সপ্তম প্রবাহ–৩ : অ্যান্টি–ইসলামিস্ট বাখান : বুদ্ধিবৃত্তিক সংকীর্ণতা : আলী সিনা ও অন্যান্য
গেল পর্বে উত্থাপিত প্রসঙ্গের সূত্র ধরে শুরুতে জানিয়ে রাখি, — কোরান ও মোহাম্মদকে জয়িফ প্রমাণের মামলায় দালিলিক তথ্য-প্রমাণের ব্যবহার ও শক্ত যুক্তি প্রণয়ন একটি বড় বিষয়। তো সেই জঙ্গে নেমে যেসব জটিলতা দৃশ্যমান হতে থাকে সেগুলো উপলব্ধি করে আলী সিনা-র মতো অ্যান্টি-ইসলামিস্টরা দালিলিক তথ্যের সহি-জয়িফ-জাল বিচার শেষে নিজের যুক্তি প্রণয়ন করছেন এমনটি মনে হয়নি। ভুল যদি বলে থাকি পাঠক শুধরে দেবেন। দালিলিক তথ্যের উৎস সম্পর্কে তাঁরা ধারণা প্রদান করেন কিন্তু এর নেপথ্যে বিরাজিত ঐতিহাসিক কার্যকরণ কৌশলে চেপে যান অথবা বিশ্লেষণ করতে যেয়ে নিজের অক্ষমতাকে প্রকট আর হাস্যকর করে তোলেন! সাধারণ পাঠক তখন বিভ্রান্ত ও প্রতারিত হয়। আমি নিজে একসময় এর শিকার হয়েছি এবং ফলস্বরূপ অ্যান্টি-ইসলামিস্টদের তথ্য বিরচন পদ্ধতি নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগলেও বিপরীত ধারায় বিরাজমান ইসলামি টেক্সট এটাকে কীভাবে মোকাবিলা করে সে-বিষয়টি তলিয়ে দেখার কথা ভাবিনি। আসলে চটক অনেক সময় চোখে আবরণ পরিয়ে দেয় এবং আবরণটি অপসারিত হতে সময় লাগে।
বিতর্কিত বিষয়ে পাঠককে দালিলিক তথ্য সম্পর্কে অবহিত করা ও তার পটভূমি বিশ্লেষণে অ্যান্টি-ইসলামিস্টরা ম্যাথোডিক্যাল কি না সে-প্রশ্ন এইবেলা ওঠে। শাহাব আহমেদের মতো লেখক ও ইসলাম গবেষকের সঙ্গে এ-কারণে তাঁদের তফাত ঘটে যায়। ইসলামের স্বরূপ ও সংজ্ঞা নির্ধারণে শাহাব প্রণীত ব্যাখ্যা নিয়ে খোদ ইসলামি মহলে আপত্তি, মতভেদ ও প্রত্যাখ্যানের মনোভাব রয়েছে। তিনি যেসব প্রসঙ্গ ধরে ইসলামের পরিধি নির্ণয় করেন এবং সেখানে তাঁর যুক্তি বিরচনের পদ্ধতি সালাফি, ওয়াহাবি এমনকি তাসাউফের পাবন্দ সুফিপন্থী বিদ্বানরা মেনে নিতে চাইবেন না। হয়তো এ-কারণে তাঁকে আগা খান ও শিয়া প্রভাবিত ইসলামের ব্যাখ্যাকার বলে অনেকে মত দিয়ে থাকেন। এখানে খেয়াল রাখতে হবে শাহাবের টেক্সট গ্রহণ না প্রত্যাখ্যান করা উচিত এ-সংক্রান্ত তর্ক কিন্তু যেসব তথ্য তিনি বইয়ে পরিবেশন করেন সেগুলো কেন্দ্র করে ঘটে না, বরং তথ্যের বিচার-বিশ্লেষণ শেষে ইসলাম সম্পর্কে যে-সংজ্ঞায় তিনি পৌঁছান তার যৌক্তিকতা নিয়ে বিদ্বানরা প্রশ্ন তোলেন। অ্যান্টি-ইসলামিস্টদের ক্ষেত্রে ঘটনা বিপরীত। তাঁরা যেসব দলিল হাজির করেন সেগুলোর ভিত্তি কতটা সঠিক সেই প্রশ্নে বেলা পার হয়, মতামতের কোয়ালিটি যাচাই বহু পরের ঘটনা!
ইসলামি শাস্ত্রের চর্চায় গোঁড়ামির ক্রমবৃদ্ধি নিয়ে রচিত বইয়ে শাহাব কোরান থেকে ‘শয়তানের পদাবলী’ (Satanic Verses) নামধারী বিতর্কিত (*দ্বিতীয় প্রবাহ-এ আলোচিত কোরানে জ্ঞানের গভীরতা-অগভীরতা এবং মিসিং আয়াত ও প্রসঙ্গমূলক টেক্সট দ্রষ্টব্য) আয়াত মিসিংয়ের তদন্ত করতে যেয়ে গভীরে গমন করেছেন। তথ্যের উৎস ও অবলুপ্তির কারণ নিয়ে সেখানে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন এবং যাচাই ও ব্যাখ্যা বিরচনে বিশেষ ফাঁক রাখেননি। এমনকি কোরান ও মোহাম্মদকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এমন টেক্সট কী-কারণে দশকে-দশকে তৈরি হয় তার নেপথ্য ঘটনাপ্রবাহ ও মুসলমান শাসকদের ধর্মকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের ফ্যাক্টরি রূপে ব্যবহার করার সমগ্র পদ্ধতি বিশ্লেষণ শেষে নিজের মতামত তিনি দিয়েছেন। ইসলামে গোঁড়ামির ক্রমবৃদ্ধির মতো স্পর্শকাতর বিষয়ের তদন্তে ম্যাথোডিক্যাল হওয়ার কারণে তাঁর বক্তব্য সেখানে বিশ্বাসযোগ্যতা লাভ করেছে; পাশাপাশি বুদ্ধিবৃত্তিক তর্কের উসকানিও কম নয়, যা ইসলাম ঘিরে খোলা মনে বাহাসে যাওয়ার জন্য দরকারি বটে। অ্যান্টি-ইসলামিস্টদের বইপত্তর নিয়ে এহেন আর্গুমেন্টে যাওয়া পণ্ডশ্রমের নামান্তর! যেসব দলিল তাঁরা ব্যবহার করেন সেগুলোর সহি-জাল-জয়িফ যাচাইয়ের ঝামেলায় তো রয়েছেই, উপরন্তু কী বুঝতে কী বুঝেছেন এইসব চক্বরে পড়ে সময় নষ্ট হতে থাকে।
অ্যান্টি-ইসলামিস্ট ঘরানার অন্যতম সেলিব্রেটি লেখক এম. এ. খান যেমন ইসলামে জিহাদ নিয়ে পরিশ্রমী গ্রন্থ লিখেছেন! গ্রন্থে ব্যবহৃত তথ্য ও ঘটনার উৎস বর্ণনায় তিনি ত্রুটি রাখেননি এবং এর জন্য ধন্যবাদ পেতেই পারেন। প্রশ্ন হলো পরিবেশিত তথ্যের দালিলিক উৎস খান নিজে কতটা গভীরে গিয়ে তলিয়ে দেখেছেন? সেখানে তাঁর যাচাই পদ্ধতি কী ছিল? অথবা শাহাব আহমেদের মতো তিনিও কি তথ্য উৎপাদনের পেছনে সক্রিয় রাজনীতির খবর করেছিলেন? তাঁর বই পাঠের পর এইসব প্রশ্নের সদুত্তর মিলে কি? ধর্মের সঙ্গে মানুষের হাজার বছরের বিশ্বাস ও অনুভূতি বিজড়িত থাকায় তাকে সিদ্ধ অথবা খারিজ করা কিংবা তার মধ্যে দৃশ্যমান স্ববিরোধ নিয়ে যুক্তি প্রণয়নে ব্যবহৃত টেক্সট ও ঘটনাপ্রবাহ আসলে কীভাবে উৎপাদন করা হচ্ছে সেই বিষয়টি ‘বুঝে’ ধারণ করা সবার আগে জরুরি। আর্গুমেন্ট বিরচনে তথ্যগত ভিত্তির গভীরে গিয়ে তাকে যাচাই না করে যুক্তি প্রণয়নের খাসলত পাঠককে প্রতারিত করে। অ্যান্টি-ইসলামিস্টদের দলিল ও যুক্তি সমূহ অগত্যা ধীমান ইসলামবেত্তার পক্ষে খারিজ করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয় বলেই মানতে হয়।
বিগত পর্বে (*সপ্তম প্রবাহ-২ দ্রষ্টব্য) আলোচিত থিওলজি কর্তৃক বিজ্ঞানকে রেফ্রেন্স রূপে ব্যবহার যাওয়ার ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। বিজ্ঞানের তদন্ত পদ্ধতি ও যুক্তি উৎপাদনের রীতি-নিয়ম তথা কালচারের সঙ্গে স্রষ্টার তাওহিদ প্রচারে নিবেদিত ধর্মীয় শাস্ত্র ও থিওলজির পার্থক্য ঐতিহাসিক এবং সেটা স্মরণ রাখা সবসময়ের জন্য জরুরি। অগত্যা মনে রাখতেই হচ্ছে …
ইতিহাসের যেসব চিহ্ন ধরে বিজ্ঞান মানব-বিবর্তনের কাহিনি শোনায়, স্রষ্টার বাণী-প্রচারক ধর্মীয় শাস্ত্র তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে একে বর্ণনা করে যায়। তামাম জাহান সৃষ্টির বিবরণের সঙ্গে ধর্মীয় শাস্ত্র ও বিজ্ঞানের কিছু জায়গায় নিবিড় সাদৃশ্য থাকলেও বিজ্ঞান কিন্তু পৃথক ছাঁচে সৃষ্টিতত্ত্ব ব্যাখ্যা করে থাকে। যেমন সে আজও বলেনি মানুষকে অ-যৌন পন্থায় অন্যত্র সৃজন করা হয়েছিল, যেখানে ধর্মীয় শাস্ত্র অ-যৌন পন্থায় মানবের সৃষ্টি ও তার ক্রম-বিকাশের দাবি থেকে সরে আসেনি। একেশ্বরবাদী ধর্মের বিকাশকাল নির্ধারণে বিজ্ঞান সমাজ বিবর্তনের বিশেষ পটভূমিতে দাঁড়িয়ে নিজের ব্যাখ্যাটি হাজির করে। বিপরীতে, ধর্মীয় শাস্ত্র অজ্ঞেয় পরজগৎকে একেশ্বরবাদের সূচনাস্থল রূপে দাগায়। অশুভ ‘আকল’র প্রতীক ইবলিশের সঙ্গে স্রষ্টার দ্বন্দ্ব সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, শুভ-অশুভ এবং ভ্রান্ত ও সঠিক ইত্যাদি জটিলতায় গমনের কারণে আদম হাওয়াকে ধরায় নেমে আসতে হয় এবং পৃথিবীতে ইমানের উৎপত্তি ঘটে। থিওলজি পার্থিব জগৎকে মানুষের জন্য শাস্তি ও পরীক্ষাগার বলেই মনে করে এবং সেই বিশ্বাস থেকে স্রষ্টার কাহিনি শোনায়।
পার্থক্য এখানে শেষ নয়! ধরার বুকে মানব প্রজাতির আবির্ভাবকে বিজ্ঞান মোটের ওপর ত্রিশ থেকে চল্লিশ লক্ষ বছরের কাহিনিছকে বাঁধে, ধর্মীয় শাস্ত্র সেখানে কয়েক হাজার বছরের ছকে ফেলে তাকে ব্যাখ্যা করে। হাজার বছরের হিসাব সেখানে হয়তো ভিন্ন হয় কিন্তু গোল বাঁধে যখন কেউ বিজ্ঞান স্বীকৃত বছরের হিসাব দিয়ে একে মাপতে যায়। বিজ্ঞান নির্ধারিত মানব-ইতিহাসে কার্বন রেটিং পদ্ধতিতে চিহ্নিত আদিমানবী লুসি মানব প্রজাতির আপাতত সবচেয়ে পুরাতন পূর্বসূরী হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে, ওদিকে ধর্মীয় শাস্ত্র আদম-হাওয়া ও তাদের সন্তান-সন্ততিকে দিয়ে মানব-ইতিহাসের ভূমিকা টানে। নিজস্ব তদন্ত পদ্ধতির জোরে অবিকশিত থেকে বিকশিত মানব হওয়ার কাহিনি ও প্রমাণের সপক্ষে সুনিপুণ যুক্তি তুলে ধরায় বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা মোটের ওপর সকলে এখন বিশ্বাস করে। ধর্মীয় শাস্ত্র মতে বিকশিত মানব রূপে আদম-হাওয়া ধরায় নির্বাসিত হয় এবং সময়ের পালাবদলে বনি আদম রূপে পরিণতি লাভ করে।
