প্যারা ৪ || শেখ লুৎফর

প্যারা ৪ || শেখ লুৎফর

বনি আদমের মুখ


মানুষের মতো লেখার মুখটা আমার কাছে সবচে জরুরি। কারো মুখের সাথে কারোটা মিলে না। তাই প্রত্যেকটা লেখার শুরু আমাকে খুব ভাবায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুরু করতেই দিনের পর দিন কেটে যায়। মনে মনে প্রথম বাক্যটা নিয়ে খুব লড়াই করি। লেখাটার মূল থিমটাও আনমনে কাজ করে। তাই প্রতিটা লেখার প্রথম প্যারাতে এমনকিছু বলতে চাই যা আগে কখনও বলিনি। বলার জন্য এমন একটা ভঙ্গির তালাশে দুনিয়াটা ঢুঁড়ে ফিরি যেটা আগে আর ব্যবহার করিনি। জিনিসটা খুব কঠিন। কঠিনের মাঝেই নরমের বসত। কারণ আমার নিজের জীবনটাই তো কঠিনের দিকে যাচ্ছে।

অনেকদিন ধরে একটা মুখ আমাকে তাড়া করছে। অ্যালুমিনিয়ামের ভাঙাচোরা বাতিল পাতিলের মতো তার এ্যাবড়োখেবড়ো মুখ। কথা বলে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে যেন সে অনেক বছর ধরে গোপন একটা অসুখে ভুগছে। টাকা বাঁচানোর জন্য জগন্নাথপুরের যে আড়ত থেকে আমি সপ্তাহে সপ্তাহে মাছ আনি লোকটা সেই আড়তের ডাকি । অর্থাৎ মাছের ডাক দেয়। মন্ত্রের মতো সে চিৎকার পাড়তে থাকে, — হাজার বিশ হাজার বিশ …, হাজার তিরিশ …।

মনমতো হলে আমি তার দিকে তাকিয়ে চোখটিপি। সে মাছের ক্যারেটটা টান দিয়ে তার পাশে রেখে দেয়। সর্বোচ্চ ডাক ওঠা সংখ্যার সাথে আমি গুনে গুনে পঞ্চাশ টাকা বেশি দেই। অনেক বছরের লেনদেনে তার সাথে একটা ভাব হয়ে গেছে। ভাবের সেই অলিখিত চুক্তির খাতিরে মাঝে মাঝে আমি সকাল সকাল হাজির হই। মানুষজন সবে আসতে শুরু করছে। কোনো কোনো আড়তদার মাইমলদের কাছ থেকে গতদিনের বকেয়া আদায় করছে। তোড়জোড় চলছে ট্রাক থেকে পাঙাস মাছের ড্রাম নামানোর। সামুদ্রিক মাছের পিকাপটা গোঁয়ারের মতো একটা আড়তের সামনে এসে জোরে ব্রেক কষে। আমি খুপরির মতো দুই পাশের আড়তের ছোট ছোট কোঠাগুলো পেরিয়ে উত্তর দিকে গিয়ে দাঁড়াই।

ভাঙা ভাঙা পারের নদীটা দেখতে সুন্দর না। কিন্তু তার বাঁক খাওয়া বুকের কালো জলে আমার মন মজে। শান্ত আর গভীর বুকে তিরতিরে ঢেউ, সকালের নরম রোদের মিষ্টি ঝিলিক। একটা পানকৌড়ি ঠোঁটে মাছ নিয়ে পানির গভীর থেকে ভেসে ওঠে। তারপর পাখাঝাপটে আকাশে চম্পট দেয়।

ভটুমামা এসে আমার পাশে দাঁড়ায়, — স্যার কী মাছ নিবা?
— দেখি, যেটা মনমতো হয়।
সে একটু মুচকি হাসে। ঠোঁটের কোণায় কী কান্নার একটু রেশ না ? চোখের গভীরে কে একজন থোম ধরে দাঁড়িয়ে আছে না?

