ইসলামবীক্ষণ : পুনর্বিবেচনার পুনর্বিবেচনা ১ || আহমদ মিনহাজ 

ইসলামবীক্ষণ : পুনর্বিবেচনার পুনর্বিবেচনা ১ || আহমদ মিনহাজ 

পরিশিষ্ট-১  / ইসলামবীক্ষণ : পুনর্বিবেচনার পুনর্বিবেচনা


শেষনবির যুগ অস্তমিত হওয়ার পর চিরায়ত নিয়মের ফেরে ইসলাম তার স্বকীয়তা হারিয়েছে। সম্প্রসারণের ঐতিহাসিক কালপর্ব থেকে উদ্দেশ্যমূলক অপব্যাখ্যার শিকার কোরান বর্ণিত ‘সরল দীন’-এর বরবাদি এখন আর অবোধ্য ঘটনা নয়। বারো ভূতের তেরো নাচের দশায় পতিত দীনের আদি স্বরূপ সংক্রান্ত অনুসন্ধান ও সেখানে ফেরত যাওয়ার তাগিদকে মাঝেমধ্যে যে-কারণে অরণ্যে রোদনের নামান্তর মনে হয়। ‘ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা’ লিখবার ক্ষণে রচনার সামগ্রিক অভিপ্রায় চিন্তা করে প্রসঙ্গটি পাশ কাটিয়ে গিয়েছিলাম। ঐতিহাসিক পথ পরিক্রমায় কোরানের আধ্যাত্মিক সারবত্তা উপলব্ধি ও তার অনুশীলনকে উপেক্ষার ফলে ইসলাম আচারসর্বস্ব আনুষ্ঠানিকতায় ডুবতে বসেছে কি-না সেই আলোচনায় শরিক হতে মন সায় দেয়নি। হাজার বছরের সংঘাতমুখর পটভূমিতে সক্রিয় ধর্মের প্রথাগত স্বরূপকে বাস্তবতা ধরে নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে সুবেদি যুক্তি ঠোকার ভাবনা সেখানে অগ্রাধিকার পেয়েছিল। পরস্পরবিরোধী তথ্যের জাল কেটে যৌক্তিক উপসংহারে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে নিজের এলেম নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্বের অন্ত ছিল না। মনে হয়েছে আরো প্রস্তুতি প্রয়োজন। সেই প্রস্তুতির পেছনে এখনো বেগার খাটার কারণে ‘ইসলামবীক্ষণ’-এর পরবর্তী পুনর্বিবেচনায় সহসা গমনের সম্ভাবনা দেখছি না। মস্তিষ্কের কোষে তরঙ্গিত ভাববীজগুলো টুকে রাখার প্রয়োজনে অগত্যা এই পরিশিষ্টের অবতারণা। হায়াতে যদি পাই তাহলে পরিশিষ্টে টুকে রাখা কথাগুলোকে কোনো একদিন পূর্ণাঙ্গ রচনায় রূপ দান সম্ভব হলেও হতে পারে।

‘ইসলামবীক্ষণ’-এর দ্বিতীয় পুনর্বিবেচনায় গমনের দিনক্ষণ ও পরিধি অনিশ্চিত হলেও কোরানকে অগ্রাধিকার দানের বিষয়টি সেখানে গুরুত্ব পাবে তাতে সন্দেহ নেই। মিথ বা অতিকাহিনির আবরণে ঢাকা প্রাচীন সভ্যতা বিশেষ করে সুমের, আক্কাদ, আসিরিয়া, ব্যাবিলন ও মিশর জুড়ে আবর্তিত সেমিটিক ঐতিহ্যের সঙ্গে কোরানের ঐতিহাসিক সংযুক্তির অনুসন্ধান সেখানে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে হয়তো। মার্কিন পদার্থবিদ হেইঞ্জ প্যাগেলসেরদ্য কসমিক কোড’ কিতাবের নাম তাই সময় থাকতে পরিশিষ্টে টুকে রাখতে চাইছি। অতিকাহিনির আবরণে ঢাকা সুমেরীয় সভ্যতায় সৃষ্ট পৃথিবীর আদি মহাকাব্য ‘গিলগামেশ’ আর মিশরীয় রাজন্যদের পরজাগতিক ভাবনার স্মারক ‘মৃতদের কিতাব’-এ সংকেতবন্দি বাস্তবতার ব্যাখ্যায় তাঁর আলোচনাপদ্ধতি অভিনব ছিল। ‘অফ গ্রামাটোলজি’ কিতাবে জাক দেরিদা মন্তব্য ঠুকেছিলেন, — অতিকাহিনিকে ঘিরে বিরাজিত ভাবনার জগৎটি হচ্ছে ধ্বংসস্তূপ, যার নিচে বিশেষ কালপর্বে সংঘটিত সামাজিক অভিসন্দর্ভরা (Social Discourses) নিথর দেহে শুয়ে থাকে; আবর্জনার স্তূপ সরিয়ে অচৈতন দেহকে সৃজনপ্রতিভার জাদুবলে পুনরায় জাগিয়ে তুলতে পারলে অতিকাহিনি নিমিষে বাস্তবিক আর সমসাময়িক হয়ে ওঠে। কোরান-পূর্ব দেশকালে বিরাজিত বাস্তবতার সঙ্গে ইসলামের সংযোগ ও বৈপরীত্যের দিশা পেতে হলে সেমিটিক সভ্যতার পৌরাণিক ইতিহাসপরম্পরাকে আমলে নেওয়া জরুরি। প্যাগেলসের কিতাব বলাবাহুল্য সেখানে প্রাসঙ্গিক বটে! পৌরাণিক বিবরণের আড়ালে বিদ্যমান সমাজ-ইতিহাসের সংকেত উদ্ধারে এই বিজ্ঞানীর সৃজনকুশলতা অতিকাহিনি পাঠের প্রথানুগ ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে পাঠককে সাহায্য করে। নতুন ভাবনার খোরাক যোগানোর কারণে অকালপ্রয়াত পদার্থবিদকে পরবর্তী গ্রন্থনায় প্রাসঙ্গিক করার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া তিন পর্বে বিন্যাস্ত পরিশিষ্টে যেসব প্রসঙ্গের অবতারণা ঘটেছে সেগুলোকে পরিশ্রুত উপসংহারে পৌঁছানোর প্রস্তুতিরূপে বিবেচনার জন্য পাঠকের প্রতি সবিনয় অনুরোধ থাকবে।

কোরানে লিপিবদ্ধ বিবরণের সঙ্গে বিশ্ব জুড়ে প্রচলিত ইসলামের সাদৃশ্য কতখানি সেই প্রশ্নটি পরিশিষ্ট লিখতে বসে মনে তরঙ্গ তুলছে। ইসলামের ঐতিহাসিক তাৎপর্য ব্যাখ্যায় রক্ষণশীল ও সংস্কারপন্থী বিদ্বানদের বিপরীতমুখী অবস্থান থেকে বোঝা যায় দীনচর্চার কাঠামো ও প্রণালি নিয়ে মতবিরোধের অবসান আজো ঘটেনি। ঐতিহ্যনিষ্ঠ পরিকাঠামোয় ইসলামচর্চার যৌক্তিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন, সংশয়, অস্বস্তি আর অসহিষ্ণুতায় যেমন ভাটা পড়েনি, ওদিকে কোরানের মৌলনীতির পরিপন্থী দল-উপদলে বিভক্ত ধর্মানুশীলনের প্রবণতাও সমানে বহমান। মতবিরোধের জের ধরে উগ্রতা বা দলাদলি কোরানসম্মত না হলেও এর ইতিবাচক দিক নেই এমনটি বলা যাবে না; দলাদলির ফলে সৃষ্ট সংঘাতের অবসান ঘটাতে ঐশী কিতাবের বহুমাত্রিক পাঠ ও ব্যাখ্যার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বিগত কয়েক দশক ধরে গুণীজনে আলোচনার পরিধি বেড়েছে, যেটি অতীতের তুলনায় বেশ ব্যাপক বলে একিন যেতে হয়। মানবজাতির করণীয় সম্পর্কে কোরানে সংকলিত বাণীর সারবত্তা উপলব্ধি করতে না পারলে ইসলামে প্রকটিত ব্যাধির উপশম সম্ভব নয়; — গত তিন দশক ধরে ভাবনাটি তীব্রতা লাভ করায় কোরানের প্রথাগত পাঠে নতুনত্ব চোখে পড়ে। ঐতিহাসিক মানদণ্ডে স্থির ইসলাম আর কোরানের সংবেদি পঠন থেকে নিষ্কাশিত ইসলামের মধ্যে বৈসাদৃশ্যের বিষয়টি ইসলামি শাস্ত্রবিদ ও বিদ্বানদের অনেকে এখন সামনে নিয়ে আসছেন। পরিপূর্ণ জীবনবিধান খ্যাত কিতাব কী কারণে যুগপ্রাসঙ্গিক তার সদুত্তর পেতে হলে নতুনত্বের এইসব সারাৎসার নিয়ে বিস্তারিত কথাবার্তা হওয়া প্রয়োজন। ‘ইসলামবীক্ষণ’-এর দ্বিতীয় গ্রন্থনায় সেই সংলাপে গমনের ইচ্ছে পরিশিষ্টে জানিয়ে রাখছি।

কোরানে লিপিবদ্ধ আয়াতের অর্থ লোকের বোধগম্য করতে এর প্রণেতা ও সংরক্ষক আল্লাহ নিজে যথেষ্ট, — এই বাক্যে অটল থেকে কোরান পাঠের অনুশীলন বিশ্বে কতটা বিদ্যমান সে-প্রশ্ন এইবেলা ওঠে। কোরানের ভাষাকাঠামোয় সংরক্ষিত বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় নিলে তার অর্থ উপলব্ধির প্রচলিত পদ্ধতিকে কেন যেন খাপছাড়া ও সাংঘর্ষিক ঠেকে। আয়াতের শানে নজুল বা মাহাত্ম্য ব্যাখ্যার ছলে গুচ্ছ-গুচ্ছ সন্দেহজনক হাদিস আর অতিরঞ্জিত তফসিরে ঠেকনা দিয়ে দাঁড়ানো (*এবং ভাষান্তরিত) কোরান সম্ভবত সেই কিতাব নয় যেটি প্রায় চৌদ্দশত বছর আগে ধরায় অবতীর্ণ হয়েছিল। অর্থ অবশ্য এই নয় লোকের অযাচিত হস্তক্ষেপের পাল্লায় পড়ে বাকি সব ঐশী কিতাবের ন্যায় সে তার স্বরূপ হারিয়েছে! কোরান সংকলনের ইতিহাস, তার ভাষাকাঠামো ও গাণিতিক বিন্যাস, বিষয়বস্তুর পুনরাবৃত্তি ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলির সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের ধারা বিষয়ক চলমান গবেষণার নির্যাস থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না নিজের আদি স্বরূপ নিয়ে যেমন থাকার কথা ছিল কোরান এখনো তা-ই রয়েছে। সুতরাং এই কিতাবকে যারা স্রষ্টাপ্রেরিত ঐশী বাণীর সমষ্টি বলে মানেন তাঁদের মনে এর অবিমিশ্র মৌলিকতা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের কারণ দেখি না। সমস্যার শিকড় অন্যত্র নিহিত। প্রাতিষ্ঠানিক উপায়ে আমজনতার নিকট কোরানকে ব্যাখ্যা বা তুলে ধরার ক্ষেত্রে ভ্রান্তি ও অজ্ঞতার সঙ্গে উদ্দেশ্যমূলক রাজনীতির বাড়াবাড়ি চোখে পড়ে! এই বাড়াবাড়ির কারণে স্রষ্টাপ্রেরিত বাণীর স্বরূপ উপলব্ধি ও সেই অনুসারে আমল করা এমনকি খোদ আরবিভাষী ব্যক্তির পক্ষে পাহাড় ঠেলার শামিল হয়ে দাঁড়ায়! কোরান ব্যাখ্যার প্রথাগত ধারায় নবতরঙ্গ কেন জরুরি তার বিস্তারিত আলোচনা পরিশিষ্টে সম্ভব নয় বিধায় আপাতত মুলতবির খাতায় তোলা থাকছে।