পৃথক ও সাংঘর্ষিক এই ছকের কারণে বিজ্ঞান দিয়ে বেদ-তাওরাত-বাইবেল বা কোরানের দু-জাহান সৃষ্টিতত্ত্ব, বস্তু ও প্রাণের বিকাশধারা, মানবের আবির্ভাব ও ক্রমপরিণতি, ইবলিশের ‘আকল’ সক্রিয় হওয়া ও আল্লাহর সঙ্গে তার বিরোধ ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত টানতে গেলে স্ববিরোধ অনিবার্য হয়। সোজা কথা ঐশী গ্রন্থে চিত্রিত স্রষ্টার মামলায় বিজ্ঞানকে যতদূর পারা যায় পাশ কাটিয়ে অগ্রসর হওয়া উচিত। এখানে সেই থিওলজির শরণ নেওয়া উত্তম যেটি তাওহিদের প্রতীক অমীমাংসিত স্রষ্টাকে জগতের প্রথম মানব থেকে আজ অবধি যত মানব ধরায় বিচরণ করে গেছে এবং এখনও করছে অথবা ভবিষ্যতে করবে তাদের সকলের পালনকর্তা রূপে ভাবতে পারে। সুতরাং ফিজিক্স নয় বরং মেটাফিজিক্স এখানে অধিক প্রয়োজনীয়, এছাড়া এহেন স্রষ্টার অস্তিত্ব ও তাঁর যৌক্তিকতা নিরূপণ কঠিন।
তো যা-ই হোক, অতিকল্পনার আশ্রয় নিয়ে বরং ভাবা যাক স্রষ্টা অর্থাৎ আল্লাহ হচ্ছেন দু-জাহানে বিদ্যমান তামাম সৃষ্টির কারিগর ও পরিকল্পনাকারী, যিনি কিনা ‘ম্যাট্রিক্স’ (১৯৯৯) মুভির অনুরূপ এক জগৎকে তাঁর পরিকল্পনার অংশ রূপে প্রোগ্রামিং করেছিলেন। জাঁ বদ্রিলারের তত্ত্বের নির্যাস থেকে অনুপ্রাণিত এবং হলিউডের সাইবারপাঙ্ক ঘরানার সিনেমায় ইতিহাস সৃষ্টিকারী ‘ম্যাট্রিক্স ট্রিলজি’র ধ্রুপদি কাহিনিছক পাঠককে স্মরণ করতে অনুরোধ করি। বদ্রিলার অবশ্য তত্ত্বের মানহানি ঘটানো হয়েছে বলে তখন বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন, তথাপি ছবিখানা দুর্দান্ত ছিল। তিনটি সিক্যুয়েলে নির্মিত ছবিটি মুক্তির এক দশকের মধ্যে বিজ্ঞান ও দর্শনশাস্ত্রে প্রভাববিস্তারী ঘটনায় পরিণত হয় এবং নতুন তত্ত্বের ধারা বেগবান করতে অশেষ ভূমিকা রাখে। সাইফাই ঘরানায় ‘স্টার ট্র্যাক’-এর পর এটা দ্বিতীয় ছবি যার প্রভাব ছিল গভীর এবং সে-কারণে ধ্রুপদির তকমাও এর অঙ্গে জুটেছে। তো ‘ম্যাট্রিক্স’-এর কাহিনিছক এইবেলা স্মরণ করা যাক :—
অব্যাহত পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের চক্রে মানুষের সাধের পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অধিকারী মেশিনদের সঙ্গে শত বছরের যুদ্ধে মানব প্রজাতির বিলুপ্তি সময়ের ব্যাপার মনে হচ্ছে। পর্যাপ্ত সূর্যালোকের অভাবে পৃথিবীপৃষ্ঠ শীতল ও বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ায় কায়ক্লেশে যারা সেখানে টিকে ছিল তাদেরকে বাধ্য হয়ে পাতালে ঠাঁই নিতে হয়েছে। ভূগর্ভের এই স্তরে বেঁচে থাকার মতো উষ্ণ পরিবেশ বজায় থাকায় মানুষের এখন সেখানে দিন কাটে। ‘ম্যাট্রিক্স’ ম্যুভির পরিভাষায় এর নাম হলো ‘জায়ন’। বেঁচে থাকা মুক্ত মানুষদের শেষ আশ্রয়স্থল এই ‘জায়ন’। সেখানে তাদের উদ্বাস্তুর মতো দিন কাটে। মেশিনরা ওদিকে শত বছরের লড়াইয়ে অসংখ্য মানুষকে ধরে-ধরে তাপবৈদ্যুতিক প্রক্রিয়ায় তৈরি বিশেষ খোলসে বন্দি করে রেখেছে। ইচ্ছে করলে মানব প্রজাতিকে তারা শেষ করে দিতে পারে কিন্তু দুটি কারণে সে-কাজ করা থেকে বিরত রয়েছে :—
প্রথম কারণ, টানা যুদ্ধের এক পর্যায়ে সূর্য থেকে এ্যানার্জি সংগ্রহের উৎস মানুষ তাদের জন্য অবরুদ্ধ করে দিয়েছিল। এর ফলে যেসব মানুষকে বন্দি করে খোলসে পুরতে পেরেছে তাদের দেহ থেকে প্রাপ্ত এ্যানার্জির ওপর ভর করে মেশিনরা আপাতত কাজ চালিয়ে নিচ্ছে। মানুষ হচ্ছে কৌটায় লুকিয়ে রাখা প্রাণভোমরা যাকে ছাড়া তাদের পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন। জৈব প্রক্রিয়ায় মানুষ তার দেহে যে-শক্তি বা এ্যানার্জি উৎপাদন করে মূলত সেটা কাজে লাগিয়ে মেশিনরাও বেঁচেবর্তে থাকে। নিষ্ক্রিয় অবস্থায় মানুষের দেহে শক্তি সঞ্চিত থাকে বলে প্রয়োজনীয় এ্যানার্জি পেতে তাদের তেমন অসুবিধা হচ্ছে না।
দ্বিতীয় কারণ, জৈব মানুষের ওপর নির্ভরতা কাটিয়ে উঠার প্রয়োজনে কৃত্রিম মানুষ তৈরির কাজে মেশিনরা অনেকদূর অগ্রসর হয়েছে। সমস্যা হলো কৃত্রিম মানবকে নিজের শক্তির উৎস রূপে ব্যবহারের প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন করতে হলে এই মুহূর্তে বাড়তি এ্যানার্জি প্রয়োজন, যা খোলসবন্দি মানুষগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে তাদেরকে সরবরাহ করতে পারছে না। মানুষ হচ্ছে এমন প্রাণী যে কেবল তার দেহের জোরে চলে না, মন বলে একটা কিছু সে ধারণ করে এবং দেহমন একসঙ্গে সক্রিয় না হলে তার এ্যানার্জি উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষমতা হ্রাস পায়। খোলসবন্দি মানুষগুলো মানসিকভাবে উদ্যমহীন হওয়ার ফলে যথেষ্ট এ্যানার্জি সরবরাহ করতে পারছে না। অগত্যা তারা ‘ম্যাট্রিক্স’ নামে একটি ‘ড্রিমওয়ার্ল্ড’ সফটওয়্যার তৈরির পরিকল্পনা করে। শতহাজার বছর যাবত ধরায় মানুষ যেভাবে জীবন কাটিয়েছে সেই জীবনের ছকে মেশিনরা সফটওয়্যারের নকশা ও প্রোগ্রামিং করে এবং মানুষের মস্তিষ্কতরঙ্গের সঙ্গে একে সংযুক্ত করে দেয়।
খোলসবন্দি মানুষের দেহমন সফটওয়্যারের প্রভাবে নিজের অজান্তে শঙ্কারাচার্যের মায়াসদৃশ বায়বীয় বাস্তবতার (Virtual Reality) জগতে প্রবিষ্ট হয়। তাদের মনে হতে থাকে তারা আর খোলসের ভিতর আটকে নেই। যুগযুগান্তর ধরে মানুষ যেভাবে পৃথিবীতে করে খেয়েছে তারা এখন সে-কাজগুলোই করছে! শামসুর রাহমানের কবিতার প্রতিধ্বনি হয়ে বিরাজ করছে ধরায়, — ‘কাজ করছি, খাচ্ছি দাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি, কাজ করছি, / খাচ্ছি দাচ্ছি, চকচকে ব্লেডে দাড়ি কামাচ্ছি, দু-বেলা / পার্কে যাচ্ছি, মাইক্রোফোনি কথা শুনছি, / ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে যাচ্ছি।’ সফটওয়্যারের প্রভাবে ‘মায়ার খেলা’-য় বন্দি মানুষগুলোর দেহমনে বিশেষ উদ্দীপনার সঞ্চার ঘটায় মেশিনরা তাদের দেহ থেকে প্রয়োজনীয় শক্তি শোষণ করে কৃত্রিম মানুষ তৈরির কাজে তুরন্ত ছুটতে শুরু করে। মাঝেমধ্যে সফটওয়্যারে ত্রুটি দেখা দেয় এবং তখন ‘জায়ন’র বাসিন্দা এখনও মুক্ত মানব কম্পিউটার হ্যাকার নিও সেখানে বসে হ্যাকিং সূত্রে টের পায় একটা কিছু গড়বড় হচ্ছে কোথাও, যদিও ঘাপলাটা ঠিক ধরা যাচ্ছে না! তাকে সেই ঘাপলার খবর দিতে মেশিনদের সৃষ্ট ‘ম্যাট্রিক্স’ সফটওয়্যারের বন্দিদশা থেকে বেরিয়ে আসা মরফিউস ও ট্রিনিটি এবার সাহায্যের হাত বাড়ায়। ছবির কাহিনিছক ক্রমশ নিও, মরফিউস, ট্রিনিটি, সাইফার, ওরাকল আর অ্যাজেন্ট স্মিথের মতো চরিত্রদের হাইথটস বাতচিত ও দুর্ধর্ষ অ্যাকশনসিনের প্রবাহে দর্শককে ঠায় বসিয়ে রাখে।
প্রশ্ন হলো ‘ম্যাট্রিক্স’ নামের এই জটিল ট্রিলজি আমাদের কি শেখায়? জগতের সকল ভাবুক কী কারণে ছবিটি রিলিজ হওয়ার পর কথার খই ফুটাতে শুরু করলেন? থিসিসি ও হাইপোথিসিসে নেটদুনিয়া সয়লাব হয়ে গেল! কারণটি সরল। ‘ম্যাট্রিক্স’ আমাদের শেখায়, — মানুষ সত্যি জানে না ধরায় অথবা অন্য জগতে অবস্থান করে এমন কারও দ্বারা সে প্রোগ্রামড্ কি না! সে জানে না পৃথিবীতে তার বিচরণ ও ক্রিয়াকাণ্ড ম্যাট্রিক্সের অনুরূপ সফটওয়্যার দ্বারা কেউ সৃষ্টি বা নির্ধারিত করছে কি না! তার জানা নেই, লক্ষকোটি আলোকবর্ষ দূরে অনুরূপ আরেকটি ম্যাট্রিক্সে সে বিরাজিত কি না! না, তার পক্ষে আন্দাজ করা সহজ নয় যেখানে এখন তার বসবাস সেখানে ‘ম্যাট্রিক্স’ হেন সফটওয়্যার দ্বারা সৃষ্ট ও নিয়ন্ত্রিত পৃথক-পৃথক ম্যাট্রিক্সে তাকে যাপন করতে বাধ্য করা হচ্ছে কি না! যেখানে মানবজাতির একদল একটি ম্যাট্রিক্সে বসে ভাবে অ-যৌন উপায়ে সৃষ্ট আদম হতে তামাম মানবজাতির সূচনা ঘটেছিল এবং স্বর্গ থেকে নির্বাসিত হওয়ার কারণে তারা ধরায় আগমন করতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে আরেকটি ম্যাট্রিক্সে বন্দি মানুষ বিশ্বাস করে মানুষের একাধিক প্রজাতি ছিল একসময় এবং মানুষ রূপে ক্রমবিকাশ প্রাকৃতিক বিবর্তনের ফসল! বাস্তবতা সম্পর্কে মানুষের ধারণা ও বোধ যদি মস্তিষ্কের রাসায়নিক সংকেত প্রক্রিয়ার ফলাফল হয়ে থাকে তবে সেই মস্তিষ্ককে নির্দিষ্ট ‘ম্যাট্রিক্স’ বা ছকে আটকে রাখতে পারে এমন সফটওয়্যারের অস্তিত্ব থাকা বিচিত্র নয়। আশ্চর্যবোধক এইসব হেঁয়ালির সঙ্গে এই ভাবনাও সংযুক্ত করা যায় বৈকি :—
মানুষ সত্যি জানে না তার ‘দেহমন ও আকল’ কার ‘ম্যাট্রিক্স’ দ্বারা এখন প্রভাবিত ও নির্ধারিত হচ্ছে! হতে পারে ইবলিশ বিরচিত ম্যাট্রিক্সে বিচরণ করে মানুষকে লুসি থেকে যাত্রা করতে দেখছে সে। অন্যদিকে বিপরীত ধারণায় স্থিত মানুষরা আল্লাহ-রচিত ম্যাট্রিক্সে বসে আদম হতে মানবজাতির সূচনা দেখতে পাচ্ছে! ‘ম্যাট্রিক্স’ কার বেলায় কখন পালটে যাবে কিংবা কে কার ম্যাট্রিক্সে ঢুকে পড়বে সেটা বলা মুশকিল। বিচিত্র নয় হামজা ইউসুফের ‘ম্যাট্রিক্স’ কাল যদি ইবলিশ হ্যাকড করে সে হয়তো ইউটার্ন নিয়ে আলী সিনা-র ম্যাট্রিক্সে ঢুকে যাবে। আবার আল্লাহ যদি সিনা-র ‘ম্যাট্রিক্স’ হ্যাক করেন সেক্ষেত্রে হামজার ছেড়ে-আসা ম্যাট্রিক্সে তাঁকে ঢুকতে হবে এটা নিশ্চিত!
