তৃতীয় প্রবাহ–১ : জ্ঞানবৃক্ষ ও নূরতত্ত্ব : প্রোগ্রামার আল্লাহ ও হ্যাকার ইবলিশ : কোডিং এবং পালটা কোডিং
উপমা সূত্রে স্রষ্টাকে মহান কম্পিউটার প্রোগ্রামার বলে যদি ভাবি তাহলে বলতে হয় কিছু জিন ও ফেরেশতাকে তিনি ‘কজমো’ রোবটের মতো সৃজন করেছিলেন। বাচ্চাদের খেলা করার জন্য রোবট প্রস্তুতকারী কোম্পানি কজমো নামের পিচ্চি রোবট (*আমার ছেলে অহরহ এই রোবটের কাজকারবার নিয়ে আমাকে ও তার মাকে জ্ঞান ঝাড়ে) সম্প্রতি বাজারে ছেড়েছে। কজমোরা দেখতে কিউট ও দুষ্টু। তাদেরকে এমনভাবে প্রোগ্রামিং করা হয় যেন তারা নিজের ‘আকল’ ব্যবহার করে মজাদার কাণ্ডকীর্তির সাহায্যে বাচ্চাদের বিনোদিত করতে পারে এবং দিনশেষে তাদের মালিকের বাধ্য ও অনুগত থাকে। মুমিন জিন ও ফেরেশতারা সম্ভবত কজমো রোবটের কাতারে পড়ে। নিজের ‘আকল’ দিয়ে দিনভর তারা নানান কাণ্ড করে বেড়ায় কিন্তু সেখানে আল্লাহর নির্দেশ মান্য করা ও তাঁর উপাসনা শেষপর্যন্ত মুখ্য বিবেচিত হয়। তাদের ‘আকল’ এই অর্থে প্রাইমোর্ডিয়াল বা প্রাগৈহিতাসিক অর্থাৎ প্রোগ্রামড্ হওয়ার পর থেকে সেখানে বিশেষ বিবর্তন তারা ঘটাতে পারেনি।
ইবলিশ টাইপের রোবটের কাজকারবার সেখানে ব্যতিক্রম ছিল মানতে হয়। প্রোগ্রামার হিসেবে আল্লাহ তাকে ‘আকল’ সমেত সংবেদন ক্ষমতার অধিকারী করে সৃজন করেছিলেন! সায়েন্স ফিকশন যাকে সাইবর্গ নামে দাগায় বিজ্ঞানীরা এখন সেরকম মানবীয় সংবেদনের অধিকারী এবং এলগরিদমের সাহায্যে নিজের ‘আকল’-এ নতুন সংবেদন ধারণ ও প্রয়োজনে পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম যন্ত্র তৈরির ধান্ধায় রয়েছেন; বিচিত্র নয় ইবলিশকে সেই সময় আল্লাহ হয়তো সেভাবে সৃজন করেন। তার ইবাদতে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে ফেরেশতাকুলের সর্দার ঘোষণা করে তিনি হয়তো পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন নিজের ‘আকল’কে সচেতন অনুভূতি ও সংবেদনশীলতার সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এমন একজন ফেরেশতা তাঁর অনুগত থাকে কি না।
ইবলিশ মনে হয় অনুগত থাকত, কিন্তু মাটি থেকে আদম ও তার পাঁজরের বক্র অংশ থেকে হাওয়া বিবিকে সৃজনের পর (*আদমের পাঁজরের বক্র অংশকে একালের ডাবল হেলিক্স সূত্রে গঠিত জেনেটিক সাবসেট টাইপের মহাফেজখানা ভাবা যেতে পারে। আদমের নারী রূপ তৈরির আইডিয়া বাস্তবে রূপ দিতে আল্লাহ তার দেহ থেকে এই সাবসেট কপি করেছিলেন এবং পরে সাবসেটের কোডিং অর্থাৎ ক্রোমোজমের বিন্যাসে পার্থক্য ঘটানো হয় হাওয়া বিবির স্বতন্ত্র অবয়ব তৈরির জন্য।) আল্লাহ যখন ইবলিশকে সেজদা দিতে বলেন তখন নিজের ক্লাসের কথা ভেবে তার মেজাজ খারাপ হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। একালে যেমন কম্পিউটার প্রসেসর তৈরির জন্য সিলিকন চিপস ব্যবহার করা হয় সেকালে ইবলিশকে ‘বুঝদার’ ফেরেশতা হিসেবে প্রোগ্রামিংয়ের সময় আল্লাহ নূর অর্থাৎ বিশেষ প্রকার বৈদ্যুতিক শক্তির ঘনীভূত ফিউশন ঘটান মনে হয়। নূর বা বিশেষ বৈদ্যুতিক শক্তি দ্বারা চালিত ইবলিশের ‘আকল’ অদ্য কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির যজ্ঞে গুগলসহ অতিকায় কোম্পানিরা সক্রিয় সেরকম কিছু হলেও হতেও পারে।
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মোদ্দা কথাটা সরল, কম্পিউটারের মস্তিষ্ক অর্থাৎ প্রসেসর যে-চিপ থেকে তৈরি সেটা আয়তনে যত ক্ষুদ্র আকৃতি ধারণ করবে সেখানে সন্নিবেশিত পরমাণুকণা তাপগতিবিদ্যার নিয়মে অধিক ঘনীভূত অবস্থায় উপনীত হবে; ঘনীভূত হওয়ার ফলে তাদের মাঝে সংঘটিত বিদারণ (Fission) ও একীভবন (Fusion) প্রক্রিয়ায় ব্যাপক শক্তি ও গতি উৎপন্ন হয়। বিগ ব্যাং বা বৃহৎ বিস্ফোরণের প্রাক-মুহূর্তে পরমাণুকণার এহেন জটলা পাকানো (Quantum Entanglement) সন্নিবেশ থেকে বিশৃঙ্খল গতি ও শক্তি উৎপাদনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, যার ফলাফল স্বরূপ মহাবিশ্ব এখনও সীমানাবিহীন দশায় সম্প্রসারিত হচ্ছে বলে পদার্থবিদরা ধারণা করেন। কোয়ান্টাম কম্পিউটার সৃজনের জন্য কম্পিউটার ল্যাবে সেরকম পরিবেশ তৈরির কাজে বিজ্ঞানীরা খেটে মরছেন। উদ্দেশ্য, প্রচলিত কম্পিউটার থেকে অধিক দ্রুত গতির কম্পিউটার তৈরি করা।
চিত্র–২ : অজ্ঞাতনামা শিল্পীর কল্পনায় ইবলিশ। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে তুরস্কে প্রচলিত চিত্রাঙ্কন পদ্ধতি সিয়াহ কালাম (Siyah Qalam) অর্থাৎ পেন্সিল স্কেচ বা মসীবর্ণ তুলির সাহায্যে অঙ্কিত প্রতিকৃতিতে ইবলিশকে শিল্পী তুর্কি ধাঁচের টুপি ও আলখাল্লা পরিহিত কৃষ্ণবর্ণ ধড়িবাজ পুরুষ রূপে এঁকেছেন। ভাঁজ করা কাগজ, সিল্ক ও অন্যান্য মাধ্যম ব্যবহার করে অঙ্কিত সিয়াহ কালাম চিত্রাঙ্কন পদ্ধতির উৎস রূপে ইরানকে গণ্য করা হলেও এর ওপর বৌদ্ধ ও শামানিক চিত্রাঙ্কন পদ্ধতির ছাপ গভীর। তুর্কি শাসনামলে তুরস্কে পদ্ধতিটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।
Image Source: Iblis: Painter: Unknown; Period: 14-15th century; Medium: Siyah Qalam
Internet Source: wikiwand.com;
বিট নির্ভর (Bit-based) এলগোরিদমে তৈরি প্রচলিত বা ধ্রুপদি কম্পিউটারে পরমাণুকণায় ইলেকট্রনের ঘূর্ণি একরৈখিক; সে হয় নিচে ঘুরে (যা বাইনারি মেট্রিক্সের বিচারে ০) অথবা ওপরে পাক খায় (বাইনারি মেট্রিক্সে ১)। শূন্য ও এক-এর বাইনারি বিন্যাসে সৃষ্ট কম্পিউটার প্রসেসর আর Quantum Entanglement-র অনুরূপ পরিবেশ থেকে তৈরি প্রসেসর তাই গুণগতভাবে ভিন্ন। পরমাণুকণার জটপাকানো সংঘাতে বিশৃঙ্খল কণাদের অভ্যন্তরে ইলেকট্রন একইসঙ্গে ওপরে ও নিচে অথবা যথাইচ্ছা পাক খেতে থাকে। তাপগতিবিদ্যার নিয়মে এটা আপাতভাবে বিশৃঙ্খলা ও অনিশ্চিত দশার কারণ হলেও কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা বিশৃঙ্খল দশাটিকে শৃঙ্খলায় বেঁধে বাড়তি গতি ও শক্তি উৎপাদন সম্ভব বলে একিন যান। বিট নির্ভর এলগোরিদম থেকে তখন তার যাত্রা ঘটবে কোয়ান্টাম বিটস (Qbits) নির্ভর এলগোরিদমে। যে-কম্পিউটার সেখানে সৃজিত হবে সেটার গণনা ও তথ্য সরবরাহের ক্ষমতা অধুনা প্রচলিত কম্পিউটার থেকে দশ হাজার গুণ বেশি হবে, যার অর্থ ধরার বুকে মানুষের জীবনযাপনের ছবি ব্যাপক বদলে যাবে।
