নামের আগে ডেফিনিট আর্টিক্যল ‘দি’ বসিয়ে এই ফিল্মমেইকার মায়েস্ট্রোকে একটা স্যাল্যুট ঠুকতে চেয়েছি শুধু। শববহনের যাত্রায় আমরা হাজির ছিলাম না কেউই, ট্রিবিউট জানাইতে যেয়েও অনেক বেশি বিলম্ব ঘটে গেল বোধহয়। সিন্দাবাদের ভূতের মতো রোজগারঘানির জোয়াল চাপে আমাদের কান্ধে কোনোপ্রকার পূর্বঘোষণা ছাড়াই, আর আমরাও সময় গেলে সাধন করতে বসে একটু মনস্তাপে ভুগি। কিন্তু অগত্যা।
হ্যাঁ, একজনই তিনি। মৃণাল সেন অদ্বিতীয়। একমেবাদ্বিতীয়ম্। যদিও এই নামপদ নিয়া আরও অনেক বঙ্গসন্তান রয়েছেন দুনিয়ায়, তাদের মধ্যে কেউ কবি কি চিত্রকর-ভাস্করও কেউ, ইংরেজি ‘দি’ আর্টিক্যল বসাইলে বুঝতে হবে এই মৃণাল হতেই পারেন না আর-কেউ ম্যুভিমায়েস্ট্রো মৃণাল সেন ছাড়া। রায় এবং ঘটকের সহরথী তিনি, ফিল্মহিস্ট্রির বইপুস্তকগুলাতে এইটা একটা কমন তথ্য।
পরিণত বয়সেই ইন্তেকাল করলেন বলতে হয়। বার্ধক্য তো সকলেরেই পাকড়াও করে আগে-পরে। সেনের জীবনে শেষ দশকটাই শুধু শ্যুট করা ছাড়া ছায়াছবি নির্মাণ ছাড়া ফাঁকা গিয়েছে। বেশ কতকগুলি ইন্টার্ভিয়্যু আর আত্মজৈবনিক বই একখানা পাওয়া গিয়েছে। এর আগের দশকগুলো কর্মমুখর ছিল, ম্যুভিনির্মাণমুখর ছিল, সংখ্যায় এবং গুণমানে সেই মুখরতা লা-জওয়াব। সব মিলিয়ে ক্যারিয়ার ছিল পাঁচ/সাড়ে-পাঁচ দশকের। এই কালপরিসরে সেনের ফ্যুললেন্থ ফিচার ফিল্ম পঁয়তিরিশের বেশি বৈ কম হবে না। আরও আছে বিস্তর তথ্যচিত্র, প্রবন্ধনিবন্ধ, প্রচুর সমালোচনাসাহিত্য, রয়েছে সিনেমার সমুজদার তৈরির সাংগঠনিক তৎপরতার সঙ্গে সেনের দীর্ঘ ও ঘনিষ্ঠ লিপ্ততা।
বাংলায় কেন, গোটা দুনিয়াতেই এতটা ধারাবাহিক সৃজনতৎপর নির্মাতা বার করা সাধ্যাতীত না হলেও শক্ত হবে। এত মগ্ন ম্যুভিনির্মাতা, সেনের মতো, আজকের দুনিয়ায় আরেকজন আসবেন বলিয়া আশ্বাস পাওয়া ভার। এত আত্মসম্মানবোধ নিয়া আর-কোনো নির্মাতা, এত কমিটেড এত কর্মযোগী শিল্পস্বতঃস্ফূর্ত, আজকের দুনিয়ায় বিরল।
মৃণাল সেনের অভিষেক হয় যে-সিনেমাটা বানিয়ে সেইটার নাম ‘রাতভোর’, আমরা জানি। কিন্তু চলচ্চিত্র নিয়া তার পরীক্ষানিরীক্ষার শুরু হয় ‘বাইশে শ্রাবণ’ নির্মাণের সময় থেকে। এই সিনেমার নির্মাণ ও মুক্তির বছর ১৯৬০। সকলেই নিঃসন্দেহ হলো বড় একজন নির্মাতার যাত্রা বিষয়ে। কেবল দর্শক আর চলচ্চিত্রবোদ্ধারাই নয়, মৃণাল নিজেও বুঝতে পারলেন ‘বাইশে শ্রাবণ’ তৈরির সময়টায় যে সিনেমাই হতে চলেছে তার কাজের ক্ষেত্র। প্রকাশের মাধ্যম হিশেবে সেনের সিনেমা তারপর থেকে একটা আলাদা আদলই তৈয়ার করেছে। দেশে এবং বিদেশে পেয়েছে অ্যাক্লেইমের পরে অ্যাক্লেইম।