…
চিত্র–১০ : ‘ম্যাট্রিক্স’ (১৯৯৯) ছবির বিখ্যাত Construct Scene। জাঁ বদ্রিলার–এর তত্ত্বে অনুপ্রাণিত এই দৃশ্যে মেশিনদের বানানো ‘ম্যাট্রিক্স’–এর ফাঁদ কেটে বেরিয়ে আসা মরফিউস হ্যাকার নিওকে ব্যাখ্যা করে মানুষের বোধের জগতে বাস্তবতা আসলে কীভাবে কাজ করে যায়। মানুষ হচ্ছে মস্তিষ্কতরঙ্গের রাসায়নিক উদ্দীপনার সমষ্টি। মস্তিষ্ক তাকে যেভাবে সবকিছু দেখায় তার বাস্তবতার বোধ সেই অনুপাতে গড়ে ওঠে। এখন এই মস্তিষ্ককে কেউ যদি বিশেষভাবে নির্মিত সফটওয়্যার দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে তখন বাস্তবতার যে–ছক বা ম্যাট্রিক্সে নিও এখন বিরাজিত সে–সম্পর্কে তার ধারণা আমূল বদলে যাবে। ‘জায়ন’-এ মুক্ত মানুষ রূপে সে এখনও বিচরণ করছে। ধরা যাক সফটওয়্যার তার মস্তিষ্কের সংকেতগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। এতদিন চারপাশে সবকিছুর সঙ্গে সে যেভাবে সংযুক্ত ছিল সেগুলোর স্মৃতি মুছে দিয়ে তার নিজস্ব ম্যাট্রিক্স সেখানে সে চালু করে দিয়েছে। এমতাবস্থায় সফটওয়্যার যদি নিওর মস্তিষ্কে সংকেত পাঠায় সে আসলে ‘জায়ন’-এ নয় একটি কারাগারে বন্দি রয়েছে, নিও তখন মুক্ত মানুষ হওয়া সত্ত্বেও সফটওয়্যারের কারণে সৃষ্ট কৃত্রিম বাস্তবতা অর্থাৎ কারাগারে নিজেকে বন্দি ভাবতে বাধ্য হবে। তার বাস্তবতা সম্পর্কিত ছবি ও অনুভূতি আর এক থাকবে না। আমরা আসলে এভাবে পৃথিবী নামক ‘ম্যাট্রিক্স’-এ বিরাজিত। এখন এটি বাস্তব না কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্ট সে এক ঈশ্বর জানেন!
‘ম্যাট্রিক্স’ ছবির মূল চিত্রনাট্য অবশ্য এখানে যেভাবে ব্যাখ্যা করা হলো হুবহু সে-রকম নয়। সুতরাং ছবিটি যাঁরা দেখেছেন তাঁরা গালি দিতেও পারেন। যদিও Construct Scene-এ নিও ও মরফিউসের মধ্যে চলমান ধ্রুপদি সংলাপের মোদ্দা কথা ওপরে যা বলার চেষ্টা করা হয়েছে তার থেকে বেশি ভিন্ন নয়। মূল কথা সেখানে একটাই, — রিয়্যাল বা সত্যিকার বাস্তবতা বলে কিছু নেই, যা রয়েছে সেটা হলো সিমুলাক্রাম বা অনুরূপতার সাহায্যে সৃষ্ট বাস্তবতা। মস্তিষ্কের তরঙ্গ দ্বারা নির্ধারিত বাস্তবতার (যেমন ধরা যাক পৃথিবী) ম্যাট্রিক্স তাই বিভ্রম বা ইল্যুশন।
শঙ্কারাচার্য এই কথা হাজার বছর আগে অন্য আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করে গিয়েছিলেন। তাঁর ‘অদ্বৈত’ ভাষ্যের সারকথা হচ্ছে, চিন্তা করলে মানুষ বুঝতে পারে সে ধরায় বিরাজিত এবং তার চারপাশের সবকিছু বাস্তব। আবার চিন্তা করলে এই জ্ঞান তার হয়, বিরাজিত কোনও কিছু নিত্য বা শাশ্বত নয়, ক্ষণ পর–পর তারা অজানা থেকে বিলীন ও আবির্ভূত হয়। তার অস্তিত্ব তাই ‘মায়ার জগতে’ বিচরণশীল, যেখানে ব্রহ্ম ছাড়া কিছুই শাশ্বত বা নিত্য নয়। ব্রহ্ম হচ্ছে মন–স্বরূপ ‘পরম’ যার মধ্যে তার যাওয়া–আসা চলতে থাকে। ব্রহ্ম তাকে যেভাবে রাখে সে সেভাবে ধরায় বিরাজ করে। জাগতিক বাস্তবতা এ–কারণে মায়া! চির অবিনাশী ব্রহ্মর সাহায্যে মানুষ জগৎকে দেখে এবং অন্তে সেই ব্রহ্ম–এ নিজে বিরাজ করে। এই বোধ যখন ঘটে যায় তখন সে বুঝতে পারে জন্ম–মৃত্যু সকলই ‘মায়ার খেলা’! একমাত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিরাজিত ব্রহ্ম–এ তার অবস্থান প্রকৃত সত্য এবং সেখানে সে চির–অদ্বৈত!
Construct Scene-র শুরুতে মরফিউসের সংলাপ অন্যভাবে শঙ্কারাচার্যকে তাই মনে করায়, ‘What is real? How do you define real? If you’re talking about what you feel, taste, smell, or see, then real is simply electrical signals interpreted by your brain.’…Image Source: Construct Scene, The Matrix, 1999, YouTube & Original Script of Matrix by Larry and Andy Wachowski;
…
‘মাট্রিক্স’ সিনেমায় নিও মরফিউসকে বলেছিল তাকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করছে এটা তার একদম পছন্দ নয়। যদিও স্বাধীনতার সংজ্ঞা কেমন হতে পারে সে তারা নিজেও ঠিক করতে পারেনি! মেশিন সৃষ্ট ম্যাট্রিক্সের সদা সতর্ক পাহারাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ অদৃষ্টবাদে বিশ্বাসী ভিলেন এজেন্ট স্মিথ যেমন বিশ্বাস করত সবকিছু আগে থেকে নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত। কোরানে যেমন আল্লাহ বার্তা পাঠান :—
‘তিনিই তোমাদেরকে মৃত্তিকা হইতে সৃষ্টি করিয়াছেন, অতঃপর এক কাল নির্দিষ্ট করিয়াছেন এবং আর একটি নির্ধারিত কাল আছে যাহা তিনিই জ্ঞাত, এতদসত্ত্বেও তোমরা সন্দেহ করো।…আসমান ও জমিনে তিনিই আল্লাহ তোমাদের গোপন ও প্রকাশ্য সবকিছু তিনি জানেন এবং তোমরা যাহা অর্জন করো তাহাও তিনি অবগত আছেন।’ — উৎস : আল–আনআম; ৬:২–৩; আল কোরান; তরজমা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ।
অ্যাজেন্ট স্মিথকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ছকে তৈরি করা হয়েছিল। ‘ম্যাট্রিক্স’ ট্রিলজির সূচনাপর্বে মেশিনসৃষ্ট ম্যাট্রিক্সে নিও ও মরফিউসের মতো মুক্তমানবদের আক্রমণ ঠেকানো এবং তারা যেন নিজের প্রতিরূপ তৈরি করতে না পারে সেই দায়িত্ব দিয়ে স্মিথকে তাদের কাছে পাঠানো হয়। ‘ম্যাট্রিক্স’ ট্রিলজির প্রথম পর্বে নিওর হাতে মারা যাওয়ার পর আপাত শেষ পর্বে (The Matrix Reloaded) অসমাপ্ত মিশন সমাপ্ত করতে নতুনভাবে তাকে পুনর্জীবিত করা হয় এবং ম্যালওয়্যার ভাইরাস রূপে সে আবার ফেরত আসে। সেখানে নিওর উদ্দেশে তার উক্তি কোরানে লিপিবদ্ধ নির্ধারণবাদী বিন্যাস থেকে বেশি দূরবর্তী নয়। নিওকে সে স্মরণ করিয়ে দিতে ভোলে না, নিজেকে স্বাধীন ভেবে লাভ নেই যেহেতু নিওর পক্ষে প্রমাণ করা কঠিন হবে সে আসলে স্বাধীন। স্মিথ তাই নিজেকে স্বাধীন ভাবে না। নিও ও মরফিউসদের পেছনে তারা তাকে লাগিয়ে রেখেছে, যেন তাদের স্বাধীন হওয়ার পথ সে ভণ্ডুল করতে পারে। এটা অমান্য করার হিম্মত তার নেই, কারণ তাকে সেভাবে ছক কষে এখানে (জায়ন) প্রেরণ করা হয়েছে। সুতরাং তাকে মুক্ত মনে হলেও উদ্দেশ্যের কথা ভাবলে সে কেন জগতের কেউ মুক্ত নয়। প্রত্যেকে কোনও-না-কোনও ম্যাট্রিক্সের বিন্যাসে বন্দি। নিজের দেহের ‘কপি’ বা প্রতিরূপ দিয়ে নিওকে ঘেরাও করার ক্ষণে স্মিথ তাই দ্বিরুক্তির ছলে সত্য উক্তিই করে :—
আমরা এখানের (*জায়ন) নই কারণ আমরা মুক্ত; আমরা এখানকার যেহেতু আমরা মুক্ত নই। পালানোর কোনও যুক্তি নেই, উদ্দেশ্যকে অস্বীকার করার মানে নেই, কেননা আমরা দুজনেই জানি, — উদ্দেশ্য ছাড়া আমাদের অস্তিত্ব থাকবে না। উদ্দেশ্য আমাদের সৃষ্টি করে, সংযুক্ত রাখে, টেনে নিয়ে চলে, আমাদের পথ দেখায়, পরিচালিত করে, সে আমাদেরকে নির্ধারিত করে এবং বেঁধেও রাখে। — Source: The Matrix Reloaded (2003) Movie Quotes; wikiquote.org.