ঐশ্বরিক জগতে ইবলিশ সেরকম দ্রুতগতির একখান ‘আকল’র অধিকারী ছিল। এরকম ‘আকলদার’ ফেরেশতা হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ যখন আদমকে সেজদা দিতে বলেন তখন তার অহমিকায় ঘা লেগেছিল সেটা নিশ্চিত। তাকে কিনা এখন নোংরা মাটি থেকে তৈরি চিজকে সেজদা দিতে হবে! অগত্যা আল্লাহকে ম্যাসেজটা সে দিয়ে দিলো ,— চেতন অর্থাৎ ‘আকল’ নামক যে-সক্রিয়তা আল্লাহ গন্দম বৃক্ষে ঝুলন্ত ফলের মধ্যে গোপন রেখেছিলেন সেটা সে জেনে ফেলেছে এবং আদম ও হাওয়াকে জ্ঞানবৃক্ষে ঝুলন্ত ফলের ব্যাপারে সচেতন করা তার জন্য ব্যাপার না। আল্লাহ ও ইবলিশের এই সংঘাতের ফলে ‘জ্ঞান’ যা এতদিন গন্দম বৃক্ষে সিক্রেট বা গোপন ছিল সেটা লিক হয়ে গেল। ইবলিশকে এ-কারণে সেকালের জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ভাবা যায়, কার্যত যার হাত ধরে ‘জ্ঞান’ নামক বস্তুর ধরায় আগমন ঘটেছিল।
সিক্রেট ফাঁস হওয়ার ঘটনা আল্লাহর জন্য বিব্রতকর ছিল, যেহেতু এর মধ্য দিয়ে ‘জ্ঞান’ আর সরলরৈখিক থাকবে না সেটা তিনি টের পেয়েছিলেন। ব্যক্তিভেদে এ-নিয়ে বিচিত্র মত-মতান্তর-বিশ্বাস-অবিশ্বাস এমনকি বিবাদ-সংঘাত ঘটবে সে-ব্যাপারে তাঁর কোনও সন্দেহ ছিল না। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এখন থেকে তাঁর সৃষ্ট জিন ও মানবকে ইবলিশ নিজের ‘আকল’-এর সাহায্যে প্রভাবিত করবে, যার ফলে সচেতনাবিহীন পুষ্পের ন্যায় সক্রিয় মানব সম্প্রদায়ের তাঁর প্রতি নিষ্ঠা ও আনুগত্য অতীতের ন্যায় নিরঙ্কুশ থাকবে না, সেখানে ভেদবিচার ও বিভক্তি কালের ফেরে অমোঘ আকার ধারণের সম্ভাবনাই অধিক! বিভক্তির খারাপ দিকটা এই, ইবলিশ ও তার অনুসারী মানবসন্তানদের বিরুদ্ধে জিহাদে লিপ্ত হওয়া ছাড়া লোকের স্বাধীন ‘আকল’-এ সর্বশক্তিমান আল্লাহর স্বকীয়তা সম্পর্কিত বোধ জারি রাখা তাঁর পক্ষে দুরূহ হবে।
এ-রকম আশঙ্কা থেকে তিনি ধরায় তাঁর প্রতিনিধিরূপে ‘চেহারাসুরতে বিলকুল মানুষ হলেও গড়পড়তা মানুষ থেকে পৃথক গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী’ নবিদের সৃজন করার কথা ভেবেছিলেন। নবি-সৃজনের মাধ্যমে আল্লাহ প্রোগ্রামিংয়ে নতুন ধারার জন্ম দিলেন। এই ধারায় নবির ‘আকল’ মানুষের অনুরূপ হলেও পৃথক। মানুষের মতো ভ্রান্তির ফেরে তাঁর সার্বভৌম একত্ব নিয়ে নবিরা যেন প্রশ্ন তুলতে না পারে সে-জন্য তাঁদের ‘আকল’কে তিনি নিজের অধীন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। নবিদের জীবনধারায় ‘জ্ঞান’ বস্তুটি ‘অজ্ঞতা ও পরমুখাপেক্ষী’র স্মারক রূপে তাই বারবার মানব সম্প্রদায়ের সমুখে হাজির করা হয়। মানবের গর্ভে জন্ম এবং ইহজাগতিক ঘটনার সঙ্গে তাঁদের সম্পৃক্ততা ও ভালোমন্দ বিবেচনার স্বাধীনতা থাকলেও ঘটনার বিচার অথবা সে-ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের চূড়ান্ত ক্ষমতা স্বয়ং আল্লাহর তরফ থেকে না-আসা পর্যন্ত নবিদের জন্য সেটা বৈধ হয় না :—
‘মুহাম্মদ একজন রসুল মাত্র; তাহার পূর্বে বহু রসুল গত হইয়াছে। সুতরাং যদি সে মারা যায় অথবা সে নিহত হয় তবে তোমরা কি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিবে?…’ — আল-ইমরান ৩:১৪৪;
‘বলো, ‘আমি তোমাদেরকে ইহা বলি না যে, আমার নিকট আল্লাহর ধনভাণ্ডার আছে, অদৃশ্য সম্বন্ধেও আমি অবগত নই; এবং তোমাদেরকে ইহাও বলি না যে, আমি ফিরিশতা; আমার প্রতি যাহা ওহি হয় আমি শুধু তাহারই অনুসরণ করি। বলো, ‘অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান?’ তোমরা কি অনুধাবন করো না?’ — আনআম ৬:৫০;
‘তোমার প্রতিপালকের নিকট হইতে তোমার প্রতি যাহা ওহি হয় তুমি তাহারই অনুসরণ করো, তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ্ নাই এবং মুশরিকদের হইতে মুখ ফিরাইয়া লও।’ — আনআম ৬:১০৬;
‘বলো, ‘আমি কোনও নতুন রসুল নই। আমি জানি না, আমার ও তোমাদের ব্যাপারে কী করা হইবে; আমি আমার প্রতি যাহা ওহি করা হয় কেবল তাহারই অনুসরণ করি। আর আমি তো এক স্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র।’ — আহকাফ ৪৬:৯;
‘অতঃপর আমি তাহাদের পশ্চাতে অনুগামী করিয়াছিলাম আমার রসুলগণকে এবং অনুগামী করিয়াছিলাম মারইয়াম-তনয় ঈসাকে, আর তাহাকে দিয়াছিলাম ইঞ্জিল এবং তাহার অনুসারীদের অন্তরে দিয়াছিলাম করুণা ও দয়া। আর সন্ন্যাসবাদ, — ইহা তো উহারা নিজেরাই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য প্রবর্তন করিয়াছিল। আমি উহাদেরকে ইহার বিধান দেই নাই; অথচ ইহাও উহারা যথাযথভাবে পালন করে নাই। উহাদের মধ্যে যাহারা ইমান আনিয়াছিল, উহাদেরকে আমি দিয়াছিলাম পুরস্কার এবং উহাদের অধিকাংশই সত্যত্যাগী।’ — আল-হাদীদ ৫৭:২৭;
‘তিনিই আদি, তিনিই অন্ত, তিনিই ব্যক্ত ও তিনিই গুপ্ত এবং তিনি সর্ববিষয়ে সম্যক অবহিত।’ — আল-হাদীদ ৫৭:৩;
উৎস : আল কোরান; তরজমা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ।
প্রোগ্রামিংয়ের সাহায্যে সর্বজ্ঞ স্রষ্টার অধীন সত্তা রূপে নবিদের সৃজন এবং সিক্রেট ‘জ্ঞান’ ফাঁস হওয়া ও সেটা নিয়ে লোকের বিচিত্র মতান্তর সামাল দিতে আল্লাহ কতটা উৎকণ্ঠ ছিলেন তার ঘটনাবহুল বিবরণ কোরানের পাতায় ইতিহাস হয়ে আছে। গন্দম বৃক্ষে গচ্ছিত কোড হ্যাক হওয়ার ফলে ইবলিশ তার নিজের মতো সেইসব কোডে পরিবর্তন সাধন করেছিল তাতে সন্দেহ নাই। মানুষের ‘আকল’ সূত্রে অর্জিত জ্ঞান সম্পর্কে কোরানের বক্তব্যে বিরোধিতা ও প্রত্যাখ্যানের যে-সুর বিচ্ছুরিত হয় তার নেপথ্যে ইবলিশ কর্তৃক কোডিংয়ের বিকৃতি সাধন ও মানব-‘আকল’-এ তার অনুপ্রবেশ হয়তো গণ্য কারণ। এখন সে-কেলেঙ্কারি সামাল দেওয়ার আশু প্রয়োজনে আল্লাহ ইবলিশের কোডিংকে প্রতিহত করতে পারে এমন কোড নবিগণ মারফত ধরায় সরবরাহ করতে থাকেন। সেইসঙ্গে ওহি বাহিত কোড অনুসরণ ও তার যথাযথ ব্যাখ্যায় সমৃদ্ধ জ্ঞান ছাড়া বাকি সকল কোড ও কোড প্রভাবিত জ্ঞানকে প্রভেদ সৃষ্টিকারী এবং বাতিলের পৃষ্ঠপোষক বলে কোরান বারবার ঘোষণা দিতে থাকে।
আল্লাহ হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন আদম ও হাওয়া ইডেনে বেশি দিন কজমো রোবটদের ন্যায় ঘোরাফিরা করবে না, ইবলিশের প্ররোচনায় তাদের ‘আকল’ সক্রিয় হবে এবং তারা গন্দম ফল ভক্ষণের মাধ্যমে সাইবর্গের মতো নিজের স্বাধিকার নিয়ে ভাবিত হবে, সুতরাং ঘটনা ঘটার পর তিনি তাদেরকে একে অন্যের শত্রু করে পৃথিবীতেই প্রেরণ করেছিলেন। কোরান তাই আল্লাহর হয়ে এই বার্তা নবিকে জানিয়ে দিতে বলে, — মানব সম্প্রদায় নিজ কর্মদোষে পৃথিবীতে অনর্থ ঘটায় এবং একে অন্যকে ধ্বংস করতে উন্মুখ থাকে; স্রষ্টা হিসেবে এই ঘটনাকে প্রশ্রয় দিলে মানুষের অস্তিত্ব এতদিনে বিলুপ্ত হয়ে যেত; সুতরাং বিলুপ্তি ঠেকানোর প্রয়োজনে বিপথগামী গোত্র-সম্প্রদায় ও জাতিকে অন্য গোত্র-সম্প্রদায় বা জাতির মাধ্যমে ধ্বংস অথবা তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে মানুষের অস্তিত্ব তিনি পৃথিবীতে জারি রেখেছেন এবং কেয়ামত ঘটার ক্ষণ অবধি সেটা চলবে :—