সেই থেকে আড়তে গেলেই আমি তাকে নজরে নজরে রাখি। দুই-চার কথা আলোচনা করতে চাই। তার সাথে যেভাবে এবং যেসব বিষয়ে আলাপ চলতে পারে ঠিক ঠিক সেই জবানে আলাপ করি।

এইভাবে আমরা অন্তরঙ্গ মানুষ হই। দুই বছর আগে আমার এক ছাত্র লন্ডনে চলে যাবার সময় একটা দামি টি-শার্ট গিফ্ট করেছিল। এখন আমি আর টি-শার্ট পরি না। কেমন চ্যাংড়া চ্যাংড়া লাগে। তাই একদিন আমি তাকে ওটা গছিয়ে দেই। জিনিসটা তাকে মানিয়েছে দেখে সে খুব খুশি হয়। এইসব ছোট ছোট খুশির ভিতর দিয়ে আমি তার চোখমুখের আবছায়া থেকে একটা মনমতো চরিত্র পেয়ে যাই।

আজ সকালে ঘুম ভাঙতেই তাকে আমি পষ্ট চোখে দেখে ফেলি। কাঁইমার্কা একটা দলামচা জীবন। তখন থেকেই লেখাটা আমার মাথায় একটু একটু গতর-গড়ন নিতে থাকে। ছাদের বাগানে কাজ করতে করতে ভটুমামার গোটা জীবনটা হাতে নিয়ে আঁতিপাতি খুঁজি।

ঘণ্টাখানেক পর ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে রুমে আসি। দ্রæত হাতে ধুলামাটিভরা প্যান্ট-শার্ট খুলতে থাকি। পা থেকে আগেই ঝেড়ে ফেলেছি রাবারের শ্যু দুইটা। সামনে দাঁড়িয়ে ভটু যেন আমার এইসব ব্যস্ততা দেখছে!

একটা চোরা আনন্দ আর সতেজ ভালোলাগা শুরু হয়। লম্বা লম্বা কদমে বাথরুমে যাই। ফিরে এসে দেখি টেবিলে নাস্তা নিয়ে মা-মেয়ে আমার অপেক্ষায়। আমি তিন কামড়ে নাস্তা শেষ করি। তারপর প্যান্ট-শার্ট পরে বউকে বলি, — একটু বাইরে যাব।

তার কপাল কুঁচকে ওঠে, তীক্ষ্ণ-হয়ে-নেমে-আসা ভুরুর পাশের রক্ততিল দুইটা একটু একটু কাঁপে, — এই রোদের মধ্যে কৈ যাবা?
— বাজারে।
— কেন?
— একটু দরকার…।
— যাও, রান্নার আগে ফিরে আসবা।
আমি অনুগতের মতো মাথা নাচাই। সে নিরাবেগ গলায় বলে, — ছাতা নিয়ে যাও।
তারপর আমার হাতে ছাতা ও কিছু ভাঙতি টাকা দেয়।
আমি খুশিয়াল গলায় বলি, — একটু গ্রামের ভিতর দিয়ে ঘুরে ঘুরে হেঁটে যাব। আসতে দেরি হলে আজ রান্নাটা তুমি একলাই করো।
— তরকারি মজা না হইলে আমি জানি না, — এই বলে সে আমায় সাবধান করে।
আমি চট করে কেটে পড়ি। বুকের ভিতর হীনম্মন্যতার বাজে একটা চাপের পাশে মাধবীলতার হালকা সুবাস।