ইসলামের ঐতিহাসিক সম্প্রসারণের ফলাফল থেকে সৃষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক ইসলামের সঙ্গে কোরানে বর্ণিত ইসলামের অসংগতি উপলব্ধি করতে হলে হাদিসশাস্ত্রের পাঠ ও এর যৌক্তিক প্রয়োগকে আলোচনায় প্রাসঙ্গিক করা প্রয়োজনীয়। কথায় আছে হাড়িতে ফুটন্ত ভাতে টিপ দিলে অবশিষ্ট ভাতের খবর জানা হয়ে যায়। সুন্নি সহি সিত্তা ও শিয়া কিতাব-আল-আরবা-য় সংকলিত পরস্পরবিরোধী হাদিসগুলো অনেকটা সে-রকম! একটি হাদিসগ্রন্থের পাতা উল্টাতে শুরু করলে বাকিগুলোর হালত বুঝতে অসুবিধে হয় না। কোরানের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক (*প্রক্ষিপ্ত, আরোপিত, স্ববিরোধী ও বিকৃত) হাদিসের খোঁজখবর পাওয়ার জন্য ইসলামি চিন্তাবিদ তথা পণ্ডিত-গবেষক বিরচিত কিতাবের অভাব নেই বিশ্বে, অন্তর্জালের যুগে গুগুলিং ও ইউটিউবও যথেষ্ট কাজে দেয়। অতঃপর যেটি বাকি থাকে সেটি হলো মূল হাদিস গ্রন্থগুলোর সঙ্গে এইসব উৎস থেকে প্রাপ্ত বক্তব্যের সারবত্তা যাচাই করা, আর আকাশ-প্রযুক্তির যুগে কাজটি কঠিন কিছু নয়। হাদিস আকীর্ণ ও হাদিস বিবর্জিত কোরান ব্যাখ্যাকে ঘিরে ঝগড়ায় ব্যস্ত বিদ্বানদের খবর নেটে ঢু মারলে মিলে। বাদবিবাদের সারমর্ম থেকে যুক্তিসংগত কথা কে বলছেন আর কে কুযুক্তি দিচ্ছেন সেই সিদ্ধান্ত পাঠক নিজ বিবেচনা অনুসারে নেবেন এবং সেখানে হয়রান হওয়ার কারণ দেখছি না। কোরানের মর্মবাণী উপলব্ধির ঘটনায় প্রশ্নবিদ্ধ ও সন্দেহজনক হাদিসের সংখ্যা একেবারে কম নয়; এইসব হাদিসের ওপর ভর দিয়ে বেড়ে-ওঠা ইসলামি ব্যাখ্যাবিজ্ঞানের সৌধকে যৌক্তিক কারণে সহযোগী/সম্পূরকের পরিবর্তে বিপত্তি বলে মানার পেছনে শক্ত যুক্তি রয়েছে; ‘ইসলামবীক্ষণ’-এর আগমনী পর্বে সেদিকে গমনের আভাস পাঠককে আগেভাগে জানিয়ে রাখা উচিত মনে করি।

ইসলামের প্রচার-প্রসার ঘটানোর বাহানায় স্থূল ইহজাগতিক ফায়দা হাসিলে কোরানের ব্যবহার নতুন ঘটনা নয়। প্রাতিষ্ঠানিক ইসলামের প্রবক্তরা আল্লাহ ও মোহাম্মদকে যে-আঙ্গিকে আমজনতার নিকট উপস্থাপন করেন তার সুলুক কোরান চষে পাওয়া শক্ত। উদ্ভট অর্থ আরোপণের এই সমস্যা সত্ত্বেও নবুয়তের ঐতিহাসিক পরম্পরার সঙ্গে হযরত মোহাম্মদের সংযোগ উপলব্ধির সর্বোত্তম মাধ্যম হিসেবে কোরান ব্যতীত অন্য উৎসকে প্রাধিকার দানের সুযোগ ইসলামে কতটা রয়েছে সেটি বোধহয় যাচাই করা প্রয়োজন। ঐশী বাণীর বক্তব্য বুঝে ওঠা ও সেই অনুসারে আমল করতে হলে হাদিস-সিরা-তফসির তথা ইসলামি ব্যাখ্যাবিজ্ঞানের মতো সম্পূরক পাঠ্যবস্তুতে (Text) গমনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বৈকি, তবে সেগুলো ব্যবহারের সময় পাঠক কার দ্বারা (*মূল নাকি সম্পূরক) নিজের আকলকে প্রভাবিত ও নির্ধারিত হতে দিচ্ছেন সে-বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি।

কোরানে সংকলিত বাণীর ভাবসম্প্রসারণ ঘটানো সম্পূরক পাঠ্যবস্তুর কাজ। এখন সেটি যদি প্রতি পদে মূল বাণীর সঙ্গে ঝামেলা পাকায়, ব্যাখ্যার নামে কোরানকে একরৈখিক (Linear) ছকে নির্ধারণে মরিয়া হয়, সেক্ষেত্রে সম্পূরকে ভর করে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো আত্মঘাতি হতেও পারে। পরিতাপের বিষয় হলো সেমিটিক ধর্মের বিচারে কনিষ্ঠ ইসলামের পরিণতি এক্ষেত্রে পূর্বসূরী ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের থেকে পৃথক নয়। হাজার বছরের পথ পরিক্রমায় রচিত সম্পূরক পাঠ্যবস্তুর চাপ সামলাতে না পেরে ইসলামি দীনের অনুসারী সম্প্রদায়কে কোরান থেকে একপ্রকার দলছুট ও বহির্গামী দেখায়! পৃথিবীর অনধিক দুশো কোটি মুসলমান ইসলামমুসলমান শব্দে নিহিত সারবত্তা উপলব্ধি ও তার অনুশীলন করেন কি-না সেই জিজ্ঞাসা একাধিক কারণে মন থেকে মুছে ফেলা কঠিন হয়ে পড়ে :—

  • প্রাতিষ্ঠানিক ইসলামের কাঠামোয় কোরানে ব্যক্ত ‘ফিতরাত’-এর (Natural Disposition) মূল বৈশিষ্ট্যের নামনিশানা এখন খুঁজে পাওয়া ভার! মুসলমান সম্প্রদায় ‘ফিতরাত’ শব্দের ওজন ও পরিধি সম্পর্কে কতটা ওয়াকেবহাল সেই সন্দেহ মনে উঁকি দিয়ে যায়। মুসলমানের যে-সংজ্ঞা স্বয়ং কোরান নির্ধারণ করে তার অস্তিত্ব একদা ধরায় ছিল অথবা এখনো রয়েছে এমতো বাক্যে আস্থা রাখা অগত্যা সুবেদি পাঠকের ওপর কঠিন চাপ তৈরি করে!
  • সুন্নি, শিয়া, সালাফি, ওয়াহাবি বিচিত্র দল-উপদল ও মতবাদে বিভক্ত ইসলামে ফিতনা প্রকাশ্য রূপ ধারণ করায় মুসলমান নামে পরিচিত সম্প্রদায়কে ছদ্ম দীনের অনুসারীর ন্যায় আচরণ করতে দেখা যায়। দীনচর্চার মামলায় ফ্যাকশন বা দল-উপদলে বিভক্তির পরিণাম সম্পর্কে সতর্কবার্তা ঘোষণায় কোরান কার্পণ্য করেনি, তথাপি ইসলামের পরিণতি খ্রিস্টান ধর্মের থেকে ভালো কিছু হয়েছে সেটি জোর দিয়ে বলা কঠিন। মুসলমান সম্প্রদায় কালের গতিতে তেয়াত্তর দলে ভাগ হওয়ার কারণে তাদের মধ্যে একদল সঠিক ও জান্নাতি আর বাদবাকিরা ভ্রান্ত বা জাহান্নামি হবে; — হাদিস সূত্রে চাউর ভবিষ্যবাণীর সমর্থন কোরান ঘেঁটে পাওয়া যায় কি? হালজামানার গবেষণা কেবল অনুমান উঠায়, তেয়াত্তর আয়াতের সমষ্টি সূরা আহযাবের ৭১ থেকে ৭৩ নাম্বার আয়াতে সংকলিত বক্তব্যের ভ্রান্ত ও উদ্দেশ্যমূলক ব্যাখ্যা থেকে কোরান পরিপন্থী ফেরকায় মুসলমান সম্প্রদায়ের ভাগ হওয়ার কাহিনি জন্ম নিয়ে থাকতে পারে :—

যাহারা আল্লাহ ও রসুলের আনুগত্য করে তাহারা অবশ্যই মহাসাফল্য অর্জন করিবে।

আমি তো আসমান, জমিন ও পর্বতমালার প্রতি এই আমানত (*কোরান) পেশ করিয়াছিলাম, উহারা ইহা বহন করিতে অস্বীকার করিল এবং উহাতে শঙ্কিত হইল, কিন্তু মানুষ উহা বহন করিল; সে তো অতিশয় জালিম, অতিশয় অজ্ঞ।

পরিণামে আল্লাহ মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী এবং মুশরিক পুরুষ ও মুশরিক নারীকে শাস্তি দিবেন এবং মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীকে ক্ষমা করিবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

  • আহযাব; ৩৩:৭১-৭৩; উৎস : আল কোরান, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।

মুসলমান সম্প্রদায়ের তেয়াত্তর ফেরকায় বিভক্তি সংক্রান্ত হাদিসের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও এ-কথা সত্য, এক জাতির পরিবর্তে জাতিগত ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য সহকারে স্রষ্টা মানবপ্রজাতিকে সৃজন করেছিলেন। তাঁর পক্ষ থেকে একটি শর্ত সেখানে আরোপ করা হয়েছিল আর সেটি হলো শত বৈচিত্র্য সত্ত্বেও মানবজাতির স্রষ্টা কদাপি এক বিনে দুই নহে! যিনি সৃষ্টি করেন তিনি সংহার ঘটান। মৃত্যুর পর তাঁর নিকট সবাইকে ফেরত যেতে হবে। অতএব জন্ম-মৃত্যুর জনক বিধাতার একত্ব নিয়ে কেউ যেন সংশয় বা সেখানে দ্বিতীয় কাউকে শরিক না করে। মৌল এই বিধানকে যে-ব্যক্তি অস্বীকার করে এবং সীমালঙ্ঘন ঘটায় কোরানের পরিভাষায় সে হচ্ছে কাফের। শুধু তা-ই নয়, সীমালঙ্ঘন করায় তার স্বভাবে মুনাফিক ও মুশরিকের লক্ষণ প্রকট হয়ে ওঠে। সোজা কথা গোত্র-সম্প্রদায়-জাতি এমনকি দল-উপদলে বিভক্ত মানবপ্রজাতির বৈচিত্র্য স্রষ্টাকে উদ্বিগ্ন করে না, একে তাঁর সৃষ্টি-পরিকল্পনার অংশ গণ্য করা যেতে পারে :—

…ইচ্ছা করিলে আল্লাহ তোমাদেরকে এক জাতি করিতে পারিতেন, কিন্তু তিনি তোমাদেরকে যাহা দিয়াছেন তদ্দ্বারা তোমাদেরকে পরীক্ষা করিতে চান। সুতরাং সৎকর্মে তোমরা প্রতিযোগিতা করো। আল্লাহর দিকেই তোমাদের সকলের প্রত্যাবর্তন। অতঃপর তোমরা যে বিষয়ে মতভেদ করিতেছিলে, সে সম্বন্ধে তিনি তোমাদেরকে অবহিত করিবেন। — মায়িদা; ৫:৪৮