‘তাহাদেরকে তাহাদের ঘর-বাড়ি হইতে অন্যায়ভাবে বহিষ্কার করা হইয়াছে শুধু এই কারণে যে, তাহারা বলে, ‘আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ’। আল্লাহ যদি মানব জাতির এক দলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করিতেন, তাহা হইলে বিধ্বস্ত হইয়া যাইত খ্রিস্টান সংসার বিরাগীদের উপাসনাস্থান, গির্জা, ইয়াহুদিদের উপাসনালয় এবং মসজিদসমূহ, — যাহাতে অধিক স্মরণ করা হয় আল্লাহর নাম। আল্লাহ নিশ্চয়ই তাহাকে সাহায্য করেন যে তাঁহাকে সাহায্য করে। আল্লাহ নিশ্চয়ই শক্তিমান, পরাক্রমশালী।’ — উৎস : হাজ্জ ২২:৪০; আল কোরান; তরজমা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ।
তো এই যখন ঘটনা মোহাম্মদ সেখানে ঘটনাছকের গুটি রূপে কোরানে নির্দিষ্ট হতে থাকেন। এও নির্দিষ্ট হয়ে যায়, পৃথিবীতে অনাদিকাল হতে আদমসুরত ধারণ করে যত মানুষ ধরায় গমন করেছে ও সেখান থেকে উবে গিয়েছে তারা সকলে আল্লাহর সৃষ্টি হলেও তাদের মধ্যে দুটি ধারা সবসময় বিদ্যমান ছিল ও থাকবে; যেখানে সংখ্যায় প্রবল ধারাটি ইবলিশ বা অশুভ শক্তির ওয়াসওয়াসা অর্থাৎ কুমন্ত্রণায় পড়ে বিভ্রান্ত এবং সে-কারণে তারা ‘মুশরিক, মুনাফিক এবং হয়তো-বা কাফিরও’; অন্য ধারাটি সূচনালগ্ন থেকে সংখ্যায় অল্প কিন্তু তারাই ‘মুত্তাকিন ও মুমিন’ অর্থাৎ সত্যিকারের ইমানদার বা সত্যপথের পথিক। কজমো রোবটের ন্যায় মুত্তাকিনরাও মাঝেমধ্যে ভুলচুক কাণ্ড করে বসে কিন্তু দিন শেষে আল্লাহকে আদি ও একমাত্র প্রোগ্রামার বলে তারা স্বীকার যায়। বিচারজ্ঞানের স্বাধীনতা দিয়ে সৃষ্টির সময় যেসব বিধান ও নির্দেশ তিনি তাদের ‘আকল’-এ কোডিং করে দিয়েছিলেন ‘স্ব-নিয়ন্ত্রিত ‘আকল’ দোষে এর বিকৃতি ঘটানোর কথা মুত্তাকিনরা ভুলেও ভাবে না।
তাঁর সময়ে জীবিত মানুষজনকে মুত্তাকিন হওয়ার ডাক দেওয়া মোহাম্মদের কাজ! যারা মুত্তাকিন হতে সম্মতি জানায় তারা ‘ইসলাম ও মুসলমান’-এ একীভূত এবং যারা আহবান অস্বীকার করে অবাধ্যতা ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তাদের বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ ঘোষণা তাঁর জন্য ফরজ, যেন পৃথিবীতে তারা সমুচিত শাস্তি ভোগ করতে পারে। মহাদুষ্টু ও অবাধ্য রোবটরা ইবলিশ নামক হ্যাকারের কোডিংয়ে নিজের ‘আকল’ জ্যাম করা এবং ফিতরাতের ওপর প্রতিষ্ঠিত দীনের বার্তা বিস্মৃত হওয়ায় তাদের কোডিংয়ের পালটি কোডিং হচ্ছে আল কোরান। সুতরাং ওহির মাধ্যমে তিনি যেসব কোড পাঠান সেগুলা লবজ করে ইবলিশের কোড বিকল করার উদ্দেশ্য থেকে মোহাম্মদকে মানব রূপে ধরায় পাঠানো হয়, যেন তাঁর উসিলায় অবাধ্য রোবটরা নিজের ‘আকল’ সংশোধনের সুযোগ পায়। সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হলে ইহজগতে নবির হাতে ধ্বংস হওয়া আর পরজগতে ‘জাহান্নাম’ ছাড়া অন্য কোথাও প্রবেশের সুযোগ নেই!
এখন জাহান্নামে প্রবেশের পর তাদের গতি কি? কোরান জানায়, তারা নিক্ষিপ্ত হবে ‘সাকার’-এ; সেখানে প্রবেশের পর তাদের দেহ ‘হুতামা’ বা লেলিহান অগ্নির দ্বারা ঝলসানো হবে কিন্তু গুরুতরভাবে অগ্নিদগ্ধ সেইসব মানবাত্মার মৃত্যু ঘটবে না, আবার তাদেরকে জীবিত বলেও মনে হবে না! ‘সাকার’-এ তাদের জন্য খাদ্য হিসেবে বরাদ্দ থাকবে ‘জাক্কুম’ বা বিষধর ফল, যা তাদের গলায় আটকে যাবে, তবু সেই ফল ভক্ষণে তাদেরকে বাধ্য করা হবে। এই যখন অবস্থা তখন ইবলিশের কোডিং দ্বারা প্রভাবিত রোবটদের লাইনে আনার জন্য স্লেজিং তো বটেই, রক্তে হস্ত রঞ্জিত করার প্রয়োজন দেখা দিলে মোহাম্মদকে সে-কাজটি সমাধা করতে হবে :—
‘অতঃপর নিষিদ্ধ মাস সমূহ অতিবাহিত হইলে মুশরিকদেরকে যেখানে পাইবে হত্যা করিবে, তাহাদেরকে বন্দি করিবে, অবরোধ করিবে এবং প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাহাদের জন্য ওঁত পাতিয়া থাকিবে। কিন্তু যদি তাহারা তওবা করে, সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয় তবে তাহাদের পথ ছাড়িয়া দিবে; নিশ্চয় আল্লাহ অতিশয় ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ — উৎস : আত–তাওবা ৯:৫; আল কোরান; তরজমা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ।
আল্লাহ ও ইবলিশের মধ্যে যুগ-যুগ ধরে চলমান হ্যাকিং যুদ্ধে নবিরা হচ্ছেন সাইবর্গের উপমা। মানব দেহধারী ও মানবচর্চিত সংবেদনের অধিকারী অথবা ধরায় মানবসুলভ জীবন যাপন সত্ত্বেও তাঁদের ‘আকল’ স্বয়ং প্রোগ্রামার আল্লাহ কর্তৃক নির্ণীত, নির্ধারিত, নিয়ন্ত্রিত, যা কিনা পরিস্থিতি সাপেক্ষে সংশোধনের এখতিয়ার আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও নেই! রক্তেমাংসে মানুষ রূপে ধরায় গমন করলেও পাঁচজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁদের তুলনা তাই সংগত নয়। তাঁরা আসলে মানবদেহধারী অন্য প্রজাতির সত্তা; ধরায় পাঠানোর পর মানবিক সীমাবদ্ধতার দোষে ইবলিশের পাল্লায় পড়ে যেন হ্যাকড হতে না হয় সে-জন্য তাঁদের ‘আকল’-এ আল্লাহ ফেরেশতা মারফত সার্জারি ঘটান। ঈসাকে যেমন ‘বিশুদ্ধ আত্মা’ নামক কোডিংয়ের সাহায্যে সার্জারি করে তবে ধরায় পাঠিয়েছিলেন :—
‘এবং নিশ্চয় আমি মূসাকে কিতাব দিয়াছি এবং তাহার পরে পর্যায়ক্রমে রসুলগণকে প্রেরণ করিয়াছি, মারইয়াম-তনয় ঈসাকে স্পষ্ট প্রমাণ দিয়াছি এবং ‘পবিত্র আত্মা’ দ্বারা তাহাকে শক্তিশালী করিয়াছি।…’ — বাকারাহ ২:৮৭;
‘স্মরণ করো, আল্লাহ বলিবেন, ‘হে মারইয়াম তনয় ঈসা! তোমার প্রতি ও তোমার জননীর প্রতি আমার অনুগ্রহ স্মরণ করো, পবিত্র আত্মা দ্বারা আমি তোমাকে শক্তিশালী করিয়াছিলাম এবং তুমি দোলনায় থাকা অবস্থায় ও পরিণত বয়সে মানুষের সঙ্গে কথা বলিতে; তোমাকে কিতাব, হিকমত, তাওরাত ও ইঞ্জিল শিক্ষা দিয়াছিলাম;…’ — মায়িদাহ ৫:১১০;
উৎস : আল কোরান; তরজমা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ।
