন্ট কিছু না। বড়ো মিউজিশিয়ানরা এক-দুইটা সিজনে আসেন, কোকফরমেটে দশ-বারোটা গান নামানোর মধ্যে আরো দশটা কাজ করেন, যারপরনাই চটকদার কন্টেন্ট বিক্রির কোক-নির্ধারিত পন্থার সাথে উনাদের সহবত, রিসার্চের ওই জায়গাটা তৈরি হইতে পারে নাই। আনকোরা কাউকে দিয়া পরীক্ষা চালানোর ঝুঁকি নিতে পারলে হয়তো কাজে দিত, যে-কোনো কারণে হোক, কোক স্টুডিও ভারতকে ওদিকপানে যাইতে দেখি না। অর্ণব তো মাত্র দুই সিজন পার করলেন! চাপটা ইতোমধ্যে ক্রিয়েটিভি থেকে ওভার ক্রিয়েটিভিটি  দেখানোর কসরতে তাঁকে নিয়া যাইতেসে মনে হয়।

গান নিয়া পরীক্ষানিরীক্ষায় আমি-আপনি-আমরা, কারো আপত্তি থাকার কারণ নাই। আমাদের মতো ইতরজনতা গানঅজ্ঞ হইতে পারি কিন্তু গান শুনতে ভালোবাসি। ধ্রুপদি যেমন শুনতে চাই, কোক হইতে চটুল…কোনোকিছু শুনতে আপত্তি নাই। আমরা তো চাইব, পুরোনো গানগুলা সময়-পরিস্থিতি-পরিপার্শ্বকে নজরে নিয়া নতুন আঙ্গিকে গীত হইতে থাকুক। সমস্যা হইল, কাজটা ভীষণ কঠিন। গানকে যদি খালি বাদ্যযন্ত্র ও গায়কের কেরদানি বইলা ভাবি তাইলে বিপদ। দেশে মোদের মতো অভাগা বিরাজ করেন, রবিঠাকুরের বেশ-আর্ধেক গান যত কম যন্ত্রানুষঙ্গে বাজবে ওইটা শুনতে যাদের ভাল্লাগে। তা-বলে যন্ত্রানুষঙ্গ যেখানে প্রকট সেইটা তারা শোনেন না এমন তো না। এমনধারা পরিবেশনা ভালো লাগে যখন গানের ভাবসম্পদ নতুন আবহ মনে পয়দা করে যায়। ঠাকুরের টেক্সটে গুঞ্জরিত আদিভাব নিদেনপক্ষে হারাইয়া যাওয়ার ফিল  যদি না জাগে তাতেও উনাদের কাজ চলে। দুইয়ের কোনোটাই যদি না থাকে, সেক্ষেত্রে এই গান ওইসব অভাগা লোকের পক্ষে হজম করা কঠিন মনে হইতে থাকে। সংখ্যাবিচারে তারা লঘু ও বিচ্ছিন্ন হইতে পারেন, গানে সুর পয়দা ও যন্ত্রানুষঙ্গের ঝকমারি সব আয়োজনের ব্যাপারে অজ্ঞ হইতে পারেন, কিন্তু তাদের ভালোলাগা মন্দলাগাটারে ক্ষণিকের তরে হইলেও বিবেচনার জায়গা দেশে অবশিষ্ট নাই।