এইভাবে আমি তোমাকে পাঠাইয়াছি এক জাতির প্রতি যাহার পূর্বে বহু জাতি গত হইয়াছে, উহাদের নিকট তিলাওয়াত করিবার জন্য, যাহা আমি তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করিয়াছি।রাদ; ১৩:৩০

হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করিয়াছি এক পুরুষ ও এক নারী হইতে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করিয়াছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাহাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হইতে পারো। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তিই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকি। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল কিছু জানেন, সমস্ত খবর রাখেন। — হুজরাত; ৪৯:১৩; উৎস : আল কোরান, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।

ওপরে উদ্ধৃত আয়াতসমূহ থেকে বেশ বোঝা যায় সৃষ্টির স্বরূপ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে মানবজাতি যেন শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে সেই লক্ষ্যে বৈচিত্র্যকে তিনি অনুমোদন দিয়ে থাকেন এবং সেই ছকে জগৎকে সাজিয়ে তুলেছেন। স্রষ্টার সতর্কবার্তা এখানে মূলত সেইসব লোকের জন্য অমোঘ হয়ে আসে যারা তাঁর ঐশী বাণীকে হীন স্বার্থ চরিতার্থে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে এবং নিজেকে সঠিক ও অবশিষ্টদের ভ্রান্ত বলে দাগায়। তেয়াত্তর ফেরকার মামলা সেই পথ ধরে ইসলামে প্রবেশ করায় তাকে কোরান স্বীকৃত সুন্নাহর পরিপন্থী ভাবা ছাড়া উপায় থাকে না।

কোরানে প্রযুক্ত ‘সুন্নাহ’ শব্দের অর্থ উপলব্ধিতে তিনটি বিষয় বিবেচনা করা প্রয়োজন:-প্রথমত স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির জন্য যেসব কর্ম সম্পাদন করে থাকেন সেগুলো হচ্ছে স্রষ্টার ‘সুন্নাহ’; দ্বিতীয়ত স্রষ্টার একত্ব ও উপাসনার বাণী প্রচারে নিয়োজিত প্রচারকদের করণীয় সম্পর্কে স্রষ্টা যেসব কৃতকর্ম স্থির করে দিলেন সেগুলো হলো নবিদের ‘সুন্নাহ’; তৃতীয়ত নবিগণ অনুসৃত ‘সুন্নাহ’-র প্রকৃতি উপলব্ধি সহ ইহজাগতিক ও পরজাগতিক দায়িত্ব সম্পর্কে স্রষ্টা প্রেরিত বিধি-বিধানের সঠিক আমলকে মানবজাতির জন্য প্রযোজ্য ‘সুন্নাহ’ ভাবা যেতে পারে। এই ত্রিভুজের বাইরে মানব প্রণীত বা সংগৃহীত উৎসে সংকলিত ‘সুন্নাহ’-র অনুশীলনকে যৌক্তিকতা সহকারে যাচাই ও প্রয়োজনে পরিহার করা বিধেয়। ‘সুন্নাহ’-র বহুবচন ‘সুনান’-এর বেলায় একই কথা প্রযোজ্য। কোরানের অনুবাদক ও ভাষ্যকার এদিপ ইউকসেল হয়তো সে-কারণে মন্তব্য করেছেন :—

There is only one valid sunna (law, way) and it is God’s sunna. Those who follow Muhammad’s sunna or, more accurately, a man-made sunna falsely attributed to him, will be convicted to the sunna mentioned in 35:43. The singular word sunna is never used for other than God to denote a positive path; but its plural, sunan, is used once in a positive sense in connection to previous generations (4:26). — Source: The Quran: A Reformist Translation by Edip Yüksel, PDF Version, 2007

দ্রষ্টব্য : উইকসেল উদ্ধৃত সূরা ৩৫ ও ৪-এর ইসলামিক ফাউন্ডেশনকৃত বঙ্গানুবাদ :— ‘পৃথিবীতে ঔদ্ধত্য প্রকাশ এবং কূট ষড়যন্ত্রের কারণে। কূট ষড়যন্ত্র উহার উদ্যোক্তাদেরকেই পরিবেষ্টন করে। তবে কি ইহারা প্রতীক্ষা করিতেছে পূর্ববর্তীদের প্রতি প্রযুক্ত বিধানের? কিন্তু তুমি আল্লাহর বিধানের কখনো কোনো পরিবর্তন পাইবে না এবং আল্লাহর বিধানের কোনো ব্যতিক্রমও দেখিবে না। — ফাতির; ৩৫:৪৩; … ‘আল্লাহ ইচ্ছা করেন তোমাদের নিকট বিশদভাবে বিবৃত করিতে, তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতিনীতি তোমাদেরকে অবহিত করিতে এবং তোমাদের ক্ষমা করিতে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ — নিসা; ৪:২৬

এদিপের ভাষ্য মোতাবেক সূরা নিসা-র ২৬ নাম্বার আয়াতটি সম্ভবত একমাত্র যেখানে ‘সুনান’ (*ওয়া ইয়াহদিয়াকুম সুনানা-ল্লা-যীনা।) শব্দকে কোরান ইতিবাচক দৃষ্টিতে বিবেচনা করেছে, যেখানে মোহাম্মদের পূর্বসূরী কোনো মানবগোষ্ঠীর ভ্রান্ত সুন্নাহর অনুশীলনকে স্রষ্টা তাদের অজ্ঞতা বিবেচনায় ক্ষমা করে দিয়েছিলেন, অন্যথায় নবির দোহাই দিয়ে মানব রচিত/সংগৃহীত/সংকলিত ‘সুনান’ সম্পর্কে কোরান নেতিবাচক মনোভাব পোষণে অভ্যস্ত। ঠিক যে-রকম ‘সালাফি’ শব্দের প্রয়োগ কোরানে সচরাচর নেতিবাচক হয়েই আসে! এ-সংক্রান্ত আয়াতগুলোয় স্রষ্টা তাঁর প্রিয় বার্তাবহককে সেইসব জনগোষ্ঠীর কথা স্মরণ করিয়ে দেন যারা স্রষ্টা প্রেরিত বার্তাবাহকের কথায় বিশ্বাস করার পরিবর্তে নিজস্ব মত চালু করে বসে অথবা বাপদাদার সুবাদে পাওয়া বিশ্বাসকে যাচাই না করে সেখানে অটল থাকে।

সে যা-হোক, এদিপ উদ্ধৃত সূরা ফাতিরনিসা-র আয়াতনিচয় থেকে বোঝা যায় নবির সুন্নাহ এমন নয় যে সেটি মোহাম্মদের সময়ে হঠাৎ চালু হয়েছিল। কোরানের বয়ান অনুসারে নবিগণ অনুসৃত সুন্নাহ পারম্পরিক ঘটনার ফসল। হযরত আদমের মর্ত্যবাসের দিন থেকে এর সূচনা ঘটেছিল। ইব্রাহিমের যুগে এসে নবি ও মানবজাতির জন্য পালনীয় সুন্নাহকে স্রষ্টা পরিপূর্ণতা দান করেন এবং পরবর্তী সকল নবি এর অনুসরণ ও প্রচারে নিয়োজিত ছিলেন :—

এবং জিহাদ করো আল্লাহর পথে যেভাবে জিহাদ করা উচিত। তিনি তোমাদেরকে মনোনীত করিয়াছেন। তিনি দীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোনো কঠোরতা আরোপ করেন নাই। ইহা তোমাদের পিতা ইব্রাহিমের মিল্লাত। তিনি পূর্বে তোমাদের নামকরণ করিয়াছেন ‘মুসলিম’ এবং এই কিতাবেও; যাহাতে রসুল তোমাদের জন্য সাক্ষীস্বরূপ হয় এবং তোমরা সাক্ষীস্বরূপ হও মানবজাতির জন্য। সুতরাং তোমরা সালাত কায়েম করো, যাকাত দাও এবং আল্লাহকে অবলম্বন করো; তিনিই তোমাদের অভিভাবক, কত উত্তম অভিভাবক এবং কত উত্তম সাহায্যকারী তিনি। — হাজ; ২২:৭৮

তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করিয়াছেন দীন যাহার নির্দেশ দিয়াছিলেন তিনি নূহকে, আর যাহা আমি ওহি করিয়াছি তোমাকে এবং যাহার নির্দেশ দিয়াছিলাম ইব্রাহিম, মূসা ও ঈসাকে, এই বলিয়া যে, তোমরা দীনকে প্রতিষ্ঠিত করো এবং উহাতে মতভেদ করিও না।… — শূরা; ৪২:১৩; উৎস : আল কোরান, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।

সুতরাং যে-ব্যক্তি সুন্নাহর সারার্থ উপলব্ধি ও পালনে আগ্রহী তাকে এর নমুনা কোরান থেকে খুঁজে নিতে হবে। এর বাইরে লিপিবদ্ধ উৎস যদি কোরানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয় সেক্ষেত্রে ঐশী কিতাবের সম্পূরক হিসেবে একে তিনি আমলে নিতে পারেন। অন্যদিকে কোরানের নিক্তিতে যৌক্তিক বা গ্রহণযোগ্য নয় এরকম উৎসকে সুন্নাহ রূপে স্বীকৃতি দান ও এর অনুশীলন সীমালঙ্ঘন ছাড়া অন্য কিছু নয়; যার ফলস্বরূপ বাহাস, বিভাজন ও সংঘাতের উত্থান রোধ করা কঠিন হয়। হাদিস শাস্ত্রে সংকলিত ‘সুনান’ চর্চায় বাছবিচারহীন প্রবণতা অগত্যা কতটা কোরানসম্মত সেই জিজ্ঞাসা মনে চেপে বসে।

  • দু-জাহানের স্রষ্টা আল্লাহর একত্ব, তাঁর সৃষ্টিপরিকল্পনা ও উদ্দেশ্য বিবেচনায় নবির মর্যাদা নিরূপণে উৎসাহী ব্যক্তি, জনগোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠান খোদ স্রষ্টার সঙ্গে মোহাম্মদকে এমনভাবে জুড়ে নিয়েছেন যেটি কোরানের সঙ্গে খাপ খায় না। হিন্দু থেকে শুরু করে সকল ধর্মে মানবরূপী অবতার (Demigod) বা পথপ্রদর্শককে স্রষ্টাতুল্য গুণাবলি আরোপণের মাধ্যমে প্রতিমায়নের (Idolization) প্রতীক রূপে বারবার নিলামে উঠানো হয়েছে; বলতে দ্বিধা নেই চিরাচরিত এই বৃত্তে ইসলামের অনুপ্রবেশ রোধ করা সম্ভব হয়নি। মোহাম্মদ প্যারালাল গড না হলেও একাধিক সন্দেহজনক হাদিস, প্রশ্নবিদ্ধ সুন্নাহর অনুশীলন আর অতিরঞ্জিত ব্যাখ্যার চাপে সাবর্ডিনেট গড রূপে মুসলমান মানসে অকাট্য হয়ে উঠেছেন। কোরানে স্রষ্টা বলতে একজনকে বোঝানো হয়েছে। ওদিকে হযরত আদম থেকে সর্বশেষ নবি পর্যন্ত বিস্তৃত কুলুজিতে একের তুলনায় অন্যজনকে উচ্চতর মর্যাদা প্রদান কোরান যেভাবে নবিদের উপস্থাপন করে থাকে তার সঙ্গে ঝামেলা পাকায় :—

বলো, ‘আমি কোনো নতুন রসুল নই। আমি জানি না, আমার ও তোমাদের ব্যাপারে কী করা হইবে; আমি আমার প্রতি যাহা ওহি করা হয় কেবল তাহারই অনুসরণ করি। আর আমি তো এক স্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র।’ — আহকাফ; ৪৬:৯; উৎস : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।