মেশিনদের স্বার্থরক্ষক অ্যাজেন্ট স্মিথের অদৃষ্টবাদ কানে নির্মম শোনালেও মানুষ আসলে অসীম ক্ষমতাধর দুই প্রোগ্রামারের ব্যাখ্যাহীন খেলার দাবার গুটি কি না এই ব্যাপারে নিশ্চিত কিছু বলা কঠিন! সে হয়তো ভিডিও গেমস-এ সৃষ্ট বাস্তবতার অনুরূপ কিছু! আল্লাহ তাঁর নিজের সৃষ্ট ‘জায়ন’-এর ম্যাট্রিক্সে তাকে রাখতে চান কিন্তু খেলার নিয়ম মেনে ইবলিশ সৃষ্ট ম্যাট্রিক্স সক্রিয় থাকায় মানুষ সেখানে গিয়েও ঢোকে। আল্লাহ খেলা জারি রাখার পক্ষে, কারণ তিনি দেখতে চাইছেন শেষ পর্যন্ত কে জেতে, তিনি না ইবলিশ! গ্যোটের ‘ফাউস্ট’-এ মেফিস্টোফেলিস যেমন ঈশ্বরকে বলেছিল মানুষ সৃজন করে তিনি খুব বড়ো ভুল করেছেন, এমন এক প্রাণী তিনি সৃজন করেছেন যাকে খুব সহজে অধঃপাতের চরমে টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব, কারণ নিজের ‘আকল’ ও ‘স্বাধীনতা’র সীমা সম্পর্কে তাদের কোনও ধারণা নেই এবং সহজে এর অপব্যবহার ঘটায়। ঈশ্বর তখন ড. ফাউস্টকে দেখিয়ে বলেছিলেন, মেফিস্টোফেলিস চেষ্টা করে দেখতে পারে তবে তাঁর মনে হয় না সে সফল হবে! পৃথিবীতে ফাউস্টের মতো মানুষকে তিনি দেখতে পাচ্ছেন যে কিনা ঈশ্বর প্রদত্ত ‘আকল’ ও ‘স্বাধীনতা’ সম্পর্কে সচেতন। তার মধ্যে জ্ঞানের ক্ষুধা ও তার ব্যবহারে তিনি সংযমের ছাপ দেখতে পেয়েছেন। সুতরাং তাঁর মনে হয় না অশুভ কোনও শক্তি তাকে বিগড়ে দিতে পারবে। মেফিস্টোফেলিস চ্যালেঞ্জটি নিয়েছিল বটে এবং বাকি ইতিহাস পাঠকের অজানা নেই।
তো খেলাটি সৃষ্টির আদি লগ্ন থেকে চলছে বলে অতিকল্পনার সূত্রসার এই মেটাফিজিক্স একমাত্র যেটি ছাড়া অন্য কোনওভাবে ধরায় আদমের নির্বাসন ও তাওহিদের সূচনা কেন ঘটে তার ব্যাখ্যা মিলে না। মানবের ধরায় আগমনের ইতিহাস নিয়ে বিজ্ঞান ও থিওলজি কেন পৃথক মত হাঁকতে বাধ্য অথবা জৈব বিবর্তনের ইতিহাস ‘ডারউইনবাদ’ আর থিওলজি প্রণীত ‘সৃষ্টিতত্ত্ব’ (Creationism) তারা কেন একে অন্যকে কনডেম করে যাবে, এইসব জটিলতার সুরাহা একুশ শতকে বিরাজিত জ্ঞানের প্রকৃতি সাপেক্ষে সহজ নয়।
যাকগে, অতিকল্পনার রাজ্য ছেড়ে এবার নিখাদ বাস্তবে ফিরি। হাইজেনবার্গের বিখ্যাত ‘Uncertainty Principle’-র যুগে বসবাস করেও নিশ্চয়তাবাদী সিনা-কে এছাড়া সন্তুষ্ট করা কঠিন হবে। স্বীকার করে নিচ্ছি আমরা মানুষ কোনও কম্পিউটার সদৃশ যন্ত্রে সৃষ্ট খেলার অংশ নই। কবুল করা যাক প্রাকৃতিক উপায়ে সংঘটিত বিবর্তনের ধারায় বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ প্রাণী রূপে এমন এক যুগে আমরা বসবাস করি যেখানে ধর্মকে টা টা বাই বাই বলার সময় হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। তো এই সত্য স্বীকার করে সিনা-কে বলতে চাই, তাঁর মনে রাখা উচিত, কোরান নিজেকে মৌলিক দাবি করেনি এবং করার প্রয়োজন মনে করেনি। কোরান ততটা মৌলিক যতটা মৌলিক তাওরাত, যাবুর ও ইঞ্জিল। অতীতে আবিভূর্ত এইসব গ্রন্থের সংশোধিত পুনরাবৃত্তি রূপে নিজেকে সে মৌলিক জানান দিয়ে যায়। তাঁর মৌলিকত্বের দাবিকে তাই উক্ত প্রাসঙ্গিকতায় বিচার করার সময় হয়েছে। উপরন্তু মোহাম্মদ কুম্ভিলক নন! তিনি তাঁর পূর্বে প্রেরিত নবিদের ধারাবাহিক প্রতিধ্বনি মাত্র। সাইবর্গের মতো বিশেষ প্রজাতির মানুষ হলেও ধরায় তাঁকে সুপারম্যান করে পাঠানো হয়নি। তাঁকে পাঠানো হয়েছিল পরীক্ষায় পাশ যেতে! তাঁর জন্য জরুরি ছিল প্রমাণ করা :—
ধরার জীবনে নিজেকে তিনি মানিয়ে নিতে পেরেছেন। ‘আকল’ খাটিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে দক্ষ হয়ে উঠেছেন। আল্লাহর মৌল স্বরূপ সম্পর্কে বিভ্রান্ত মানুষকে জ্ঞান দানের শক্তি তাঁর হয়েছে। ইবলিশ অর্থাৎ অশুভ শক্তির সঙ্গে আল্লাহর চলমান সংঘাতের ইতিহাসে তার ‘আকল’-এর খপ্পর থেকে মানব সম্প্রদায়কে উদ্ধার করার কৌশল উপলব্ধি করতে তিনি সক্ষম। মিশনে কিছু ব্যাপারে আল্লাহ তাঁকে সরাসরি সাহায্য করবেন এবং অনেক ব্যাপারে নীরব থাকা সমীচীন ভাববেন, সে-অনুযায়ী তাকে কাজ করে যেতে হবে এবং সময় হলে তাঁর দৈহিক মৃত্যু ঘটাবেন ও আত্মিক ঊর্ধ্বারোহনের জগতে তাঁকে উঠিয়ে নেবেন ইত্যাদি।
পরীক্ষায় নামানোর আগে মূল কোডিংগুলো তাঁর মধ্যে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইতিহাসের ধারায় এখন তিনি মক্কায় গমন করছেন আল্লাহর একত্বের বাণী প্রচার ও তা পুনরুদ্ধারের জন্য। তাওহিদের নমুনা তিনি সেখানে ও অন্যত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে দেখতে পাবেন এবং তার বিকৃতি নিজের চোথে নজর করতে পারবেন। উভয়ের মধ্য থেকে তাওহিদের পরিচয়সূচক চিহ্নগুলো তাঁকে খুঁজে নিতে হবে, যেন লোকে বুঝে তিনি যে-বাণী প্রচার করছেন সেটা নতুন নয়, বরং অতীতের প্রতিধ্বনি। আল্লাহর মৌল গুণাবলী যেমন অবিনাশী চিরন্তন, তাঁর একত্বও চির-পুরাতন, যুগে-যুগে দেশকালে মানুষকে এ-সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে। ইবলিশের ‘আকল’ দ্বারা প্রভাবিত মানুষ একে বিকৃত করা সত্ত্বেও সেই বাণীর অবশেষ ধরার প্রতিটি কোণে কারও-না-কারও মধ্যে মিলবেই। ধরার পরিবেশে বিচরণের সময় মোহাম্মদকে সে-খবর নিতে হবে। তিনি যেন খবর করতে পারেন সেই ‘আকল’ তার মধ্যে যথাসময়ে সক্রিয় হওয়ার ব্যবস্থা স্রষ্টা করে দিয়েছেন, এখন বাকিটা তার নিজের ক্ষমতার ওপর নির্ভর করবে।
ইসলামের পরিভাষায় এটা হলো ‘আকল আল-মাঅ‘আশ’ বা সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান, যেখানে নবির সঙ্গে আমআদমির তফাৎ নগণ্য। সেই কাণ্ডজ্ঞানের ব্যবহার ঘটে মোহাম্মদ যখন জাগতিক সমস্যার সমাধানে নিজের ‘আকল’ খাটান। সেখানে অনেক সময় ভুলচুক হয়ে যায়। বুঝে ঘাটতি দেখা দেয়। আল্লাহ প্রয়োজন বুঝে তাঁকে সেটা ধরিয়ে দেন। অনুরূপভাবে এই কাণ্ডজ্ঞান ব্যবহার করে তিনি উৎসগুলোর খবর করতে থাকেন এবং হেরা গুহায় বসে এসব নিয়ে ভাবেন। তাওহিদের স্মারক ও কোরানের আদি প্রতিধ্বনি যেখানে যতটুকু অবশিষ্ট রয়েছে সেগুলোকে নিজের মধ্যে ধারণের কাজ এগিয়ে যেতে থাকে। সুতরাং জায়েদ ইবনে উমর থেকে নিতে তার বাঁধে না। জায়েদ মক্কার প্যাগান গোত্রের মধ্যে ব্যতিক্রম ছিলেন। তিনি প্রতিমা উপাসনাকে শিরক ভাবতেন এবং সিরিয়া ভ্রমণের সুবাদে ইব্রাহিম প্রচারিত আদি একেশ্বরবাদী ধারায় নিজেকে সংযুক্ত করেছিলেন। মোহাম্মদ কেন তাঁর অভিজ্ঞতাকে আপন করে নেবেন না? নিতে তিনি বাধ্য! কোরানে আল্লাহর পরিকল্পনাছক যদি বিবেচনা করি তবে একজন নয় এরকম আরও বহু জায়েদকে পাওয়া যাবে যাঁরা প্রত্যেকে মোহাম্মদের জন্য অনুপ্রেরণা ও নিদর্শন হয়ে এসেছিলেন।
নিদর্শন যদি না থাকে তাহলে কোরানে অসংখ্যবার ব্যক্ত এই দাবির কোনও অর্থই থাকে না যেখানে আল্লাহ তাঁর নবিকে জানাচ্ছেন, — যুগে-যুগে মানব সম্প্রদায় স্বাধীনতার সীমা অতিক্রম করেছে, অবাধ মুক্তির স্বাদ ভোগ করতে গিয়ে তাওহিদের পথ ছেড়ে গোমরাহীর ক্ষুরে তারা মাথা কামিয়েছে, এবং সবসময় কিছু লোক সেখানে তবু থেকেই গিয়েছিল যারা মূল সত্য থেকে বিচ্যুত হয়নি। ঘটনাবহুল কোরানের পাতায় সেই ইতিহাস চেপে যাওয়া হয়নি! নিজের সৃষ্ট ম্যাট্রিক্সে মানুষকে প্রবিষ্ট করানোর কাজে ইবলিশ বরাবর সফল হয়েছে। তথাপি সকল যুগে মরফিউস, সাইফার বা ট্রিনিটির মতো কিছু লোক থেকে গেছে যারা ‘আকল’ খাটিয়ে ম্যাট্রিক্স থেকে নিজেকে ঠিক বের করে নিয়ে এসেছে। জায়েদ ইবনে উমর হচ্ছে সেকালের মরফিউস। ওয়ারাকা ইবনে নওফল সাইফার। খাদিজা হচ্ছেন ট্রিনিটি। আবু লাহাব হয়তো এজেন্ট স্মিথ। এরকম আরও মানুষ মোহাম্মদের জীবনধারায় ক্রমান্বয়ে সংযুক্ত হয়েছিলেন এবং তাঁর জন্য এটা অগ্নিপরীক্ষা ছিল যে নিজের কাণ্ডজ্ঞান খাটিয়ে তাঁদরেকে তিনি চিনতে পারছেন ও প্রয়োজনে ব্যবহার করছেন।
…
চিত্র–১১ : Door concept in Matrix
‘These doors lead to many places — hidden places; but one door is special — one door leads to the source.’ — The keymaker; Matrix Movie Quotes; wikiquote.org;
…
সিনা যদি বিষয়টিকে এভাবে ভাবেন তাহলে মোহাম্মদের অন্যের থেকে ধার নেওয়ার অর্থ একরকম দাঁড়াবে, আবার যদি সায়েব বিরচিত পদ্ধতির ছকে ঢুকে ভাবেন তবে কে কার থেকে কী আত্মসাৎ করলেন সেই খোঁজে বেলা পার হবে। শুধু কোরান নয় সকল ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠের সময় পাঠপদ্ধতির প্রচল ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে নতুন ছকে ভাবার রাস্তায় তিনি গমন করতে পারবেন না এবং পরম নিশ্চয়তার কুটিরে বসে জয়িফ রেফ্রেন্স ছাড়তে থাকবেন। সিনা ও তাঁর অ্যান্টি-ইসলামিস্ট কলিগদের ধর্ম বিষয়ক আলোচনা এবং রায় প্রদান নির্দিষ্ট ছক থেকে বেরিয়ে পারতপক্ষে নিজেকে যাচাই করার কথা ভাবে না। গোঁড়া মার্ক্সবাদীরা যেরকম জগতের সকল বিষয় সেই ছকে বসে যাচাই ও ব্যাখ্যা করেন এবং দ্বিতীয় কোনও পন্থা নিয়ে ভুলেও ভাবেন না অ্যান্টি- ইসলামিস্টদের ভেদবিচার তার থেকে ভিন্ন নয়। বৈজ্ঞানিক পন্থায় সত্য যাচাইয়ের ওপর তাঁরা গুরুত্ব দিয়ে থাকেন অথচ বাস্তবে নিজেরা এর কতটা পরোয়া করেন সেই প্রশ্নটি ওঠে। ইসলামকে অশুভ শক্তির প্রতীক রূপে হাজির করার মিশনে তাঁদের সাক্ষ্য-প্রমাণ অর্থাৎ তথ্যের উৎস সম্পর্কে শুরুতে খানিক আভাস দিয়েছি। এখানে তাকে আরও নির্দিষ্ট করা বোধহয় অবান্তর হবে না। ইসলাম-বাতিল মিশনে উৎস বা রেফ্রেন্স ইত্যাদির খোঁজে সিনা ও তাঁর কলিগদের সচরাচর তিনটি ধারায় গমনাগম করতে দেখা যায় :—
প্রথম ধারায় ইসলামের আদি যুগের নিকটবর্তী সময়ে (*অনধিক তিনশো বছর) রচিত টেক্সট সমূহের ওপর তাঁরা ভরসা করেন। দ্বিতীয় ধারায় ইসলামের সম্প্রসারণ থেকে ক্রমান্বয়ে স্তিমিত হওয়ার কালপর্বে (*অনধিক আটশো বছর) রচিত টেক্সট ও দলিল-দস্তাবেজকে গুরুত্বপূর্ণ উৎস রূপে খুঁটিয়ে পাঠ করেছেন বলে দাবি করেন এবং নিজেদের লেখায় প্রায়শ সেইসব টেনে আনেন। তৃতীয় ধারায় তাঁদের মূল অবলম্বন হয়ে ওঠে ঊনবিংশ থেকে চলমান শতক অবধি পশ্চিম গোলার্ধে ইসলাম বিষয়ক গবেষণার ধারাবাহিকতায় রচিত গ্রন্থ সমূহ। উক্ত ধারাগুলোর বাইরে বিচ্ছিন্নভাবে ইহুদি ও খ্রিস্টান থিওলজির অংশবিশেষ এবং মুসলমান বিদ্বানদের রচিত টেক্সটের ব্যবহার তাঁদের রচনায় চোখে পড়ে। রেফ্রেন্স ব্যবহারের এই ছক নিয়ে কারও বলার কিছু নেই এবং ইসলামপন্থীরা এতে আপত্তি জানিয়েছেন বলেও জানা নেই। তথাপি দুটি প্রশ্ন সেখানে ওঠে :—
ইসলাম খারিজের মামলায় ব্যবহৃত এইসব উৎস নিজের রচনায় পেশ করার সময় তাঁরা কি নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করেন এবং করে থাকলে পন্থাটি সেখানে কী? প্রথম প্রশ্নের লেজ ধরে দ্বিতীয় প্রশ্ন ওঠে, ইসলামের মৌল ভিত্তি কোরানের সঙ্গে তথ্যের অসংগতি যদি থেকেই থাকে তাহলে এর চিরুনিতদন্ত তাঁরা করেন কি? যদি করে থাকেন তাহলে সেটা কীরকম?