আমি বাজারে যাই না। গ্রামের ভিতরে সিমেন্টঢালাই আর আঁকাবাঁকা পথ ধরে খুব ধীরে ধীরে হাঁটি। অসংখ্য খালের উপরে ছোট ছোট ব্রিজ। মাঝে মাঝে শুকিয়ে-যাওয়া ছোট ছোট জলাশয় কিংবা ঘন জঙ্গল থেকে মাথার উপর ঝুঁকে-পড়া বাঁশঝাড় পাশে ফেলে ঢালাই সড়কগুলো একটা থেকে আরেকটা আমাকে টেনে টেনে নেয়। আড়ে আড়ে চারপাশের গাছগাছালি, ঘন বাঁশঝাড় দেখি। কোথাও কোথাও মাথার উপর হিজল-করচের ঘন ছায়া, বাতাসে লতাপাতা আর জংলি ফুলের মিশেলে আজব এক ঘ্রাণ। আমি নিবিড় মনে লেখার মুখটা খুঁজি। মানুষের মুখের দিকে তাকালে যেমন তার দশআনাই মালুম হয় আমার যে-কোনো লেখার প্রথম প্যারাটাও তা-ই চাই।

হয়-হয় দুপুরে আমি রুমে ফিরে আসি। চোরের মতো কাঁপা কাঁপা হাতে পানির বোতল লই, নোটখাতা আর কলম লই। তারপরেই ছাদে চম্পট দেই। দরজাটাও বাইরে থেকে লাগিয়ে দিয়েছি যাতে চাইলেও বউ ছাদে না যেতে পারে। রান্না তাকে আজ একলাই করতে হবে।

কদমের ছায়ায় বসে নোট নিতে শুরু করি : আড়তের ছোটবড় সবাই মানুষটাকে ভটুমামু বলে ডাকে। ঢ্যাঙা চেহারা আর ছোট ছোট চোখ দুইটায় ধূর্ত একটা ঝিলিক। এখানে ধূর্ত না হয়ে উপায় নাই। আড়তে আজব একটা খেলা চলে। ফাও-মারার খেলা। ডাক হচ্ছে। অন্তত তিরিশজন লোক মাছের ক্যারেটগুলো ঘিরে মৌচাকের মাছির মতো ছোট্ট একটা বৃত্তে জমাট বেঁধে আছে। সেই ভিড় থেকেই একজন ডাকছে, — দুই হাজার সত্তর দুই হাজার সত্তর…।

এই ফাঁকে টোকাইরা তাদের পায়ের ফাঁক দিয়ে একআধটা মাছ নিয়ে কেটে পড়ে। আপনি ভদ্রলোক। একটু কমদামে তাজা মাছ নিতে এসেছেন। আপনি ডাকে অংশীদার হতে পারবেন না। আপনাকে বাঁয়া ধরতে হবে। সেই মধ্যমজনও আপনার কাছ থেকে ফাও মারবে। তারপর মাইমল-আড়তদার, আড়তদার-ফিশারিমালিক কিংবা হাওরের জেলে সবাই পরস্পরকে ফাওমারার তালে থাকে। সবসময় কিন্তু মারা খায় জেলেরাই। যারা মানিকবাবুর কুবেরের মতো সরাসরি হাওর থেকে মাছ ধরে আনে।

কার মাথা যে কে খায়, প্রথম প্রথম কিচ্ছু বুঝতাম না। অনেকদিনের কঠিন ফিকিরে একটু একটু করে মাছের আড়তটাকে বুঝেছি। এতে আমি খুশি। কষ্ট করে শিখলে অনেক ছোট ছোট জিনিসও চোখকে ফাঁকি দিতে পারে না।

বিয়ে করার পরেই ভটুমামু একটু একটু বদলে যেতে শুরু করেছিল। চোখ লাল থাকে। মাছের যে ক্যারেট পছন্দ হয়েছে সেইটা ডাকের সময় চোখ টিপলেও আমার জন্য একপাশে সরিয়ে রাখে না। নাস্তা অফার করলে মুখটা বাঁকা করে বদরাগী মানুষের মতো থুতু ফেলে বলে, — না, খাইবার টাইম নাই।