সুতরাং নবিগণের মধ্যে তুলনা-প্রতিতুলনা অর্থাৎ একজনকে অন্যজনের থেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণের প্রবণতা ডেমিগড বা নরদেবতা রূপে তাঁদেরকে উপাসনার ঝুঁকি সৃষ্টি করে। স্রষ্টার পরিকল্পনা অনুসারে ধরায় নবিদের প্রেরণ করা হয় এবং সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও মানবজাতির করণীয় সম্পর্কিত বাণীর প্রচারে তাঁরা নিবেদিত থাকেন। এই ইতিহাসচেতনার আলোয় সকল নবিকে তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা প্রদান ও ধর্মচর্চায় তাঁরা যেসব উদাহরণ রেখে গিয়েছেন সেগুলো অনুসরণের আহবান কোরানে ফিরে-ফিরে ব্যক্ত হয়েছে। ইসলামি ব্যাখ্যাবিজ্ঞানকে এখানেও গোলমাল পাকাতে দেখি। মোহাম্মদের গুণাগুণ নিরূপণের ক্ষণে তাঁকে নরদেবতার আদল দানের প্রবণতা প্রশ্নবিদ্ধ একাধিক হাদিস থেকে শুরু করে ইসলামিশাস্ত্রের সকল উৎসে কমবেশি চোখে পড়ে। নবির গুণাগুণ ও কর্মপরিধি সম্পর্কে কোরানের বিবরণের সঙ্গে বিষয়টি প্রকারান্তরে সাংঘর্ষিক হওয়ার ফলে ইসলামবেত্তাদের সতর্কতা সহকারে একে যাচাই করা উচিত।

  • ইকুয়ালিটি (Equality) বা সমতা নয় বরং ইকুইটি (Equity) অর্থাৎ ন্যায্যতার ভিত্তিতে ধর্মানুশীলন ও ইহজাগতিক দায়িত্ব পালন বিষয়ে জরুরি দিকনির্দেশনা প্রদানে কোরান কৃপণতা করেনি। মানুষকে ন্যায়সংগত আচরণের শিক্ষা দিতে মোহাম্মদকে নবি করে ধরায় পাঠানো হয়েছিল। ন্যায্যতার বনেদ সম্পর্কে আরব তথা সমগ্র মানবজাতিকে অবহিত করা ও সেটি প্রতিষ্ঠার উপায় সম্পর্কে কোরানে কোনো অস্পষ্টতা রাখা হয়নি। আল্লাহর একত্ব এবং মৃত্যুর পর তাঁর নিকট প্রত্যাবর্তনে বিশ্বাস মুসলমান হওয়ার প্রাথমিক শর্ত। বাদবাকি বিষয়গুলো যেমন ধরা যাক সালাত, সিয়াম, হজ, সদকা, যাকাত থেকে শুরু করে মানুষের জীবনে সংঘটিত সকল ক্রিয়াচার পালনে ন্যায্য আচরণ প্রদর্শনের কথা স্বয়ং নবি ও তাঁর অনুসারী মানবজাতিকে ফিরে-ফিরে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোরান যেহেতু লোকদেখানো ধার্মিকতাকে সমর্থন করে না, সংগত কারণে শান্তি ও সামাজিক সুস্থিতি রক্ষায় মানুষের সকল ক্রিয়াকর্মে বাড়াবাড়ি বা সীমালঙ্ঘনের পরিবর্তে ভারসাম্য বজায় রেখে চলা ইমানের লক্ষণ হিসেবে সেখানে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়ে থাকে।

জীবন-জীবিকা, বিষয়-সম্পত্তির বণ্টন, নারী-পুরুষের সম্পর্ক, বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদ, অবৈধ সম্পর্ক বা ব্যাভিচার, খাদ্য ও লেবাস, প্রাকৃতিক সম্পদ ও তার ব্যবহার, দুস্থ-অসহায়-দরিদ্র লোকজনের অভাব মোচনে বিত্তবানের করণীয় থেকে শুরু করে সামগ্রিক সৃষ্টি জগতের সঙ্গে ব্যক্তির আত্মিক সংযোগ উপলব্ধি ও কৃতকর্তব্য পালনে ন্যায্যতার শর্ত মেনে চলাকে কোরান আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যের সারবস্তু রূপে গণ্য করে। ব্যক্তির আচরণে যদি এই সৌন্দর্যের বিচ্ছুরণ না ঘটে তবে হাদিস প্রভাবিত ব্যাখ্যাবিজ্ঞানের ছকে বোনা পঞ্চ স্তম্ভ ও শরিয়তের আমল বকধার্মিকতার নামান্তর, আর এরূপ বকধার্মিক তথা মুনাফিকের নিন্দায় কোরান রাখঢাক করেনি। সহস্র বছরের ধর্মানুশীলনে মুসলমান সম্প্রদায় কোরান স্বীকৃত ইকুইটি বা ন্যায্যতাকে অন্তরে স্থান দিয়ে স্রষ্টার আরাধনায় লিপ্ত ছিলেন কি? একুশ শতকের যুগবিশ্বে পঞ্চস্তম্ভের আমলে নিবেদিত মুসলমানের জীবনাচারে ন্যায্যতার পরিচয় কি ফুটে ওঠে? পরবর্তী বিবেচনার জন্য পরিশিষ্টে প্রশ্নগুলো রেখে যেতে চাই।

  • পরিতাপের বিষয় হলো ইসলামি জীবনব্যবস্থার বনেদ রচনার যজ্ঞে মাযহাব নির্ধারিত আইনি বিধান অনুসরণের চাপে কোরানের মৌলনীতি বিস্মৃতির গর্ভে তলিয়ে যেতে বসেছে! মোহাম্মদ ও তাঁর দলভুক্তরা যে-ইসলাম চর্চায় একদা নিবিষ্ট ছিলেন তার সঙ্গে বিশ্ব জুড়ে চর্চিত ইসলামের আকাশ-পাতাল পার্থক্য ঘটে গিয়েছে। বর্তমান যুগবিশ্বে চর্চিত ইসলাম মূলত রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থে সৃষ্ট আনুষ্ঠানিক দীনচর্চার স্মারক, যার মধ্যে কোরানের আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যের ছাপ অণুবীক্ষণ যন্ত্রেও ধরা কঠিন! বিষয়টি কোরানের সেই আয়াত মনে করতে বাধ্য করে যেখানে রাব্বি এজরা ওরফে উযায়র তাওরাতের বারোটা বাজিয়েছিলেন বলে স্রষ্টা তাঁর নবিকে সতর্ক করেছিলেন :—

ইয়াহুদিরা বলে, ‘উযায়র আল্লাহর পুত্র’ এবং খ্রিস্টানরা বলে, ‘মসিহ্ আল্লাহর পুত্র।’ উহা তাহাদের মুখের কথা। পূর্বে যাহারা কুফরি করিয়াছিল উহারা তাহাদের মতো কথা বলে। আল্লাহ উহাদেরকে ধ্বংস করুন। আর কোনো দিকে উহাদেরকে ফিরাইয়া দেওয়া হইয়াছে! — তাওবা; ৯:৩০; উৎস : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।

ইতিহাসে লেখে তাওরাতে ব্যক্ত ফিতরাতের বিনষ্টি রাব্বি এজরার কল্যাণে সেই সময় ত্বরান্বিত হয়েছিল! সেন্ট পল যিশুর বাণীকে অজাচারে বিনষ্ট করেছিলেন এবং ফিতরাত সেখানেও নিখোঁজ। ওদিকে শুষ্ক ধর্মানুশীলনের চাপে কোরানের আধ্যাত্মিক স্ফুরণ অবভাস বা মিথ্যাজ্ঞানের ছায়ায় ঢাকা পড়েছে। মিথ্যাজ্ঞানের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি কি করে মুমিন ও মুত্তাকি গণ্য হতে পারে? প্রশ্নটি পরিশিষ্টে তোলা রইল, যেন পরবর্তী গ্রন্থনায় এসব নিয়ে ভাবার অবকাশ জোটে।

এইসব কার্যকারণ দোষে ইসলামের প্রকৃত নির্যাস এমনকি কোরান খুলে ঠিকঠাক ধরতে পারা কঠিন! সম্পূরক টেক্সট শাসিত কোরানের ভাষান্তর ও ব্যাখ্যায় উদ্দেশ্য প্রণোদিত অর্থারোপ নিয়ে যাঁরা অবিরত প্রশ্ন তুলছেন তাঁদের যুক্তিধারা তাই বিবেচনার সময় হয়েছে। অন্যথায় এইসব টেক্সটের হাতে ইসলামের অপব্যাখ্যা, উল্টাসিধা অর্থ আরোপণ, ত্রুটিপূর্ণ তরজমা, স্রষ্টা-উপাসনার অজুহাতে কদাচারের অনুশীলন ইত্যকায় চাপে কোরানকে মরুভূমিতে পরিণত করার প্রথায় লাগাম টানা সম্ভব নয়। সূরা ইব্রাহিম-র ২২ নাম্বার আয়াত (*ঐতিহ্যপন্থী বিদ্বান ইয়াসির কাদির আয়াতটিকে রোজহাশরের ময়দানে শয়তানের খুতবা রূপে ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন।) এ-প্রসঙ্গে চকিত স্মরণ করা যেতে পারে :—

যখন বিচারকার্য সম্পন্ন হইবে তখন শয়তান বলিবে, আল্লাহ তো তোমাদেরকে সত্য প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন, আমিও তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলাম, কিন্তু আমি তোমাদেরকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করিয়াছি। আমার তো তোমাদের উপর কোনো আধিপত্য ছিল না, আমি কেবল তোমাদেরকে আহবান করিয়াছিলাম এবং তোমরা আমার আহবানে সাড়া দিয়াছিলে। সুতরাং তোমরা আমার প্রতি দোষারোপ করিও না, তোমরা নিজেদেরই প্রতি দোষারোপ করো। আমি তোমাদের উদ্ধারে সাহায্য করিতে সক্ষম নই এবং তোমরাও আমার উদ্ধারে সাহায্য করিতে সক্ষম নও। তোমরা যে পূর্বে আমাকে আল্লাহর শরিক করিয়াছিলে আমি তাহা অস্বীকার করিতেছি, জালিমদের জন্য তো মর্মন্তুদ শাস্তি রহিয়াছে। — সূরা ইব্রাহিম; ১৪:২২; উৎস : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।

এই আয়াতের মর্মার্থ আলোচনা কেন জরুরি সেটি অবধানে পরিশিষ্ট যথেষ্ট নয়, সংগত কারণে আগামী পুনর্বিবেচনার বিষয়টি নিয়ে আলাপে গমন সমীচীন মনে করি।

হাজার বছরের ইতিহাসে কোরান অবিকৃত থাকলেও জনমানসে এর ব্যাখ্যা ও ভাষান্তর থেকে সৃষ্ট পাঠ্যবস্তুর প্রভাব শেষ নবিকে বহুল পরিমাণে পাল্টে দিয়েছে। কোরানের মর্মবাণীর সঙ্গে বিসদৃশ হাদিসকে আয়াত ব্যাখ্যার উৎস রূপে ব্যবহারের প্রবণতা সিংহভাগ তফসির প্রণেতা ও গবেষক-আলোচকদের গ্রন্থে কমবেশি চোখে পড়ে। মৌখিক পরম্পরায় সংগৃহীত এইসব হাদিসের গ্রহণযোগ্যতা কোরানের নিক্তিতে যাচাইয়ের পরিবর্তে উল্টো তাদেরকে দিয়ে কোরান ব্যাখ্যার ঐতিহ্যে গমনের পর সুবেদি পাঠক আল্লাহর প্রিয় বার্তাবাহককে যুদ্ধপরায়ণ, ঈর্ষাকাতর, সেক্সিস্ট ছাড়া অন্য বিশেষণে ভাবতে অপারগ হয়ে পড়ে! এর পাশাপাশি একাধিক ঘটনায় তাঁর আচরণকে পাঠক স্ববিরোধী ও ভীতিপ্রদ ভাবতে বাধ্য হয়। অথচ কোরানের মৌলবাণীর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হাদিসগুলো মাথা থেকে বিদায় করে সে যখন কোরানে গমন করে তখন স্রষ্টার বাণী প্রচারে নিবেদিত মোহাম্মদের প্রকৃত স্বরূপ তার চেতনায় তরঙ্গ বহায়। বক্ষ্যমান পরিশিষ্টের রচয়িতা নিজে সেই অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যাচ্ছে বলে কথাগুলো জানিয়ে রাখা।