‘পবিত্র আত্মা’-য় কোডবদ্ধ ঈসাকে শুদ্ধ ও আল্লাহনিষ্ঠ নবি (*সমালোচকরা যদিও একে মগজধোলাই বা ব্রেইন ওয়াশ বলে দাবি করেন।) রূপে ধরায় প্রেরণ অবশ্য কাজে দেয়নি। খ্রিস্টধর্ম এক-অদ্বিতীয় ঈশ্বরকে স্বীকার গেলেও ট্রিনিটি বা ত্রিত্ববাদের অজুহাতে ঈশ্বরের গুণের সার বা এসেন্স থেকে ‘পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মা’ নামে ত্রিমূর্তি খাড়া করে একত্ব ভঙ্গকারী কোডের জন্ম দিয়ে বসে। আল্লাহর এই অনুরূপতা বা সিম্যুলেশন ভারতীয় বৈদিক ধর্মের বিচারে প্রাসঙ্গিক হলেও সেমিটিক ঐতিহ্যে লালিত ইসলামে এটা শিরকের সমতুল্য। কোরানে আল্লাহ পৃথক গুণাবলির অধিকারী আদি অন্তহীন ও নিজ গুণে সক্রিয়; তাঁর স্বরূপে সৃষ্টিসঞ্জাত কোনও কিছুর সমাধি ঘটার সুযোগ নেই। তিনি সৃষ্টি করেন এবং সময় হলে সৃষ্টি সংহার করবেন, কিন্তু সংহারের পর সেই সৃষ্টির গতি পৃথকভাবে নির্ণীত ও নির্ধারিত হবে। তামাম জাহানের স্রষ্টা বা প্রোগ্রামার হলেও তাঁর মধ্যে তাই জাহানের অবস্থান অথবা জাহানের সঙ্গে তিনি সরাসরি সম্পৃক্ত ও অভিন্ন নন।
সুতরাং খ্রিস্টধর্মে চার্চসূত্রে ট্রিনিটি প্রভাবশালী ধারা হয়ে উঠায় তার সঙ্গে কোরানের বিবাদ অনিবার্য হয়। কোরান ইঞ্জিলের সেই অংশে নিজের সাদৃশ্য খুঁজে বেড়ায় যেখানে ঈসা খোদার সিম্যুলেশন বা প্রতিলিপি না হলেও তাঁর কলব্ বা অন্তঃকরণ খোদা কর্তৃক নির্দিষ্ট কোডিংয়ে সুরক্ষিত এবং সে-কারণে পবিত্র। স্মরণ রাখতে হয় মূলধারার ইসলাম আল্লাহর সক্রিয় সত্তার সঙ্গে তাঁর সৃষ্ট জগতের কোনও প্রকার অনুরূপতা ও আত্তীকরণ স্বীকার করে না। যে-কারণে মনসুর হাল্লাজ যখন মোরাকাবায় অনুভবের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছানোর আবেশে নিজেকে ‘আনাল হক’ (*‘আমিই সত্য’ মতান্তরে ‘রব বা ইলাহ্’) ঘোষণা করেন তখন সেটা বিপত্তির কারণ হয়। সুফি ও মরমিধারায় হাল্লাজের এই ঘটনা ‘ইফসাহ্-ই শি’র’ বা গোপনীয়তা ফাঁস নামে সমালোচিত হয়েছিল। ইসলামি ব্যাখ্যাশাস্ত্রে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ইমাম গাজ্জালি মূলধারার ইসলামের পৃষ্ঠপোষক হলেও সুফিবাদকে ইসলামে লিমিট পর্যন্ত অ্যালাউ করেছেন। ‘আনাল হক’ টাইপের বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে এ-রকম স্পর্শকাতর সিক্রেট বা গোপনীয়তা ফাঁসের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় স্মরণ রাখার পক্ষে তিনি মত দিয়েছিলেন। ইসলামগবেষক শাহাব আহমেদ তাঁর ‘What is Islam: The Importance of Being Islamic’ গ্রন্থে গাজ্জালির অভিমত নিয়ে আলোচনা করেছেন, যার সারকথাটি হচ্ছে :—
প্রথমত, আল্লাহর সঙ্গে তাঁর বান্দার সম্পর্ক নিয়ে কলহ জন্ম দিতে পারে এমন বিবৃতি দানের বেলায় সমতুল্য চিন্তাশক্তির অধিকারী কোনও ব্যক্তির সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করা যেতে পারে। গাজ্জালি মনে করেন এহেন বক্তব্য যে রাখতে চায় তার জন্য এটা হবে বুদ্ধিমানের কাজ। দ্বিতীয়ত, ভাবনার বহুরৈখিক স্তর ও বৈচিত্র্য বিষয়ে ‘আকলদার’ লোকের সঙ্গে ভাবনা-বিনিময়ে ঝুঁকির কারণ নেই। প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরে যাদের অবস্থান তাদের সঙ্গে মতামত বিনিময়ের জের ধরে বাদানুবাদ সৃষ্টি হলেও প্রাণ-সংহারী কাণ্ড ঘটার সম্ভাবনা সেখানে ক্ষীণ, বরং নতুন জ্ঞান জন্ম লাভের সুযোগ রয়েছে। তৃতীয়ত, ‘আনাল হক’ জাতীয় উপলব্ধি এমন পরিমণ্ডল বা আবহে কদাপি ব্যক্ত করা উচিত নয় যাদের ‘আকল’ এর গূঢ়ার্থ উপলব্ধির শক্তি রাখে না অথবা যোগ্য লোকের মতো বাহাসে গমন করতে পারে না।
গন্দমবৃক্ষ কেলেঙ্কারি কেন আল্লাহকে অতটা উতলা করেছিল তার আভাস গাজ্জালির অভিমতে খানিক ধরা পড়ে। জ্ঞান ব্যক্তির মনোজগতে যেসব কোড সৃষ্টি করে তার কোনটা আম বা পাবলিক স্ফিয়ারে ব্যক্ত করা উচিত আর কোনটা খাস বা সংবেদী ও বিবেচক মহলের জন্য সংরক্ষিত রাখা উত্তম ইত্যকায় বিষয় নিয়ে ইসলামে বিচিত্র মতামত ও বাহাস এখনও সচল। অন্যদিকে জ্ঞানকে সিক্রেট গণ্য করা সত্যের বরখেলাপ ঘটায় অথবা ‘খাস’ অভিধায় বিশিষ্ট ব্যক্তি ও গোষ্ঠী উক্ত সিক্রেটকে স্বার্থ চরিতার্থে ব্যবহার করে বলে যে-অভিযোগ সে-নিয়ে বিবাদ আজও তামাদি হয়নি। হাল্লাজের ডিক্লারেশন তাই একদিক থেকে সিক্রেট লঙ্ঘন এবং অন্যদিকে সত্যকে যারা ব্যক্তি বা সামষ্টিক স্বার্থে কুক্ষিগত করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নিশান।
শাহাব আহমেদ তাঁর বইয়ে হাল্লাজের প্রসঙ্গটি অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন এবং এই আলোচনায় সে-ব্যাখ্যা প্রাসঙ্গিক নয়। বক্ষ্যমাণ রচনাকারের ক্ষুদ্র বিবেচনায় মনে হয়েছে মনসুর হাল্লাজের ‘আমি সত্য’ বিবৃতি যদি ‘তিনি সত্য’ অর্থাৎ আল্লাহর স্বয়ংক্রিয় একত্ব বুঝিয়ে থাকে সেক্ষেত্রে মূলধারার ইসলাম বিবেচনায় তাঁর বক্তব্য সাংঘর্ষিক ও শিরকের পরিপোষক নয়। কিন্তু হাল্লাজ যদি মোরাকাবার পরম স্তরে পৌঁছানোর আবেশে সক্রেটিসের মুখ নিঃসৃত ডেলফি-বচন ‘নিজেকে জানো’র (*‘মান আরাফা নাফসাহু ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু’ অর্থাৎ ‘যে-ব্যক্তি নিজেকে জানে সে তার রবকেও জানে।’) সুবাদে অর্জিত জ্ঞানের জোরে আল্লাহর গোপন সত্য জেনে ফেলেছেন ভাবেন এবং ‘তিনি ও স্রষ্টা’ অভিন্ন এই ইশারা দিতে চান, সেক্ষেত্রে তাঁর বিবৃতি শিরকের দ্যোতক এবং কোরান বিরোধীও বটে।
কোরানের আল্লাহ সৃষ্টির আদি কারণ বা গ্রোগ্রামার হওয়ার বদলৌতে মৌলিক ও চিরন্তন, আর মৌল কোনও কিছুর মধ্যে সৃষ্ট বস্তুজগতের সম্পৃক্ত বা অভেদ হওয়ার চান্স নেই। আল্লাহর চির-অপরিবর্তনীয় স্বরূপের যেসব ইশারা কোরানে ব্যক্ত হয় তার মূর্ত গাঠনিক রূপ সম্ভব নয়, সুতরাং কল্পনার সাহায্যে উক্ত রূপের প্রতিমা ও বিগ্রহ রচনা ইসলামের বিচারে সিদ্ধ হয় না। কোরানে বর্ণিত স্রষ্টার স্বরূপকে রূপকার্থে ইংরেজ কবি উইলিয়াম ব্ল্যাকের ‘উরিজেন’ বা তীব্র আলোকশিখার সমার্থক ভাবা যেতে পারে, যার বজ্র নির্ঘোষ ও দ্যুতিচমক থেকে সমগ্র জগৎ সাকার আকৃতি লাভ করেছিল। এই নূর বা আলোকশিখার জেনেসিস কী করে সম্ভব হয় সেটা মানবের অজ্ঞাত, তবে সৃষ্ট বস্তুজগৎকে যদি আয়না ধরা যায় তাহলে আয়নাটি সে-নূরের চমকে চমকিত সন্দেহ নেই। কোরান যে-কারণে মানব সম্প্রদায়কে সৃষ্টিজগৎ নিরিখ করার জন্য বারবার তাগাদা দেয় :—
চিত্র–৩ : The Law of Urizen as Creator
Laws of peace, of love, of unity;
Of pity, compassion, forgiveness.
