পোপদ্বয় || আহমদ মিনহাজ

পোপদ্বয় || আহমদ মিনহাজ

খ্রিস্টান চার্চ ও তার যাজক-পুরোহিতদের কাজকারবার ঘিরে সিনেমার সংখ্যা প্রচুর হলেও তার সবগুলো মনকে সমান টানে না।  চিলির সিনেনির্মাতা পাবলো লারিনের এল ক্লাব  (The Club) আর ব্রাজিলের ফার্নান্দো মেইরেলেসের দ্য টু পোপস  আমার দেখা এই জনরার সেরা ছবির কাতারেই পড়ে। লোকে যাজক-পুরোহিতদের নিষ্পাপ ও স্বর্গীয় ভাবতেই অভ্যস্ত, যদিও দিনের অন্তে উনারা মনুষ্যকুলে পড়েন। রুটিনছন্দে বাঁধা পৌরহিত্যের চাপ সামাল দিতে গিয়ে তাদের ভুল হয়, পদস্খলন অহরহ ঘটে, সংশয় জাগে মনে। নিজেকে সংশোধনের পন্থা আর অনুশোচনার ভিতর দিয়ে যেতে হয় বৈকি। লারিনের ছবিখানা এ-রকম একাধিক অভিযোগবিদ্ধ পুরোহিতদের সংশোধনালয়ে বসবাস ও পরবর্তী ঘটনা দিয়ে বোনা।

ধর্মযাজকরা আজকের দুনিয়ায় কীভাবে খাপ খাওয়াবেন সেই প্রশ্ন ছবির ঘটনাপ্রবাহ ক্রমশ উন্মোচন করে যায়। খ্রিস্টান যাজকতন্ত্রের শ্বাসরোধী চাপে পুরোহিতদের নৈতিক অধঃপতনের সমালোচনা আর আত্মমুক্তির অন্বেষণও সেখানে উপজীব্য হয়। পরিচালক পুরোহিততন্ত্রের গুরুতর সমস্যার ভিতর ঢুকতে চেয়েছেন, যা তাকে পেডোফিলিয়া থেকে শুরু করে জোরপূর্বক ধর্মান্তরের মতো ঘটনা ধামাচাপা দিতে বাধ্য করায়। পাদ্রি-পুরেহিত-যাজকরা সেখানে অন্যকে ভিক্টিম করেন আর চার্চ নিজের মান রক্ষায় স্বয়ং তাদেরকেই কৌশলে বলির পাঁঠা করে। ছবির আন্তঃবয়ান জটিল ভাবনার সূত্রপাত ঘটায়। এই নিবন্ধটা যারা পড়ছেন, তাদের মধ্যে কেউ যদি সিনেমাটা না দেখে থাকেন তবে দেখে নিতে পারেন।

দ্য টু পোপস  ক্যাথলিক খ্রিস্টান সমাজের মুখপত্র ও ভ্যাটিকান সিটির গোপন নথিপত্র ফাঁসের ঘটনায় বিব্রত পোপ দ্বিতীয় ষোড়শ বেনেডিক্ট-এর পদত্যাগ আর বর্তমান পোপ ফ্রান্সিসের দায়িত্ব গ্রহণের সত্য ঘটনাকে ঘিরে সৃষ্ট নাটকীয়তার ছায়া অবলম্বনে বিরচিত। নান্নি মোরেত্তির উই হ্যাভ অ্যা পোপ  ছবিতে ভ্যাটিকান সিটির পোপ দেহ রাখলে কীভাবে নতুন পোপকে নির্বাচন করা হয় তার ওপর আলো ফেলেছিল। মেইরেলেসের ছবি ঘটনার আরো গভীরতলে প্রবেশ গিয়েছে। মাত্র দেখে শেষ করলাম বলে হয়ত আবেগপ্রবণ বোধ করছি এখনো, তবে এই ছবিখানা একাধিকবার দেখে ফেলা যায়। কিছুদিন পরে আবার দেখবো বলেই মনে হয়।

পোপ ফ্রান্সিস ওরফে হর্হে মারিও বার্গেলিয়ো ইউরোপ মহাদেশের বাইরে প্রথম পোপ হিসেবে ২০১৩ থেকে দায়িত্বে বহাল আছেন। ক্যাথলিক চার্চের বিধি অনুসারে মৃত্যু অবধি তিনি পদে বহাল থাকবেন। অন্যদিকে জার্মান নাগরিক পোপ বেনেডিক্ট দ্বিতীয় পোপ জন পোলের মুত্যুর পর দায়িত্ব লাভ করেন। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে খ্রিস্টান যাজকতন্ত্রকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ঐতিহ্যপন্থী ও রক্ষণশীল হওয়ার কারণে তাকে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। সেইসঙ্গে ভ্যাটিকান সিটির অভ্যন্তরে ঘটা কেলেঙ্কারি শক্ত হাতে মোকাবিলায় ব্যর্থ হওয়ায় নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন।