শ্রোতাপসন্দ কিংবা ফরমেটেড বইলা স্বীকৃত গানের আদবে নতুন আবহ ক্যামনে খাপ খাওয়ানো যায় তার প্রমাণ ঋতুপর্ণ ঘোষের রবিগান বিষয়ক কাজকারবারে খানিক পাওয়া যায়। রবিকে নিয়া গানের ওপারে  নামে একখানা টিভিসিরিয়াল করতেন ঋতুপর্ণ। জনপ্রিয় ছিল ওপার বাংলায়। অর্ণবের বয়সী বা কাছাকাছি বয়সের শিল্পী স্যমন্তক সিনহা তখনো পরিপক্ক হইয়া উঠেন নাই। অপরিপক্ক তরুণকেই ঋতুপর্ণ গানের ওপারে  ডাকলেন। শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি  গানটা আরবানধাঁচ মাথায় নিয়া গাইতে বললেন তারে। ঋতুপর্ণের ডিরেকশন মেনে স্যমন্তক গানটা যেভাবে গাইছিলেন, রবিগানের স্বীকৃত ঘরানায় অভ্যস্ত কারো সেইটা অ্যালাউ  করার কথা না। ডিস্টর্শন  বইলা ফাল দিয়া উঠার কথা ছিল উনাদের, এবং তারা সেটাই করছিলেন তখন। তো এই ডিস্টর্শনটাই কিন্তু শুনতে বেশ লাগে। তখন যেমন বেশ লাগত, এখনো লাগে। সুতরাং গানের বহুস্বীকৃত আদবের বরখেলাপ মানেই কালাপাহাড়ি কাণ্ড এমন না-ও হইতে পারে।

ঠাকুরকে বক্ষে লালন করে তাঁর থেকে বাহির হওয়ার ধান্ধায় কাজটা করছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। স্যমন্তকের কণ্ঠে জনপ্রিয় গানটা শ্রোতাকে কিন্তু আজব পরিস্থিতির সম্মুখীন হইতে বাধ্য করে। ঠাকুরের শরৎবন্দনাকে সে এখন কোন জায়গা হইতে বুঝবে? প্রশ্নটা তাকে পীড়িত করে বৈকি। গানটা যে রবিঠাকুরের এইটা অস্বীকার করা তার পক্ষে সম্ভব না। অন্যদিকে একে হুবহু ঠাকুরের বইলা ভাবার রাস্তা ঋতুপর্ণ স্বয়ং বিষম কইরা তুলতেছেন। এ-যুগের শহুরে পোলাপাইনের দেহে বহতা সিগ্ধ উল্লাস, সেলিব্রেশন, ইটকাঠপাথরের শহরে যারা শরৎ কিংবা কাশফুল দেখে না, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হয়তো তাদের মনে বিরক্তি পয়দা করে, এমন সব জগাখিচুড়রি মধ্যে যারা নিজের তারুণ্যকে চিয়ার আপ  রাখে…, মানে ওইসব নগরযুবার মনে কল্পিত এক শরৎফ্যান্টাসির খবর নিতে বুঝি-বা ঋতুপর্ণ শরৎবন্দনায় রবিকে এনক্যাশ করলেন! রবির গান নিয়া বাঙালি বাবুদের কত শত মধ্যবিত্তপনা! ওইটাকে ধাক্কা দিতে ঋতুপর্ণ যে-কাণ্ডটা ঘটান সেইটা কিন্তু গানঅজ্ঞ শ্রোতারা লুফে নিতে দ্বিধা করে নাই। দ্বিধার কিছু ছিলও না সেখানে।

মাকসুদের কথা কেউ তুলতে পারেন। কইতে পারেন, উনিও তো ঠাকুরের গান ব্যান্ডফরমেটে গাইসিলেন, কই তারে তো কেউ বাহবা দেয় নাই তখন। মাকসুদ যে-সময়ে কাণ্ডটা ঘটান, প্রসঙ্গ বিবেচনায় ওইটা করতে সাহস ও এলেম দুই-ই দরকার ছিল। উনি সেই হ্যাডম দেখাইতে পিছপা হন নাই, তবে রবিকে গাওয়ার ধরন স্বয়ং মাকসুদ কি উপভোগ করতে পারছিলেন সেই সময়? আমার কেন জানি সন্দেহ হয়। রবিকে ব্যান্ডগানের আদলে পরখ করতে চাইতেসিলেন উনি। রবির গান নিয়া যে-সমস্ত বিচ্ছিরি টাবু  দেশে বিরাজিত, ওইটা ভাঙতে মরিয়া ছিলেন। উদ্দেশ্য মহৎ বা সেইটা নিয়া কথা বলার জায়গা নাই, কিন্তু গাইতে গিয়া নিজের সাথে নিজের সংযোগ কি ঘটাইতে সফল ছিলেন মাকসুদ? প্রশ্নটা তখন কেন জানি ওঠে নাই। রবির গান করার ঘটনায় তিনি কি স্বচ্ছন্দ বোধ করতেছিলেন?  নাকি ডিসকমফোর্ট  টের পাইতেসিলেন ভিতরে? অনুমান সত্য না হইতে পারে, তবে গানটা শুনতে গিয়া ওই ফিলটা কেন জানি মনে আগে জাগে। স্যমন্তকে সেইটা ঘটে না।