উত্থাপিত প্রশ্নের সুবাদে বিনীতভাবে বলতে চাই, অ্যান্টি-ইসলামিস্ট ঘরানায় যেসব লেখক বিচরণ করেন তাঁদের লেখাপত্র পাঠের সুযোগ অল্পবিস্তর হয়েছে এবং একসময় প্রভাবিত হয়েছি, এখন ফিরে তাকাতে গিয়ে বলতে বাধ্য হচ্ছি, — উৎস ব্যবহারে ‘নির্ভরযোগ্যতা ও অসংগতি’ যাচাইয়ে তাঁদের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ মনে হয়নি। ক্ষেত্রবিশেষে এমন উৎস তাঁরা ব্যবহার করেন যার ভিত্তি জয়িফ ও বিতর্কিত এবং সে-কারণে সন্দেহজনক বটে! আয়েশার সঙ্গে বিবাহের ঘটনাকে উপজীব্য করে মোহাম্মদকে Pedophile বা শিশুমৈথুনাবেশে আক্রান্ত বলে তাঁরা বিদ্ধ করে থাকেন। ‘বুখারী শরীফ’র হাদিস সূত্রে মোহাম্মদকে অভিযোগবিদ্ধ করলেও ঘটনার স্থান-কাল-পরিপার্শ্ব ও কোরানের সঙ্গে ঐক্য ইত্যাদির পরোয়া না করে রেফ্রেন্স ছাড়তে থাকেন! পেশকৃত হাদিস সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা এবং গবেষক ও চিন্তাবিদরা কে কী ভেবেছেন তার কোনও পরিচয় পাঠক পায় না অথবা সেগুলোকে সেখানে প্রাসঙ্গিক করা হয় না! এমনকি ক্রুসেড চলাকালে মোহাম্মদের চরিত্রের ওপর কালিমালেপনের ঐতিহাসিক ঘটনা এবং আয়েশা বিষয়ক অপবাদের উৎপত্তি সেই সময় ঘটেছিল কি না, দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এসবের তোয়াক্কা না করে তাঁরা কামান দাগতে থাকেন!
বিতর্কিত বিষয়কে রেফ্রেন্স করতে হলে কীভাবে অগ্রসর হওয়া উচিত তার অজস্র উদাহরণ চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। মার্কিন নাগরিক ও লম্বা সময় ধরে ইসলাম নিয়ে গবেষণায় নিয়োজিত কেসিয়া আলী-র (Kecia Ali) কিতাবকে (*দ্রষ্টব্য : Sexual Ethics and Islam: Feminist Reflections on Qur’an, Hadith, and Jurisprudence by Kecia Ali 2006) এর সাম্প্রতিক নজির গণ্য করা যায়। আয়েশার ঘটনা যাচাইয়ে তিনি সেই সময়ের পটপ্রবাহ বিবেচনায় নিয়েছেন, স্থানিক প্রথা ও সংস্কৃতি মনে রেখেছেন, কোরান ও হাদিসে বিবাহ সংক্রান্ত বিধান রি-চেক করেছেন, এবং সবচেয়ে জরুরি অর্থাৎ একুশ শতকের নিরিখে এই ঘটনা ইসলামি চিন্তাবিদরা কোন চোখ দেখেন সে-আলোচনা বিস্তৃত পরিসর জুড়ে করেছেন; কেসিয়া সেইসঙ্গে স্মরণ রেখেছেন, মোহাম্মদের ওপর কালিমালেপন নতুন ঘটনা নয় বরং ক্রুসেডের সময় থেকে এটা চলে আসছে। তাঁর বইটি বাংলায় অনূদিত হয়েছে কি না জানি না। যদি হয়ে থাকে তো ভালো! গুরুত্ব বিবেচনায় বক্তব্যের চুম্বক অংশটি স্ব-কৃত তরজমায় একবার পাঠ যাওয়া প্রয়োজন মনে করি :—
নবি-র বিবাহ সংক্রান্ত ঘটনা অন্য ধর্মাবলীম্বদের সমালোচনার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়া নতুন ঘটনা নয়। মধ্যযুগে নবি-র ওপর আক্রমণ শানানোর পন্থায় তাঁর চরিত্রে অপবাদ আরোপ দৈনন্দিন বৈশিষ্ট্যে রূপ নিয়েছিল, আর ধর্ম হিসেবে ইসলামের বিশ্বাসযোগ্যতায় আঘাত হানা ছিল এরই সম্প্রসারণ। — Source: Sexual Ethics and Islam: Feminist Reflections on Qur’an, Hadith, and Jurisprudence By Kacia Ali, 2006; PDF Edition.
কেসিয়া তাঁর নিবিড় অনুসন্ধানে মোহাম্মদের বিবাহ ও যৌনজীবনকে যেসব ঐতিহাসিক ঘটনা ও কার্যকারণ সূত্রে পাঠ করেছেন তাকে গোনায় ধরলে সহজে বোঝা যায় পেডোফেলিয়ার মতো গুরুতর কিছু তিনি সেখানে খুঁজে পাননি। প্রচলিত ছকের বাইরে এসে যে-কাজটি তিনি করেছেন সেটা বরং বর্তমান সময়ের বিচারে অনেক বেশি গুরুত্ব রাখে। প্রতিটি ঘটনাকে তিনি সেকালের ফ্রেমে বিবেচনা করেছেন, আবার একালের একজন মুসলমানের কাছে এইসব ঘটনার অভিঘাত কী হতে পারে সেটা এই ফাঁকে যাচাই করে নিয়েছেন। মিলিট্যান্ট ইসলামের রমরম মৌসুমে ঘি ঢেলে বিখ্যাত হওয়ার মতলব তাঁর ছিল না সেটা বইপাঠে বেশ বোঝা যায়; যদিও যে-বিষয় তিনি বেছে নিয়েছিলেন সেখানে আলী সিনাদের মতো ‘কাবঝাব’ রেফ্রেন্স দিয়ে তোলপাড় ঘটানোর যথেষ্ট সুযোগ তাঁর ছিল। বইটি নেটে বিনামূল্যে সুলভ বিধায় পাঠক ইচ্ছে করলে মিলিয়ে নিতে পারেন।
অ্যান্টি-ইসলামিস্টদের চরিত্রদোষ হলো কোরানকে তাঁরা প্রায়শ ‘সাব-টেক্সট’-এর আঙ্গিকে ব্যবহার করেন! অথচ কোরান হচ্ছে প্রসঙ্গমূলক বা ‘রেফ্রেন্সিয়াল টেক্সট’ (*দ্বিতীয় প্রবাহে প্রসঙ্গমূলক টেক্সট বিষয়ক আলোচনা পাঠক দেখতে পারেন), যার অনুপুঙ্খ তদন্ত ও বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়া যে-উৎস থেকে রেফ্রেন্স দিন-না-কেন সেটা আসলে বৈধতা ও ন্যায্যতা পায় না। কোরানকে একপ্রকার পাশ কাটিয়ে ইসলামের ত্রুটি-বিচ্যুতি বিচারে নামার ফলে দলছুট নাবিকের মতো তাঁরা ইসলামি ব্যাখ্যাবিজ্ঞান ও মুসলমান শাসকদের কর্মকাণ্ড ইত্যাদির মধ্যে নাও বাইতে থাকেন এবং সেখান থেকে যেসব রেফ্রেন্স নৌকায় বোঝাই করেন সেগুলোর বৈধতা যাচাইয়ে সায়েবসুবো প্রণীত বইপত্র ছাড়া তাঁদের গতি থাকে না! এরকম দলছুট ছুটোছুটির ফলে তাঁদের রেফ্রেন্স ব্যবহার ও তার ব্যাখা দাঁড় করাতে যেয়ে গৃহীত সিদ্ধান্তে বিস্তর ফাঁকি থেকে যায়, যা খণ্ডন করা একজন প্রকৃত ইসলামবেত্তার পক্ষে কঠিন কিছু নয়। কথাটি কেন বলছি সেটা পরিষ্কার করার প্রয়োজনে সূরা ‘বাকারাহ’র ২২৩ নাম্বার আয়াতখানাকে বোধহয় বিবেচনা করার সময় হয়েছে! ধর্মাধর্ম নির্বিশেষ বহুল উদ্ধৃত এই আয়াত নিয়ে দু-কথা বলার আগে বাংলা ও ইংরেজি তরজমায় একবার পাঠ করে নেওয়া যাক :—
‘তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের শস্যক্ষেত্র। অতএব তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা গমন করিতে পারো; তোমরা তোমাদের ভবিষ্যতের জন্যও কিছু করিও এবং আল্লাহকেও ভয় করিও। আর জানিয়া রাখিও যে তোমরা আল্লাহর সম্মুখীন হইতে যাইতেছ এবং মুমিনগণকে সুসংবাদ দিও।’ — উৎস : বাকারাহ; ২:২২৩; আল কোরান; তরজমা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ।
‘Your wives are as a tilth unto you; so approach your tilth when or how ye will. But do some good act for your souls beforehand; and fear God and know that ye are to meet Him (in the Hereafter) and give (these) good tidings to those who believe.’ — Al Quran, Translated by M. Yusuf Ali; Source: quranyusufali.com.
কোরান ও মোহাম্মদ নারীকে আসলে কী চোখে দেখতেন তার উদাহরণ টানতে গিয়ে বিখ্যাত আয়াতের প্রথম অংশটি (*‘তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের শস্যক্ষেত্র। অতএব তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা গমন করিতে পারো;…’) অ্যান্টি-ইসলামিস্ট ও নারী অধিকার বিষয়ে সংবেদনশীল ব্যক্তিরা সুযোগ পেলেই উদ্ধৃত করেন। এর পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তির খবর করতে গিয়ে দেখা গেল সার্চগুরু গুগল ইংরেজিতে প্রচুর উৎসের খবর দিচ্ছে এবং বাংলায় সেই সংখ্যা মোটেও নগণ্য নয়! উৎসগুলো ঘাঁটলে নেটে চালু বাদ-প্রতিবাদের উত্তাপ ভালোই টের পাওয়া যায়। আয়াতের সপক্ষে যাঁরা যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন তাঁরা রজঃস্বলা নারীকুলের ঋতুকাল থেকে ভ্রূণতত্ত্ব অবধি সফর শেষে তবে দম নিয়েছেন। অনেকে আবার সেখানে সন্তুষ্ট না হতে পেরে জগতে যত প্রকার বিদ্যা রয়েছে তার সব ধরে টান দিতে বাকি রাখেননি! ওদিকে বিপক্ষে যাঁরা যুক্তি ঠুকেছেন তাঁরাও কম যান না! অবমাননাকর, নারী অধিকার ও প্রগতির অন্তরায় এইসব বিশেষণ ছাড়াও সমকামের বিরুদ্ধে খাপ্পা ইসলাম নিজে একটি পায়ুকামী ধর্ম ইত্যাদি রায় প্রদান করে নিজের গোসসা মেটানোর কসুর তাঁরা করেছেন। তাঁদের আসলে দোষ নেই! আয়াতাংশ পাঠের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় চিত্তে বিক্ষোভ জাগে বৈকি!
তরুণ বয়সে ইয়ারবন্ধুরা মিলে ইসলামকে একহাত নেওয়ার খায়েশে এই আয়াতাংশ উদ্ধৃত করিনি এমন তো নয়! অনতি তারুণ্যে পঠিত হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’ গ্রন্থে এর উল্লেখ ছিল মনে পড়ে। কাঁচা বয়সে এহেন পঠনের অভিঘাত এতদূর মর্মান্তিক ছিল যে ইসলাম সম্পর্কে জানার কৌতূহল মাটি হতে বসেছিল। বহুজন সূত্রে আয়াতটি পাঠ ও ব্যাখ্যার চাপে পরবর্তী কালে কোরানে গমন ও সূরা ‘বাকারাহ’ পাঠ করলেও আয়াতখানার ব্যাপারে ইসলামপন্থীদের ভাবনা যাচাইয়ে মন ওঠেনি। একজন পাঠক কারও প্রভাব বলয়ে নিজেকে একবার বন্দি করলে সেখান থেকে বের হতে সময় লাগে এবং ‘বাকারাহ’-র ক্ষেত্রে ঘটনাটি ঘটেছিল। সমস্যা হলো, ইসলামবিশ্বাসী সংবেদনশীল নারী-পুরুষ থেকে সরলপ্রাণ ধার্মিকদের মনে এই আয়াত সম্পর্কে বিরাজিত অস্বস্তি নেট ঘাঁটলে বেশ টের পাওয়া যায়। তাঁরা হয়তো মনে-মনে ভাবেন, নারীর মর্যাদা ও অধিকার রক্ষায় সচেতন কোরানে এহেন আয়াত কেমন করে নাজিল হতে পারে! তো এর থেকে আয়াতটি আলী সিনা, হুমায়ুন আজাদ বা তসলিমা নাসরিনদের প্রিয় হওয়ার কারণ বেশ আঁচ করা যায়। কোরানে এহেন বাক্যের সন্ধান তাঁদের জন্য মোক্ষম হাতিয়ার হয়ে আসে যার সাহায্যে মোহাম্মদকে কচুকাটা করে বহু কচিকাঁচার মাথা বিগড়ে দেওয়া যায় বৈকি!
