বর্ষশেষের বনতুলসী || উৎপলকুমার বসু

বর্ষশেষের বনতুলসী || উৎপলকুমার বসু

জঙ্গল মহালের এইদিকে কোনও বড় গাছ নেই। কেবল ঝোপঝাড়, কাঁটালতা। ডাঙা জমি। নাবাল মাটি।

চৈত্রশেষের ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে এই প্রান্তরে আমি আর মধুবাবু ছাতা মাথায় ঘুরছি। ভদ্রলোকের পিতৃদত্ত নাম একটাকিছু ছিল বটে কিন্তু এখন আশি বছর বয়সে তিনি সকলের মধুবাবু।

পথের পাশে সর্ষেক্ষেত। দু-একটা সর্ষেফুল হাতে ঘষে তিনি অক্ষরের মতো পাঠ করেন, শোঁকেন এবং বলেন — এবার কালবৈশাখী আসতে দেরি আছে। অন্তত হপ্তাখানেকের মধ্যে নয়। আমরা নিচু জমি, কাঁকর-ল্যাটেরাইটের একটা শুকনো জলের স্রোত ধরে দূরের গ্রামটার দিকে এগোতে থাকি।

“হ্যাঁ, গান্ধীজিই আমার নাম দেন। বলেন — ‘দেখো বাংগালী বাবু, আজসে তুম মধুবাবু বন্ যাও। দেশকো মধু পিলাও।’
আমার ছেলেবেলা থেকে পশুপাখির খুব শখ। কথাটা খুব মনে ধরেছিল। মৌমাছিবিশেষজ্ঞ হয়ে উঠলুম।
ওয়ার্দায় অনেক মৌমাছির বাকশো বসিয়েছিলুম …”

সংক্রান্তির সূর্য এখন মধ্যগগন পার হয়েছে। মধুবাবু হাঁটছেন। জিরোচ্ছেন। হঠাৎ এদিক-ওদিক মোড় নিচ্ছেন। ভাঙা দেওয়ালের পাশে, কাঠের ফ্রেমের ওপর বসানো একটা চৌকো বাকশো, অনেকটা লেটারবক্সের মতো। ভেতরে উঁকি দিয়ে উনি বললেন — হ্যাঁ, ঠিক আছে। বা, কোনোটায়, — নাহ্, এ বাকশোটাকে আরও উঁচুতে বাঁধতে হবে।

এ পর্যন্ত গোটা তিরিশেক মৌমাছির বাকশো আমরা দেখেছি। বেলা পড়ে আসার আগে আরও কয়েকটি বাকশো পর্যবেক্ষণ করার কথা।

— ‘বছর কিন্তু শেষ হয়ে এল, মধুবাবু। কেমন কাটল আপনার বছরটা? — পাশে হাঁটতে হাঁটতে আমি প্রশ্ন করি।
— ‘আপনার কেমন কাটল, আগে বলুন?’ উনি জবাবের বদলে প্রশ্ন করেন।
— ‘আমরা কাগজের লোক। খারাপ খবর, খুন-জখম-রাহাজানি, দেশনেতাদের কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি — এইসব নিয়ে কারবার আমাদের। সে-হিসেবে বছরটা ছিল যাকে বলে ঘটনাবহুল।’
— ‘হ্যাঁ, তা ঠিক। কিন্তু ভালো কিছু খুঁজে পাননি? মানবজাতিকে সামান্য একটু আশার বাণী শোনাতে পারে — এমন কিছু নজরে পড়েনি?’
— ‘অত বড় মাপে যদি ধরেন তবে বলব, অর্থাৎ একটা নেগেটিভ ঘটনা বলব যার ফল কিন্তু অত্যন্ত পজিটিভ বা মঙ্গলদায়ক। যেমন ধরুন এ-বছর পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হয়নি। হতে তো পারত। এজন্য রেগন-গরবাচভকে ধন্যবাদ জানাতে হয়।’
— ‘এবং মধুবাবুকে।’
— ‘অ্যাঁ, আপনিও ওদের র‍্যাকেটে আছেন নাকি? গোপনে আণবিক বোমাটোমা বানাচ্ছেন এই জঙ্গলে বসে?’

আমরা ততক্ষণে একটা কুঁড়ে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছি। এটা মধুবাবুর ঘর, ল্যাবোরেটরি এবং মধুসংগ্রহশালা।

— ‘আন্দামানে শিখেছিলুম ব্যাপারটা। মৌমাছি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ। যেমন ধরুন মৌমাছি যদি ফুলে ফুলে উড়ে না বেড়ায় তবে তো পলিনেশন হবে না। অতঃপর ফল হবে না। সামনের বছর কোনও বীজ পাওয়া যাবে না, ফুল ফুটবে না, মৌমাছির খাদ্য বা মধু পাওয়া যাবে না। তারা উন্মাদ হয়ে যাবে। লোকজনকে আক্রমণ করবে। বড় মাপে কাজটা করতে পারলে গ্রাম-কে-গ্রাম উজাড় করে দেবে। দেশের কৃষিব্যবস্থা সম্পূর্ণ বানচাল হয়ে যাবে।’
— ‘সর্বনাশ! মৌমাছির এমন ট্রেনিং দেওয়া যায় নাকি? কে দেবে?’
— ‘হ্যাঁ যায় এবং দিতে পারে এই শর্মা। কেবল ঐ ছবির নিচে বসে ও-কাজ আমি করতে পারব না।’
মধুবাবু দেওয়ালে সদাহাস্য গান্ধীজির ছবিটা দেখান।

— ‘ওসব ভয়ের কথা থাক। আপনার সংগ্রহে শ্রেষ্ঠ মধু কোনটা — সেটা দেখি।’
মধুবাবু একটা বড় মাপের হোমিওপ্যাথির শিশি থেকে ছোট্ট একচামচ মধু ঢাললেন। অনেকটা সাদা ঘিয়ের মতো ঐ পদার্থের চা-চামচপ্রতি দাম বেয়াল্লিশ টাকা। কবিরাজি ওষুধে ব্যবহার হয়। বাজারে পাওয়া যায় না। আমি সামান্য স্বাদ নিয়ে দেখলুম। উত্তেজক বটে।
— ‘এটা কিসের মধু?’
— ‘নির্ভেজাল বনতুলসীর!’

[গানপারটীকা : আর্টিকেলটি গৃহীত হয়েছে লেখকের ‘গদ্যসংগ্রহ ১’ থেকে। এই অ্যান্থোলোজি প্রকাশিত হয়েছে ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে ইন্ডিয়ার একটা প্রাদেশিক শহর কলকাতা থেকে। প্রকাশনা হাউজের নাম ‘নান্দীমুখ সংসদ’। প্রথম প্রকাশের বই থেকেই গৃহীত রচনা। আলাদা আটটি বিভাগে ন্যাস্ত বইয়ের ‘ব্যক্তিত্ব’ অংশ থেকেই গৃহীত হয়েছে এই বিউটিফুল ছোট্ট লেখাটা। ফার্স্ট পাব্লিশের ১৮৭ থেকে ১৮৮ পৃষ্ঠা জুড়ে এইটা ছাপা। — গানপার]

… … 

পরের পোষ্ট
আগের পোষ্ট

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you