মাকসুদ যদি কাজটা আরো করতেন তাইলে রবিগানে উনার নিজস্ব ধাঁচ জাতি একসময় বুঝতে পারত। সমালোচনা কিংবা ব্যক্তিগত কারণ যা-ই থাকুক নেপথ্যে, মাকসুদের রবিগানের জার্নি পরে আগায়নি। শিরোনামহীন অনুরূপ;—একটা অ্যালবামের পর ওদিকপানে গমনের উৎসাহ দেখান নাই। উনাদের নিজস্ব কমফোর্ট জোনের কথা ভেবে হয়তো আরো আগুয়ান হওয়ার আগ্রহ হারাইয়া ফেলছিলেন। অথচ দেখেন, দোহার  ব্যান্ডে কালিকাপ্রসাদ ও তাঁর দল ফোকের পাশাপাশি রবিগানে সমান কামিয়াবি নয়ের দশকের শেষ-অর্ধে ঠিকই হাসিল করলেন! নীল অঞ্জনঘন পুঞ্জ ছায়ায় সম্বৃত অম্বর, হে গম্ভীর;—ঠাকুরের কঠিন পর্যায়ের গানের অন্যতম, উক্ত গানখানায় দেবব্রত বিশ্বাস ও পীযূষকান্তি ভট্টাচার্য্য তুলানারহিত। উনাদের পরে আরো অনেকে গাইছেন কিন্তু দোহার-র পরিবেশনা সেই অনেকের মধ্যেই কানে নতুন সংগতি দিয়া যাইতে খামতি রাখে না। ঠাকুরের বাউলাঙ্গের গান মারের সাগর-এ স্যমন্তক ও সাহানা বাজপেয়ীর কলাবরেশনটাও তা-ই ছিল, শুনতে আরাম লাগে। কোন গানটা নতুন আঙ্গিক ও আবেদন বহাইতে কাজে দিবে সেটা বাছাই করা শক্ত কাজ। ঋতুপর্ণ স্বয়ং যে-কারণে শরৎ আলোর অঞ্জলিটা একবারই করছিলেন। রবিগানের ব্যবহার তাঁর জন্য ডালভাত হইলেও সেগুলা মোটের ওপর রাবীন্দ্রিক বা শান্তিনিকেতন যা-ই বলি, তার ইতরবিশেষ ছিল।