Let each chuse one habitation:
His ancient infinite mansion:
One command, one joy, one desire,
One curse, one weight, one measure
One King, one God, one Law.
Source — Chapter-II, Stanza-8; The Book of Urizen Written and Illustrated by William Blake; Source: PDF Edition;
‘যিনি সৃষ্টি করিয়াছেন স্তরে স্তরে সপ্তাকাশ। দয়াময় আল্লাহর সৃষ্টিতে তুমি কোনও খুঁত দেখিতে পাইবে না; তুমি আবার তাকাইয়া দেখ, কোনও ত্রুটি দেখিতে পাও কি?’ — মুলক; ৬৭:৩;
‘অতঃপর তুমি বারবার দৃষ্টি ফিরাও, সেই দৃষ্টি ব্যর্থ ও ক্লান্ত হইয়া তোমার দিকে ফিরিয়া আসিবে।’ — মুলক ৬৭:৪;
উৎস : আল কোরান; তরজমা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ।
উইলিয়াম ব্ল্যাইক অবশ্য বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্বকে উপহাস করতে উরিজেনের কাহানি রচনা করেছিলেন! অনন্ত নিরাকারে অবস্থিত উরিজেন অজ্ঞাত উপায়ে অপ্রকাশ্য অবস্থা থেকে প্রকাশ্যে নিজের আবির্ভাব ঘটিয়ে বসে। প্রকাশ্য হওয়ার কারণে জগৎ সৃষ্টির যজ্ঞে তাকে নিয়োজিত হতে হয় এবং সৃষ্ট জগৎকে শাসন করার ইচ্ছা তার মধ্যে জেগে ওঠে। জগৎ সৃষ্টি ও এর একচ্ছত্র প্রভু হওয়ার খেয়ালে মশগুল উরিজেন টের পায় না ইতোমধ্যে অনন্ত অপ্রকাশ্য থেকে রহসম্যয় অশুভ অর্কের (Orc) অভ্যুদয় ঘটে গেছে। শুভর সঙ্গে অশুভর উৎপত্তি ঘটায় দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে ওঠে এবং দ্বন্দ্বের কারণে শুভ না অশুভ কে বেশি যৌক্তিক সে-প্রশ্ন সামনে চলে আসে। দ্বন্দ্ব হচ্ছে যুক্তির জনক আর যুক্তি হলো অশুভের প্রতীক। যা কিছু অ-সৃষ্ট তা যুক্তিবিহীন, কিন্তু সৃষ্টকে যৌক্তিক হতেই হয়, অন্যথায় সে কেন বিরাজিত এই প্রশ্নের উত্তর মিলে না। সুতরাং জগৎ সৃষ্টির ধারা বজায় রাখা ও একে শাসন করা ছাড়া উরিজেনের মুক্তি নেই। ইচ্ছে করলেও তার পক্ষে নিজের অতীত অবস্থানে ফেরত যাওয়া সম্ভব নয়। আত্মপ্রকাশ একবার ঘটে গেলে তাকে আর নিরাকারে নিবারণ করা যায় না। উরিজেন এখন স্ব-সৃষ্ট জগতের ফাঁদে বন্দি! নিরাকারে যুক্তিবিহীন অবস্থায় সে বিরাজিত ছিল, নিরাকার ভঙ্গ করে আত্মপ্রকাশ ঘটানোয় নিজেকে যুক্তিযুক্ত করা ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। সুতরাং যুক্তি অশুভের জনক কি না ব্ল্যাকের উরিজেন সে প্রশ্ন রেখে যায় বটে!
সৃষ্টি যদি ত্রুটিহীন হয়ে থাকে তাহলে ইবলিশ সেখানে কী উপায়ে গ্যাঞ্জাম পাকায়, নাকি ইবলিশের এই গ্যাঞ্জাম পাকানোর ক্ষমতাসহ নিজের সৃষ্টিকে আল্লাহ ত্রুটিহীন ঘোষণা দিতে চান ইত্যাদি প্রশ্ন ব্ল্যাকের উরিজেন সূত্রে সংশয়ী মনে উঁকি দিয়ে যায়! যদিও কোরানের মূল বক্তব্য মোটের ওপর একইরকম থাকে, — আল্লাহ নিজে অ-সৃষ্ট মৌল গুণাবলীর দ্যোতক, সুতরাং মানব ছাড়াও যা-কিছু তিনি সৃজন করেছেন তা প্রকারান্তরে তাঁর গুণাবলীর প্রতিভাস হলেও নিজের সৃষ্টি থেকে তিনি পৃথক ও বোধের পক্ষে অগম্য উপায়ে সক্রিয়। কিয়ামতের পর মানব রুহানিয়াত ও সমগ্র সৃষ্টিকে যখন পুনরায় জীবিত করা হবে তখনও মৌল প্রকৃতির কারণে পুনর্জীবিত রুহানিয়াত তাঁর মৌল প্রকৃতিতে অভিন্ন হবে না। শেষ বিচারের ক্ষণেও তারা পৃথক ও স্বতন্ত্র থাকবে। এই বায়বীয়তার কারণে আল্লাহর মৌল প্রকৃতি ও জ্যোতির্ময়তা সম্পর্কে চূড়ান্ত নিদান হাঁকা কঠিন। সূরা ‘নূর’-র ৩৫ নাম্বার আয়াতাংশে ব্যক্ত ‘নূরুন আলা নূরিন’ অর্থাৎ ‘Light upon light’ সর্বপরিব্যাপ্ত সে-নূর বা জ্যোতি আসলে কেমন তার খানিক ইশারা দিয়ে যায় :—
‘আল্লাহ আসমান ও পৃথিবীর জ্যোতি
তাঁর সে-জ্যোতি যেন দীপাধার
যেখানে রয়েছে কাচপাত্রে ঢাকা প্রদীপ,
কাচপাত্রটি যেন-বা জ্যোতির্ময় নক্ষত্র
পবিত্র জলপাই বৃক্ষের আলোয় প্রজ্বলিত
যা পূর্ব অথবা পশ্চিমের নয়
অগ্নি তাকে স্পর্শ করেনি তবুও সে প্রদীপ্ত
জ্যোতির ঊর্ধ্বে জ্যোতি;
আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে
সে-জ্যোতির অভিমুখী করেন।’
-
- উৎস : নূর; ২৪:৩৫; আল কোরান; শায়েখ তোসান বায়রাক কর্তৃক ইংরেজিতে অনূদিত ইয়াহিয়া ইবনে হাবাশ সোহরাওয়ার্দী বিরচিত ‘হায়াকাল আল–নূর’ বা জ্যোতির স্বরূপ এবং এ. ইউসুফ আলী কৃত কোরানের ইংরেজি তরজমা অনুসারে বঙ্গানুবাদ লেখককৃত।
সূরা ‘নূর’-এর গাঠনিক বিশ্লেষণ তিনটি বিষয় ক্লিয়ার করে, প্রথমত ভূমি থেকে আসমান অবধি পরিব্যাপ্ত বস্তুজগৎ আল্লাহর নূরের প্রতিভাসে চমকিত। দ্বিতীয়ত তিনি অ-সৃষ্ট নূর বা কাচপাত্রে ঢাকা প্রদীপ, যাঁর পরিব্যাপ্তি ও উৎস সৃষ্ট বস্তু বা জীবের পক্ষে বোধগম্য নয়। নিজের পরিব্যাপ্তি ও উৎস সম্পর্কে তিনি ছাড়া অন্য কেউ জ্ঞাত না হওয়ার ফলে কোরানে বর্ণিত স্রষ্টা স্বয়ংক্রিয় সচেতনা বা অটোমেটেড কনশাসনেসের স্মারক হতেও পারেন। তৃতীয়ত আল্লাহর নূর বা জ্যোতি অন্য কোনও নূর অথবা নূরসম আলোকের মিথস্ক্রিয়া থেকে জারিত নয়। তাঁর নূরপ্রদীপ অগ্নি ব্যতীত নিজ থেকে প্রজ্বলিত বিধায় তিনি আহাদ বা এক। এখন আহাদ তাঁর নিজেকে কেমন করে প্রজ্বলিত রাখেন অথবা বস্তুজগৎকে গঠিত, সংহত ও সক্রিয় থাকতে বাধ্য করেন ইত্যাদি জ্ঞান তাঁর নিজের মাঝে সংরক্ষিত থাকায় তিনি ‘আলিফ’ বা মানবমনের অজ্ঞাত গুপ্তজ্ঞানের আধার।
‘আলিফ লাম মিম, আলিফ লাম রা, তা হা, তা সিন মিম, হা মিম’ ইত্যকায় বর্ণ বা অক্ষরের সমষ্টি থেকে জাত আয়াতাংশকে যে-কারণে আরবি ভাষাবিদ ও সংখ্যাতাত্ত্বিকরা ‘মুকাত্তা’আত’ (Muqatta‘at) বা সংযোগবিচ্ছিন্ন রহস্যময় অক্ষরের সমাবেশ গণ্য করেন। ইহজাগতিক দৃষ্টিকোণে মেটাফরিক্যাল এই বর্ণগুলো আরবি ভাষার প্রাচীন রূপমূল থেকে উদ্ভূত, যার আদি অর্থ কী হতে পারে বা কোরানে তাদের সংযুক্তির কার্যকারণ রীতিমাফিক নিবিড় গবেষণার বিষয়। অন্যদিকে পরজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি সহকারে অগ্রসর ব্যক্তি বর্ণ সমূহের ভিতরে সাংকেতিক যে-বিচ্ছুরণ নজর করে সে-সম্পর্কে একমাত্র আল্লাহ সম্যক অবগত বলে অভিমত রাখেন। বড়োজোর অনুমান করা যায়, এইসব বর্ণের সমাবেশ থেকে বিকীর্ণ ইশারা গোপন সেই কোডিং যার অনুধ্যান করতে পারলে আল্লাহ কেন মৌল রূপে একা বিরাজ করেন এবং নিজের অভিলাষ পূরণে যৌগিক সৃষ্টির সূচনা ঘটান তার খানিক আভাস পাওয়া যায়।