ইসলামি ব্যাখ্যাশাস্ত্রের জগতে সক্রিয় টেক্সটগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে যে-ব্যক্তি কোরান হাতে নিচ্ছেন কেবল তার পক্ষে কিতাবে বর্ণিত আল্লাহ ও মোহাম্মদের প্রকৃতি সম্যক উপলব্ধি করা হয়তো সম্ভব। এই পাঠ তাকে ধরতে শেখায় আল্লাহ তাঁর গুণের মাঝারে নিহিত সারবস্তু দিয়ে সৃষ্টিকে কেন সৃজন করেছিলেন। তার তখন বুঝতে কষ্ট হয় না কী কারণে লোকে তাঁকে দুনিয়া ও আখেরাতের রব বলে মানে আর কেন সৃষ্টিকে তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। কোরানের প্রত্যাদেশে ব্যক্ত বার্তার পুনরাবৃত্তি, সুরাগুলোর বিন্যাসগত অসংলগ্নতা অথবা ঘটনা ও বিষয়বস্তুর একঘেয়ে ছকে আবর্তনের কার্যকারণকে সে তখন বিশ্লেষণ করতে শিখে। পরিতাপের বিষয় হলো কোরানের আয়াত ব্যাখ্যায় সেইসব হাদিসের ব্যবহার ব্যাপক নয় যেগুলো এই কিতাব কী কারণে ঐশী-মরমি-সংবেদি ও অধ্যাত্মচেতনায় সমৃদ্ধ ইত্যাদি বোঝার ক্ষেত্রে পাঠকের সহায় হতে পারে।

সামাজিক ও রাজনৈতিক লক্ষ্য চরিতার্থে ধর্মকে উপযোগ রূপে ব্যবহারের প্রবণতা সমগ্র মধ্যযুগে তীব্র ছিল। কোরানের সঙ্গে প্রতিপদে সাংঘর্ষিক দীনী বয়ান প্রতিষ্ঠার স্বার্থান্ধ বাসনা ইসলাম সম্প্রসারণের দিনগুলোর সঙ্গে বিদায় নিয়েছে এমনটি ভাবার অবকাশ নেই। মসনদ কেন্দ্রিক রাজনীতির ছকে কোরানের ব্যাখ্যা ও উদ্দেশ্যমূলক প্রয়োগের ইতিহাসে লোভী-দুর্বিনীত শাসক থেকে শুরু করে দীনী শিক্ষায় শিক্ষিত ইসলামবেত্তাদের সম্পৃক্তি নতুন ঘটনা নয়। আশআরি, খারাজি, মোতাজিলা, মাতরুদি প্রমুখ দার্শনিক মতবাদ, ফিকাহ বা আইনি কাঠামোর উৎস রূপে গণ্য মাযহাব আর মধ্যযুগের কালপর্বে বিকশিত ব্যাখ্যাবিজ্ঞান ইসলামের মসনদ কেন্দ্রিক রাজনীতির ছায়াতলে বেড়ে উঠায় পরবর্তীতে ফিতনার ভরকেন্দ্রে পরিণত হয়। ইসলামের স্বর্ণযুগে আবিভূর্ত বিদ্বানরা কোরানপাঠে ভেজাল মিশানোর পক্ষে ছিলেন তা নয়। দীনের স্বরূপ অনুসন্ধানে পরস্পরের বিপরীত স্রোতে গমন করলেও সে-যুগে আল-কিন্দি, ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ, আল ফারাবি, ইমাম গাজ্জালি, ইবনে আরাবি কিংবা ইবনে খলদুনের মতো উচ্চমানের চিন্তকগণের কোরান ব্যাখ্যায় সামঞ্জস্য ধরে রাখার চেষ্টা পাঠকের নজর এড়ায় না। কতক ক্ষেত্রে তাঁরা হয়তো র‌্যাশনাল থাকতে পারেননি, অনেক সময় সংবেদনশীলতার পরিচয় রাখতে বিফল হয়েছেন, সুবেদি ভারসাম্যে ঘাটতিও কমবেশি চোখে পড়ে, তথাপি তাঁদের ব্যাখ্যাশাস্ত্রে ইহজাগতিক কিংবা পরজাগতিক বিষয়ের আলোচনায় কোরানকে মূল উৎস গণ্য করার প্রবণতা চোখে পড়ে। আল্লাহ ও তাঁর বার্তাবাহককে হৃদয়ে ধারণের জন্য হাদিস, সিরা বা মাযহাব প্রসূত আইনি পরিকাঠামোকে বিবেচনা করলেও সেটি তাঁদের রচনার মূল লক্ষবস্তুকে নিয়ন্ত্রিত বা প্রভাবিত করেনি; — ইসলামি জ্ঞানতত্ত্বের হালফিল আলোচনায় বিষয়টি বোধহয় খেয়াল রাখা প্রয়োজন।

ইজতিহাদ বা ব্যক্তির ধীশক্তির সাহায্যে কোরান ব্যাখ্যায় গমন করতে হলে সৃজনী-প্রতিভা আবশ্যক হয় এবং একালের বিদ্বানদের মাঝে এর ঘাটতি চোখে পড়ে! এটি হচ্ছে সেই কিতাব যেখানে বিষয়বস্তুর পৌনঃপুনিক পুনরাবৃত্তি ও আপাতদৃষ্ট অসলংগ্নতার যৌক্তিক কার্যকারণ রয়েছে। উক্ত বিষয়ে ধারণা পেতে আগ্রহী পাঠক ইসলামগবেষক নিল রবিনসন রচিত Discovering the Qur’an: A Contemporary Approach to a Veiled Text কিতাবখানা পাঠ করতে পারেন। সে যাহোক, সূরা ইয়াসিন-এ স্রষ্টা মানবজাতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন :—

আমি রসুলকে কাব্য রচনা করিতে শিখাই নাই এবং ইহা তাহার পক্ষে শোভনীয় নয়। ইহা তো কেবল এক উপদেশ এবং সুস্পষ্ট কোরান; — ইয়াসিন; ৩৬:৬৯; উৎস : আল কোরান, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলোদেশ।

‘ইন্ হুওয়া ইল্লা যিকরুন ওয়া কুরআনুম মুবিন’ অর্থাৎ This is a reminder and clear Quran — সূরা ইয়াসিনের আয়াতাংশে ‘দাল কাফ রা’ ধাতুমূল থেকে নিষ্পন্ন যিকর/যিকরুন শব্দটি বিশেষ্য/ভাববিশেষ্য রূপে স্মরণ করা (Reminder, Remembrance) ও বার্তা প্রচার (Message) অর্থে অনধিক দুইশত বিরানব্বই বার কোরানে ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলা ভাষান্তরে Reminder সচরাচর শ্রুতিমাধুর্য রক্ষায় ভাববাচ্যে উপদেশ অর্থেই অনূদিত হয়ে থাকে। যিকরুন হচ্ছে চাবি, যার মাধ্যমে স্রষ্টা কোরানের মৌল উদ্দেশ্য মানবজাতির কাছে স্পষ্ট করছেন। ইসলামিশাস্ত্রের অতিকায় জগতে অল্প সংখ্যক বিদ্বানের সুলুক মিলে যাঁরা কোরানের নিরিখে যিকরুন শব্দের তাৎপর্য ব্যাখ্যায় সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রাখতে পেরেছেন!

অনুসন্ধানী জ্ঞানচর্চা তথা ক্রিটিক্যাল থিংকিংকে বিপজ্জনক ভাবার প্রবণতা সকল যুগে কমবেশি প্রবল হলেও সেকালের তুলনায় একালকে অধিক রক্ষণশীল মানতে হয়। এ-কথা ঠিক কথায়-কথায় শিরচ্ছেদ ও শারীরিক নির্যাতনের মাত্রা কমে এলেও ‘কাফের, মুরতাদ’ ঘোষণা, হত্যার হুমকিধামকি অথবা দেশ থেকে বিতাড়িত হতে বাধ্য করার ঐতিহ্যে আজো ছেদ পড়েনি। ইসলামের রাজনৈতিক সম্প্রসারণের যুগসন্ধিক্ষণে মৌখিক উৎস থেকে প্রাপ্ত কাহিনির বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশের পাশাপাশি সাংঘর্ষিক হাদিসের সাহায্যে কোরান ব্যাখ্যার প্রবণতাকে ইমাম মহিউদ্দিন আল’আশআরি, নাফিস শাহরেস্তানি, শারিক আলায়ি মুতা’জালি, আব্দুল্লাহ জানজানি এবং রাগিব আল-ইস্পাহানির মতো যুক্তিবিদরা প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন। কওমের চেতনায় ফিতনা সৃষ্টির অপরাধে তাঁদেরকে ক্রুশবিদ্ধ নয়তো শিরচ্ছেদে হত্যা করা হয়েছিল। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অপরাধে সতেরো শতকে জিওর্দানো ব্রুনোকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার ঘটনা সকলের জানা! যদিও অধুনা মুসলিম বিশ্বে বিস্মৃতপ্রায় শেখ মোহাম্মদ তাহির আল-মাক্কিকে সেই পঞ্চম শতকের মধ্যভাগে পুড়িয়ে মারা হয়! কোরান ব্যাখ্যায় মোল্লাশাসিত প্রাতিষ্ঠানিক প্রবণতা নিয়ে পরিহাস করেছেন এই অভিযোগে মাক্কিকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার ফতোয়া জারি হয়েছিল তখন।

ঐতিহ্যপন্থীদের মাত্রাতিরিক্তি হাদিসপ্রীতি ও কোরানের তোতাপাখিসুলভ ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে ইসলামের স্বর্ণযুগ থেকে এখন অবধি যারা আওয়াজ তুলেছেন তাদেরকে ‘কাফের’ নয় ‘মুরতাদ’ ঘোষণা অথবা দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। সেই তালিকায় ইবনে রুশদ, ইবনে সিনা, ইয়াহিয়া ইবনে হাবাশ সোহরাওয়ার্দি থেকে শুরু করে হামিদুদ্দিন ফারাহি, মুফতি মোহাম্মদ আব্দুহ, জালালুদ্দিন আফগানি, আল্লামা ইকবাল, মোহাম্মদ আসাদ, এনায়েত উল্লাহ খান মাশরিকি, মরিস বুকাইলি, আব্দুস সালামের মতো স্মরণীয় ব্যক্তিরা রয়েছেন। বিগত তিন দশকের পটপ্রবাহে ভ্রমণ করলে দেখা যায় কোরানের নিক্তিতে হাদিস ও সুন্নাহর প্রাসঙ্গিকতা পরখ করার পক্ষে সোচ্চার হওয়ার অপরাধে বিশ্ব জুড়ে বিদ্বানদের হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে। মুসলমানের পালনীয় সুন্নাহ অনুশীলনে কোরান ব্যতীত অন্য উৎসের ব্যবহার নিয়ে বিরূপ মনোভাব পোষণের দায়ে অভিযুক্ত ভারতের কেরালানিবাসী আলেম চাকনূর মাওলভি আশির দশকের শুরুতে নিখোঁজ হন এবং পরে তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয় উগ্রপন্থীরা তাঁকে প্রথমে গুম ও পরে হত্যা করেছিল।