আরেকদিন গেলাম খুব সকাল সকাল। সে ফাঁকা আড়তের সামনে, প্লাস্টিকের চেয়ারে গতর ছেড়ে বসে আছে। চোখ দুইটা মরা মাছের মতো অন্তসার। ভাঙাগাল দুইটার নিচে মোটা মোটা ঠোঁট দুইটা ঝুলে পড়েছে। আমি পাশে গিয়ে তার হাত ধরি, — চলো মামু নাস্তা খাবা।
সে আমার মুখের দিকে এক নজর তাকিয়েই উঠে পড়ে।
আমরা আড়তের কোনার দিকের নোংরা হোটেলটাতে গিয়ে মুখোমুখি বসি, — মামু তোমার ভালো ঘুম হয় না?
— না।
— কেন?
— ঘুমের মাঝে মাছের ডাক দেই। আমি নাকি সারারাইত আটশ চল্লিশ আটশ চল্লিশ কৈয়া চেঁচাই।  হে (ভটুমামুর বউ) সারারাইত দুই চৌখ্যের পাতি এক করতারে না। হেলিগ্যা তোমার মামি বাপের বাড়ি গ্যাছে গ্যা।

এইসব মানুষ তাবিজ-কবজে খুব বিশ্বাসী হয়। ‘বিশ্বাসে ভগবান মিলে’ — এই চেতনা থেকে আমি তাকে আমার পরিচিত এক হুজুরের কাছ থেকে একটা তাবিজ নিয়ে দেই। সে খুব খুশি হয়। তাবিজের কথা শুনে বউও এসেছিল। কিন্তু তাবিজে কাজ হয় না দেখে সে আবার বাপের বাড়ি চলে গেছে। আমি তাকে বলি, — আমার সাথে সিলেটে চলো, তোমাকে মানোসিক ডাক্তার দেখাব।
সে সারাটা আড়তে একবার চোখ বুলিয়ে আমাকে বুঝাতে চায়, — এই যে অতঅত মানুষে মাছের ডাক দিতাছে তাগোর মানসিক দোষ অয় না খালি আমার বেলায়?
আমি তাকে সান্ত্বনা দিতে বলি, — সবার নার্ভ সমান না।
কথাটা বুঝল কি না জানি না। রুটির শেষ টুকরাটা মুখে ভরতে ভরতে বলে, — স্যার সব আমার নসিব।

ছাদে বসে এইটুকু লেখতেই বউ নিচের ব্যালকনি থেকে ডাকে, — কৈ আসো…।
তার ডাকে লেখার স্রোতটা কেটে যায়। আমি হাতের কলম ফেলে ছাদের কিনারে গিয়ে মুখ নিচু করে তার বরাবরে বলি, — প্লিজ! প্লিজ! আজ একটু সময় দাও।
আমার গলার কাতর সুর তাকে কাবু করে নাকি রাগে আরও গম্ভীর করে দেয় ঠিক বুঝতে পারি না। তবে নিচ থেকে আর ডাক আসে না।

আমার আর লেখতে ইচ্ছা করে না। আমি পাটিতে চিত হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জানতে চাই, — শুধু একটু লেখার জন্য আমি আর কত প্লিজ প্লিজ  করে দুনিয়ার কাছে মিনতি জানাব?

আর লেখটেখা আসে না। আমি মনখারাপ করে নিচে নেমে আসি। একটু পরেই একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসে, — আমি অনুপম ইসলাম, যশোর থেকে বলছি।
— জি, বলুন।
— আপনি শেখ লুৎফর না?
— জি।
— আমরা ‘ঘাসফুল’ নামে একটা ছোটকাগজ করি। আকমল হোসেন নিপুভাই আমাকে আপনার নাম্বারটা দিছেন। আমরা রিমোট এ্যারিয়ার প্রচারবিমুখ কবিসাহিত্যিকদের নিয়ে বছরে একটামাত্র সংখ্যা করি।

কবিসাহিত্যিক কথাটা শুনে আমার জিবের নিচে কেমন তেঁতো তেঁতো লাগে। দুই কারণে আমি এই শব্দ দুইটা সইতে পারি না। ১. আমার দেখা কবিসাহিত্যিকদের বেশিরভাগেরই মারাত্মক ইগো। ২. আমার বিচারে সাহিত্য শব্দটা এসেছে সাধনা থেকে। আমার সাধনা কৈ?