সুফি ভাবধারার অন্যতম পথিকৃৎ এবং প্লেটো ওরফে আফলাতুন ও প্লোতিনোস-র ভাবধারায় উজ্জীবিত ইয়াহিয়া ইবনে হাবাশ সোহরাওয়ার্দী হয়তো সে-কারণে তাঁর হায়াকাল আল–নূর (The Shape of Light) কিতাবে কোরানে বর্ণিত আল্লাহর জ্যোতির্ময় একত্বকে সম্ভাব্য সাতটি গাঠনিক স্তরে ব্যাখ্যা করেছিলেন প্রারম্ভিকা সহযোগে, — আল্লাহ হচ্ছেন মালাকুত (Malakut) বা আধ্যাত্মিক রাজ্যের অধীশ্বর এবং এই রাজ্যে বিদ্যমান জ্যোতির ঝলক সৃষ্ট জীবের পক্ষে বাক ও বোধশক্তির অতীত। তিনি একাধারে অদৃশ্য, পরমার্থিক ও বিমূর্ত হলেও নিজের মধ্যে পূর্ণ। সোহরাওয়ার্দীর ‘নিজের মধ্যে পূর্ণ’ এই আল্লাহ লাওৎস-র মানবসত্তাকে ‘জলের মতো সহজ’ (Be like water) ভাবার দর্শনে ‘তাও’ (Tao) রপে ধরা দিয়েছিলেন :—
‘আকার নেই তথাপি সে পূর্ণ, আকাশ ও ধরণীর পূর্ব হতে বিরাজিত।
নীরব ও অসীম, একা আর পরিবর্তনের অতীত।
সর্বত্র বিহারী ক্লান্তিহীন।
আসমানী বস্তুরাজির জনয়িত্রী।
নাম জানি না তাই ‘তাও’ বলে ডাকি।
আমায় তাকে বলতেই হবে ‘মহান’।
প্রবাহিত মহান।
দূর-দূরান্তে বহমান।
সুদূরে গমন শেষে আসে ফিরে।
তাও মহান।
আকাশ মহান।
ধরণী মহান।
অপিচ মানুষ মহান।
মহাবিশ্বে চার মহান বস্তুরাজির
একটিতে মানুষের অধিষ্ঠান।
মানুষ ধরণীর অনুগামী।
ধরণী আকাশের অনুগামী।
আকাশ অনুগামী তাওয়ের।
তাও তার নিজ স্বভাবের অনুগামী।’
—উৎস : The Tao Te Ching: Lao Tzu, Translation: Tolbert McCarroll; তরজমা : লেখককৃত; PDF Edition.
প্রকৃতির মতো সহজিয়া স্রোতে বহমান থাকায় বিশ্বাসী লাওৎস-র বচনে ধৃত অনামা-অজ্ঞেয় ‘তাও’র মালাকুত বা রাজ্য আসলে কেমন হতে পারে সে-অনুমান নিগূঢ় মেঘে ঢাকা থাকায় তাঁকে ‘নিজ স্বভাবের অনুগামী’ ভাবা ছাড়া উপায় থাকে না। যে-কারণে হয়তো-বা কোরানে ব্যক্ত আল্লাহর একইসঙ্গে প্রকাশ্য ও গুপ্ত থাকার রহস্যের খেই পেতে সোহরাওয়ার্দী পরমাণু তত্ত্বের শরণ গ্রহণ করেন। তাঁর মতে, সৃষ্ট জগতের সাপেক্ষে বাক-বোধ ইত্যাদির অগোচর আল্লাহর নূর বা জ্যোতির্ময় অবস্থিতি পরমাণুর ন্যায় সূক্ষ্ম হওয়ায় তিনি একাধারে ওয়াজিব, মুমকিন ও মুমতানি বিবেচিত হতে পারেন। শব্দত্রয়ীর ব্যাখ্যায় সোহরাওয়ার্দী তাঁর কিতাবে অ্যারিস্টটলের Syllogism বা অনুমানমূলক যুক্তি নির্মাণ পদ্ধতি ব্যবহার করে যে-অভিমত রাখেন তার সারকথা এখানে স্মরণ করা যেতে পারে :—
সোহরাওয়ার্দীর মতে ওয়াজিব (Wajib) হলো জরুরি বা অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজনীয়তা (Absolute Necessity) যার সক্রিয় উপস্থিতি ছাড়া সৃষ্টি সম্ভব নয়। পরমাণুর সমাবেশ হতে যেমন বস্তু বা পদার্থ গঠিত হয় তেমনি মৌল বা অপরিবর্তনীয় প্রকৃতির অধিকারী আল্লাহ ব্যতীত সৃষ্টির বিকাশ খাপছাড়া ঘটনা এবং কার্যত অসম্ভব। অন্যদিকে মুমকিন (Mumkin) সেই অবস্থার প্রতীক যেখানে বস্তু বা পদার্থ সীমিত পরিসরে ক্রিয়াশীল থাকায় পদার্থ গঠনকারী পরমাণুর অবস্থান সেখানে সুনিশ্চিত নয়। বস্তুর রূপান্তর ও অবক্ষয় থেকে অনুমেয়, তাকে গঠনকারী পরমাণু সীমিত পরিসরে চিরকাল অটল থাকে না। পদার্থ গঠনে ভূমিকা রাখলেও নিজেকে সে সেখানে সীমাবদ্ধও করে না। নিজের চির-অপরিবর্তনীয় মৌল নূর বা এ্যানার্জি ব্যবহার করে আল্লাহ জগৎ সৃষ্টি করেছেন কিন্তু সেখানে তাঁর নূরের অবস্থান ও অনবস্থান সম্ভাবনার বিচারে সমান। মোদ্দা কথা সৃষ্টিতে তাঁর অবস্থান মুমকিন বা সম্ভবপর হলেও সেখানে অবস্থান গ্রহণ তাঁর অজ্ঞাত ইচ্ছা ও স্বভাবের অধীন। আর মুমতানির (Mumtani) মূল কথা হলো আল্লাহর মৌল গুণাবলীর বস্তুজগতের সীমিত পরিসরে অটল থাকার সুযোগ নেই। এই পরিসর তাঁর ব্যাপ্তিকে (‘নূরুন আলা নূরিন’ বা জ্যোতির ঊর্ধ্বে জ্যোতি) সাকার বা দেহধারী জীবের সমতুল করে, সুতরাং পরমাণু যেমন সূক্ষ্ম বিচরণশীল স্বভাবের কারণে সীমাবন্দি থাকে না, আল্লাহর জ্যোতির ছটাও সীমিত পরিসরে নির্দিষ্ট থাকতে পারে না।
পরমাণুতত্ত্বের উপমায় বর্ণিত বাচনিকতায় সোহরাওয়ার্দী স্রষ্টা আল্লাহর নূর বা জ্যোতিকে সেই ‘কারণ’ রূপে বিশিষ্টতা দান করেছেন যিনি মৌল অর্থাৎ ‘আহাদ বা এক’, যাঁকে ছাড়া সৃষ্টি সম্ভব নয়। সেইসঙ্গে স্মরণ রাখা প্রয়োজন, পদার্থে গঠিত জগতের সঙ্গে নিজের নূরকে একীভূত বা সেখানে সীমাবদ্ধ না করলেও বিদ্যমান রূপের জগৎ তাঁর মৌল নূরের নানাপ্রকার প্রতিভাস বটে! এই দ্বিরাভাস কোরানে আল্লাহর ‘একত্ব’ বোঝার চাবি। নিজের কিতাব ‘হায়াকাল আল-নূর’-এ সোহরাওয়ার্দী বিস্তারিত যে-আলোচনা করেছেন তার একাধিক চুম্বক অংশ থেকে প্রাসঙ্গিক একটি অংশ অধমের অপুট ভাষান্তরে নিচে পেশ করছি :—
যাকে পরিমাপ করা যায় না তাকে পরিমাপযোগ্য কোনও বস্তুর মধ্যে আঁটানোও যায় না। মানব-অস্তিত্বের সার বিবেচিত আত্মা বস্তুগত পদার্থ নয় এবং বস্তুর সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। স্থান-কাল মুক্ত হওয়ার কারণে স্নায়বিক সংবেদনের সাহায্যে তাকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। এই আত্মা আহাদ অর্থাৎ এক ও একমাত্র এবং সামাদ অর্থাৎ পরম ও চিরন্তন আল্লাহ থেকে জাত। [আল কোরান; ইখলাস ১-২] মহাজাগতিক কারণ নামে অভিহিত মানুষের আত্মা হচ্ছে অবিভাজ্য আলোক এবং অনুমান প্রক্রিয়ার সাহায্যে এর ব্যাখ্যা হয় না; এই অবিভাজ্য এক ও অদ্বিতীয় পরম-চিরন্তন আল্লাহ থেকে আগত পবিত্র আলো। — উৎস : ইয়াহিয়া ইবনে হাবাশ সোহরাওয়ার্দী বিরচিত হায়াকাল আল–নূর বা The Shape of Light; ভাষান্তর : শায়েখ তোসুন বায়রাক আল–জেরিহ্ আল–হালভেতি; ১৯৯৮; তরজমা : লেখককৃত।