সমস্যা হইতেসে সকল গানে সকল ক্ষেত্রে কাজটা সম্ভব না। সম্ভব হইলেও বিচার-বিবেচনা করা ভালো। শ্রোতাদের মনে ঘুমাইতে থাকা স্মৃতিকাতরতা বড়ো কথা না সেখানে। যে-সমগ্রতায় যাত্রার ভিতর দিয়া একটা গান তৈয়ার হয় এবং লোকের কানে স্থায়ী রূপে আভাসিত হইতে থাকে, নতুন আঙ্গিক ও আবেদন তৈরির সময় বিষয়টা খিয়াল রাখা প্রয়োজন। রক্ষণশীল, নস্টালজিয়ার বিমারে আক্রান্ত, গানের কিছু বোঝে না, নতুনকে অ্যালাউ করতে চায় না…ইত্যাদি বইলা যতই আমরা মনের ঝাল মিটাই, একটা গান শ্রোতাপ্রিয় হওয়ার পেছনে যেসব অনুষঙ্গ থাকে সেগুলাই গানের সমাজইতিহাস  জন্ম দিয়া যায়। টাবুও হইতে থাকে ক্রমশ। একটা যৌথ সেলিব্রেশনের জোয়ারে ভাসতে থাকা গানটাকে আমরা এভাবে আইকনিক হইতে দেখি। সুতরাং নতুন মোড়কে তারে হাজির করার সময় হঠকারী হইতেসে কি না ইত্যাদি বিবেচনায় ক্ষতির কি আছে? ঋতুপর্ণ ওইটা বুঝতেন বলা যায়। রবিকে তাঁর আসলি মেজাজে বেশিরভাগ সময় রেখে দিতে দ্বিধা করেন নাই।

কিউ  ওরফে কৌশিক মুখার্জিও তাসের দেশ-র সিনেমাটিক জেশ্চারে রবিকে নিয়া অ্যানার্কি যা করার করছিলেন, এবং ভালোমতোই করছিলেন, তারপর ওই কাজ ছেড়ে অন্য কাজে মন দিতে দেখসি তাঁরে। সিনেপর্দায় তাসের দেশকে নিয়া নিরীক্ষায় মত্ত কৌশিকের চেতনসত্তা কিন্তু রবিগানের ভিন্নমাত্রিক প্রয়োগের ব্যাপারে টনটনে সচেতন ছিল। অস্বস্তি, যেইটা সচেতনভাবে কৌশিক এই গীতিনাট্যের সামগ্রিক অবয়ব জুড়ে ভয়াবহ আকারে ঘটাইতে থাকেন, ফ্যান্টাসিকে জটিল যৌনঅনুষঙ্গে চুবাইতে থাকেন আচ্ছামতন, গানগুলা সেই তালে ছবিতে আসে-যায়। তাসের দেশ-এ উনার এই সজ্ঞান অ্যানার্কিটারে ভালো কিংবা খারাপ বলার সুযোগ তিনি রাখেন না। দক্ষিণ ভারতের মাইয়া সুশীলা রহমান গোপন কথাটি  সেখানে গাইতে থাকেন, সুশীলার কণ্ঠে তাল দিয়া অধিবাস্তব দৃশ্যায়ন চলে পর্দায়, রবিকে যা অন্যমাত্রায় বিকৃত করে, এবং নতুন করে তৈরিও করতে থাকে। টাবুবিধ্বংসী  এই অ্যানার্কিটারে কুর্নিশ ঠোকা কঠিন। বাঙালির নোলা কৌশিকের ছবির ভাষা হজমের উপযুক্ত নয়। আমি যদিও নীরবে তাঁর সাহসটারে কুর্নিশ করি বারবার। একবারও মনে হয় নাই রবির ছয় ফুট লম্বা দেহে সক্রিয় সৃজনসত্তাকে কৌশিক তাচ্ছিল্য করতেসেন। রবিকে নতুন আঙ্গিকে আবিষ্কারের এই নৈরাজ্য আপাতদৃষ্টে বিদঘুটে ঠেকলেও মন তাতে সাড়া দিতে বিমুখ হয় না। কৌশিকও কিন্তু কাজটা একবারই করছিলেন মন ঢেলে, বারবার বা অবিরত ওই পথে হাঁটেন নাই।