মিশরের খ্যাতনামা বিদ্বান ও ধর্মতত্ত্ববিদ নসর হামিদ আবু জায়েদকে একইভাবে কট্টরপন্থী শরিয়া কোর্ট মুরতাদ অর্থাৎ নিজ ধর্ম ত্যাগ করেছেন এই অভিযোগে স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটানোর ডিক্রি জারি করে। ইসলামে বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাজীবীদের কোরানচর্চার প্রবণতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা জায়েদের জন্য কাল হয়েছিল। প্রতিষ্ঠান কর্তৃক স্বীকৃত ছকে ধর্মের অনুশীলন তার সারল্য, স্বকীয়তা ও স্বতঃস্ফূর্ততাকে হত্যার সঙ্গে নিছক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উপজাতে (Cultural and political byproduct) পরিণত হয়। ইসলাম ধর্মের ইতিহাস অনুসরণ করলে কোরানকে সাংস্কৃতিক উপজাত ব্যতীত অন্য কিছু ভাবা কেন কঠিন হয়ে পড়ে সেই কথাগুলো জায়েদ তাঁর গবেষণায় বলার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর এই ব্যাখ্যা বলাবাহুল্য ইসলামের ভূত-ভবিষ্যৎ নির্ধারণে তৎপর প্রাতিষ্ঠানিক বলয় ও সেখানে সক্রিয় মুফতি-আলেম-মুহাদ্দিস থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্টজনকে খুশি করতে পারেনি। জায়েদের বক্তব্যে কোরানের অপব্যাখ্যা, শরিয়ার মারাত্মক লঙ্ঘন ও ইসলামবিরোধী কুফরি কথাবার্তার সন্ধান পেতে তাদের কালবিলম্ব ঘটেনি। মানবিক ব্যাখ্যাবিজ্ঞানের আলোয় কোরান পাঠের জায়েদকৃত প্রস্তাবনাকেও তাঁরা যথারীতি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন! অতঃপর যা হয়ে থাকে সেটির পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল, — কোরান অবমাননার অভিযোগে তাঁর ওপর মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া জারি হয়। প্রাণে বাঁচতে উদারপন্থী কোরানগবেষক নেদারল্যান্ডসে পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরে দেশে ফিরলেও মানসিক চাপে জীবনশক্তি হারিয়ে ফেলা জায়েদ কিছুদিন পর পরপারে পাড়ি জমান। কেবল নসর আবু জায়েদ নন, গত তিন-চার দশকে ঐতিহ্যপন্থী বিদ্বানদের কোরান পাঠ ও ব্যাখ্যার ধারা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় মোস্তফা ইসলামাওলু, ক্যানার তসলমান, গোলাম আহমদ পারভেজ, জাভেদ আহমদ গামিদি, শেহজাদ সেলিম, ড. শব্বির আহমেদ, ড. খালিদ জহির … সোজা কথা কারো যেন রেহাই মিলছে না!

অনুসন্ধিৎসা ও মুক্তচিন্তাকে দমিয়ে রাখার প্রবণতা থেকে মূলত প্রথানুগ ব্যাখ্যার জগতে পাক খাওয়ার অভ্যাস মুসলমানের মনোজগতে অটল রূপ নিয়েছে। আমজনতার মনস্তত্ত্বে এর সফল প্রয়োগ সেই রাজনীতির জন্ম দিয়েছে যেটি কোরান বর্ণিত পরমত সহিষ্ণুতার ধারা বোঝার চাইতে এর ওপর ভ্রান্ত অর্থ আরোপণকে অধিক প্রীতিকর ভাবে! ইসলামের জ্ঞানতাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় ভ্রান্ত ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত অর্থারোপের যজ্ঞে ক্রিটিক্যাল থিংকিং অগত্যা অনেকের কাছে ইমান খোয়ানোর শামিল গণ্য হয় এবং সেটি রক্ষার যুদ্ধে নিজের সকল শক্তি তাঁরা ক্ষয় করে চলেন। হাদিসঅন্ধ বিতার্কিক জাকির নায়েকের উগ্র কথাবার্তা এখন একপ্রকার গা-সহা হয়ে গিয়েছে, নায়েকের তুলনায় ঢের সুবেদি ও কোরানের শিক্ষায় মানববিশ্বকে আলোকিত করার স্বপ্নে বিভোর নোমান আলী খান, ইয়াসির কাদির, হামজা ইউসুফ কিংবা সাবির আলীকেও ক্রিটিক্যাল থিংকিং-এর বিপক্ষে সাফাই গাইতে দেখি। ইসলামিশাস্ত্রে পণ্ডিত এইসব বিদ্বান বাকপটু হতে পারেন কিন্তু ধীমান চিন্তাবিদ হওয়ার এলেম ও স্পর্ধা কতটা রাখেন সেই সংশয় থেকে তাই মুক্তি মিলে না!

কোরানকে ব্যাখ্যা করছে এমন উৎসের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অথবা এর চিরুনিতদন্ত সারতে হলে সুবেদি যুক্তির সঙ্গে সৃজনী-প্রতিভার সংযোগ ঘটানো আবশ্যক হয়। একালের সিংহভাগ বিদ্বানকে এ-ব্যাপারে ভয়কাতুরে মনোভাব পোষণ করতে দেখা যায়। কোরানে সংকলিত আয়াতের ব্যাখ্যায় নবির ইন্তেকাল লাভের অনধিক আড়াইশো বছর পরে সংকলিত হাদিস আর মধ্যযুগে বিরচিত তফসির ও ঐতিহাসিক উৎসের ওপর তাঁরা মূলত নির্ভর করেন, যেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অনুসন্ধান কালের বিচারে অনিবার্য হয়ে পড়েছে। কোরান উপলব্ধির চাবি স্বয়ং কোরানে নিহিত। হাদিস ও অন্যান্য উৎসকে সেখানে সহায়কের অতিরিক্ত কিছু না ভাবাই বাঞ্ছনীয়। বিনয়ের সঙ্গে বলতে হয় একালের বিদ্বানদের বৃহৎ অংশ ইবনে আরাবি দূরে থাক, তাঁরা এমনকি কট্টরপন্থী গাজ্জালির দ্বারা অনুপ্রাণিত নন যে কোরানের ব্যাখ্যায় স্বকীয় অবধানশক্তি ও সৃজনী-প্রতিভার স্বাক্ষর রাখবেন! ইসলামি দর্শন, ধর্মতত্ত্ব ও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা মধ্যযুগের পর বিশেষ অগ্রসর হতে পেরেছে কি-না সেই জিজ্ঞাসা এইবেলা মনে ঘাই দিয়ে যায়।

কোরানের পটভূমি বিবেচনায় হাদিস ও সুন্নাহ হচ্ছে স্রষ্টা স্বয়ং দিকনির্দেশক যেসব ফুরকান বা মানদণ্ড স্থির করে দিয়েছেন সেগুলোর অনুশীলন। ‍ফুরকানের আলোয় সুন্নাহর অনুশীলনে অন্যত্র গমন কেন অপরিহার্য নয় সেটি উপলব্ধির জন্য কোরানের সতর্ক পাঠ জরুরি, যেহেতু মানবজাতির জন্য পালনীয় বিধি সম্পর্কে স্রষ্টা তাঁর রসুলকে সেখানে শিক্ষা দান করেছেন :—

এইরূপে আমি মানব ও জিনের মধ্যে শয়তানদেরকে প্রত্যেক নবির শত্রু করিয়াছি, প্রতারণার উদ্দেশ্যে তাহাদের একে অন্যকে চমকপ্রদ বাক্য (*যখরুফা’ল কাওলি) দ্বারা প্ররোচিত করে। যদি তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করিতেন তবে তাহারা ইহা করিত না; সুতরাং তুমি তাহাদেরকে ও তাহাদের মিথ্যা রচনাকে বর্জন করো। — আন’আম; ৬:১১২

আল্লাহ অবতীর্ণ করিয়াছেন উত্তম বাণী সম্বলিত কিতাব যাহা সুসমঞ্জস এবং যাহা পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি করা হয়। …

আমি এই কোরানে মানুষের জন্য সর্বপ্রকার দৃষ্টান্ত উপস্থিত করিয়াছি, যাহাতে উহারা উপদেশ গ্রহণ করে,…

আরবি ভাষায় এই কোরান বক্রতামুক্ত, যাহাতে মানুষ সাবধানতা অবলম্বন করে। — যুমার; ৩৯:২৩, ২৭, ২৮

যাহারা আমার আয়াতসমূহকে বিকৃত করে তাহারা আমার অগোচর নয়। … তোমাদের যাহা ইচ্ছা করো; তোমরা যাহা করো তিনি তাহার সম্যক দ্রষ্টা।

কোনো মিথ্যা ইহাতে অনুপ্রবেশ করিতে পারে না — অগ্র হইতেও নয়, পশ্চাৎ হইতেও নয়। ইহা প্রজ্ঞাময়, প্রশংসার্হ আল্লাহর নিকট হইতে অবতীর্ণ।

আমি যদি ‘আজমি ভাষায় (*বিদেশি অর্থাৎ আরবির সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন ভাষা) কোরান অবতীর্ণ করিতাম তবে উহারা অবশ্যই বলিত, ‘ইহার আয়াতগুলি বিশদভাবে বিবৃত হয় নাই কেন?’ কী আশ্চর্য যে, ইহার ভাষা ‘আজমি, অথচ রসুল আরবীয়! বলো, ‘মুমিনদের জন্য ইহা পথনির্দেশ ও ব্যাধির প্রতিকার।’ কিন্তু যাহারা অবিশ্বাসী তাহাদের কর্ণে রহিয়াছে বধিরতা এবং কোরান হইবে ইহাদের জন্য অন্ধত্ব। ইহারা এমন যে, ইহাদেরকে যেন আহ্বান করা হয় বহুদূর হইতে। — ফুসিলাত; ৪১:৪০, ৪২, ৪৪

কাফিররা বলে, ‘সমগ্র কোরান তাহার নিকট একবার অবতীর্ণ হইল না কেন? এইভাবেই আমি অবতীর্ণ করিয়াছি তোমার হৃদয়কে উহা দ্বারা মজবুত করিবার জন্য এবং তাহা ক্রমে ক্রমে স্পষ্টভাবে আবৃত্তি করিয়াছি।

উহারা তোমার নিকট এমন কোনো সমস্যা উপস্থিত করে না, যাহার সঠিক সমাধান ও সুন্দর ব্যাখ্যা আমি তোমাকে দান করি না।

তুমি কি দেখ না তাহাকে, যে তাহার কামনা-বাসনাকে ইলাহরূপে গ্রহণ করে? তবুও কি তুমি তাহার কর্মবিধায়ক হইবে? — ফুরকান; ২৫:৩২-৩৩, ৪৩; উৎস : আল কোরান, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।

সূরা আন’আম, যুমার, ফুসিলাত ফুরকান-এর আয়াতনিচয় তিনটি বিষয় পরিষ্কার করে :— প্রথমত, কোরানের আয়াতে মর্মরিত বার্তার অভিপ্রায় ও মানবজাতির কাছে এর সারার্থ প্রচারে যেন ত্রুটি না ঘটে সেজন্য স্রষ্টা ধাপে-ধাপে নবিকে এ-বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা দান করেছেন। দ্বিতীয়ত, কোনো সমস্যার সমাধানে কোরান কেন অগ্রাধিকার পাবে সেটি উপলব্ধির জন্য দেশকাল সাপেক্ষে তার পাঠ-পদ্ধতিকে Closed বা বদ্ধ রাখার পরিবর্তে Open অর্থাৎ উন্মুক্ত রাখাই উত্তম। তৃতীয়ত, কোরানের আয়াত ব্যাখ্যায় ব্যক্তিভেদে মতপার্থক্য এমনকি মতান্তর স্বাভাবিক ঘটনা হলেও অভিসন্ধিমূলক পদ্ধতির আশ্রয় সেখানে গ্রহণ করা উচিত নয়। হীন রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত কিংবা সামাজিক স্বার্থ পূরণে আয়াতের অর্থ ব্যাখ্যায় মনগড়া উৎসে গমন কোন্দল ও বিভক্তিকে অমোঘ করে।

প্রশ্নটি তাই তোলা যায়, — ইহজাগতিক সমস্যার সমাধানে কোরান পরিষ্কার ইশারা দিলেও সেখানে লিপিবদ্ধ সুন্নাহর প্রকৃতি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় এই অজুহাতে হাদিসশাস্ত্রের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা স্রষ্টা প্রেরিত কিতাবের প্রতি সুবিচার করে কি? প্রশ্নটি ফিরে-ফিরে উঠলেও একে দমিয়ে রাখার চেষ্টা ইসলামের সম্প্রসারণপর্ব থেকে আজোবধি প্রবল হয়ে বিরাজিত! বিষয়টি স্রষ্টার স্বরূপ উপলব্ধি, তাঁর উপাসনা পদ্ধতি ও মানবসমাজের জন্য প্রণীত ফুরকান বা দিকনির্দেশনার চর্চায় ইসলামি ঘরানায় অবস্থিত বিদ্বানদের সীমাবদ্ধতাকে প্রকট করে। মসনদলোভী রাজনীতির গুটি রূপে তাঁরা কীভাবে যুগে-যুগে ব্যবহৃত হয়েছেন সেই ইতিহাসকে এটি নগ্ন করে যায়!