ফোনের অপর পারের জন আমার জবাবের অপেক্ষায়। একটা গলা খাকারি দিয়ে বলি, — আমি সাহিত্যিক না। লিখতে চেষ্টা করছি।
তিনি আবেগভরা গলায় বলেন, — আমরা আপনাদের মতো লেখককেই খুঁজছি।
আমার বুকে একটা শক্ত ধাক্কা লাগে। কারণ আমি লেখক শব্দটাকে মনে মনে ভয় পাই। মনোবিজ্ঞান বলে, — ঘৃণা ও হতাশা থেকে মানুষের মনে ভয়ের সৃষ্টি হয়।

কথায় বলে, — যার নাই কোনো গতি, সে করে হোমিওপ্যাথি। দুনিয়াতে আমার কিচ্ছু করার নাই বলে আমি লিখি। যে লেখে সে-ই তো লেখক। সেই হিসাবে আমার বউও লেখক। তাকে টাকার অঙ্ক আর বাজারের ফর্দের সাথে প্রায়ই খুব লড়াই করে লিখতে দেখি।

বউ ফোনের আলাপ শুনে পাশের রুম থেকে নিশব্দে এসে দাঁড়ায়। ফোন কানে নিয়েও আমি নীরবে তার চোখের ভাষা পড়ি। তার বড় বড় চোখ দিয়ে মায়া গড়াচ্ছে। আমি, —  ‘আচ্ছা দেখি’ বলে ফোন কেটে দেই। বউ আমার পিঠে নরম হাত রাখে, — লেখাটা দিয়ো।
এই বলে সে আমার চারপাশে মিষ্টি একটা সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পাশের রুমে চলে যায়।
আমি আমার মাটির বিছানায় ফিরে আসি। কম্পিউটার চলছে। ‘লুকা টি স্টল’-এর অষ্টম অধ্যায় লিখছি। লেখক শব্দটা তখনো আমার বুকের নরম জমিন সমানে কামড়ে চলেছে। তাই যন্ত্রটা বন্ধ করে দেই। তারপর খুব আস্তে দরজা খুলে ছাদে পালিয়ে যাই।

সময়গময় নাই, যখন দুনিয়াটা তেঁতো লাগে তখন আমি ছাদের বাগানে কাজ করি, রোদ-বৃষ্টি আমাকে দমাতে পারে না। একটু একটু করে ছাদটা আমার মনের মতো করে গড়ে তুলেছি। সিঁড়িকোঠার টিনের ছাদের বর্গার সাথে সুতলি দিয়ে বাতিল একটা প্লাস্টিকের পাটি বেঁধে রেখেছি। মাঝে মাঝে পানির বোতল, সিগারেট আর নোটখাতা নিয়ে এখানে এসে পাটি বিছাই। এই কদমগাছের ছায়ায় বসে পুবের বিশাল হাওরটার দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকি। বুলবুলির ঝাঁক এসে আমার মাথার উপরের নেট থেকে কচি কচি ঝিঙা খেয়ে যায়। আমি টের পাই না। মাঝে মাঝে বউও আসে। নোটখাতায় ঝুঁকে আছি দেখে সে হেসে বলে, — সাহিত্যসাধনা হচ্ছে?

চল্লিশটা টবে একুশ প্রজাতির ফুল আর কয়েকটাতে বারোমাসি মরিচ, বেগুন। টমেটোগাছ দুইটা। বড় বড় সাতটা টবে লাউ, কুমড়া, ঝিঙা, চিচিঙ্গা। ছাদটার দুইদিক আম-কাঁঠাল ও কদম গাছে ঘেরা। এই কোয়ার্টারে এসে আমি প্রথম বছরই এদেরকে লাগিয়েছিলাম। আজ তারা ঝকঝকে তরুণ। আমাকে ছায়া দেয়, ফল দেয়। মাঝে মাঝে যখন দুনিয়ার কিছুই ভালোলাগে না, কারো কাছে আশ্রয় পাই না তখন তারা আমাকে করুণা করে প্রশ্রয় দেয়, নীরবে মায়ার জাল বিস্তার করে।

আমি পাটিতে চিত হয়ে আকাশ দেখছিলাম, মার্চের আকাশ কত উঁচু আর নীল!
আমি কেন লিখি?
আমার বুকের ভিত্তে একটা বিষণ্ণ মানুষ সবসময় ছবি তুলছে। আমার চারপাশের ছবি। যেসব ছবি আমাকে আলোড়িত, ব্যথিত করে আমি তাদেরকে লিখি। লিখি মানে নিজেকে ভুলে থাকি। নিজের মনের অসুখগুলোকে সারিয়ে তুলতে আমার কাছে এরচে আর সেরাটা নাই। তাই আমি শুধু নিজের জন্য লিখি।

আমার প্রথম গল্পের বই ‘উল্টারথে’ বেরোবার পর একটা ঝুলাব্যাগে কয়টা বই নিয়ে ঢাকায় গেছিলাম। সরকার মাসুদকে শাহবাগে পেয়ে একটা গছিয়ে দিলাম। দিলাম সরকার আশরাফকেও। দুপুরে গেলাম নামকরা এক দৈনিকের সাহিত্যসম্পাদকের অফিসে। হেনতেন আলাপের পর তার হাতেও এককপি উল্টারথে  দিলাম। তিনি বিষাক্ত হেসে বললেন, — আমাকে দিয়ে কী হবে ভাই? জাতিকে দেন।
সেইদিন বিকালে আমি ঢাকা থেকে চোরের মতো পালিয়ে এসেছিলাম।

বাসে সিলেট আসতে আসতে গভীর রাত। মনে পড়ল একজনের কথা। ছেলেটা সাহিত্য করতে চায়। আমাকে খুব পছন্দ করে। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে চাকরির অপেক্ষায় একটা মেসে থাকে। হোটেল থেকে খেয়েদেয়ে গেলাম তার কাছে। আমাকে দেখে সে খুব খুশি। তার টেবিলে দেখলাম উল্টারথে । বলল, মেলা থেকে কিনে এনেছে।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে উল্টারথের গল্পগুলো একটা একটা করে জটিল ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে একেবারে খারিজ করে দিলো। আমি টুঁ-শব্দটা না করে শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পরদিন ঘুম ভাঙল দেরিতে। উঠে দেখি সে পত্রিকার পাতা উল্টাচ্ছে। আমি জেগে উঠেছি দেখে সে জটিল একটা হাসি দিয়ে বলল, — আমি ভেবেছিলাম আপনি খুব ভোরে আমাকে না-বলেই পালাবেন।
শেষরাতের দিকে খুব ভালো ঘুম হয়েছিল। তাই একটা হাই তুলতে তুলতে বললাম, — কেন?
— কাল রাতে আপনাকে যে ঝাড়া দিলাম!
আমি উচ্চহাস্যে তাকে একটা সিগারেট দিয়ে বলি, — আমি সাহিত্যিক হলে সত্যিই পালাতাম কিংবা তর্ক করে তোমাকে নাজেহাল করে ছাড়তাম।
দেখি তার মুখটা কালো হয়ে গেছে। বুঝলাম আমাকে জব্দ করতে এসে সে নিজেই মনের দিক থেকে গুঁড়িয়ে গেছে।

সিলেট থেকে ফেরার পথেই ঠিক করেছিলাম, হয় লেখা ছেড়ে দেবো, না-হয় নিজের আনন্দের জন্য লিখব। কিন্তু আর কোনোদিন আমি লেখক হওয়ার জন্য লিখব না।

ইসহাকপুর / ২২.০৩.২০২১


প্যারা ৩
গানপারে শেখ লুৎফর রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you