বস্তুজগৎ বা ইহজগতে বিদ্যমান গঠনপ্রকৃতির নানাবিধ চিহ্নের সঙ্গে আল্লাহর প্রভেদ হচ্ছে ‘আলিফ লাম মিম’-এর। ‘আলিফ’ রূপে তিনি গুপ্ত, অদ্বিতীয় ও অবিকার জ্যোতির স্মারক; কোরানে ব্যক্ত ৯৯টি নামবাচক বিশেষণের সাহায্যে সে-জ্যোতির মাঝে বিরাজিত গুণ সম্পর্কে মানুষকে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এই ধারণার সাংগীতিক বন্দনা পাকিস্তানের খ্যাতিমান শিল্পী আতিফ ইসলাম সম্প্রতি ‘আসমাউল-হুসনা’ (*আল্লাহর গুণবাচক নাম) শিরোনামে নিজ কণ্ঠে ধারণ ও ইউটিউবে প্রকাশ করেছেন। আগ্রহীরা ইচ্ছা করলে আতিফের পরিমিতি পরিবেশনাটি সেখানে শ্রবণ করতে পারেন (আসমাউল-হুসনা / আতিফ ইসলাম)। সে যা-ই হোক, ‘মিম’ হলো পর্দা বা আড়াল অথবা সূরা ‘নূর’-এ বর্ণিত জ্যোতির ছটায় চমকিত বাতিধার, যার অন্তরালে ‘আলিফ’ রূপে বর্ণিত চির অজ্ঞাত নূরপ্রদীপের অবস্থান। পর্দা অর্থাৎ আবরণের অন্তরাল থেকে প্রদীপের ছটা আয়নায় প্রতিফলিত কিরণরশ্মির মতো যেমন জগতে চমকিত হয়, তদরূপ আবরণ অপসারিত হলে তার তেজল্লি লোকের চোখ ধাঁধায়, সে-লোকের অন্তর তখন চিরবিশুদ্ধ আলোকশিখায় স্নাত হওয়ার কারণে সৃ্ষ্টির মৌল গুণের প্রতিভাসকে নিজের মধ্যে তরঙ্গিত টের পায়। তূর পাহাড়ের সন্নিকটে গমনের পর মূসার এই অভিজ্ঞতাটি হয়। মোহাম্মদ সে-অভিজ্ঞতা লাভ করেন পবিত্র রজনীতে ‘মিরাজ’ বা আত্মিক ঊর্ধ্বারোহনের মাধ্যমে। ফকির লালন হয়তো সে-কারণে ভাবের আবেশে একদিন গীত বেঁধেছিলেন :—
আছে আলিফ লাম মিম আহাদ নুরী। তিন হরফের মর্ম ভারী। আলিফে হয় আল্লাহ হাদী। মিমে নূর মুহম্মদী। লামের মানে কেউ করলে না। নুক্তা বুঝি হলো চুরি। নব্বই হাজার কলম জারি। নবির সঙ্গে করলেন বারী।। তিরিশ হাজার শরিয়ত জারি। যাট হাজার বুঝাইতে নারি। সিরাজ সাঁই বলে রে লালন। নুক্তার আগে কর নিরূপণ। নুক্তা নিরিখ ঠিক হবে যখন। থাকবে না তো কোট-কাছারী। বিচার না জানিলে কেমনে কোরান বুঝবে। দেহের মাঝে আছে হরফ কয়জন তা দেখবে। — উৎস : লালন গীতিকা : খণ্ড–২; উইকি সংকলন।
লালনের মিম বাখানের প্রতিধ্বনি পাই তাঁর পূর্বসূরী সুফি, মরমি ও লোকসাহিত্যের অতুল খনি পাঞ্জাব অঞ্চলের বাসিন্দা সন্ত বুল্লে শাহ-র (১৬৮০-১৭৫৭) কালামে, — ‘আহাদ ও আহমদে ভেদ সামান্য ভারী, / ও বুল্লে / ভেদ ঘটে ‘মিম’ নামে গিঁটের কারণে।’ [উৎস : বুল্লে শাহ–র কালামাংশ : তরজমা : লেখককৃত; সংগৃহীত : ইন্টারনেট] পাঞ্জাবদেশি বুল্লে ও বাঙাল লালন উভয়ের কাছে ‘মিম’ সেই গিট্টু যা আহাদ নামে সুবিদিত ‘আল্লাহ’র সঙ্গে আহমদ রূপে নন্দিত ‘মোহাম্মদ’-এর প্রভেদ জগতে জারি রেখেছে। ‘মিম’ তাই প্রতিবন্ধক আবরণ যার অপসারণ ঘটলে আহাদ ও আহমদে ভেদ নেই বলে বুল্লে ও লালন দুজনে বিশ্বাস যান। এই মতও আছে, ‘মিম’ হলেন মোহাম্মদী নূর এবং আল্লাহ যদি উপমার্থে প্রদীপ হয়ে থাকেন মোহাম্মদ সেই প্রদীপকে ঘিরে থাকা আবরণ বা দীপাধার, যেটি কার্যত আল্লাহর নূর থেকে সৃষ্ট। এখন দীপাধার যদি অপসারিত হয় তখন আল্লাহর চির অমলিন নূরের জ্যোতিতে মোহাম্মদী নূর বিলীন হতে থাকে এবং এভাবে নূর আল্লাহ ও নূর মোহাম্মদ অভিন্ন আকার ধারণ করেন। চতুর্দশ শতকের পারস্যদেশি মরমি ভাবুক মাহমুদ শাবিস্তারি তাঁর ‘গুলশান ই রাজ’ বা ‘অবগুণ্ঠিত গোলাপ বাগান’ (The Mystic Rose Garden) নামে বিরচিত জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থে উক্তি করছেন :—
মিম জুদা করেছে আহাদকে আহমদ হতে;
বিশ্ব নিমজ্জিত একমাত্র সেই মিমে।
এ রাহার সমাপ্তি তাঁরই মাঝে,
‘খোদা নামে যাঁকে স্মরি’, সে-নামের বারাম সেখানে।’
— উৎস : The Mystic Rose Garden (Gulshan I Raz) by Sa’d Ud Din Mahmud Shabistari; Translation: E H. Whinfiled: 1880; বাংলা তরজমা : লেখককৃত; পিডিএফ সংস্করণ।
মোহাম্মদ ওরফে আহমদ নামক আলোকিত অবগুণ্ঠনের আড়ালে সংগুপ্ত আল্লাহ বা আহাদকে বোঝার চাবি রূপে ‘মিম’ শাবিস্তারির কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। জগতের কাছে জ্ঞাত (Knowable) মোহাম্মদকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারলে সর্বজনবিদিত হওয়া সত্ত্বেও অজ্ঞাত (Unknowable) আল্লাহর খবর করা অসম্ভব কিছু নয়। অ্যারিস্টটল প্রভাবিত যুক্তিছক অনুসারে শাবিস্তারি নিজের গোলাপ বাগানকে সেভাবে সাজিয়ে তুলেছিলেন। তাজদিক অর্থাৎ আল্লাহর একত্বের প্রস্তাবনায় প্রত্যয় যাওয়া সম্ভব যখন ‘মিম’-এর অবগুণ্ঠনে প্রকটিত মোহাম্মদকে সঠিকভাবে কেউ বুঝতে পারবে। স্রষ্টা যেহেতু সেই অবগুন্ঠনের আড়ালে কল্পনাতীত স্বরূপ ধরে বিরাজিত থাকেন তাঁর খবর করার উপায় হলো জগতের কাছে Known Property রূপে প্রকাশ্য মিম মোহাম্মদের অনুধাবন। অজ্ঞাতর কাজকারবার উপলব্ধির জন্য লালনের মতো শাবিস্তারিও আস্থা রেখেছেন যাঁকে জানা সম্ভব সেই জ্ঞাত মোহাম্মদে : ‘From proper arrangement of known conceptions/The unknown proposition becomes known.’ (*দ্রষ্টব্য : Gulshan I Raz by Sa’d Ud Din Mahmud Shabistari); এবং অবধারিতভাবে তাঁকে সম্যক জানতে গিয়ে তিনি অবতরণ করেন প্রাচ্যে চর্চিত মরমিবাদের চিরায়ত ছকে, যেখানে ‘মিম’ হঠালে আহাদ ও আহমদে ভেদ জারি থাকে না বা তাঁরা এভাবে অদ্বৈত হয়ে উঠেন ইত্যাদি। এই অভেদত্ব বোধে প্রভাবিত হওয়ার কারণে শাবিস্তারি, বুল্লে ও লালন সকলেই মোহাম্মদকে উপায় বা মুর্শিদ রূপে তাঁদের রচনায় বন্দনা করেছেন।
আল্লাহর মৌল গুণাবলির প্রতিভাস মানবদেহে ধারণ করে দীনের নবি মা আমিনার গর্ভ থেকে ধরায় ভূমিষ্ট হন এবং মানব সম্প্রদায়কে মুসলমানী দীন গ্রহণের মাধ্যমে ফিতরাতে অটল থাকতে ও আত্মিক উৎকর্ষ অর্জনে ডুব দিয়ে আল্লাহর নূরতরঙ্গে স্নাত হওয়ার আহবান জানান। আত্মিক উৎকর্ষ অর্জিত হওয়ার পর ‘মিম’র পর্দা অপসারিত হয়; অতুল জ্যোতির স্মারক আহাদকে স্ব-চিত্তে তরঙ্গিত বোধ করার শিহরনে মানবমন সেই দশায় উপনীত হয় যেখানে গমনের পর আহাদ ও আহমদে প্রভেদ থাকে না, সেইসঙ্গে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝখানে বিরাজিত বারযাখ বা অন্তরায় ঘুচে যায়! অভেদ চেতনায় উপনীত মানব তখন অনুভবের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছায় এবং টের পায় আল্লাহ হচ্ছেন বিন্দু বা পরম জ্ঞানের উপমা। ইনি সেই বিন্দুরূপী উপমা যিনি তাঁর অব্যক্ত রূপ ব্যক্ত করার বাসনা থেকে নিজ নূরের জ্যোতি বা তেজল্লির সাহায্যে তামাম জাহান সৃষ্টি করেছিলেন। হযরত আলী-র বচনে এই আল্লাহ হচ্ছেন ‘আল’ইলমু নুক্তাতুন’; উল্লেখ্য যে সোহরাওয়ার্দী তাঁর কিতাবে আলী-র বচনের সারকথা ‘All knowledge is a dot’ নামে বুঝে নিতে চেয়েছিলেন। বাংলায় ‘আল’ইলমু নুক্তাতুন’র তফসির এমতো হতে পারে, — তামাম জাহানে বিদ্যমান সকল সৃষ্টি ও সৃষ্টি সম্পর্কিত চিহ্ন পরমজ্ঞান নামে নন্দিত বিন্দু থেকে আগত এবং পরিশেষে সেখানে বিলীন।