চিত্র-১ : Islamic Jurisprudence on Ottoman Era; Source: dailysabah.com

ইজমা নিয়ে এখন নানা প্রশ্ন ও সমালোচনা থাকলেও মনে রাখা প্রয়োজন কোরানের সারবত্তা অন্বেষণে আদিপর্বের পণ্ডিতগণ ইজমা ও ইজতিহাদকে পৃথক অঙ্গে ব্যবহার করতেন। সমস্যার সমাধানে একমত হওয়ার লক্ষ্যে সকলে মিলে এক ক্ষুরে মাথা কামানোর ইজমাচর্চায় তাঁদের সায় ছিল না। কোরানের ব্যাখ্যায় পণ্ডিতগণের মধ্যে বক্তব্য বা মতভেদকে স্বাভাবিক ভাবতে তাঁরা অভ্যস্ত ছিলেন। মতপার্থক্যের স্বীকৃতি সেই পরিসরের জন্ম দিয়েছিল যেখান থেকে ব্যক্তি নিজের অবধানশক্তি ব্যবহার করে ইজতিহাদে গমনের উপায় খুঁজতেন। ইজমা ও ইজতিহাদের পারস্পরিক সংযোগ ঘটিয়ে ঐকমত্যে উপনীত হওয়ার তাগিদ সেখানে পরিলক্ষিত হলেও একমত হতেই হবে এরকম নাকে খত দিয়ে কোরান পাঠ ও অনুশীলনে সে-যুগের বিদ্বানরা অভ্যস্ত ছিলেন না। ইজমা ও ইজতিহাদে যাতায়াত করতে গিয়ে স্পষ্ট উপসংহার টানা সম্ভব হচ্ছে না বুঝলে কিয়াস বা অনুমানমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনেক সময় জরুরি হতো সেখানে, বলাবাহুল্য এই কিয়াসের অনুশীলনে তাঁরা বেশ সিদ্ধহস্ত ছিলেন। অর্থের রকমারি বৈচিত্র্যে বসবাস করে ইজমায় লিপ্ত হওয়ার ধারা কোরানের সৃজনশীল চরিত্রকে সেই সময় উর্বর করে তুলেছিল। ধর্মানুশীলনের জ্ঞানভিত্তিক বাতায়নকে উন্মুক্ত রাখার ক্ষেত্রে বিষয়টি অনুকূল ছিল সন্দেহ নেই। কালের ফেরে কোরানকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট জ্ঞানচর্চার এই ধারা ক্রমশ স্তিমিত ও পরে অবলুপ্ত হয়ে যায়।

কোরানের আলোয় মীমাংসায় পৌঁছানোর ইতিহাসে ইজমা, ইজতিহাদ ও কিয়াসের ছকে বৈচিত্র্য এবং সৃজনশীল স্ফুরণ থাকলেও ইসলামের সম্প্রসারণ ঘটানোর মিশনে তৎপর রাজনৈতিক ছকের কাছে এই মুক্তচর্চা ফলদায়ক ছিল না। মসনদকেন্দ্রিক রাজনীতির জগৎ সেই ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া ছিল যেটি কোরানকে নির্দিষ্ট কাঠামোয় ব্যাখ্যা দিতে পারদর্শী। ঐশী কিতাবকে সুনির্দিষ্ট ছকে বাঁধাই করে জনতার সম্মুখে হাজির করার বাসনায় রাজন্যরা উতলা ছিলেন। সম্প্রসারণের সমগ্র কালপর্বে চাপটি অব্যাহত থেকেছে। কোরানের নিরিখে সমস্যা সমাধানের মামলায় হাদিসশাস্ত্র এস্তেমালের প্রবণতা জনপ্রিয়তা লাভ করায় ব্যক্তির ধীশক্তি ও সৃজনী-প্রতিভায় আকাল নেমে আসে। মতপার্থক্যকে স্বাভাবিক ধরে নিয়ে নতুন অর্থ অনুসন্ধানের তাড়না পরনির্ভরশীল হয়ে ওঠার ফলে ইসলামে মুক্তচিন্তার অনুশীলনে সেই যে ভাটা পড়তে শুরু করেছিল সেখান থেকে আর বেরুনো সম্ভব হয়নি। কোরানকে হাদিসশাস্ত্রের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য করে তোলা হলো এবং প্রাতিষ্ঠানিক ইসলামের গতিপথ অতঃপর ছকবাঁধা খাতে নিয়ন্ত্রিত হয়ে চলেছে। ইজমা থেকে ইজতিহাদে গমনের আদি চরিত্রে পরিবর্তন ঘটার ঐতিহাসিক ক্ষণ থেকে তাকলিদ বা অন্ধ-অনুকরণের চর্চা সমগ্র মুসলিম বিশ্বে জোরদার হয়েছে এবং সেখানে আজো ছেদ পড়েনি।

সমস্যার সমাধানে সংখাগরিষ্ঠ বিদ্বানরা অভিন্ন মতামত দিয়েছেন; — ইজমার স্বরূপ বদলের ইতিহাসে মধ্যযুগে এই ছকটিকে জনপ্রিয় করে তোলা হয়েছিল। মতপার্থক্য থেকে সৃষ্ট ইজমার সড়ক ধরে নতুন ব্যাখ্যায় প্রাণবন্ত ইজতিহাদে বিচরণের পথ রুদ্ধ করতে ঘটনাটি ঘটানো হয়। সাম্প্রতিক বিশ্বে ইজমা হয়ে ইজতিহাদে গমনের অর্থ হলো সহমতের ভিত্তিতে প্রণীত মাসালার ভাবসম্প্রসারণ, অর্থাৎ মাসালার সমাধানে গৃহীত প্রস্তাবকে অধিক যৌক্তিক প্রমাণের জন্য একালের ডিগ্রধারী আলেম-উলামা ও ইসলামি শাস্ত্রে পণ্ডিত ব্যক্তিরা ব্যাখ্যাবিজ্ঞানকে ব্যবহার করেন, যেন মানুষের মনোজগতে এর স্বতঃসিদ্ধতা নিয়ে সংশয় অবশিষ্ট না থাকে। মতামতের ভিন্নতা নয় বরং যেনতেনভাবে হলেও মতৈক্যকে সঠিক প্রমাণ করা একালের ইজতিহাদচর্চার অন্তিম লক্ষ্য!

কোরানচর্চার এমতো হালতের কারণে আচার-উপাসনা থেকে শুরু করে জীবনের সকল ক্ষেত্রে মানুষের করণীয় সম্পর্কে মতামত বা রায় প্রদানের ঘটনায় ধর্মীয় নেতৃত্ব ও প্রতিষ্ঠানকে প্রমোট করার কোরান পরিপন্থী প্রথা ইসলামে জাঁকিয়ে বসেছে। প্রতিষ্ঠান স্বীকৃত কাঠামোর বাইরে নিজের ধীশক্তি ব্যবহার করে কোরান-হাদিসের অর্থ ব্যাখ্যায় নিয়োজিত ব্যক্তির জন্য সেই পরিসরটি অবশিষ্ট রাখা হয়নি যেটি ইসলামের আদিপর্বে মোটের ওপর বজায় ছিল। দীনের মামলায় জনগণের কর্তব্য সম্পর্কে ইসলামি ডিগ্রিধারী বিদ্বানরা যেসব নসিহত দিয়ে থাকেন সেগুলোর বাইরে অন্য উৎসকে প্রাসঙ্গিক ভাবার প্রবণতা একপ্রকার ছেটে ফেলা হয়েছে। মুসলমানি দীনের মসনদকেন্দ্রিক সম্প্রসারণের জন্য এরকম বাতাবরণ সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা ছিল। জগতের সকল ধর্মের ন্যায় ইসলামও রাজন্য আর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের যৌথ মিলনে সেই বৃত্তে প্রবেশ করেছে যেখানে কোরানের সুবেদি চর্চায় মানুষকে কৌতূহলী ও উদ্বুদ্ধ করার বাসনা কারো নেই, বরং যন্ত্রের ন্যায় ধর্মানুশীলনকে সেখানে অকাট্য প্রথায় পরিণত করা হয়েছে! ঘটনাটি মধ্যযুগে যাজকশাসিত খ্রিস্টান ধর্মের চরিত্রের সঙ্গে বিলকুল মিলেঝুলে যায়!

কোরানের সতর্ক পাঠ থেকে অনায়াসে স্পষ্ট হয় ঐশী কিতাবের সারবত্তা ব্যাখ্যা ও অনুশীলনে ডিগ্রিধারী বিদ্বান ও ডিগ্রিদাতা বিদ্যালয় সহায়ক শক্তি হলেও প্রশ্নাতীত মানদণ্ড নয়। মানবজাতির জন্য প্রযোজ্য ইহজাগতিক ও পরজাগতিক দায়িত্ব সম্পর্কে স্রষ্টার দিকনির্দেশনার ব্যাপারে মানুষকে স্বচ্ছ ধারণা প্রদান ও এর অনুশীলনে সহায়তা যোগানোর অতিরিক্ত তৎপরতাকে সেখানে বাড়াবাড়ির শামিল গণ্য করা উচিত। নিজের ধারণা ও মতামতকে অন্যের ঘাড়ে জোর করে চাপানো কোরান সমর্থন করে না, কথাটি সকল ইসলামি বিদ্যালয় ও আইনি প্রতিষ্ঠানের মাতব্বরদের মনে রাখা প্রয়োজন। জ্ঞানী ব্যক্তি তথা বিদ্যাজীবীর সহায়তা গ্রহণ একজন ব্যক্তির জন্য দোষণীয় নয়, তবে সহায়তা গ্রহণের ক্ষণে স্রষ্টা প্রদত্ত ‘আকল’-কে ব্যবহার করা প্রয়োজন, অন্যথায় অন্ধ অনুকরণের ঝুঁকি এড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে। সোজা কথা, অন্যের কথায় কান দিয়ে অথবা পরের মুখের ঝাল খেয়ে ‘মুসলমান’ হওয়া আর জেনেবুঝে ‘মুসলমান’ হওয়া এক কথা নয়। দুইয়ের মাঝে বিদ্যমান ব্যবধান উপলব্ধি করা প্রকৃত ইমানদারের লক্ষণ। বিদ্যাজীবী ও বিদ্যাধারী প্রতিষ্ঠানের কাজ হলো ‘বুঝতে শেখা’-র পরিবেশ সৃষ্টি করা, যেন মানুষ নিজের ‘আকল’ ব্যবহারের সুযোগ পায় ও কোরানকে বুঝে ওঠার বল পায় মনে। মানুষের মাঝে স্রষ্টার ফুরকান বা দিকনির্দেশনা প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত রসুলের সুন্নাহ আসলে কেমন ছিল সেটি উপলব্ধির জন্য কোরান কেন যথেষ্ট তার দিশা পেতে নিচে উদ্ধৃত আয়াতগুলো এই ফাঁকে পাঠ করা যায় :—