এইবেলা আরেকবার রিপিট করি, আয়াতাংশের প্রাথমিক ও খণ্ডিত পঠনে ব্যক্তিত্ব-সচেতন সংবেদনশীল নারী মনে আঘাত লাগা স্বাভাবিক। কোরান ঘটনাবহুল টেক্সট এবং এই আয়াত সেখানে ব্যতিক্রম নয়। স্পর্শকাতর প্রথম অংশের সম্প্রসারণ থেকে ধারণা হয় এর সঙ্গে পূর্বাপর আয়াতগুলোর (*দ্রষ্টব্য : আয়াত ২২১-২২২; ২২৮-২৩৭) সংযোগ রয়েছে। সেইসব আয়াত যেখানে বিবাহ, তালাক, তালাকপ্রাপ্ত নারীর ভরণপোষণ ও রজঃকালীন অবস্থায় যৌনমিলন ইত্যাদি ব্যাপারে আল্লাহ তাঁর নবিকে দিকনির্দেশনা দান করেছেন। মানে দাঁড়াচ্ছে, আয়াতের পূর্বাপর পটভূমি যাচাই না-করে নারীদেহকে ‘শস্যক্ষেত্র’ ও সেখানে পুরুষের ‘যথা ইচ্ছা গমন’ বোঝাতে কেউ যদি উদ্ধৃত করেন তবে ভ্রান্তি ও গোলযোগ সৃষ্টি হয়, উপরন্তু যিনি এভাবে উদ্ধৃত করলেন তার মতলব সম্পর্কে তখন মনে প্রশ্ন জাগে। আলী সিনা থেকে হুমায়ুন আজাদ, তসলিমা থেকে আম-তসলিমা, প্রগতিপন্থী নারীবাদী থেকে ‘প্রগতি’ বস্তুখানা বোঝেন না এমন নারীগণ…তারা সকলে মিলেঝুলে কাজটি কমবেশি করেছেন বিধায় কতিপয় সওয়াল আপনা থেকে সেখানে মনে জাগে :—
সওয়াল-১. সূরা ‘বাকারাহ’ আদ্যেপান্ত পাঠ যাওয়ার পর এই আয়াতাংশ কি তাঁরা উদ্ধৃত করেন নাকি অন্য কারও থেকে ধার নিয়ে কাজ সারেন? সওয়াল-২. আয়াতের ব্যাখ্যা সম্পর্কে তাঁরা কি খোঁজ-খবর করেন অথবা কোরানে ব্যক্ত অর্থ তাঁদের কাছে যথেষ্ট মনে হতে থাকে? সওয়াল-৩. আয়াতখানার অর্থ ও ব্যাখ্যা জানার কৌতূহলে তাঁরা তফসির পাঠ করেন কি? যদি করে থাকেন সেটা কার তফসির? আদি তফসির প্রণেতা কেউ, যেমন ইবনে খাতির অথবা আত-তাবারি? তুলনামূলক সাম্প্রতিক মাওলানা শফি কিংবা মওদুদীর তফসিরে এই আয়াতের ব্যাখ্যা কি তাঁরা পাঠ গিয়ে থাকেন? সওয়াল-৪. তফসির পাঠ যাওয়ার পর ব্যাখ্যা সম্পর্কে তাঁদের মনোভাব কী? তাঁরা কি সন্তুষ্ট বোধ করেন নাকি অসন্তোষ আরও তীব্র হয়ে ওঠে? সওয়াল-৫. এই আয়াতের সঙ্গে ‘বুখারী’র ৪১৭১ ও ৪১৭২ নাম্বার হাদিসের নিবিড় সংযোগ রয়েছে। তাঁরা কি উক্ত হাদিস পাঠ করেন? পাঠের পর তাঁদের প্রতিক্রিয়া কী দাঁড়ায়?
সওয়াল-৬. ‘বুখারী’র ৪১৭১ নাম্বার হাদিস আয়াত নাজিলের বাখান গাইতে গিয়ে ঘটনাকে অন্য খাতে প্রবাহিত করে এবং জটিল সমস্যার সূত্রপাত ঘটায়। এ-ব্যাপারে তাঁরা কিছু ভাবেন কি? সওয়াল ৭. উদ্ধৃতি এস্তেমাল যাওয়ার ক্ষণে ‘বুখারী’ বর্ণিত হাদিসের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের বাতচিত শ্রবণের আগ্রহ কি তাঁরা বোধ করেন? এবং শেষ সওয়াল, আয়াতাংশ ও এ-সম্পর্কিত ব্যাখ্যা কি তাঁরা কোরান ও ‘বুখারী’ থেকে নিয়েছিলেন অথবা সায়েবদের বই থেকে সরাসরি ধার করে কাজ চালান? সেক্ষেত্রে সায়েব কারা ছিলেন? ইহুদি বা খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাস করেন এমন কেউ? কোনও ধর্মে বিশ্বাস করেন না তবে ইসলাম নিয়ে বইপত্র লিখেছেন এরকম কোনও ইতিহাসকার? অথবা এমন কেউ যিনি উৎসের প্রতি বিশ্বস্ত এবং সেখানে ভ্রান্তি ঘটে থাকলে সংশোধনে দ্বিধা করেননি, সেরকম কোনও মহান প্রাণ থেকে আয়াতখানার শানে নজুল কি তাঁরা অবগত হয়ে পরে উদ্ধৃত করেন?
সওয়াল মনে জাগে কারণ সূরা ‘বাকারাহ’-র আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় তফসির প্রণেতারা একটি ছক মেনে অগ্রসর হয়েছেন দেখতে পাই। আদি তফসির প্রণেতা ইবনে খাতির মূল আয়াতে লিপিবদ্ধ আরবি শব্দ ‘হারথুন লাকুম’-এর (Harthon lakum) ‘হারথ’ অপভ্রংশকে চাবি ধরে চাষাবাদের জমির উপমায় আয়াতখানা তরজমা ও ব্যাখ্যার কাজ সেরেছেন। খাতির সেখানে সংগত কারণে ‘হারথ’-কে নারী-যোনিমুখে (Vulva) পুরুষের লিঙ্গের প্রবেশ অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন। একজন পুরুষের জন্য বিবাহসূত্রে বৈধ এই যোনিমুখ হচ্ছে সেই জমিন যেখানে পুরুষের লিঙ্গকর্ষণ ও বীর্য নিঃসরণ অর্থাৎ প্রজননের জন্য বীজ বপনে কোনও বাধা নেই। বিবাহের মাধ্যমে এই জমিন তার জন্য বৈধ ও পবিত্র হয়ে গেছে এবং এর সংরক্ষণে সে এখন বাধ্য।
খাতিরের তরজমা ও ব্যাখ্যা পরবর্তী তফসির প্রণেতা ও কোরান অনুবাদকরা কমবেশি গ্রহণ করেছেন। ইসলামি ভ্রূণতত্ত্ব বিদ্যার সঙ্গে সংযুক্ত করে আয়াতটি পাঠ যাওয়ার পেছনে তাঁর ব্যাখ্যা সকলকে উৎসাহিত করেছে তাতে সন্দেহের কারণ নেই। তফসির যদিও অসংখ্য এবং সকল পাঠ যাওয়া কোনও মানুর পক্ষে সম্ভব নয়! তবে নেট ঘেঁটে এই ধারণাটি হয়েছে, কমবেশি সকল তফসির প্রণেতা খাতিরের ব্যাখ্যাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ব্যবহার করে গেছেন। ব্যতিক্রম মাওলানা মওদুদী! ২২৩ নাম্বার আয়াতের প্রথম অংশের সুনির্দিষ্ট কোনও ব্যাখ্যা তাঁর তফসিরে পাওয়া যায় না। আয়াতের অপভ্রংশ অর্থাৎ সংযুক্ত অংশকে উপজীব্য করে সংক্ষেপে বাতচিত সেরেছেন। মোহাম্মদ আসাদও তাঁর কোরানের টীকাভাষ্যে প্রায় অনুরূপ রীতি অনুসরণ করেছেন বলা চলে।
ওদিকে তুর্কদেশি আলী উনাল মোটের ওপর মওদুদী ও আসাদের রাস্তায় হেঁটেছেন। ‘বাকারাহ’-র ১৮৭ নাম্বার আয়াতের সঙ্গে একে জুড়ে দিয়ে তিনি ব্যাখ্যা সেরেছেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো বিবাহের পবিত্রতা সম্পর্কে বুখারী ও তিরমিজির দুটি হাদিসের রেফ্রেন্স টীকাভাষ্যে জুড়লেও মূল হাদিসের (৪১৭১ ও ৪১৭২) ধারেকাছে তিনি গমন করেননি! হতে পারে ‘সহি’ হওয়া সত্ত্বেও উক্ত হাদিস নিয়ে তাঁর মনে দ্বন্দ্ব বিরাজিত থাকায় টীকায় সংযুক্ত করা থেকে বিরত থেকেছেন। অথবা, তিনিও সেই অস্বস্তির শিকার হয়েছিলেন যা আদি যুগে ইবনে খাতিরের মধ্যে ছিল না। তাঁর হয়তো মনে হয়েছিল, আয়াতের টীকাভাষ্যে ‘বুখারী’-র উল্লেখ ফিতনা তৈরি করতে পারে এবং সেক্ষেত্রে পাশ কাটিয়ে যাওয়া উত্তম। ফলে তফসির থেকে এই আয়াতাংশ নাজিলের কার্যকারণ, দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে ঠিক যেন বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না।
আলী সিনা-রা যদি তফসির সত্যি পাঠ গিয়ে থাকেন সেক্ষেত্রে এই ঘটনায় তাঁদের উৎফুল্ল বোধ করাই উচিত! একটি আয়াতকে সন্তুষ্টি সহকারে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না এহেন সমস্যা অ্যান্টি-ইসলামিস্টদের সুবিধা করে দেয়। মানে দাঁড়াচ্ছে, মোহাম্মদ নিজে কোরানে ঘাপলা পাকিয়ে গেছেন এবং স্পষ্ট প্রমাণ মিলে নারীকুলের প্রতি তাঁর মমতা দূরে থাক বরং তাদের দেহকে যেমন খুশি ব্যবহারে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন! আলী সিনা ও তসলিমা ভক্তদের খুশির মাত্রা আরেক ডিগ্রি বাড়িয়ে দিতে ‘বুখারী’-র ঝামেলাপূর্ণ পয়লা হাদিসটি এইবেলা উদ্ধৃত করা যায়। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মূল অনুবাদের অনলাইন সংস্করণ নেটে সুলভ হওয়ায় সেখান থেকে সরাসরি টুকলি করছি :—
‘… আবদুস সামাদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার কাছে হাদিস বর্ণনা করেন আমার পিতা, তিনি বলেন, আমার কাছে হাদিস বর্ণনা করে আইয়ুব, তিনি নাফি‘ থেকে আর নাফি‘ ইবনু উমর (রাঃ) থেকে। فَأْتُوا حَرْثَكُمْ أَنَّى شِئْتُمْ ‘অতএব তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা গমন করতে পারো।’ (২: ২২৩)। রাবী বলেন, স্ত্রীলোকের পশ্চাৎ দিক দিয়ে সহবাস করতে পারো। মুহাম্মদ ইবনু ইয়াহইয়া ইবনু সাঈদ তাঁর পিতা থেকে, তিনি উবায়দুল্লাহ থেকে, তিনি নাফি‘ থেকে এবং তিনি ইবনু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন।’ — উৎস : সহিহ বুখারী; ৪১৭১; হাদিসের মান : সহি; মূল বর্ণনাকারী : নাফি‘ (রহ.); ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; হাদিস সংকলন গ্রন্থনা : হাদিথবিডিডটকম।
হায়! ষোলটি বছর হাদিস সংগ্রহ আর সহি-জয়িফ-জালি যাচাইয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে বুখারী এমন এক হাদিসকে ‘সহি’ বলে নিজের সংগ্রহে স্থান দিলেন যেটি কিনা কোরানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক! কোরান ও সুন্নাহর বিচারে ইসলামে সমকাম দূরে থাক বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে পায়ুকামে লিপ্ত হওয়া সিদ্ধ নয়। ‘তাওরাত ও কোরানে’ আল্লাহ সোদোম ও গোমরাহ নগরবাসীর সকল পাপাচার ক্ষমা করে দিতে প্রস্তুত হলেও তাদের সমকামী অভ্যাসকে তিনি ক্ষমার অযোগ্য বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। ধনজনসভ্যতায় উন্নত সোদমে নবি লূত কিছুদিন অতিথি রূপে অবস্থান করেছিলেন। সেই সময় তাঁর গৃহে মানবের বেশধারী দুই ফেরশেতাকে প্রবেশ করতে দেখে তাদের সঙ্গে সমকামে লিপ্ত হওয়ার জন্য সোদমবাসী কেমন পাগলপারা হয়ে উঠেছিল সেই বিবরণ তাওরাতের পাতা উলটালেই মিলে।
সমকামের জন্য সোদম নগরী ধ্বংসের বিবরণে কোরান ও তাওরাত প্রায় অভিন্ন হলেও তাওরাতের ভাষ্য পাঠে লোট ওরফে লূতকে নবি বলে চিনে ওঠা যায় না! ইব্রাহিমের সমসাময়িক এবং তাঁর মাধ্যমে সোদমে গমনকারী লূত কোরানে নবি রূপে স্বীকৃত ও সেই মর্যাদায় বর্ণিত হয়েছেন। ওল্ড টেস্টামেন্ট বা তাওরাতের বিবরণ সেখানে পৃথক। তাওরাতের বয়ান অনুসারে সোদম ধ্বংসের পর বৃদ্ধ লূত তাঁর দুই যুবতী কন্যা নিয়ে জননির্জন এক গুহায় আত্মগোপন করেন। বংশধারা রক্ষায় বদ্ধপরিকর লূতের দুই কন্যা তখন পিতাকে মদ্যপানে বেহুঁশ করে পরপর দুই দিন তার সঙ্গে মিলিত হয়। তাওরাতের বিবরণ অনুসারে মদ্যপানের প্রভাবে নেশাতুর লূত কন্যারা কে কখন তাঁর সঙ্গে কী করছে সেটা নাকি টের পাননি। আজব এই অজাচারের ফলশ্রুতিতে মোয়াব ওরফে মুয়াবিয়া এবং আম্মি নামে দুই জাতি জন্মলাভ করে। তাওরাত ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায় নেটে সুলভ। পাঠক ওল্ড টেস্টামেন্টের জেনেসিস পুস্তকে বর্ণিত সে-কাহিনি ইচ্ছে করলে মিলিয়ে নিতে পারেন।
এ-রকম বহু ঘটনা রয়েছে যা তাওরাত ও কোরানকে পরস্পরের নিকটবর্তী যেমন করে আবার দূরে ঠেলে দেয়। এখানে কে কাকে কপি করেছে তার চেয়ে স্রষ্টার একত্ব ও উপাসনা প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঘটনা কীভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে সেটা অধিক গুরুত্ব রাখে। মদ্যপান, অজাচার কিংবা সমকাম বিষয়ে কোরানের কঠোর মনোভাবের নেপথ্যে এই বিষয়গুলোর ভূমিকা মোটেও নগণ্য কিছু নয়। একেশ্বরবাদী সকল ধর্মে সমকামের ওপর নিষেধাজ্ঞা তাই যুক্তিযুক্ত, কারণ এটি স্রষ্টার সামগ্রিক পরিকল্পনা ও যে-ছকে সৃষ্টিজগৎকে তিনি প্রোগ্রামিং করেন সেখানে ঝামেলা পাকায়। সমকামকে ছাড়পত্র দিলে এই-যে তিনি বিপরীত লিঙ্গের প্রাণী সৃজন করলেন এবং তাদের মিলন ঘটাতে প্রজননের প্রক্রিয়া স্থির করলেন তার কোনও যৌক্তিকতা থাকে না। সুতরাং সমকামের ব্যাপারে সকল একেশ্বরবাদী ধর্মে যে-কঠোর মনোভাব দেখা যায় তা স্রষ্টার পরিকল্পনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।
এখন পদার্থবিদ লরেন্স ক্রাউস ইসলামিস্টদের সঙ্গে তর্কে নেমে যুক্তি দিতে পারেন, প্রাণীজগতে জিনগত বিবর্তনের ধারায় দশ শতাংশ প্রাণীর মাঝে সমকামী প্রবণতা সহজাতভাবে দৃশ্যমান ইত্যাদি, কিন্তু এতে ইসলামের কিছু যায় আসে না। কেননা ইসলামি সৃষ্টিতত্ত্বের বিচারে সমকাম আল্লাহর নির্দেশ ও পরিকল্পনার লঙ্ঘন। সমকাম সূত্রে সংরক্ষিত নিষেধাজ্ঞার কারণে বিপরীত লিঙ্গের মধ্যে পায়ুকামকে সিদ্ধ ভাবা কোরানের সঙ্গে একপ্রকার বিরোধ তৈরি করে। হাদিসবেত্তা ও ইসলামি আইনশাস্ত্রে পারঙ্গম ব্যক্তি পারতপক্ষে কোরানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু মনে স্থান দেওয়ার কথা চিন্তা করতে পারেন না। এখন ইমাম বুখারী সূরা ‘বাকারাহ’-র আয়াতের কাহিনি বয়ান করতে যেয়ে Back Passage বা ‘পশ্চাৎ দিক’-এর প্রসঙ্গ টানায় আয়াতের প্রকৃত ব্যাখ্যা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। আলী সিনা বা তসলিমা নাসরিনদের জন্য বিষয়টি সুখকর ঘটনা হয়েই আসে! উনারা চাইলে হায়দারি হাঁক হাঁকতে পারেন, ইসলামের নবি কামক্ষুধায় এতদূর কাতর ছিলেন স্ত্রীলোকের ‘পশ্চাৎদেশ’ও রেহাই পায়নি! তাঁরা না-হয় খুশিতে হায়দারি হাঁক ছাড়লেন, এখানে প্রশ্ন হলো খোদ বুখারী কী হেন কারণে এরকম একটি হাদিস (তাও সহি) রেখে দিলেন! তাহলে কি ‘পশ্চাৎ দিক’-এ রমণ বলতে তিনি অন্য কিছু বুঝিয়েছিলেন? ভাষাভঙ্গির দুর্ঘটের কারণে যা এখন ‘ভুল বোঝার’ সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে!