ওপার বাংলার ছবিতে নতুন গান পয়দা না হওয়ার নেপথ্যে ঋতুপর্ণকে অনেকে এখন দোষেন। তাঁর সৃজনশীল ভাবনা বাংলা সিনেপর্দায় রবিঠাকুরের নতুন এন্ট্রি ও পৃথক ট্রেন্ড জন্ম দিলেও অন্যরা সেইটা অনুসরণ করতে গিয়া ঠাকুরের গানকে একঘেয়ে কিমাকার বস্তুতে পরিণত করছেন। ছবিতে গানের কথা উঠলে একটা রবিঠাকুর পাঞ্চের রেওয়াজ কলকাতার ছবিতে অনেকদিন যাবত ব্যাপক। রিপিটিশন যতটা আছে সেখানে, ওই পরিমাণ নতুন বিনির্মাণ কদাচিৎ চোখে পড়ে। ঋতুপর্ণ বা কৌশিকের মতো আবেশ সৃজনের ক্ষমতা যেখানে শূন্য! কোকবাংলার গানেও ব্যাপারটা ক্রমশ প্রকট মনে হইতেসে। দুই সিজনে কানে আরাম বহায় এরকম কিছু কম্পোজিশন উনারা অবশ্যই উপহার দিতে সক্ষম হইসেন। দ্বিতীয় সিজনে অদিতি মহসিন ও বাপ্পাকে দিয়া ঠাকুরের যে-গানটা অর্ণব করলেন সেইটা মন্দ না। ভারসাম্য ও পরিমিতির কারণে শুনতে বেশ লাগে। রাবীন্দ্রিক ঘরানা থেকে অদিতিকে অর্ণব বাহির হইতে বলেন নাই। অদিতিও তাঁর কমফোর্ট জোনে বসে গানটা ডেলিভারি দিতে কার্পণ্য করেন নাই। অন্যদিকে অদিতির জুড়ি বাপ্পা গানের দেহে যেভাবে এন্ট্রি নিলেন সেইটা নিখাদ ছিল। রবি বা নজরুলের গানে কোককে যতটা স্বচ্ছন্দ্য দেখায়, বাউল ও ফোকধাঁচের গানগুলার সাথে অন্য গানের সংযোজন (ব্যতিক্রম বাদ দিলে) কানে সেই আরাম বহাইতে পারে না।

দেশিবিদেশি বাদ্যযন্ত্রের একটার আরেকটার সাথে সমন্বয়, ওভারল্যাপ না করে একে অন্যকে স্পেস দিয়ে বাজতে থাকা…, এইসব নিয়া আমরা গানঅজ্ঞ সাধারণ শ্রোতা বলার অধিকার রাখি না। ওইটা যারা মিউজিক জানে-বোঝে উনারা বলবেন, কিন্তু সামগ্রিক উপস্থাপনে শ্রোতা তো কেবল খালি মিউজিক না বরং যে-গানটা গাওয়া হইতেসে তার ভাবছবি মনে-মনে স্মরণ করে। সেখানে তাকে ধাক্কা দিয়া নতুনকে কুর্নিশ করতে বলার মতো পরিবেশনা কোকফরমেটে কতটা সম্ভব? প্রশ্নটা নিয়া তর্ক হইতে পারে। দিলারামের সাথে নিজের গান অর্ণব জুড়লেন ভালো কথা, তাঁর এই গানটা পৃথক স্পেসে আমরা শুনছি, ভালো লাগছে, কিন্তু এখানে তিনি বা তাঁর গান কি হামিদার সাথে অবিচ্ছন্ন হইতে পারছে? সাধারণ শ্রোতা (*যে কিনা গানটানের কিসসু বুঝে না) যদি বইলা বসে, ভাইরে, হামিদা বানু তো যা গাওয়ার পরিষ্কার গাইতেসেন, হাছনজানকে দিব্যি দেখতে পাইতেসি তাঁর কণ্ঠ দিয়া, কিন্তু অর্ণব বিড়বিড় করে কীসব বলতেসেন, ওইটা তো মাথার ওপর দিয়া গেল! এখন গানে ফিউশনপাগলরা ওই নাদানকে কষে গালিগালাজ করতে পারবেন ঠিক আছে, সেই অধিকার উনাদের আছে, কিন্তু তাতে অর্ণবের নিজের গানের ভাববস্তু নিয়া হামিদার সাথে তাল দিতে না পারার ব্যক্তিগত অস্বস্তি মিছা হয়ে যায় না।