এই কোরান আল্লাহ ব্যতীত অপর কাহারও রচনা নয়। পক্ষান্তরে, ইহার পূর্বে যাহা অবতীর্ণ হইয়াছে ইহা তাহার সমর্থন এবং ইহা বিধান সমূহের বিশদ ব্যাখ্যা। ইহাতে কোনো সন্দেহ নাই যে, ইহা জগৎ সমূহের প্রতিপালকের পক্ষ হইতে।

তাহারা কি বলে, ‘সে ইহা রচনা করিয়াছে?’ বলো, ‘তবে তোমরা ইহার অনুরূপ একটি সূরা আনয়ন করো এবং আল্লাহ ব্যতীত অপর যাহাকে পারো আহবান করো, যদি তোমরা সত্যবাদী হও। — ইউনূস; ১০:৩৭-৩৮

কোরান তো তোমার ও তোমার সম্প্রদায়ের জন্য সম্মানের বস্তু; তোমাদেরকে অবশ্যই এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হইবে। — আয-জুখরুফ; ৪২:৪৪

সুতরাং তুমি উহার (*কোরান) দিকে আহ্বান করো ও উহাতেই দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থাকো যেইভাবে তুমি আদিষ্ট হইয়াছ এবং উহাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করিও না। বলো, আল্লাহ যে কিতাব অবতীর্ণ করিয়াছেন আমি তাহাতে বিশ্বাস করি এবং আমি আদিষ্ট হইয়াছি তোমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করিতে। আল্লাহ আমাদের প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক। আমাদের কর্ম আমাদের এবং তোমাদের কর্ম তোমাদের; আমাদের ও তোমাদের মধ্যে বিবাদ-বিসম্বাদ নাই। আল্লাহ আমাদেরকে একত্র করিবেন এবং প্রত্যাবর্তন তাঁহারই নিকট।

আল্লাহ যদি ইচ্ছা করিতেন তবে তাহারা শিরক করিত না এবং তোমাকে তাহাদের জন্য রক্ষক নিযুক্ত করি নাই; আর তুমি তাহাদের অভিভাবকও নও।

আল্লাহকে ছাড়িয়া যাহাদেরকে তাহারা ডাকে তাহাদেরকে তোমরা গালি দিও না। কেননা তাহারা সীমালঙ্ঘন করিয়া অজ্ঞানতাবশত আল্লাহকে গালি দিবে। এইভাবে আমি প্রত্যেক জাতির দৃষ্টিতে তাহাদের কার্যকলাপ সুশোভন করিয়াছি; অতঃপর তাহাদের প্রতিপালকের নিকট তাহাদের প্রত্যাবর্তন। অনন্তর তিনি তাহাদেরকে তাহাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে অবহিত করিবেন। — আন’আম; ৬:১০৭-১০৮

উহারা যদি মুখ ফিরাইয়া নেয়, তবে তোমাকে তো আমি ইহাদের রক্ষক করিয়া পাঠাই নাই। তোমার কাজ তো কেবল বাণী পৌঁছাইয়া দেওয়া। …

মানুষের এমন মর্যাদা নাই যে আল্লাহ তাহার সঙ্গে কথা বলিবেন ওহির মাধ্যম ব্যতিরেকে, অথবা পর্দার অন্তরাল ব্যতিরেকে, অথবা এমন দূত প্রেরণ ব্যতিরেকে, যেই দূত তাঁহার অনুমতিক্রমে তিনি যাহা চাহেন তাহা ব্যক্ত করেন, তিনি সমুন্নত, প্রজ্ঞাময়।

এইভাবে আমি তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করিয়াছি রুহ্ তথা আমার নির্দেশ; তুমি তো জানিতে না কিতাব কী এবং ঈমান কী। পক্ষান্তরে আমি ইহাকে করিয়াছি আলো যাহা দ্বারা আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাহাকে ইচ্ছা পথনির্দেশ করি; তুমি তো প্রদর্শন করো কেবল সরল পথ… — শূরা; ৪২:১৫, ৪৮, ৫১-৫২

যেন আল্লাহ তোমার অতীত ও বর্তমান ত্রুটিসমূহ মার্জনা করেন এবং তোমার প্রতি তাঁহার অনুগ্রহ পূর্ণ করেন ও তোমাকে সরল পথে পরিচালিত করেন, … — ফাতহ্; ৪৮:২; উৎস : আল কোরান, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।

*দ্রষ্টব্য : সমন্ধ পদবাচ্য বিশেষ্য বা সর্বনাম রূপে সূরা ফাতহ-য় প্রযুক্ত ‘যা’মবিকা’ শব্দটি কোরানে ৩৯ বার ‘পাপকার্য সম্পাদন’ অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে। ইউসুফ আলী ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন তাঁদের ভাষান্তরে ‘পাপ’-এর পরিবর্তে ‘ত্রুটি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন সম্ভবত এই বিবেচনায় যে, মানবিক সীমাবদ্ধতার কারণে স্রষ্টাপ্রেরিত নবিগণের কর্ম-সম্পাদনে ভুলচুক ঘটলেও তাঁদেরকে দিয়ে পাপকার্য কিছুতেই সম্ভব নয়। এ-কথা ঠিক মানবজাতিকে সঠিক পথ দেখানো ও সর্বোত্তম আচরণের নিদর্শন সম্পর্কে ধারণা প্রদানের লক্ষ্যে স্রষ্টা নবিগণকে ধরায় প্রেরণ করে থাকেন আর সে-কারণে হীনোচিত কার্যে লিপ্ত হওয়া তাঁদের পক্ষে যৌক্তিক ও বিধিসংগত হতে পারে না; কিন্তু এর অর্থ আবার এই নয় যে নবিগণ মানবিক সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বের কোনো জীব! মানুষ রূপে ধরায় জন্মগ্রহণ ও প্রতিপালিত হওয়ার কারণে তাঁদের পক্ষে ভুলত্রুটিমুক্ত থাকা কঠিন, কাজেই জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে হীন পাপকার্যে নিজেকে জড়িয়ে ফেলার সম্ভাবনা থেকেই যায়। নবিরা যেন এহেন ভ্রান্তি ও পাপাচারের কবলে না পড়েন সেজন্য স্রষ্টা তাঁদেরকে সতর্ক করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন। মানবিক সীমাবদ্ধতা দোষে যেখানে অন্যায় বা হীন কার্য সম্পাদনের সামান্যতম সম্ভাবনা রয়েছে সেটি থেকে নবিগণকে নিবৃত্ত রাখতে তিনি স্বয়ং সেখানে হস্তক্ষেপ করেন। শেষনবির উদ্দেশে প্রেরিত সূরা ফাতহ-র আয়াতে স্রষ্টা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন কীভাবে সকল প্রকার অহিত কার্যের সম্ভাবনা থেকে তিনি তাঁর রসুলগণকে রক্ষা করে থাকেন। সুতরাং ‘যা’মবিকা’র ভাষান্তরে ‘ত্রুটি’ শব্দের প্রয়োগ আয়াতের প্রকৃত মর্ম অবধানে ভ্রান্তি ও নবিগণকে ধরায় প্রেরণের মৌল উদ্দেশ্য উপলব্ধিতে বিঘ্ন ঘটায়। নবি দাউদ, সুলেমান, ইউনূস ও মূসা-র কাহিনি বর্ণনায় নাজিলকৃত একাধিক আয়াতেও সূরা ফাতহ থেকে উদ্ধৃত আয়াতের অনুরণন পাওয়া যায়।

রুহ  শব্দটি সচরাচর আত্মা অর্থে প্রযুক্ত হলেও সূরা শূরা-র ৫২ নাম্বার আয়াতাংশে ‘ওহি’ (Inspiration) বা প্রত্যাদেশ বোঝাতে এর প্রয়োগ কোরানের পটভূমি বিবেচনায় বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। ‘ওয়া কাযালিকা আওহাইনা ইলাইকা রুহামমিন্ আমরিনা-’ অর্থাৎ প্রত্যাদেশবাহী রুহ হচ্ছে দিকনির্দেশনার সমষ্টি। স্রষ্টা কর্তৃক মানবসত্তায় রুহ ফুঁকে দেওয়া মানে কেবল দৈহিকভাবে সত্তার জগতে সক্রিয় হওয়াকে বোঝায় না, অধিকন্তু সেইসব নির্দেশনা সেখানে সচল হয় যার মাধ্যমে সত্তা নিজের নফস বা আত্ম-স্বভাবের গতিপ্রকৃতি অনুধাবন ও এর ওপর নিয়ন্ত্রণ লাভের ক্ষমতাটি অর্জন করে। নফসকে যে-ব্যক্তি সঠিকপথে পরিচালনা করতে আগ্রহী তার ক্ষেত্রে রুহ বা প্রত্যাদেশ সম্পর্কিত উপলব্ধি একরকম হয়, পক্ষান্তরে বিভ্রান্ত ব্যক্তি বিপরীত পরিণতি বেছে নিতে নিজেকে মজবুর করে। সুতরাং রুহ বা প্রত্যাদেশের কোরানসম্মত উপলব্ধির ওপর মানবসত্তায় সক্রিয় নফসের উৎকর্ষ-অপকর্ষ নির্ভর করে। সূরা শূরা-য় নবির সুন্নাহ বা করণীয় সম্পর্কে মোহাম্মদকে উপদেশ দানের পাশাপাশি মানবজাতিকে এর প্রকৃতি অবধান ও সেখান থেকে নিজের করণীয় নিষ্কাশনের উপায় সম্পর্কে স্রষ্টা ইশারা দিয়েছেন, সুতরাং উদ্ধৃত আয়াতনিচয়ের সারসংক্ষেপ এই ফাঁকে ছকে নেওয়া যেতে পারে :—

যে-ব্যক্তি স্রষ্টার একত্ব-এ বিশ্বাস করে তার জন্য প্রথমত প্রতিকূল অবস্থায় কোরানে অবিচল থাকা ও সেই মোতাবেক ন্যায়সংগত আচরণে নিজেকে দীক্ষিত করা আবশ্যক। দ্বিতীয়ত কোরানকে যারা অস্বীকার করছে অথবা সীমালঙ্ঘন করেছে তাদেরকে শাস্তি দানের প্রশ্নে সূরা আন’আম-র ১০৭ ও শূরা-র ৪৮ নাম্বার আয়াতে প্রযুক্ত ‘হাফিজান’ বা রক্ষক শব্দের সারবত্তা উপলব্ধিতে কতখানি ধীশক্তি ও সংযমের পরিচয় দিতে পেরেছেন সেটি নফসের প্রকৃতি শুধরে নিতে আগ্রহী ব্যক্তির জীবনে পালনীয় শর্ত হয়ে আসে। সেইসঙ্গে নবির জন্য প্রযোজ্য সুন্নাহর আলোকে প্রকৃত মুমিনের স্মরণ রাখা প্রয়োজন কোরানের অন্তর্নিহিত বার্তা অন্তরে ধারণের জন্য মানুষকে আহবান জানানোর যজ্ঞে নেমে মনগড়া ব্যাখ্যা, রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি ও জোরজবরদস্তি মোটেও কাম্য নয়। কেন নয় সেই আলোচনা পরিশিষ্টের দ্বিতীয় কিস্তিতে করাটাই সমীচীন মনে হচ্ছে।


আহমদ মিনহাজ প্রণীত ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ১-১৫

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you