খেয়াল করা প্রয়োজন, কোরানের সহায়ক টেক্সট প্রামাণ্য হাদিস সংকলনে লিপিবদ্ধ কোনও হাদিস সমস্যা সৃষ্টি করছে দেখে তাকে অগোচরে গায়েব করার রেওয়াজ ইসলামে সচরাচর দেখা যায় না। কোরানের নিক্তিতে উক্ত হাদিসকে পৌনঃপুনিক যাচাই করার চর্চা বরং বহু যুগ ধরে চলে আসছে। যাচাইয়ের পর সাংঘর্ষিক মনে হলে সেই হাদিস এমনকি ‘সহি’ হলেও আর অগ্রাধিকার পায় না। সেক্ষেত্রে কোরানের আয়াতকে ‘মান্য’ বলে ধরে নেওয়া হয়। সহি হাদিস মানে ‘বেদবাক্য’ এই ভাবনায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গিও যোগ হয়েছে। প্রথমে দেখা হয় হাদিসের সঙ্গে কোরানের আয়াতের সরাসরি সংযুক্তি রয়েছে কি না, যদি থাকে তবে তাকে ভিত্তি ধরে সহিত্বের মান যাচাই করা হয়। হাদিস যদি সেখানে কোনও কারণে সাংঘর্ষিক মনে হয় তবে সহি হলেও সেটা আর অগ্রাধিকার পায় না। কোরানের সঙ্গে সংযোগ না থাকলে অবশ্য ভিন্ন কথা। সেরকম হাদিসের সহিত্ব বিচারে ঐতিহাসিক পটপ্রবাহ থেকে শুরু করে তথ্যের উৎস ও সেমিওটিক্স অনেককিছু সেখানে বিবেচ্য গণ্য হতে থাকে।
তো এই জায়গা থেকে বুখারী কর্তৃক লিপিবদ্ধ হাদিস নাম্বার ৪১৭১ নিয়ে ইসলামি শাস্ত্রবিদরা মোটের ওপর দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে মতামত দিয়েছেন। কারযাভী প্রামাণিক যুক্তি সহকারে মত দিয়েছেন ইসলামে সমকাম হারাম বলে গণ্য এবং স্ত্রীলোকের সঙ্গে পায়ুকামও সিদ্ধ নয়। তাঁর মতের সঙ্গে সিংহভাগ সুন্নি বিদ্বান সহমত পোষণ করেছেন। তাঁরা সকলেই মনে করেন Back Passage অর্থাৎ পেছন দিকে রমণ মানে পায়ুপথে গমন করতে হবে এমন ভাবার যৌক্তিকতা ‘বুখারী’-র এই হাদিস কোনওভাবে স্পষ্ট করে না; বরং এখানে Missionary Position অর্থাৎ পেছন দিক দিয়ে যোনিমুখে লিঙ্গের প্রবেশ ঘটানোর কথা বলা হয়েছে এবং এহেন রমণে আপত্তির কিছু থাকতে পারে না।
সুন্নি ও শিয়া ঘরানায় কিছু বিদ্বান যদিও সূরা ‘হুদ’-এর ৭৮ নাম্বার আয়াতে বর্ণিত ঘটনা সূত্রে স্ত্রীলোকের পায়ুপথে গমনকে বৈধ মনে করে থাকেন। মানববেশধারী ফেরেশতাদের সঙ্গে সমকামে লিপ্ত হতে ব্যাকুল সোদমবাসীকে নিবৃত্ত করতে নবি লূত মজবুর হয়ে অতিথিদের পরিবর্তে তাঁর দুই কন্যাকে তাদের হাতে বিবাহের মাধ্যমে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ‘O my people! Here are My daughters : they are purer For you (if ye marry)!’ (*দ্রষ্টব্য : হুদ; ১১:৭৮; The Holly Quarn: Translated by A. Yusuf Ali; quranyusufali.com] সোদমবাসীরা যেহেতু পায়ুকামে অভ্যস্ত ছিল সেক্ষেত্রে লূত বিকল্প সমাধান হিসেবে কন্যাদের পায়ুপথে গমনের প্রস্তাব দিয়েছেন বলে তাঁরা মনে করেন। এছাড়াও অনেকে হযরত আলী, ইমাম বুখারী, আত-তাবারি, আল আরাবি, মালিক ইবনে আনাস প্রমুখের গ্রন্থ ও মন্তব্য সূত্রে স্ত্রীলোকের পায়ুপথে গমনকে অপছন্দনীয় কাজ হলেও হারাম মনে করেন না, কারণ এটা অনেকক্ষেত্রে জন্মনিয়ন্ত্রণে সহায়ক। ‘সুনান আবু দাউদ ও সহিহ বুখারী’ বর্ণিত হাদিসে মহানবি জন্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ‘আযল’ অর্থাৎ বীর্য বাইরে নিক্ষেপের বিধান দিয়েছিলেন এই মত সহকারে, আল্লাহ যদি প্রাণ প্রেরণ করবেন বলে মনস্থির করেই থাকেন সেক্ষেত্রে ‘আযল’ করেও বিশেষ ফায়দা না মিলতে পারে।
হাদিস বিশেষজ্ঞ ও বিদ্বানদের সহমতের মধ্যে ইমাম হাম্বলি সম্ভবত ব্যতিক্রম যিনি এ-ব্যাপারে ভিন্ন মত দিয়েছেন। তাঁর মতে যৌনমিলনের ক্ষণে স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় পায়ুপথ গমনে স্বামীকে সম্মতি দান করেন এবং তাকে কোনও প্রকার আহত না করে নিছক রমণসুখ লাভ ও ভালোবাসা চরিতার্থের মধ্য দিয়ে ঘটনাটি ঘটে সেক্ষেত্রে দোষ ধরার কিছু নেই। তবে জোরজবরদস্তি বা চাপ প্রয়োগ করে স্ত্রীকে এ-ব্যাপারে রাজি করানো বৈধ হবে না। উইকিপিডিয়া (*দ্রষ্টব্য : Talk: Islamic views on anal sex) ও অন্যান্য উৎস স্ত্রীলোকের পায়ুপথে গমন বিষয়ে বিদ্বানদের এইসব মতবিরোধের বাখান গাইলেও কোরানে আল্লাহর সৃষ্টি-পরিকল্পনার ছক বিবেচনায় নিলে পায়ুকাম বৈধ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে পড়ে এবং সে-কারণে অধুনা প্রায় সকল বিদ্বান একে একপ্রকার নিষিদ্ধ গণ্য করেন। ফলে ‘বুখারী শরীফ’-এ সূরা ‘বাকারাহ’-এর ২২৩ নাম্বার আয়াতসূত্রে লিপিবদ্ধ হাদিসটি সহি হওয়া সত্ত্বেও অগ্রাধিকারের প্রশ্নে গৌণ হয়ে পড়ে।
ইবনে খাতিরকে অগত্যা বিচক্ষণ মানতে হয়! বহু আগে সমস্যার প্রকৃতি ঠাহর করতে পেরে যোনিমুথে লিঙ্গ প্রবেশের অর্থে আয়াতটি তিনি ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মোটের ওপর এই হাদিস নিয়ে গোল থাকলেও ইসলামি শাস্ত্রবেত্তারা কোরানের নিক্তিতে যৌক্তিক ব্যাখ্যা হাজির করায় এর ওপর ভর করে আলী সিনা কিংবা তসলিমা যদি মোহাম্মদ ও ইসলামকে পায়ুকামী প্রমাণ করতে চান তাহলে বিশেষ সুবিধা করতে পারবেন বলে প্রত্যয় হয় না। তর্কটা এখানে আক্ষরিক (Literal) হওয়ার পরিবর্তে আলঙ্কারিক-এ (Rhetorical) মোড় নিতে বাধ্য এবং সেক্ষেত্রে বিরোধীপক্ষের যুক্তি খণ্ডনের মতো বিদ্বানের অভাব ইসলামে ঘটার কারণ নেই।
ঘটনা এখানে শেষ নয়। বুখারীর এই হাদিস নিয়ে এতটা বিস্তারিত হওয়ার কারণ পাঠকদের সঙ্গে নিজে এই সবক নেওয়া যে অ্যান্টি-ইসলামিস্টরা আক্ষরিক অর্থের ওপর ভর করে এবং বিশেষ যাচাই-বাছাই ও খোঁজখবর না নিয়ে জঙ্গে নামায় তাঁদের তথ্য ও যুক্তির ওপর আস্থা আর বজায় থাকে না। ঘটনাটি যেমন অগভীরতার পরিচায়ক অন্যদিকে বৃদ্ধিবৃত্তিক কদর্যতাকে প্রকটিত করে। তাঁদের এইসব তোঘলকি লম্ফঝম্প ইসলামি চরমপন্থীদের অধিক হারে উগ্র হতে উৎসাহী করায় বিরোধী মত লালন ও পারস্পরিক সংলাপে গমনের পথ দিনদিন সংকীর্ণ হতে বসেছে।
সমাজে বহু মতপথের লোকজন থাকবে এবং সে-কারণে সকলের মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংরক্ষণ জরুরি। তবে মনে রাখা দরকার, স্বাধীনতা যদি স্বেচ্ছাচার ও সহিংসতার হাতিয়ারে পরিণত হয় সেক্ষেত্রে সংঘাত ও চরমপন্থার উত্থান ঠেকানো সম্ভব নয়। ইসলামে জঙ্গিবাদের উত্থান যদি মাথাব্যথার কারণ হয়ে থাকে, পরিতাপের সঙ্গে বলতে হয় এর দাওয়াই রূপে আবিভূর্ত অ্যান্টি-ইসলামিস্টরা সেখানে বিরিক্তকর উৎপাত হয়ে দেখা দিয়েছেন। তাঁরা দুজনেই পরস্পরের প্রতি সমান অসহিষ্ণু, অবিবেবচক এবং অগভীর! এটা হচ্ছে ‘ফিতনা’, এটা হলো ‘ফ্যাসাদ’, যার কথা কোরানে বারংবার উল্লেখিত হয়েছে। ‘ফ্যাসাদ’ আরবি শব্দ এবং কোরান ও হাদিসে এই টেক্সট বহুরৈখিক অর্থে ব্যবহৃত ও বর্ণিত হয়ে থাকে, চরমপন্থী মুসলমান আর অ্যান্টি-ইসলামিস্টরা বহু অঙ্গে বিকশিত ‘ফ্যাসাদ’র একটি অঙ্গ মাত্র।
তো এই ফ্যাসাদ বাঁধানোর লক্ষ্যে সূরা ‘বাকারাহ’-র ২২৩ নাম্বার আয়াতাংশ আর তার সঙ্গে বুখারী কর্তৃক লিপিবদ্ধ ৪১৭১ নাম্বার হাদিস জুড়ে দিয়ে আলী সিনা-রা যখন অনলাইন দাপিয়ে বেড়ান তখন তাঁদের মন একবারও এই প্রশ্নের তালাশে নামার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না, — রেফ্রেন্স দেওয়ার আগে বরং জেনে নেওয়া যাক কী কারণে ‘বুখারী শরীফ’-এ ইসলাম ও মোহাম্মদের জন্য বিব্রতকর হাদিসটি ঠাঁই করে নিয়েছিল! তাঁরা তালাশ না করলেও ইসলামি ঘরানায় অবস্থিত বিদ্বানরা এ-নিয়ে যথেষ্ট মাথা ঘামিয়েছেন এবং এতক্ষণ যাবত সেই বিবরণ পাঠ যাওয়ার পর পাঠকের কাছে বিষয়টি অস্পষ্ট থাকার কথা নয়। মাথা ঘামানোর কারণে হয়তো-বা অ্যান্টি-ইসলামিস্টরা যখন ‘বাকারাহ’-র আয়াতাংশ ও বুখারীর হাদিস নিয়ে হট্টগোল বাঁধান তাঁরা তখন মুচকি হেসে বুখারীর দ্বিতীয় হাদিসে (৪১৭২) গমন করেন। স্বাভাবিক! কেননা পরের হাদিসে খোদ বুখারী ঘটনা ক্লিয়ার করে দেন। উক্ত হাদিসটি পাঠ যাওয়ার পর বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না পূর্ববর্তী হাদিস এক্ষেত্রে কেন কোরানের বিচারে যুক্তিসংগত হয়ে ওঠে। এমনকি কোরানকে আপাতত বিবেচনা না করলেও তার বৈধতার হানি কেনই-বা ঘটে না!