আমাদের মতো গানঅজ্ঞ কিন্তু গানপাগল শ্রোতারা আসলে ভিকটিম। মোদের কোনো পছন্দ-অপছন্দ থাকতে নাই। বাপ্পা মজুমদারের সাথে পডকাস্টে জন কবির ভালো একটা কথা বলছেন। জন সেখানে বলতেসেন, গান থেকে আরম্ভ করে তামাম বস্তুকে লোকে এখন কন্টেন্ট  হিসেবে বিচার করে। তো এই কন্টেন্টের বাজারমূল্য টের পাইতে বাইরের দুনিয়ায় নাকি টিকটকে কোন টেন্ড্র চলতেসে সেইটা আগে দেখে, তারপর গানের কম্পোজিশনে শিল্পীকে ঘাড়ে ধইরা বসায়। এমতাবস্থায় আমাদের মতো শ্রোতারা প্যারায় আছেন। কেন আছেন সে-ব্যাখ্যায় এখন আর না যাই। গ্রাসরুটসের ১৩ নাম্বার কবিতার কয়েকছত্রে সেইটা ভালো প্রকাশিত দেখতে পাইতেসি। কবি তাঁর মনের কথাটাই বলছেন সেখানে, কোট করি অদ্য :

তারা, যারা খাপ-না-খাওয়া, যারা আগন্তুকপ্রতিম সবিস্ময় সন্ত
যারা বাউলবর্ণিল, সহজিয়া, যারা আগডুম-বাগডুম পণ্ডিতির পানে পিঠ-ফেরা
যারা গানপোকা কিন্তু ওস্তাদজির পশমিনা শালের প্রশংসায় কৃপণ
যারা আস্ত গাছটাই ভালোবাসে, কেবল ফুলপসন্দ খণ্ডিত দর্শনে সায় নাই যাদের
যারা মুড়িপ্রিয়, মুড়কিও পছন্দ, তবে মুড়ি ও মুড়কি পৃথক স্বাদের বলে জেনেছে … 

কবিচিহ্নিত এই তারা বড়ো বিপদে আছেন। তারা হইতেসেন পরাভূত পাখি। যুগের হুজুগে মেতে উঠতে নাচার। পশমিনা শালের ভাগিদার হইতেও ওদিকে অপারগ। কর্পোরেটবিধাতা প্রণীত নির্বাক নীল নির্মম মহাকাশ-এ এই সমস্ত তারা অথবা তাদের দাঁড়াইবার জায়গা অবশিষ্ট নাই। সামারীন দেওয়ান, হামিদা কিংবা সেজুল দাঁড়াইবার চেষ্টায় সক্রিয় বটে কিন্তু কতদিন? এইটা এখন একমাত্র চিন্তা ও দেখার বিষয়।

১. বড় লজ্জা পাইমু রে বন্ধু : ক্বারী আমির উদ্দিন; শিল্পী – সেজুল হোসেন
২. এই কি প্রেমের প্রতিদান : শাহাজাহান মুন্সি; শিল্পী – সেজুল হোসেন
৩. শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি : শিল্পী- স্যমন্তক সিনহা; গানের ওপারে, ঋতুপর্ণ ঘোষ
৪. গোপন কথাটি রবে না গোপনে : শিল্পী- সুশীলা রহমান; তাসের দেশ, কৌশিক মুখার্জি (কিউ)
৫. নীল অঞ্জনঘন পুঞ্জ ছায়ায় সম্বৃত অম্বর, হে গম্ভীর : শিল্পী – দোহার ব্যান্ড
৬. মারের সাগর : শিল্পী – সাহানা বাজপেয়ী
৭. আনন্দধারা : কোক স্টুডিও বাংলা; শিল্পী – অদিতি মহসিন ও বাপ্পা মজুমদার 

— আহমদ মিনহাজ


তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you