সিনেমায় মৃণাল সেনের অন্বেষণ ও বিষয়বৈচিত্র্য বহুবিধ। অক্লান্ত তিনি সিনেভঙ্গি তথা কাহিনিবয়ন ও প্রদর্শনের শৈলী তল্লাশিবার কাজে। সেসব কিছুই কিন্তু খুব উচ্চকিত নয়। নির্লিপ্ত শৈল্পিক শৌখিনতাও নৈব চ। তবু পোলিটিক্যাল ওভারটোনের ব্যাপারটা কারো কারো অবলোকনে এসেছে সেনের ছবির ক্রিটিক করতে যেয়ে এবং তা মাঝেমাঝে অসত্যও নয় মনে হয়। কিন্তু নৈর্ব্যক্তিকতা আর ব্যক্তিকতার মিশেলে সেই টোনটা আলাদা মাত্রায় উন্নীত হয়ে সেনঘরানায় রূপ নিতে পেরেছে শেষমেশ।
গল্প বলা বা কাহিনি বয়নের ভঙ্গি প্রসঙ্গে সেনের ছবি ইয়াদ করতে গেলে এন্তার কথা চালাতে হয়। একদম শর্টকাটে বলি। ‘নীল আকাশের নিচে’ সিনেমায় একটা সাধারণ ভঙ্গিতে সেনকে বলতে দেখি, আবার ‘ইন্টার্ভিয়্যু’ কি ‘পদাতিক’ বা ধরা যাক ‘কোরাস’ প্রভৃতি সিনেমায় এসে সেই চিরাচরিত বলনভঙ্গিটিই ভেঙে ফেলেন সেন। গল্পবলা ধারণাটাকেই যেন নয়া কায়দায় ভাবতে শেখান আমাদেরে।
এরপরে, একের পরে একে, সেনের শিল্পচিন্তা বিবর্তিত হয়েছে সেলুলয়েডের আদরায়। কাহিনিচিত্রে, তথ্যচিত্রে, লেখায় এবং মুখোমুখি চিন্তাবিনিময়ে সেনের বিকাশের সঙ্গে বাংলা চলচ্চিত্রও অনেকটাই বিকশিত ও বৈভব-উদ্ভাসিত হয়েছে খেয়াল করব। বিষয়ের সঙ্গে আঙ্গিক বা প্রকরণ যেমন, তেমনি আঙ্গিকের সঙ্গে বিষয় হেঁটেছে কখনো পাশাপাশি আবার কখনও সমানুপাতিক দূরত্বান্বয়ে সমন্বিত হয়ে। কখনো প্রত্যক্ষ পোলিটিক্স, কখনো সমষ্টি, কখনো-বা ব্যষ্টির মানসচিত্র পরিস্ফুটন ও সংশ্লেষণ-বিশ্লেষণে সেনের অবিরল অনলস নির্মাণশ্রম ও প্রতিভার সাক্ষাতে বাংলা চলচ্চিত্র পরিণত হতে থাকে।
মৃণালের বেশিরভাগ কাজের পটভূমি হিশেবে আমরা একটা শহরেরই উপস্থিতি লক্ষ করি ফিরে ফিরে। সেই শহর আর-কোনটা হবে সেনের প্রিয় শহর কলকাতা ছাড়া? তাই বলে কেবল শহুরে জনসমষ্টি নিয়াই তিনি সিনেমা বানায়া নাগরিক মধ্যবিত্তের পকেট তাক করেন নাই। ক্ষয়িষ্ণু গ্রামীণ ইশ্যু উত্তোলন ও বিশ্লেষণেও মৃণালের মন, মেজাজ ও মর্জি ক্রিয়াশীল থাকতে দেখি জীবনভর। ‘মাটির মনিষ’, ‘ওকা উরি কথা’ ছায়াছবিগুলা আমরা এই বিবেচনাকালে মেমোরিতে রাখব।