ক্লিয়ার হয়ে যায় ‘বাকারাহ’-র আয়াতটি ঐতিহাসিক ঘটনাছকের অংশ রূপে মোহাম্মদের কাছে প্রেরিত হয়েছিল, যার সঙ্গে নারীকুলকে অপমান করা ও হেয় চোখে দেখার কোনও সম্পর্ক নেই। অন্য বহু আয়াতের মতো আয়াতটি নাজিল হয়েছিল কোরানের ভাষায় সত্যত্যাগী সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে, যাদের সঙ্গে বিবাদ কেয়ামত অবধি অনিবার্য বলে একজন মুসলমান তার অন্তরে বিশ্বাস যায়। তার এই বিশ্বাস নিয়ে তর্ক-বিতর্ক ও আপত্তি থাকাটাই স্বাভাবিক। পৃথক প্রসঙ্গ রূপে এ-নিয়ে আলোচনাও হতে পারে, তবে বক্ষ্যমাণ নিবন্ধের সাপেক্ষে জরুরি নয় বলে সেদিকে যাওয়ার কারণ দেখি না। অ্যান্টি-ইসলামিস্টদের তথ্য পরিবেশনের প্রবণতা নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে পরিতাপের সঙ্গে দেখতে পাচ্ছি কিছু না জেনে না বুঝে এবং বাছবিচারের পরোয়া না করে তাঁরা কেমন অনায়াসে টুকলিবাজি করেন কিংবা তার ওপর ভর করে গলা ফাটান! এই-যে এতদিন ধরে আলী সিনা-রা ইসলামকে ইভিল প্রমাণে হায়দারি হাঁক ছাড়লেন, দেশে-বিদেশে আমজনতা থেকে গুণীজনকে সূরা ‘বাকারাহ’র আয়াতাংশের ভুল ও অযৌক্তিক পাঠে প্ররোচনা দিয়ে গেলেন, তাঁদের এমনধারা তোঘলকি কারবারকে উপহাস করতেই বুঝি-বা ইমাম বুখারী তাঁর সংগ্রহের ঝুলি থেকে ৪১৭২ নাম্বার হাদিসটি বের করে আনেন ও সযত্নে পরিবেশন করেন। ভণিতা ছেড়ে হাদিসখানা এবার পাঠ করা যাক :—
‘আবু নু ‘আইম (রহ.)…জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইহুদিরা বলত যে, যদি কেউ স্ত্রীর পেছন দিক থেকে সহবাস করে তাহলে সন্তান টেরা চোখের হয়। তখন (তাদের এ ধারণা রদ করে) سَاؤُكُمْ حَرْثٌ لَكُمْ আয়াত অবতীর্ণ হয়।’ — উৎস : সহিহ বুখারী; ৪১৭২; হাদিসের মান : সহি; মূল বর্ননাকারী : জাবির ইবনু আবদুল্লাহ আনসারী (রাঃ); ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; হাদিস সংকলন গ্রন্থনা : হাদিথবিডিডটকম।
বুখারী পরিবেশিত এই অনতিপরবর্তী হাদিস এবং তার সঙ্গে পূর্ববর্তী ও সূরা ‘বাকারাহ’র মূল আয়াতের সংযোগ এখানে তিনটি বিষয় খোলাসা করে যায়, — প্রথমত ‘বাকারাহ’-র বহুল উদ্ধৃত আয়াতের সঙ্গে নারীকুলকে অপমান ও খাটো করার কোনও সংযোগ নেই এবং জগতের ফেমিনিস্টগণ শোর মাচানোর আগে দয়া করে তথ্যের ভিত্তি যাচাই করে নেবেন। দ্বিতীয়ত ৪১৭১ নাম্বার হাদিস Back Passage বা পেছন দিকে লিঙ্গ চালনা নিয়ে বিদ্বান মহলে স্ত্রীলোকের সঙ্গে পায়ুকামে (*সমকাম নয়) লিপ্ত হওয়া ‘বৈধ না অবৈধ’ এই বিতর্কের সূত্রপাত ঘটালেও বিষয়টি কোরানের কনটেক্সটে মোটের ওপর মীমাংসিত। উপরন্তু পরের হাদিসে সন্তান জন্মদানের বিষয় উল্লেখিত হওয়ায় বুঝতে বাকি থাকে না ইহুদি সম্প্রদায়ে বিদ্যমান মিশনারি পজিশনে রমণ সংক্রান্ত কুসংস্কারের জবাব দিতে আয়াতটি নাজিল করা হয়, যেটি কোনওভাবে পায়ুকামের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল না। তৃতীয়ত মক্কা ও মদিনার ইহুদি গোত্রের সঙ্গে মোহাম্মদের লম্বা বিবাদের ইতিহাস, যা মূসা-র সময় থেকে এখন অবধি বহাল রয়েছে, ‘বাকারাহ’-র আয়াত সেই বিবাদকে পুনরায় সামনে হাজির করায়। বিবাদের যৌক্তিকতা ও তার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া নিয়ে পৃথক যুক্তিতর্ক চলতে পারে এবং সেই নিরিখে কোনও ব্যক্তি ইসলামকে ‘ফিতনা’ সৃষ্টিকারী ও সহিংস অভিধায় চিহ্নিত করতেই পারেন, তথাপি মনে রাখতে হবে এর সঙ্গে যয়িফ ও ভ্রান্ত তথ্যের ওপর ভর করে সুকুমার রায়ের ‘হযবরল’-র সেই উদো-র পিণ্ডি বুধো-র ঘাড়ে চাপানো মুক্তমনের পরিচয় বহন করে না। অ্যান্টি-ইসলামিস্টদের সে-কারণে আরও কুশলী ও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। ইতিহাস পরম্পরা যাচাই না-করে আলী সিনা মোহাম্মদকে চরিত্রহীন ও কুম্ভিলক প্রমাণে ধা করে পাঁচটা হাদিস হাজির করবেন আর তার্কিকরা সেটা খণ্ডন করতে পারবেন না, এই যুগ আসলে তামাদি হয়ে গেছে।
অ্যান্টি-ইসলামিস্টদের অব্যাহত দাবি ও উপহাসের পালটি হিসেব ইসলামি ধর্মবেত্তাদের সরাসরি এ-কথা বলা উচিত, — হ্যাঁ, মোহাম্মদ দু-হাত ভরে নিয়েছেন! আরব প্যাগান গোত্রদের থেকে তিনি নিয়েছেন। মক্কার ট্রানজিট রুট ধরে গমনরত বিচিত্র বিশ্বাস ও সংস্কৃতির প্রবাহ থেকে নিয়েছেন। সিরিয়া ও পাশ্ববর্তী অঞ্চল থেকে অবলীলায় নিয়েছেন। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফার্সির থেকে নিতেও কুণ্ঠিত হননি। মোহাম্মদ যা নিতে পারেননি এবং নেওয়ার ক্ষমতায় সেখানে তাঁকে সীমিত করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে ‘আকল আল-আলওয়াল’ বা আদি প্রজ্ঞা। আল্লাহর মৌল গুণাবলী, সৃষ্টি প্রক্রিয়া, রুহ ওরফে নফস ওরফে আত্মা, হাশর, দোজখ, জান্নাত, মালাইক, জিন, হুর, গেলমান ইত্যাদি কেন ও কীভাবে বিরাজ করে তার জ্ঞান মোহাম্মদের জন্যও অধরা। এসব সম্পর্কে বাণী প্রচারের এখতিয়ার তাঁকে দেওয়া হচ্ছে কিন্তু তাদের বিদ্যমানতা ও কার্যকারণ স্বয়ং সেই ‘আকল আল-কুল্লি’র অধিকারে যিনি তাঁর সৃষ্টির মাঝে জ্ঞেয় হওয়া সত্ত্বেও অজ্ঞেয়। কোরানের সূরাগুলোর মধ্যে ‘মুতাশাবিহাত’ সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলোর সামগ্রিক পাঠ যাওয়া প্রয়োজন, অন্যথায় তার থিওসফি ও থিওলজি বুঝে আসে না। সিনা-র লেখাপত্তর এই বিবেচনায় নিতান্ত ভাসা-ভাসা বা সুপারফিসিয়াল, গভীরতা সন্ধানী মোটেও নয়।
বড় কথা হচ্ছে কোরান-হাদিসে বিষয়গুলো গোপন করা হয়েছে এমন তো নয়! উৎসগুলোর স্বীকৃতি কিতাবকে প্রচলিত ছক থেকে বেরিয়ে পাঠ করলে আপনা থেকে মিলে। তাহলে এটা কেন ভাবব না, বিব্রতকর যদি হয়ে থাকে তবে কী কারণে বিরোধীরা শোরগোল তুলবে এমন আন্দাজ পাওয়া সত্ত্বেও এইসব রেফ্রেন্স কোরান-হাদিসে জ্বলজ্বল করতে থাকে। এই প্রশ্ন ধরে অগ্রসর হলে পাঠ ও অনুসন্ধানের ধারা পালটে যেতে থাকে। স্মরণ রাখা উচিত, কোরান ও মোহাম্মদকে অবধানের জন্য ইসলামের ইতিহাস ও ব্যাখ্যাবিজ্ঞানের রচয়িতারা অপরিহার্য হলেও তাঁরা কেউ ইসলামের অথিরিটি নন। ইসলামের আদি-অকৃত্রিম অথরিটি হচ্ছে কোরান। কোরানের পর হাদিস-সিরা ও অন্যান্য উৎস গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হতে পারে এবং হয়ে থাকেও। অতএব, কোরানের কোনও আয়াত কিংবা কোনও হাদিস অথবা সিরার ঘটনা নিয়ে বিদ্বানদের ব্যাখ্যা ও মতামতের সত্যতা এবং যুক্তি বিরচন পদ্ধতি গভীরভাবে যাচাই করা প্রয়োজন।
এইসব ব্যাখ্যা যে-সময়ে রচিত হয়েছিল সেকালের পরিপার্শ্বও বিবেচিত হওয়া জরুরি। অন্যথায় বিদ্যাচর্চায় ফাঁকি থেকে যায় এবং প্রগতিশীলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য করে। এই ব্যাপারে ইসলামি ঘরানায় সক্রিয় বিদ্বানদের দায়ভার মোটেও কম নয়! কোরান ও হাদিস বর্ণিত মৌল বিধান এবং তার ঐতিহাসিক অপপ্রয়োগ বিষয়ে পৃথক পরিসরে আলোচনার ঐতিহ্য নির্মাণে তাঁদেরকে ব্যর্থ বলা ছাড়া উপায় থাকে না। এই ব্যর্থতা দীনের ভিত্তি কোরান ও মোহাম্মদের বিরুদ্ধে আলটপকা তথ্য ও যুক্তি বিরচনে সিনাদের সুবিধা করে দিয়েছে। ইসলামবীক্ষণের প্রায় অন্ত ভাগে এ-বিষয়ে কিঞ্চিৎ আলো ফেলা প্রয়োজন হবে।
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ১১
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ১০
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৯
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৮
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৭
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৬
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৫
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৪
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৩
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ২
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ১
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS