ইসলামবীক্ষণ : পুনর্বিবেচনার পুনর্বিবেচনা ২ || আহমদ মিনহাজ

ইসলামবীক্ষণ : পুনর্বিবেচনার পুনর্বিবেচনা ২ || আহমদ মিনহাজ

পরিশিষ্ট-২  / ইসলামবীক্ষণ : পুনর্বিবেচনার পুনর্বিবেচনা


মুসলমানি দীনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্প্রসারণের ইতিহাসে পরিশিষ্টের প্রথম কিস্তিতে বর্ণিত সারসংক্ষেপের প্রতিফলন কখনো ব্যাপক হয়ে ওঠেনি। নবির সুন্নাহ অনুসরণের অজুহাতে কোরান বহির্ভূত ব্যাখ্যাবিজ্ঞানের দুষ্টচক্রে মানুষের চেতনাকে কারারুদ্ধ করার নিয়তি সে এড়াতে পারেনি। দুঃখজনক হলেও সত্য শাফি’ঈ মাযহাবের প্রবর্তক মোহাম্মদ ইবনে ইদ্রিস আল-শাফি’ঈ (৭৬৭-৮২০) এই দুষ্টচক্র সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন! ইসলামকে বিধিসংগত চেহারা প্রদানের ভাবনা মালিকি মাযহাবের রূপকার মালিক ইবনে আনাসের শিষ্য শাফি’ঈকে তাঁর ওস্তাদের বিপরীত পথে গমনে প্ররোচিত করেছিল। আগেই বলেছি ইজমার অতীত ধারায় নিহিত সৃজনশীল চরিত্র ইজতিহাদের নতুন ক্ষেত্রকে অবারিত করলেও ইমাম শাফি’ঈ সেখানে যবনিকা ঘটাতে মরিয়া ছিলেন। রাষ্ট্র পরিচালনার আইনি কাঠামোর সঙ্গে কোরানের নিরিখে ধর্মানুশীলনের সমন্বয় ঘটানোর চাপ সেকালে তীব্র হয়ে উঠেছিল। কোরানকে ঘিরে সচল বিচিত্র ব্যাখ্যা ও মতপার্থক্যের পরিধিকে কাটছাট করে কীভাবে তাকে একটি একরৈখিক চেহারা দান করা যায় সেই ভাবনা শাফি’ঈকে সম্ভবত উদ্দীপ্ত করে থাকবে। ডিজক্লোউজার (Disclosure) বা উদঘাটনের বহুমাত্রিক স্বভাবে আস্থা রাখার পরিবর্তে এনক্লোউজার (Enclosure) অর্থাৎ ঘেরায়তনে কোরানে গুঞ্জরিত অর্থের জগৎকে তিনি বাঁধতে চাইছিলেন। প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এর যৌক্তিকতা থাকলেও তাঁর এই উদ্যোগকে এ্যানক্যাশ করে ভবিষ্যতে মাযহাব কেন্দ্রিক দীনচর্চাকে মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য অকাট্য করে তোলা হবে, সেটি স্বয়ং শাফি’ঈ হয়তো কল্পনা করতে পারেননি!

ঘটনা যেমন হোক, জাক দেরিদার ভাষ্য ধার করে হয়তো বলা যায় কোরানের অনধিক সাড়ে ছয় হাজার আয়াতের ব্যাখ্যাকে ঘিরে সচল মতপার্থক্যের জগৎকে একরৈখিক কাঠামোয় নির্দিষ্ট করার ভাবনা শাফি’ঈকে উতলা করে তুলেছিল। অন্যদিকে আয়াতের বহুমাত্রিক ব্যাখ্যাকে সংকুচিত ও একরৈখিক করার পরিবর্তে স্থগিত বা মুলতবি বিবেচনা করলে সেখানে শূন্য পরিসরের জন্ম হয়, যেটি সংগত কারণে স্থগিত অবস্থায় বিরাজিত মতপার্থক্যের পুনর্পাঠ ও নতুন ব্যাখ্যা প্রদানে ব্যক্তিকে তাড়না যোগায়; বলাবাহুল্য এরূপ স্থগিতকরণের প্রয়োজনীয়তা তাঁকে ভাবায়নি। দেরিদীয় ছকে মৌখিক (Verbal), আটপৌরে (Informal), সাংকেতিক (Symbolic) এবং অক্ষর ওরফে বর্ণমালা ওরফে লিপিবিন্যাসের (Alphabetic order) গ্রন্থনা (Articulation) থেকে সৃষ্ট পাঠ্যবস্তুতে (Text) সক্রিয় অর্থ ও ব্যাখ্যার জগৎ কখনো পুরোপুরি খারিজ বা তামাদি হয় না। পাঠ্যবস্তুর দেহে বিরাজিত পরস্পরবিরোধী ও সাংঘর্ষিক অর্থ সমূহ সেখানে পুনরায় পঠিত ও বিশ্লেষিত হওয়ার জন্য মুলতবি নামের কোষাগারে জমা থাকে, যেন সেখান থেকে নতুন ব্যাখ্যার পরিসরকে অবারিত করা যায়।

মনে রাখা প্রয়োজন পাঠ্যবস্তুকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ব্যাখ্যা-পরম্পরা সম্পূরক (Supplementary) অর্থ উৎপাদনের কাজে সর্বদা নিয়োজিত থাকে। পরিপার্শ্বে বিদ্যমান যেসব বস্তুরাজি ও ঘটনাকে মানুষ সচরাচর মৌল/আদি/আদ্য/প্রাকৃতিক (Originary) ইত্যাদি বিবরণের আওতায় সংজ্ঞায়িত, গ্রন্থিবদ্ধ (Articlulated) ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে পাঠ্যবস্তুতে পরিণত করে, মনে রাখা প্রয়োজন এহেন গ্রন্থনায় (Articulation) মোড় নেওয়ার আগে অবধি উক্ত বস্তু বা ঘটনারাজি মূক, বর্ণনাতীত ও স্বয়ংক্রিয়তায় বিদ্যমান চিহ্নের নিদর্শন রূপে বাস্তবে বিরাজ করছিল। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সমষ্টি মানুষ স্নায়বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার (*মানবমস্তিষ্কে দৃষ্টি-শ্রবণ-স্পর্শানুভূতি থেকে জাত সাড়া, উদ্দীপন, আবেগের রসায়ন থেকে সৃষ্ট ভাষিক বিবরণ।) সাহায্যে বাস্তবতায় বিরাজিত চিহ্ন তথা নিদর্শনকে বিবরণযোগ্য করে তোলায় চিহ্ন তার স্বকীয়তা হারিয়ে সম্পূরক অর্থ/ব্যাখ্যার অধীন পাঠ্যবস্তুতে রূপান্তরিত হয়। সুতরাং পাঠ্যবস্তুর যত আকার-প্রকার মানুষ পৃথিবীতে সৃজন করে চলেছে তার ষোলআনাকে আদ্য (Beginning) ও প্রাকৃত (Inborn/Natural) চিহ্নের অনুকরণ (Imitation) বা কৃত্রিম ভাবা ছাড়া উপায় থাকে না।

পাঠ্যবস্তু উৎপাদনের এই পদ্ধতি অগত্যা আদ্য/মৌল/প্রাকৃতিক শিরোনামে ভূষিত চিহ্ন/নিদর্শনধারী বস্তজগৎকে সম্পূরক অর্থের সমাবেশে সৃষ্ট ঘটনায় পরিণত করে, যেখানে সম্পূরককে বাদ দিয়ে তাকে বোঝার সুযোগ অবশিষ্ট থাকে না। সম্পূরক-অর্থ-শৃঙ্খলে (Supplementary Meaning Chain) বাঁধা পড়া বা গ্রন্থিত হওয়ার কারণে পাঠ্যবস্তুর দেহে সক্রিয় সকল ভাষিক বিবরণ অবিরত নতুন অর্থ/ব্যাখ্যার দ্বারা স্থানান্তরিত, গৌণ, উহ্য, অবলুপ্ত হতে থাকে। যারপরনাই ‘বাক্ অথবা লেখ্’-এর (Speech/Writing) কাঠামোয় ঘনীভূত ভাষিক বিবরণের একটিও আদ্য কিংবা মৌলিক নয়; অর্থ/ব্যাখ্যাগত পার্থক্যে জেরবার হওয়ার দোষে তারা অবিরাম শুরুর বৃত্তে (*হাইডেগারের ভাষায় Beginning of beginning) ফেরত যায় এবং সেই অবস্থায় পরবর্তী পরিণতির অপেক্ষায় থাকে।

ইহজগৎ সম্পর্কিত সকল বিবরণ ও ব্যাখ্যাকে আপাত নির্দিষ্ট বা নির্ধারিত মনে হলেও উক্ত স্বরূপে অটল থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ভাষা ও সংগীতের আদ্য/প্রাকৃত উৎস সন্ধানে জঁ-জাক রুশো বিরচিত বাখানের পাঠ-বিশ্লেষণে নেমে দেরিদা এই প্রতিপাদ্যকে ক্রমশ অকাট্য করে তোলেন, — বিবরণের উপযুক্ত হওয়া মাত্র একটি চিহ্ন নিজের আদিআক্ষরিক স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে! তাকে কেন্দ্র করে গড়ে-ওঠা বিবরণের বিশ্বটি নির্দিষ্ট, নির্ধারিত, কেন্দ্রীভূত থাকতে চাইলেও বিচিত্র অর্থগত পার্থক্যের জন্ম ও সেই চাপে পাঠ্যবস্তুতে পরিণত চিহ্ন ক্রমশ অ-নির্দিষ্ট, অ-নির্ধারিত ও কেন্দ্রচ্যুত হওয়ার নিয়তি প্রতিরোধে লাচাড় হয়, ফলস্বরূপ তার পুনর্পঠনকে অমোঘ করে তুলতে শূন্য পরিসর (Empty Space) সেখানে ফিরে-ফিরে জন্ম নিতে থাকে!

জঁ-জাক রুশো ও ক্লোদ লেভি স্ত্রাউস-র রচনায় গমনের ধারায় দেরিদা ইঙ্গিত উঠান, — ব্যক্তি যখন ভাষার সাহায্যে বিবরণ প্রদান করে তার সেই বিবরণ অর্থের বর্গীকরণ (Classification of meaning) ও অর্থগত মতপার্থক্যের ক্ষেত্রকে উর্বর করার কারণে সেখানে উৎপাদিত বিবরণের জগৎ Under Erasure অর্থাৎ উহ্যায়ন ও অবলুপ্তির সম্মুখীন হতে বাধ্য থাকে। আপাতভাবে একটি পাঠ্যবস্তুকে একরৈখিক অর্থ/ব্যাখ্যায় নির্দিষ্ট মনে হতে পারে, তবে নির্দিষ্ট থাকার চেষ্টা তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়, যেহেতু অর্থগত মতপার্থক্য ও ব্যাখ্যার জোয়ারকে সেখানে ঠেকিয়ে রাখা কঠিন। ‘অফ গ্রামাটোলজি’তে রুশো-র পাঠ্যবস্তু নিয়ে আলোচনার ক্ষণে দেরিদা মন্তব্য ঠোকেন, — But what is no longer deferred is also absolutely deferred. অর্থাৎ যে-বিষয়কে মীমাংসিত বলে মনে হচ্ছে সেটি অচিরেই মতপার্থক্যের কোপানলে অমীমাংসিত হয়ে ওঠে।

পাঠ্যবস্তুকে কেন্দ্র করে অর্থ উৎপাদনের খেলা অগত্যা বি-নির্মাণের মধ্য দিয়ে গৌণ, উহ্য, অবলুপ্ত, পরিবর্তনশীল ও সমসাময়িক হওয়ার সম্ভাবনায় নিজেকে সক্রিয় রাখে। ভাষা ও পাঠ্যবস্তুর আবির্ভাবকে এখানে সত্তার অস্তিত্ব লাভের ঘটনার ন্যায় প্রহেলিকা ভাবা যেতে পারে। যত প্রকার লেখ্য-বস্তুর আমদানি ভাষায় ঘটে থাকে তাদেরকে স্রষ্টা নামক অধিবিদ্যক অর্থমালায় সক্রিয় ধারণার অনুরূপ কিছু অর্থাৎ ‘নিজ হইতে বিদ্যমান’ (Self-Presence) ও ইনফিনিটাম (Infinitum) বা কিনারাবিহীন মনে হতে থাকে। ঘটনাটি প্রকারান্তরে লেখ্যবস্তুর আধার রূপে ব্যবহৃত ভাষা-উপকরণকে মুহূর্তিক-এর (Instantaneous) সঙ্গে সংযুক্ত হতে বাধ্য করায়। মৌখিক কিংবা লেখ্য উপায়ে সৃষ্ট পাঠ্যবস্তুর তাই সুনির্দিষ্ট জন্মক্ষণ বলে কিছু থাকে না, ওদিকে তার মরণ সেখানে অনিশ্চয়তার দ্যোতক! এইসব কারণে ভাষার সাহায্যে ব্যক্ত চিহ্ন সমূহকে মৌল, আদ্য, প্রাকৃত, অবিকৃত ইত্যাদি অভিধায় বিশ্লেষণ দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। রুশো কথিত Proper Names অর্থাৎ আদি কিংবা আক্ষরিক নাম-পরিচয়ে ব্যক্তি অথবা বস্তুর বিবরণ প্রদানের ঘটনায় অর্থ আরোপণের প্রক্রিয়া সদা অব্যাহত থাকায় একরৈখিক কাঠামোয় অটল থাকা ভাষার পক্ষে সম্ভব নয়। পাঠ্যবস্তুতে সৃষ্ট জ্ঞানের প্রকৃতি Logocentric বা একমুখীন নয় বরং নির্দিষ্ট অর্থ/ব্যাখ্যার গণ্ডি কেটে কেন্দ্রচ্যুত হওয়ার প্রবণতা তাকে সর্বক্ষণ পাঠ-উপযোগী রাখে। রুশোর আলোচনায় দেরিদা এ-কারণে মন্তব্যটি করেছিলেন :—

When within consciousness, the name is called proper, it is already classified and is obliterated in being named. It is already no more than a so-called proper name.Of Grammatology: Jaques Derrida; Translation: Gayatri Chakravorty Spivak; PDF Version; 1997

মুখের ভাষায় ধ্বনি/আওয়াজ আর লেখার ক্ষেত্রে চিত্রগুণ সম্বলিত বর্ণমালা/অক্ষর/লিপির সংযোগ-সমাবেশ-স্থানান্তর থেকে সৃষ্ট পাঠ্যবস্তু নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় চিরকাল কায়েমি থাকার অধিকার এভাবে হারিয়ে ফেলে। স্মরণ রাখা উচিত, ‘অফ গ্রামাটোলজি’ ব্যক্তির (*মতান্তরে রচয়িতার) ব্যবহৃত ভাষা ও তার কাঠামোকে খারিজ করতে উতলা হওয়ার পরিবর্তে এটি বলার জন্য মুখিয়ে থাকে …

সভ্য সায়েব-বাবু থেকে শুরু করে আদিম মানব প্রজাতির ভাষাজগতে পাঠ্যবস্তু জন্ম নেওয়ার ক্ষণে তাকে বিবরণের উপযুক্ত চিহ্ন ও কাঠামোর জন্ম হয়। মৌখিক ও লেখ্য পন্থায় ভাষার শরীরে তারা অর্থ উৎপাদন করে যায়। সমাজ বিন্যাসের ছকে এইসব ভাষিক বিবরণ কী চেহারা ধারণ করছে সেটি সেখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ভাষার শরীরে প্রবাহিত বিবরণের ওপর অর্থ আরোপণের মাধ্যমে যে-সমাজ একে অধিক নির্দিষ্টতা প্রদান করতে তৎপর হয় সেখানে অর্থের ভাঙন তীব্র হয়ে ওঠে! ‘অফ গ্রামাটোলজি’তে রুশো প্রসঙ্গে দেরিদাকে অগত্যা গুরুত্বপূর্ণ এই অনুচ্ছেদটি লিখতে হয়েছিল :—

… এটা এজন্য যে আক্ষরিক নাম-পরিচয়গুলো আর আক্ষরিক নেই, জন্মই তাদের মরণ ডেকে আনে, যেহেতু বর্ণমালার উহ্যায়ন ও আরোপণ হচ্ছে আসল ব্যাপার, কেননা আক্ষরিক পাঠ্যবস্তুর ওপর তারা মাতব্বরি করে না; এ-কারণে আক্ষরিক নাম-পরিচয় বলে কিছু নেই, যেমনটি একমেবাদ্বিতীয়ম (*অর্থাৎ ঈশ্বর বা অধিবিদ্যক বিষয়বস্তু সংক্রান্ত বিবরণ, যেগুলোর সত্য-মিথ্যা, বিদ্যমান থাকা ও না থাকা ইত্যাদি সম্পর্কে নিশ্চিত সুরাহা ভাষায় বিরচিত অর্থ দিয়ে সেরে ফেলা কখনোই সম্ভব হয় না।অনুবাদক।) সত্তার জন্য রক্ষিত সংজ্ঞার ক্ষেত্রে রয়েছে; — সহজসরল আদিম গল্পগাছা ছাড়া বাদবাকিরা অবলুপ্তির অধীন থাকে; যে-কারণে অর্থগত পার্থক্য সৃষ্টি করে এরকম ব্যবস্থায় নিহিত বর্গীকরণে নিজেকে সক্রিয় না রাখলে আক্ষরিক নাম-পরিচয় বলে কিছু সম্ভব হতো না। — অফ গ্রামাটোলজি : জাক দেরিদা; ইংরেজি ভাষান্তর : গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক; বাংলা ভাষান্তর : লেখককৃত; পিডিএফ সংস্করণ; ১৯৯৭

আমাজনের গহিন অরণ্যে নাম্বিকওয়ারা গোত্রের সঙ্গে সঙ্গ-যাপনের মিশ্র অভিজ্ঞতা শেষে ক্লোদ লেভি স্ত্রাউস জানিয়েছিলেন তাঁর সেখানে গমনের আগে অবধি নিজের পরিচয় প্রদান কিংবা লেখ্য উপকরণের সাহায্যে মনের ভাব ব্যক্ত করার পদ্ধতি সম্পর্কে আদিবাসী গোত্রটি বিলকুল অজ্ঞ ছিল। স্ত্রাউসের কল্যাণে এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটে, যদিও সেটি সুখকর কিছু হয়নি। নিজেকে পরিচিত করানো বা লেখ্য উপকরণের সাহায্যে মনের ভাব প্রকাশের কসরত করতে যেয়ে গোত্র সদস্যদের মনোজগতে পরস্পরের প্রতি সুপ্ত হিংসা, বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা নগ্ন হয়ে ওঠে! নিজের গবেষণায় স্ত্রাউস দুঃখ করে লিখেছিলেন :— ‘আমার অনুমান যদি সঠিক হয়ে থাকে তবে যোগাযোগের উপায় রূপে লেখ্যবস্তুর প্রাথমিক কাজটি হচ্ছে মানুষকে অন্যের ক্রীতদাস বানানোর জোগালে খাটা।’ (দ্রষ্টব্য : অফ গ্রামাটোলজি : জাক দেরিদা, ১৯৯৭)

স্ত্রাউসের আদিবাসী-সঙ্গ নিয়ে বিরচিত নৃতাত্ত্বিক গ্রন্থ থেকে প্রয়োজনীয় অংশ চয়ন করে দেরিদা অবশ্য দেখিয়েছিলেন ধীমান নৃতাত্ত্বিকের বিবরণ প্রমাণ করে নাম্বিকওয়ারা গোত্রকে তিনি যতটা নির্দোষ ভাবছেন এবং তাদের সহজ-সরল জীবনে বিদ্বেষ আমদানির ঘটনায় নিজের তথা সভ্যতার অনুপ্রবেশকে দায়ী করছেন তার মধ্যে সত্যতা নেই এমন নয়, তা-বলে প্রাকৃতিক জীবনধারায় সহজাত গোত্রটি অতটা সরল বা নির্দোষ নয়। নিজের পরিচয় দান ও লেখ্যবস্তুর সাহায্যে মনের ভাব প্রকাশের আগে থেকেই মানব প্রজাতির রক্তে প্রবাহিত ঘৃণা, বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসার সঙ্গে তারা বেশ ভালোভাবে পরিচিত ছিল এবং প্রয়োজন অনুসারে এর ব্যবহারে দুটানায় ভোগেনি। মোদ্দা কথা, সভ্য সমাজে লেখ্যবস্তু মানুষকে রকমারি পন্থায় নির্দিষ্ট অর্থের ক্রীতদাস হতে বাধ্য করে আর সমাজ প্রগতির ইতিহাস বিবেচনায় ঘটনাটি মিছে নয়; পক্ষান্তরে দাসত্বের এই কাঠামো আবার লেখ্যবস্তুকে ঘিরে কেন্দ্রীভূত অর্থের উহ্যায়ন ও অবলোপ ঘটাতে মানুষকে খেপিয়ে তোলে। ঠিক যেমন মানবসমাজে নৈতিকতা অনুশীলনের মানে দাঁড়ায় না যতক্ষণ অনৈতিক বলে কিছুকে মৌখিক বা লেখ্য উপায়ে কেউ চিহ্নিত করতে সমর্থ হচ্ছে!



চিত্র-২ : Derrida on Proper Names

… It is because the proper names are already no longer proper names, because their production is their obliteration, because the erasure and the imposition of the letter are originary, because they do not supervene upon a proper inscription; it is because the proper name has never been, as the unique appellation reserved for the presence of a unique being, anything but the original myth of a transparent legibility present under the obliteration; it is because the proper name was never possible except through its functioning within a classification and therefore within a system of differences,…Of Grammatology by Jaques Derrida; Translation: Gayatri Chakravorty Spivak; PDF; 1997; Picture: Google Images

দেরিদা-ভাষ্যের অনতিসংক্ষেপ বিবরণের অন্তে পৌঁছে স্বীকার করা প্রয়োজন, কোরানের আয়াত-ব্যাখ্যাকে ঘিরে সচল মতপার্থক্যের পাঠ ও সেখানে নতুন ব্যাখ্যা সংযোজন সহজ কম্মো নয়। প্রথমত কোরানে ব্যক্ত স্রষ্টা অধিবিদ্যক হলেও তাঁকে বিশ্বাস না করলে গ্রন্থটির কোনো ভিত্তি বা যৌক্তিকতা থাকে না। বিষয়টি দেরিদা কথিত আদি/আক্ষরিক নাম-পরিচয়ের অবিরত উহ্যায়ন বা অবলুপ্ত হওয়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গে দ্বন্দ্ব তৈরি করে। ব্যক্তি বা বস্তু সম্পর্কিত চিহ্নকে সঠিক পরিচয়ে নির্দিষ্টতা প্রদানের সমস্যা আলোচনায় ‘অফ গ্রামাটোলজি’ ভাষায় সৃষ্ট পাঠ্যবস্তুর কেন্দ্রাতিগ হওয়ার প্রবণতাকে গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরলেও ঈশ্বর বা মৃত্যুর মতো অমীমাংসিত ঘটনায় বিজড়িত অর্থের জগতকে নৈরাজ্য রূপে চিহ্নিত করে যায়। এহেন বিবরণে গ্রন্থিত অর্থ বা ব্যাখ্যা ইন্দ্রিয়াতীত ও অপ্রামাণিক ঘটনার ওপর দাঁড়িয়ে থাকার কারণে অধিবিদ্যায় নিজেকে মুলতবি রাখে আর অধিবিদ্যার কোনো সূচনা ও পরিসমাপ্তি থাকে না। কোরানে লিপিবদ্ধ ভাষা দেরিদা বর্ণিত ‘নিজ হইতে বিদ্যমান’ (Self presence) অধিবিদ্যক অস্তিত্বের নমুনা বহন করায় এ-সম্পর্কিত বিবরণ সেখানে অধিবিদ্যক হতেই বাধ্য থাকে।

তথাপি অধিবিদ্যক নাম-পরিচয় ও তার ‘নিজ হইতে বিদ্যমান’ (Self-presence) থাকার ভাষিক বিবরণ সম্পর্কে গ্রামাটোলজির বক্তব্যের সারনির্যাস থেকে এ-কথা বলা যায়, — কোরানে বর্ণিত স্রষ্টা ও সৃষ্টি সংক্রান্ত বিবরণ ‘পূর্ব হইতে বিদ্যমান’ (a priori) প্রতিজ্ঞায় অটল থাকার কারণে দেরিদীয় বিচারে একে ‘অনাসক্ত’ (Impassive), ‘অধরা’ (Intangible), ‘শাশ্বত’ (Eternal) ও ‘অমীমাংসিত আদ্য পার্থক্যে স্থগিত’ (Infinite Originary Differance) অর্থের নমুনা রূপে পাঠ করা উত্তম। সংগত কারণে ‘বিশ্বাস’ শব্দে নিহিত অধিবিদ্যক অর্থ-পরম্পরায় মনকে অটল রাখা ছাড়া ব্যক্তির পক্ষে এই বিবরণকে বিশ্বাসযোগ্য ভাবার যুক্তি থাকে না। অর্থের জন্ম, অবলোপ ও পুনর্জন্মের মামলায় প্রকৃতি (Nature) ও তার বিবরণ প্রদানে লিপ্ত ভাষার আদি/আদ্য/মৌল উৎস (Originary Trace) বিদ্যমান থাকে কি-না সে-আলোচনায় এহেন উৎসকে অমীমাংসিত পার্থক্যে স্থগিত অধিবিদ্যা রূপে পঠিত হতে দেখি :—

মৌল উৎস বা প্রকৃতি সম্পর্কিত ধারণা সংযোজন ও পরিপূরকতায় গচ্ছিত অতিকাহিনিকে বিশুদ্ধ সংযোজকের সাহায্যে রদ করা ব্যতীত অন্য কিছু নয়। এটি হলো (*আদি/মৌল উৎস নামে বিদিত।) নিশানা বিলোপণের অতিকাহিনি, যাকে অমীমাংসিত আদ্য পার্থক্যে স্থগিত বলা যায়; সে বিদ্যমান বা অনুপস্থিত নয়, কিংবা নেতিবাচক ও ইতিবাচকের কোনোটাই নয়। অমীমাংসিত আদ্য পার্থক্যে স্থগিত থাকার অর্থ হলো কাঠামোর ন্যায় সম্পূরক কিছু। এখানে কাঠামো বলতে বোঝায় এমন জটিলতা যেটি কখনো হ্রাস পায় না, বিদ্যমান বা অনুপস্থিত থাকার খেলাকে লোকে সেখানে আকৃতি দান অথবা এর রদবদল ঘটাতে পারে, যেখানে এই অধিবিদ্যার জন্ম হতে পারে যেটি চিন্তনাতীত। — অফ গ্রামাটোলজি : জাক দেরিদা; ইংরেজি ভাষান্তর : গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক; বাংলা ভাষান্তর : লেখককৃত; পিডিএফ; ১৯৯৭

যারপরনাই কোরানের অধিবিদ্যা প্রসূত বিবরণকে দেরিদীয় ছকে পাঠ করার ক্ষেত্রে দুটি বর্গীকরণ অনিবার্য হয় :—

প্রথম বর্গীকরণে ‘মুতাশাবিহাত’ অর্থাৎ স্রষ্টার একত্বের প্রকৃতি, গায়েবি বা অদৃশ্য সৃষ্টি, কিয়ামত-পুনরুত্থান ও পরজাগতিক জীবন সংশ্লিষ্ট রূপকধর্মী আয়াতের ব্যাখ্যাকে ঘিরে বিরাজিত মতপার্থক্যগুলো বিবেচনা করা প্রয়োজন। আলোচনাটি বলাবাহুল্য অমীমাংসিত আদ্য পার্থক্যে স্থগিত প্রক্রিয়ার সাহায্যে সমাধা করা উত্তম। ‘মুতাশাবিহাত’ কেন্দ্রিক আয়াতের ব্যাখ্যায় বিদ্যমান মতপার্থক্যের সমষ্টিকে দেরিদীয় Metaphysics of presence-এর ছকে ফেলে আলোচনার অর্থ হলো সেই থিওলজির উন্মোচন যেটি একাধারে আধ্যাত্মিক ও মরমি এবং সে-কারণে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বলয় থেকে উৎপাদিত অর্থে তাকে বন্দি করা সম্ভব নয়; — অবশ্য এই শর্ত মেনে নিয়ে, — স্রষ্টা হলেন স্বয়ম্ভূ এবং তাঁর দিকে জগতের প্রত্যাবর্তন ঘটবে। দেরিদীয় পাঠ পদ্ধতির সাহায্যে কোরানের আয়াত ব্যাখ্যার ক্ষণে মনে রাখা জরুর, স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে ঘিরে বিরচিত অধিবিদ্যক ভাষার জগৎকে নতুন অর্থ দিয়ে গৌণ, উহ্য, অবলুপ্ত ও নাকচ করা হয়তো কঠিন নয়, অন্যদিকে পাল্টা অর্থের সাহায্যে নাকচ করার খেলাটিকে স্থগিত বা তার প্রতিস্থাপনও সম্ভব! সুতরাং অর্থের কাটাকুটি খেলায় স্রষ্টাকেন্দ্রিক বিবরণ সেই অধিবিদ্যায় পর্যবসিত হতে বাধ্য যেখানে অতীন্দ্রিয় স্বরূপে নিজেকে উহ্য করা ভাষার নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়!

দ্বিতীয় বর্গীকরণে ইসলামের সংজ্ঞা, মুসলমান শব্দের সারার্থ, মুমিন ও মুত্তাকিনের ইহজাগতিক কৃতকর্তব্য সম্পর্কে কোরানে লিপিবদ্ধ ফুরকান অর্থাৎ বিধি-বিধান সংশ্লিষ্ট ‘মুহকাম’ বা সোজাসরল আয়াতের ব্যাখ্যাকে কেন্দ্র করে বিরাজিত মতপার্থক্য সমূহ পাঠ করা যেতে পারে। এটি মতপার্থক্যের নেপথ্যে সক্রিয় সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসকে পুনরায় নতুন অর্থে পাঠ ও ব্যাখ্যার সুযোগ তৈরি করে দেয়, দেরিদা যেটি রুশো ও লেভি স্ত্রাউসের পাঠ্যবস্তু বিশ্লেষণের বেলায় ঘটিয়েছিলেন।

কোরানের মতো কিতাবে লিপিবদ্ধ বাচনিকতার দেরিদীয় পন্থায় Obliteration বা ধসকে সতর্কতা সহকারে যদি পাঠ করা যায় তবে অনেক ফিতনার অবসান ঘটানো হয়তো সম্ভব। দেশকাল সাপেক্ষে কোরানের পাঠ ও ব্যাখ্যায় নতুন পন্থা অনুসরণ যুগের বিচারে আবশ্যক হয়ে পড়েছে। ইজমা ও ইজতিহাদের ভারসাম্য বজায় রেখে প্রথাবন্দি ব্যাখ্যাগুলোকে খারিজ করার পরিবর্তে মুলতবির খাতায় জমা রাখা ও নতুন ব্যাখ্যায় গমনের অনুশীলনকে গতিশীল করা গেলে কোরানকে বদ্ধ টেক্সট ভাবার যুক্তি অবশিষ্ট থাকে না। শাফি’ঈ-র প্রসঙ্গটি এই কারণে পুনরায় টানতে হয়! কোরানের ব্যাখ্যাকে কেন্দ্র করে সচল মতপার্থক্যের জগৎকে সীমিত বা একরৈখিক কাঠামোয় বাঁধার সংকল্পে তাঁর বিপরীত পথে গমন সুখকর উদাহরণ সৃষ্টি করেনি, যেহেতু এর জের ধরে ঐতিহ্যে অটল থাকার প্রথাকে মুসলমান সমাজে অমোঘ করে তোলা হয়, যার খোঁয়ারি সম্ভবত আজো কাটেনি!

অধুনা যে-পন্থায় ইসলামি চিন্তাবিদরা ইজমা, ইজতিহাদ ও কিয়াসে গমন করেন সেটি কোরানকে ইতিহাস পরম্পরায় চর্চিত সূত্রের সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে স্বস্তি বোধ করে, যারপরনাই হাদিস ও মাযহাব প্রসূত ব্যাখ্যাবিজ্ঞান ছাড়া কোরানে গমনকে ভ্রান্তি ও ফিতনার কারণ বলে গণ্য করা হয়। খেয়াল করা প্রয়োজন, কোরানে সংকলিত আয়াত স্ট্যাটিক বা স্থিতিশীল স্বভাবের হলেও যুগের পরিবর্তন ও অগ্রগতির সাপেক্ষে তার ব্যাখ্যা গতিশীল বা ডাইনামিক হতে বাধা নেই। সেই পথে গমনের বদলে পুরোনো ব্যাখ্যাকে মানদণ্ড ঠাউরে ধর্মানুশীলন ঐতিহ্যের অন্ধ অনুসরণকে অমোঘ করে! বলা বোধহয় নিষ্প্রয়োজন এরূপ ধর্মানুশীলন কোরান সম্মত নয় :—

যখন তাহাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ যাহা অবতীর্ণ করিয়াছেন তাহা তোমরা অনুসরণ করো, তাহারা বলে, ‘না, বরং আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে যাহাতে পাইয়াছি তাহার অনুসরণ করিব|’ এমনকি তাহাদের পিতৃপুরুষগণ যদিও কিছুই বুঝিত না এবং তাহারা সৎপথেও পরিচালিত ছিল না — তৎসত্ত্বেও। — বাকারাহ ২:১৭০; সমধর্মী আয়াত মায়িদা ৫:১০৪; আল আ’রাফ ৭:২৮, ৭০-৭১, ১৭২-১৭৩; ইউসুফ ১২:৪০; লুকমান ৩১:২১; ইব্রাহিম ১৪:১০; হিজর ১৫:১৩ ইত্যাদি।

এইভাবে তোমার পূর্বে কোনো জনপদে যখনই আমি কোনো সতর্ককারী প্রেরণ করিয়াছি তখন উহার সমৃদ্ধিশালী ব্যক্তিরা বলিত, ‘আমরা তো আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে পাইয়াছি এক মতাদর্শের অনুসারী এবং আমরা তাহাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করিতেছি।’

সেই সতর্ককারী বলিত, ‘তোমরা তোমাদের পূর্বপুরুষদেরকে যে পথে পাইয়াছ, আমি যদি তোমাদের জন্য তদাপেক্ষা উৎকৃষ্ট পথনির্দেশ আনয়ন করি তবুও কি তোমরা তাহাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করিবে? তাহারা বলিত, ‘তোমরা যাহাসহ প্রেরিত হইয়াছ আমরা তাহা প্রত্যাখ্যান করি।’ — যুখরুফ; ৪৩:২৩-২৪

এইগুলি আল্লাহর আয়াত, যাহা আমি তোমার নিকট তিলাওয়াত করিতেছি যথাযথভাবে। সুতরাং আল্লাহর এবং তাঁহার আয়াতের পরিবর্তে উহারা আর কোন্ বাণীতে (ḥadithin) বিশ্বাস করিবে? — জাসিয়া; ৪৫:৬; উৎস : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।

স্থিতিশীল আয়াতের ব্যাখ্যায় গতিশীল হতে অপারগ ঐতিহ্যপন্থীদের বাড়-বাড়ন্তের কারণে একুশ শতকে পা রাখা ইসলামকে ঘিরে তাকলিদ বা অন্ধ অনুকরণের জয়জয়কার প্রথায় পরিণত হয়েছে। কোরানের নিরিখে কেউ যখন ওজু, সালাত, সিয়াম, হজ, যাকাত, হিজাব ও হারাম-হালাল সম্পর্কে আলাপে উদ্যোগী হয় তাকে কোরান বহিভূর্ত উৎসে সংকলিত নবির হাদিস ও সুন্নাহর কথা প্রতি পদে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, এবং সেটি এই যুক্তিতে যে কোরানে বিষয়গুলো খুঁটিনাটি সহকারে লিপিবদ্ধ হয়নি, সুতরাং এর ওপর ভর করে ইসলাম ধর্মের চর্চা পূর্ণতা পায় না! যদিও কোরানের সতর্ক পাঠ থেকে উল্লেখিত বিষয়গুলো সম্পর্কে স্রষ্টার দিকনির্দেশনা অনুধাবন ও সেই অনুসারে সুন্নাহর অনুশীলন কঠিন নয়।

উক্ত কারণে প্রশ্নটি ওঠে, স্রষ্টা যেখানে মানবজীবনে সংঘটিত সকল ক্রিয়াকর্মের পূর্ণাঙ্গ পথনির্দেশক রূপে কোরানকে স্বীকৃতি দিয়েছেন সেখানে তাকে অপূর্ণ ভেবে কোরান বহিভূর্ত উৎসে গমন ও মানুষের ওপর ধর্মচর্চার নাম করে অতিরিক্ত অর্থের বোঝা চাপানো কতটা যৌক্তিক? স্রষ্টা সাধ্যের অতিরিক্ত কিছু মানুষের ওপর চাপিয়ে দেননি; — এই বার্তার সত্যতা যে মিছে নয় সেটি কোরানে গমন করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে; পক্ষান্তরে যুগের ধারায় সংযোজিত ইসলামি ব্যাখ্যাবিজ্ঞানকে বিবেচনায় নিলে উক্ত বার্তার সত্যতায় আস্থা রাখা কঠিন হয়। ইসলামে এই ‘অতিরিক্ত’-র সংযোজনকে দোষণীয় বলার অভিপ্রায় অধমের নেই। পাঠ্যবস্তুতে অতিরিক্ত অর্থের সংযোজন কেন অবধারিত এবং কী কারণে এটি পাঠ্যবস্তুকে কেন্দ্রচ্যুত হতে বাধ্য করে সেটি দেরিদা ব্যাখ্যা করে গিয়েছেন; যদিও এই অতিরিক্তকে পাঠ যাওয়ার ক্ষণে সময়-পরিবেশ-পরিপার্শ্বকে বিবেচনায় রাখা কেন জরুরি সে-কথা মনে করিয়ে দিতে ভোলেননি। ‘অফ গ্রামাটোলজি’র বয়ানে রুশোর চিন্তার ধাঁচ বুঝতে গিয়ে দেরিদা যে-আলাপ জোড়েন সেটি ইসলামি শাস্ত্রে ভাবনার বনেদ কীভাবে গড়ে ওঠে তার পুনর্পঠনে কাজে লাগতেও পারে :—

সেই অর্থে (*ভাষা/পাঠ্যবস্তুতে) অর্থ সংযোজন একটি শূন্যগর্ভ ঘটনা, তার নিজের কোনো শক্তি নেই, না রয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত বিচলন। সে হলো পরগাছা, একটি কল্পনা বা বিবৃতি, যেটি আকাঙ্ক্ষায় নিহিত শক্তিকে নির্ধারণ ও পরিচিতি করায়। প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক বলকে (Force) বিবেচনায় নিলে কোনো কিছু আসলে ব্যাখ্যার উপযুক্ত হতে পারে না, ঘটনা হচ্ছে, পছন্দ বা অগ্রাধিকারে পার্থক্য সৃষ্টি করে এমন কিছু হয়তো নিজস্ব শক্তি ছাড়াই সেখানে বল প্রয়োগ করতে থাকে। এহেন অব্যক্ত কিছু সকল শৈলী ও আকৃতি নিয়ে রুশো-র ভাবনায় নিজেকে ন্যস্ত করেছে। — অফ গ্রামাটোলজি : জাক দেরিদা; ইংরেজি ভাষান্তর : গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক; বাংলা ভাষান্তর : লেখককৃত; পিডিএফ; ১৯৯৭

ইসলামের ইতিহাসে কালের ধারায় সংযোজিত কোরান বহিভূর্ত উৎসকে অগত্যা নির্ণায়ক না ভেবে ব্যক্তির বিবৃতি প্রদানের আকাঙ্ক্ষায় সৃষ্ট সম্পূরক/সংযোজক পাঠ্যবস্তু রূপে পাঠ করা যেতে পারে। ব্যক্তি বিরচিত এইসব পাঠ্যবস্তুর প্রভাববিস্তারী হওয়ার নেপথ্যে সক্রিয় রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনাবলীর পুনর্পঠনকে সেখানে প্রাসঙ্গিক করা প্রয়োজন। এরকম পাঠে গমনের পর কোরান বহিভূর্ত উৎসের ইসলামি ঐতিহ্যে অনুপ্রবেশের পেছনে রাজনৈতিক অভিসন্ধির ভূমিকা খোলা চোখে দৃশ্যমান হতে থাকে! মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তারের কৌশলকে কেন্দ্র করে আবর্তিত ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর পুনর্পাঠ তাই সময়ের দাবি, যেটি পশ্চিমা সভ্যতায় রেনেসাঁ প্রভাবিত আলোকায়নের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মিশেল ফুকো বা দেরিদারা ঘটিয়েছিলেন।

এখানে খেয়াল রাখা প্রয়োজন, অফ গ্রামাটোলজিতে দেরিদার পাঠ-পদ্ধতি অধিবিদ্যক অর্থ উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় সামাজিক ও রাজনৈতিক বৃত্তে সক্রিয় ভাষা উৎপাদনের প্রণালীকে ফিরে-ফিরে পাঠের বিষয়বস্তু করে তুলেছিল। এই প্রণালীতে উৎপাদিত অধিবিদ্যা অর্থ উৎপাদনের একরৈখিক ছকে প্রবিষ্ট হওয়ার ফলে কেন নৈরাজ্যের কারণ হয় ও শেষতক নিজেকে বিপন্ন করে সেই সত্য তোলে ধরে। দেরিদার পাঠ-পদ্ধতি যে-কারণে তাকলিদ বা অন্ধ অনুগমনের চাপে সমাজের ক্রীতদাসে পরিণত হওয়ার নিয়তিকে প্রতিহত করে যায়। ইসলামে ইজমা, ইজতিহাদ ও কিয়াসের মাযহাব কেন্দ্রিক পাঠ-পদ্ধতির ঐতিহাসিক বিবর্তনে বিকল্প পাঠ্যবস্তু দিয়ে কোরানকে কীভাবে বারবার গৌণ ও উহ্য করা হয়েছে তার বিবরণ বইপত্তর ঘাঁটলে মিলে, কোরানে সংকলিত বাণীর নিরিখে কথিত ইসলামিশাস্ত্র ও ধর্মানুশীলনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করলেও বিষয়টি অস্বচ্ছ থাকে না। পাকিস্তানের প্রয়াত বিদ্বান গোলাম আহমেদ পারভেজ কিংবা মালয়েশিয়ার কোরানপন্থী আন্দোলনের জনক কাসিম আহমদের বক্তব্যে এর অনুরণন টের পাই :—

With the victory and general acceptance of Shafi’i’s jurisprudential theory where the hadith was given a position of almost equal importance with the Quran (the formula is ‘second primary source’), the use of creative thought or ijtihad for all practical purposes was abolished. This came to be known later as ‘the closing of the door of ijtihad’ and the beginning of the regime of taqlid or blind imitation of the great masters, a period beginning from about the fourteenth century till the end of the nineteenth or beginning of the twentieth centuries AD. — Hadith: A Re-Evaluation by Kassim Ahmad; Translation: Syed Akbar Ali, PDF; 1997

কাসিম আহমদের এই বক্তব্য অবধানের পর তাকলিদের বৃত্ত ভেঙে কোরানের সুবেদি পঠনকে পুনরায় সচল করার সম্ভাবনা কেন্দ্রিক আলোচনায় বিস্তারিত হওয়ার জরুরত বোধহয় ‘ইসলামবীক্ষণ’র পরবর্তী গ্রন্থনায় এড়ানো যাবে না।


ইসলামবীক্ষণ : পুনর্বিবেচনার পুনর্বিবেচনা ১
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ১-১৫
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you