বার্গেলিয়ো আর্জেন্টিনায় সত্তর দশকের সামরিক শাসনের দিনগুলোয় সংঘটিত গুম-হত্যা প্রতিরোধে সঠিক ভূমিকা পালন করতে না পেরে মনস্তাপে জর্জরিত ছিলেন। সময়ের সঙ্গে ভ্যাটিকান সিটির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পারার হতাশাও তাকে পীড়িত করে তোলে। যারপরনাই কার্ডিনাল বিশপের পদ থেকে অব্যাহতির জন্য পোপ বেনেডিক্টের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশে রোমে গমন করেন। তার জনপ্রিয়তা ও সর্বজনগ্রাহ্যতার কারণে ক্যাথলিক সমাজ যদিও তাকেই সম্ভাব্য পোপ হিসেবে দেখতে চাইছিল। দুই পোপের সাক্ষাৎ, সংলাপ বিনিময়, সংগীত (বিশেষভাবে বিটলস), ফুটবল ও ট্যাঙ্গো নিয়ে বাতচিত, ঈশ্বরের সঙ্গে সংযাগ, একাকিত্ব আর ফেলে-আসা দিনগুলোয় নিজ ভ্রান্তি তথা পাপের খতিয়ান বিষয়ে পরস্পরের নিকট অকপট স্বীকারোক্তিকে ছবিতে কুশলতার সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। এই বাতচিতের ভিতর দিয়ে তারা একে অন্যকে বুঝে ওঠার সফরটা সেরে ফেলেন।

ছবিটা তার নির্মিতিগুণে আগ্রহ ধরে রাখে। নির্মাণপ্রণালি এককথায় চিত্তাকর্ষক, ভাবনাজাগানিয়া, সময়-প্রাসঙ্গিক এবং মনোবিধুরও বটে। চোখে জল সহজে আসে না কিন্তু এই ছবিটি বিশেষ করে পোপ ফ্রান্সিসের আত্ম-উপলব্ধি ও জীবনযাপন মনকে আবেগাতুর করে। ধর্ম মানে তো খালি আচারবিধি নয়, ওটার প্রতি অঙ্গ থেকে স্পিরিচুয়াল হিলিঙের প্রকৃত সুবাস ছলকে ওঠা চাই, নতুবা সকলই গরল ভেল। তো এই বিবেচনায় পরিচালকের সংবেদি বয়ান প্রথম দেখায় মন কেড়েছে। বুদ্ধিদীপ্ত নির্মিতি। সময় করে দেখে নেবেন আপনারাও। টরেন্টে দুটি ছবিই সুলভ বলে লিঙ্ক আর দিচ্ছি না।

আমাদের ইমামতন্ত্র নিয়ে দ্য টু পোপস-এর মতো ছবি কবে হবে কে জানে! আজ না হোক কাল হয়ত হবে। আরববিশ্বে সিনেমার নতুন তরঙ্গ আস্তেধীরে গতি লাভ করছে। সৌদি আরবে বাদশাহ সালমানের সংস্কার-উদ্যোগ পরিস্থিতির খানিক বদল ঘটিয়েছে। সময়ের চাপে খ্রিস্টান যাজকতন্ত্র নিজেকে মানুষের বিবিধ সমস্যার আধ্যাত্মিক নিরাময়ের সঙ্গে সংযুক্ত করার যিশুসুলভ প্রেরণাকে আবারো ফিরে পেতে চাইছে। ইমামরা সেটা একদিন ভাবতে বাধ্য হবেন মনে করি। অন্যথায় ইসলামি পুরোহিততন্ত্র নিজের অবক্ষয় ঠেকাতে পারবে না। সেইদিন লারিন বা মেইরেলেসের মতো নির্মাতা সেই ছবি বানাবে যা ইমামতন্ত্রের গোপন অলিন্দে গিয়ে ঢুকবে ও তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে যাবে। সমালোচনার সঙ্গে আত্মমুক্তির অনুসন্ধানও হয়ত উঠে আসবে সেদিন।

সেইদিনের অপেক্ষায় আছি যেদিন সুদানের আমজাদ আবু আলালার মতো ইউ উইল ডাই অ্যাট টুয়েন্টির মতো ছবি যেন বানাতে না হয়। মর্মবিদারক এই সিনেভাষার বয়ান নিয়ে আপাতত আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।


তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you