‘ভুবন সোম’ থেকেই মৃণালের যাত্রা আরেকটা বাঁক নেয়। এক অন্য মৃণাল যেন। প্রথানুবর্তী গল্পকাঠামো নস্যাৎ করে একলা আজনাবি রাস্তায় হাঁটতে বেরোনো স্রষ্টা এক। ন্যারেটিভ ভাঙার এই নয়া যাত্রায় একে একে এল কখনো ‘খন্ডহর’, কখনো ‘খারিজ’ প্রভৃতি সিনেমা। বা, আরও প্রলম্বিত তালিকা আনতে চাইলে বলা যায়, ‘একদিন প্রতিদিন’ বা ‘পরশুরাম’ বা ‘একদিন আচানক’ প্রভৃতি। ঠিক যে একেক সিনেমায় একেক মৃণাল এবং প্রত্যেকবারই পূর্বাপেক্ষা পরিণত, তবু সবকিছুর মধ্যে একটা অখণ্ড মালার ন্যায় মৃণালের দেখা আমরা পাবো নোটিস করতে চাইলে। এবং অনুসন্ধিৎসু সদা ভ্রামণিক মৃণাল। বৈচিত্র্যসন্ধানী মৃণাল। ‘জেনেসিস’ সিনেমায় নারী-পুরুষ সম্পর্কবিশ্লেষণ উপজীব্য হয়েছে দেখতে দেখতে পরক্ষণে দেখব ‘মহাপৃথিবী’ সিনেমায় মানবিক মূল্যবোধের বিপর্যয়ে তাড়িত আরেক মৃণাল। এবং এই তাড়নারই যেন চূড়ান্ত প্রকাশ-পরিণতি দেখতে পাই ‘অন্তরীণ’ সিনেমায়। একটা সাধারণ গল্পকে কী অসামান্য সাধারণ ভঙ্গিমায় প্রেজেন্ট করা যায় এর একটা হাজির নজির দেখা যায় ‘আমার ভুবন’ ম্যুভিটিতে।
এই মৃণালের আনাগোনা শারীরিক অনুপস্থিতি দিয়া থামিয়া যাবার নয়। এই মৃণালের পুনঃপুনঃ প্রত্যাবর্তন ম্যুভিসমুজদার দর্শকেরা পারবেন দেখে যেতে আজীবন।
ইন্তেকালের খবর আখবারে পড়ে একটা কথা বারবার মনে পড়ছিল। কবিতা ভালোবাসতেন মৃণাল। রবীন্দ্রনাথ-দান্তে-হিকমত-হিমেনেথ অনেকেরই। ইন্টার্ভিয়্যুতে একবার পড়েছিলাম, একবার নয় বেশ কয়েকবার কয়েক জায়গায়, দুনিয়াজোড়া খ্যাতিমান এই সিনেমাভাবুক নির্মাতার প্রিয় কবির নাম শঙ্খ ঘোষ। তাকে জিগ্যেশ করা হয়েছিল নতুন সিনেমায় হাত দিচ্ছেন কবে, এর উত্তরে হেসে জবাব দিয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষের নতুন বই বেরোলেই। বিস্তারে বলেছিলেন, সমাজের গতিবিধি তিনি কবিতার ভিতর দিয়ে যেমনটা আন্দাজ করতে পারেন অন্য কিছু দিয়ে সেভাবে এত জোরালো বোঝাপড়া তার হয় না। আর এক্ষেত্রে শঙ্খ ঘোষের কবিতা তার কাছে শেষ ভরসা।
ট্রিবিউটগদ্য : সুবিনয় ইসলাম
… …
- গোপালটিলায় গানসন্ধ্যা - February 2, 2021
- গান ও গঞ্জনা - December 1, 2019
- নগরনাট সঞ্জীবস্মরণ - November 21, 2019
COMMENTS