এ-প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য, ধীমান পদার্থবিদ জন আর্চিবল্ড হুইলার কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোলস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটির দিনে শক্তিবহনকারী পরমাণুকণার সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম আচরণ ও পরিণাম পর্যবেক্ষণ শেষে মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও ক্রিয়াকর্মকে ‘It from bit’ নির্ণায়ক উক্তিমধ্যে বন্দি করেছিলেন। মহাবিশ্বের অস্তিত্বের কারণ রূপে ‘বিট’ বা তথ্য বহনকারী মৌল কণারা কীভাবে পরস্পর তথ্যের আদান-প্রদান করে তাকে সর্বাগ্রে বিবেচনা করা উচিত বলে তিনি অভিমত রেখেছিলেন।
চিত্র–৪ : Wheeler-eye
Narration: The universe viewed as a self-excited circuit. Starting small (thin U at upper right), it grows (loop of U) and in time gives rise (upper left) to obsever-participancy-which in turn imparts “tangible reality” (cf. the delayed-choice experiment) to even the earliest days of the universe. — Source: Beyond the Black hole by John Archibald Wheeler;
সৃষ্টির সার বা নির্যাস বহনকারী তথ্যবাহক ‘বিট’র উপস্থিতি, সমাবেশ ও আদান-প্রদান সকল অস্তিত্বের গণ্য কারণ। তাদের সক্রিয়তার ফলাফল স্বরূপ মহাবিশ্ব বিদ্যমান ও সম্প্রসারণশীল থাকে। অন্যদিকে তথ্যবাহক ‘বিট’র অনুপস্থিতি অজ্ঞেয় কার্যকারণের ফেরে অস্তিত্বকে মহাবিস্ফোরণ (Big bang) হেন অবস্থায় আনীত করে। হুইলার তাঁর ‘অংশগ্রহণমূলক মহাবিশ্ব’ (Participatory Universe) তত্ত্বে অভিমত রেখেছিলেন, মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও বিদ্যমানতা সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান দর্শক বা পর্যবেক্ষকের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে দর্শক যেভাবে ব্যাখ্যা করেন সে-অনুপাতে মহাবিশ্বের চরিত্র স্থির ও নির্ণীত হয়ে থাকে। মহাবিশ্বের সূচনা ও পরিণতি বিষয়ক ব্যাখ্যাকে তিনি তাই Observer Rhetoric বা পর্যবেক্ষক সাপেক্ষে অলঙ্কৃত বলে চিহ্নিত করেছিলেন।
বিখ্যাত দ্বৈত-ছেদক পরীক্ষণের (Double-slit experiment) প্রলম্বিত সংস্করণ বিলম্বিত-বাছাই পরীক্ষণের (Delayed-choice Experiment) সাহায্যে হুইলার প্রমাণ করেছিলেন কাচের অনুরূপ পর্দার ছিদ্র দিয়ে আগত ফোটন কণার গতিবিধি ও আচরণ সেই কণা পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত দর্শক বা পর্যবেক্ষক পর্দার যৎসামান্য অবস্থানগত হেরফের ঘটানোর মাধ্যমে অনায়াসে পালটে দিতে সক্ষম। অবস্থানের এই পরিবর্তন ফোটনের গতির ওপর প্রভাব রাখায় তার গতি সম্পর্কে পর্যবেক্ষকের পূর্বলব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় পরিবর্তন আসে। মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানুষের সকল জ্ঞান ও ব্যাখ্যা হচ্ছে তদরূপ। পর্যবেক্ষক কোন অবস্থান থেকে কীভাবে মহাবিশ্বকে নজর করছেন তার ওপর তার ধারণা ও ব্যাখ্যা ভাষা পায়। প্রশ্ন হলো, কোনও দর্শক বা পর্যবেক্ষকের অস্তিত্ব যদি না থাকে সেক্ষেত্রে মহাবিশ্ব বলে কিছুর অস্তিত্ব থাকে কি? উত্তরে হুইলার তাঁর সেই বিখ্যাত ডায়াগ্রাম অঙ্কন করেছিলেন যেটি পরে Wheeler-eye বা হুইলারের নয়ন নামে সমাদৃত হয়েছিল।
নিজের অঙ্কিত ডায়াগ্রামে ধীমান বিজ্ঞানী ইংরেজি ইউ (U) অক্ষরকে মহাবিশ্ব বা ইউনিভার্সের স্মারক রূপে উপস্থাপন করেছিলেন। ইউ-র অগ্রভাগ বা মুণ্ডুর ওপরে বসানো চোখ হচ্ছে সেই দর্শক যে তার নিজের লেজ অর্থাৎ ইউ-র প্রান্তভাগ নিরিখে ব্যস্ত। ডায়াগ্রামটি এঁকে হুইলার বুঝাতে চেয়েছিলেন, প্রচলিত কোনও ব্যক্তি বা দর্শক নয় বরং মহাবিশ্ব স্বয়ং তার নিজেকে নিরীক্ষণ করতে সক্ষম। অর্থাৎ দর্শক বা পর্যবেক্ষকশূন্য অবস্থায় ইউ সদৃশ মহাবিশ্ব স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের আদিঅন্ত নিরীক্ষণ ও গতিবিধি পরিচালনা করে থাকে। ব্যক্তি-দর্শকের উপস্থিতি ও অনুপস্থিতিতে তার আসলে কিছু যায় আসে না, তেমনি নিজের আদিঅন্তের সুরাহা একমাত্র সে ব্যতীত দ্বিতীয় কারও পক্ষে সমাধা করা সম্ভব নয়। এখন মহাবিশ্ব নিজেকে সচেতন জ্ঞানের সাহায্যে পর্যবেক্ষণ করে কি না এই প্রশ্নের উত্তর ব্যক্তির ভাবনা ও পরীক্ষণ ভেদে ভিন্ন হতে পারে। ধীমান বিজ্ঞানী যদিও মহাবিশ্বকে স্রষ্টা জাতীয় কিছুর সঙ্গে সম্পৃক্ত করে ভাবেননি, তবে আল্লাহর মৌল গুণাবলীর স্বয়ংক্রিয়তা ও তাঁর মাধ্যমে বস্তুজগতের উৎপত্তিকে ‘হুইলার আই’ ও আলী-র ‘ডট’ উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবা সম্ভব।
এখন প্রশ্ন হলো ‘ডট অথবা বিট’-এ লিপিবদ্ধ রহস্যময় যেসব জ্ঞানের সাহায্যে আল্লাহ নিজেকে একাধারে ব্যক্ত ও অব্যক্ত রেখেছেন মানবমনে সেই জ্ঞান সম্পর্কে বোধের উদয় ঘটায় স্রষ্টার মৌল একত্বে কি সৃষ্টি নিজে একীভূত হয় বা হতে পারে? জ্ঞানের উদয় ঘটার কারণে আহাদ রূপী আল্লাহর একত্বর সঙ্গে আহমদ রূপী মোহাম্মদ সত্যি অভিন্ন হয়ে উঠেন কি? বঙ্গদেশের অতুল ভাবসাধক লালন তাঁর গানে এমনটা বুঝাতে চেয়েছিলেন মনে হওয়ায় প্রশ্নটি তুলতে হচ্ছে। সেই তালাশে লালনের নূরনবিরসুল তত্ত্বে ব্যক্ত আহাদ ও আহমদের অভিন্নতা বিষয়ক টেক্সট পাঠ যাওয়া প্রয়োজন। ওদিকে দূর বৈদেশের নাগরিক ইয়াহিয়া ইবনে হাবাশ সোহরাওয়ার্দী শরিয়া, সুফি ও মরমি ভাবধারার ত্রিমুখী স্রোতে অবগাহন শেষে আহাদ-আহমদ মামলাটি কীরূপে সমাধা করেন সে-আলোচনা চলতি প্রবাহের পরবর্তী ভাগের জন্য আপাতত তোলা রইল।
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ২
ইসলামবীক্ষণ একটি পুনর্বিবেচনা ১
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS