পঞ্চম ক্লাসে ওঠার পরে আমার আরও কিছু বন্ধুবান্ধব জুটে গেল, যারা অকারণেই বেঙ্গলি ভাষায় কথাবার্তা বলে। তারা যে সত্যি সত্যি সিলেটি তা ধরার উপায় নাই। কারণ তাদের অ্যাক্সেন্টে সিলেটি টান একেবারেই অনুপস্থিত। পান্নার সাথে সাথে ক্রমশ তারাও আমার বন্ধু হয়ে উঠল। এদের মাঝে দারুণ স্টাইলিশ বন্যা। সে যেমন চ্যুজি তেমনই ম্যুডি! বন্যা সবার সাথে বন্ধুত্বও করত না। তারও ববড্ কাট, সিল্কি ও স্ট্রেইট হেয়ার। জামাকাপড়ও ফ্যাশনদুরস্ত। আর মুখে হাসিটি লেগেই আছে। সে নাটকে অভিনয় করত। গান ও আবৃত্তিও করত। তখন বন্ধু হবার জন্যে আমরা তেমন বাছবিচার করতাম না। কে আমলার কন্যা আর কে মামলা খেয়ে এল, কে ডিসির কন্যা আর কে কেরানির — এসব কিছুই আমাদের কাছে ম্যাটার করত না। যার সাথে মন পড়ত আমরা তার সাথেই চলতাম। মন পড়া মানে ভালো আন্ডারস্ট্যান্ডিং তৈরি হওয়া। মন পড়া মানে যার সাথে চলেফিরে-হেসেগেয়ে সুখী থাকা। অবশ্য সবাই এমন ছিল তাও নয়। কারো কারো ওই বয়সেই যথেষ্ট উন্নাসিকতা ছিল। বাছবিচার ছিল। নিজেদের সেইম ক্লাস না হলে কৌশলে এড়িয়ে চলার ফন্দিফিকিরও ছিল। আমার অবশ্য ওসব কিচ্ছুরই বালাই ছিল না। আমি ছিলাম সদা প্রফুল্ল। ফুর্তিবাজ আর দৌড়ঝাঁপে আনন্দ করে বেড়ানো পাবলিক, যার কাছে পাঠ্য বইয়ের বাইরের অন্য সবকিছুকেই দারুণ আকর্ষণীয় মনে হতো। এই যেমন ইশকুলের গভীর পুষ্করিণী, তার পাশ ঘেঁষে পুরাতনী নোনাধরা এক দেয়াল। দেয়ালের ওপর বনস্পতি কড়ই গাছের গা-ছমছম এবং হিম-হিম ভুতুড়ে ছায়া। পুকুরের প্রাচীন জলের ধারে খুব করে ঝুঁকে থাকা তরুণ কদমগাছ। পাঁচিলের প্রায় কালো হয়ে যাওয়া শ্যাওলার উপর লতিয়ে ওঠা কোনো অচেনা পাতাছড়ানো জংলি গাছ। আমি তো এইসব দেখতে দেখতেই বেভুলো হয়ে যেতাম!
এর মাঝে বন্যার মাথায় এক আইডিয়া এল — আমাদের টিফিনপিরিয়ডটা কি করে আরও আনন্দমুখর করে তোলা যায়। ইশকুলে ঢোকার মুখেই এক খোলা প্রান্তর। সেই প্রান্তর ছায়াচ্ছন্ন করে রেখেছে বিশাল এক কৃষ্ণচূড়া গাছ। বয়সের সমস্ত মালিন্য ও ঔজ্জ্বল্য নিয়ে সে সদা মৌনমুখর অথচ মায়াময় শীতল! গাছের পাশেই বড়আপা মানে হেডমিস্ট্রেসের অফিস। পর্দাঢাকা রহস্যময় এক গুরুগম্ভীর কক্ষ! সেই কক্ষের সম্মুখে লালকাঁকরে ছেয়ে থাকা ওই প্রান্তরে কিছু ইট ফেলে রাখা। দুই-একটা সিমেন্টের স্ল্যাব। এরাও বহুকালের পুরাতন। স্ল্যাবের শরীরে সময়ের শ্যাওলার পিচ্ছিল স্তর। বন্যা ওই প্রান্তরের নাম দিল — কৃষ্ণচূড়া পার্ক!
কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষের ছায়াঢাকা বলে এমন নাম। এপ্রিল-মের দিকে ওই গাছের শাখায়-পাতায় একেবারে আগুন লেগে লাল হয়ে থাকত। আর সিলেটে ঝড়বাদল ছিল অবধারিত। তখন ওই আগুন এসে লুটিয়ে পড়ত আমাদের পায়ের তলায়। আমরা অবাক-বিস্ময়ে দেখতাম তুখোড় আগুনে ফুল কীভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে পথের ওপর লুটিয়ে পড়ে! ঝড়ে উড়ে আসা কৃষ্ণচূড়াফুলের পাপড়িগুলি হাতে নিয়ে আমাদের মন বেদনায় ভরে উঠত।
স্থির হলো আমরা ক্লাসের টিফিন নিয়ে কৃষ্ণচূড়া পার্কে গিয়ে বসে বসে খাবো। ক্লাসে যে টিফিন দিত, তাতে আমাদের পেট ভরার কোনো উপায়ই ছিল না। ইশকুলের দেয়া টিফিন বলতে অলিম্পিয়া বেকারির একটা ভালো কোনো বিস্কুট, নইলে একটা মিষ্টি। কালোজাম বা একটা ছোট রসগোল্লা। কিংবা একটা চিনিচম্পা কলা। এই তো। ফলে আমরা বাসা থেকে সবাই কিছু না কিছু টিফিন নিয়ে আসতাম। টিফিন না আনলেও কিছু কিনে খাওয়ার জন্য আব্বা আমাকে বাড়তি পয়সা দিয়ে দিত। শুধু আমাকে নয়, অন্যদে্র বাবা-মাও দিয়ে দিত অবশ্যই।
এই কৃষ্ণচূড়া পার্কের সদস্যসংখ্যা খুব বেশি নয়। কারণ ওই পার্কে কে কে যাবে তা বন্যাই সিলেক্ট করে দিলো। মানে বন্যাই ছিল ওই পার্কের ডিরেক্টর কাম কেয়ারটেকার কাম মালি কাম ঔনার। কৃষ্ণচূড়া পার্কে টিফিন খেতে পারার সৌভাগ্যবানদের মাঝে আমিও ছিলাম। আর ছিল পান্না, রত্না, জেনেট। আরেকজন ভারী মিষ্টি চেহারার, অত্যন্ত ভদ্র ও লাজুক টাইপের এক মেয়ে — ওর নাম বলাকা। বলাকা আর কাকলী দুই বোন একই সঙ্গে আমাদের ক্লাসে পড়ত। আর কে যেন একজন ছিল ওই পার্কের সদস্য, তার নাম আজ আর আমার মনে নেই!
জেনেট মেয়েটা পরে অবশ্য লন্ডন চলে যায়। আমি কিন্তু আজও সেই জেনেটকে খুঁজে ফিরি, যার পরনে থাকত হাই-কলার স্লিভলেস ফ্রক আর গলায় সোনার চেইনে ছোট্ট একটা হার্ট শেইপের লকেট। আমি আদতে জেনেটকে খুঁজে ফিরি নাকি আমার বালিকাবেলা খুঁজে ফিরি, আমি ঠিক জানি না।
ওই শ্যাওলা-ধরা স্ল্যাবগুলির উপরে আমরা কাগজ বিছিয়ে সাবধানে বসে টিফিন খেতাম। একে অন্যের টিফিন ভাগাভাগি করেও খেতাম। পয়সা দিয়ে চানাচুর আর মালাই আইসক্রিম কিনে খেতাম। আচার কিনতাম। ফুকল!
উফ রে! ওই চানাচুর ছিল ওয়ার্ল্ডের সবচাইতে মজাদার চানাচুর! কী তার ঘ্রাণ আর স্বাদ! আর কী যে মুচমুচে ছিল!
তিনআঙুলের মাথা দিয়ে কোনোরকমে অন্যদের টিফিনের ভাগ দিতাম। কিন্তু এই সামান্য ভাগ দিতে গিয়ে আমাদের সকলেরই কলিজা চড়চড় করত, কিন্তু তাও দিতাম! বন্ধু বলে কথা!
এর মাঝেই একদিন বন্যা তার পুতুলবিয়ের আয়োজন করে ফেলল। জেনেটের মেয়েপুতুলের সাথে বন্যার ছেলেপুতুলের বিয়ে। বিয়ে হবে টিফিনআওয়ারে, আমাদের ক্লাসরুমেই। আমিও নিমন্ত্রিত অতিথি। কিন্তু আমি পড়েছি মহা ফ্যাসাদে। বিয়েতে কিছু উপহার তো দিতে হবে? কিন্তু কি দিব আমি? আব্বা কোনোদিনই দর্জিবাড়ি থেকে নতুন কাপড় কাটছাঁটের পরে ফেলে-দেয়া টুকরাটাকরা এনে দেবে না। ছোটকাও কিছুতেই নয়। আমাদের বাসায় এসব কেউ বোঝেই না! আমাদের বাসা্য আমি আর আম্মা ছাড়া আর সবাই পুরুষ মানুষ। তারা কেউই পুতুলটুতুল খেলে না। ফলে আমার কাছে পুতুলের জামাকাপড় বা পুঁতির মালা কিছুই নাই! আম্মা যেসব কাপড় কাটে সেসব মেপেমুপে আলাদা করে গুছিয়ে রাখে। ওইসবে হাত দেয়ার এখতিয়ার আমার নাই। রাগে-দুঃখে আমার চোখ ভরে জল আসে। এখন বন্যার পুতুলের বিয়েতে তো আমায় কিছু দিতেই হবে! কিন্তু কি দিব আমি?
আম্মার অগোচরে আমি আমার সামান্য পুরানো হয়ে যাওয়া একটা চেকজামা কেটে ফেলি। সেই জামা থেকে পুতুলের শাড়ি আর স্লিভলেস ব্লাউজ বানাই। বানিয়ে ভাঁজ করে একটা ম্যাচের খালি বাকশে ভরে রাখি। সেই বাকশ আবার রঙিন কাগজে যত্ন করে মুড়িয়েও রাখি।
মহা ধুমধামে বন্যা আর জেনেটের পুতুলের বিয়ে হয়ে যায়। বন্যা ছেলের বউকে ম্যালাই শাড়ি-গয়না দেয়। অতিথি হিসেবে আমাদের খাওয়ায়ও সে। ছোট ছোট কিউব আকৃতির বিস্কুট। এই বিস্কুট ভীষণ স্বাদের। আব্বা অলিম্পিয়া বেকারি থেকে প্রায়ই আনে। হালকা মিষ্টি কিন্তু দারুণ ফুশফুশে মজাদার! বন্যার পুতুলের বিয়ের সমস্ত খায়খরচ ওর মামনি দিয়েছে। কিউব বিস্কুটের সাথে একপিস করে ড্রাইকেক। জেনেট আমাদের হাতে গুঁজে দেয় মিমি চকলেট আর একমুঠ করে চানাচুর।
এত ভুঁড়িভোজের পরও আমি কিছুটা বিমর্ষ থাকি। কারণ আমি নতুন কাপড় দিয়ে কিছু বানিয়ে আনতে পারিনি। আমার আনা উপহার কিছুতেই আমার মনপছন্দ হয় নাই। বন্যা সেসব দেখে কী না কী ভেবে বসে কে জানে?
খাওয়াদাওয়া শেষ হলে বন্যা মহা উৎসাহে বরবউকে বাকশে বন্দী করে ফেলে। গিফটের প্যাকেট খুলে খুলে দেখে কে কী রঙের কাপড়ের টুকরা দিলো। কিংবা একরত্তি পুঁতির মালা? আমার দেয়া সেই ম্যাচ বাকশের মোড়ক খুলতে চাইলে আমি আস্তে করে বলি —
বাসায় গিয়ে দেখো।
আমি বন্যাকে কি করে বলি এতসব উজ্জ্বল কাপড়ের টুকরার ভিড়ে আমার দেয়া উপহার কত বেমানান দেখাবে? বন্যা আলগোছে ম্যাচের খোলটা পুতুলের বাকশে সরিয়ে রাখে। সবার দেয়া সব উপহার দেখা হলেও আমার দেয়া সেই অনুজ্জ্বল উপহার আনদেখাই রয়ে যায়। ইশকুল ছুটি হলে আমরা ঘরে ফিরি। পরদিন ফের ইশকুলে যাই। কিন্তু বন্যা আমার দেয়া গিফট নিয়ে কিছুই বলে না। যেন কোথাও কিছুই ঘটে নাই, এমন মুখ করে থাকে। আমিও চুপচাপ সবার সাথে যথারীতি কৃষ্ণচূড়া পার্কে যাই। লাল-কমলা-হলদে রঙের এন্তার ফুলের পাপড়ি বিছিয়ে থাকা প্রান্তরে বসে হল্লা করে টিফিন খাই। হাতের আঙুল চেটে আচার খাই। কিন্তু পুতুলের বিয়েতে নতুন কাপড় উপহার দিতে না-পারার দুঃখ আমার কিছুতেই ঘোচে না!
বন্যা এ নিয়ে ক্লাসের কাউকে কিছুই বলে না। এমনকি আমাকেও না! আমি ভাবি, ওর এতসব নতুন কাপড়ের টুকরাটাকরার মাঝে আমার দেয়া অনুজ্জ্বল কাপড়টা হয়তো লুকিয়ে পড়েছে…!
ব্যানারে ব্যবহৃত ছবিকাজের শিল্পী আলফ্রেড আমিন
… …
- সুরমাসায়র ১২ || পাপড়ি রহমান - July 8, 2020
- সুরমাসায়র ১১ || পাপড়ি রহমান - July 2, 2020
- সুরমাসায়র ১০ || পাপড়ি রহমান - June 23, 2020
COMMENTS