যদিও সত্যিই বিশ্বাস করি যে গানের অনুবাদ হয় না; ভাবানুবাদ হতে পারে কবিতার, কিন্তু গানের তা-ও নয়, একটা গান তার উৎসভাষা থেকে উদ্দিষ্টভাষায় আনয়নকালে যে ছায়ানুসৃতি হয় সে-সময় সিন্সিয়ার্লি দরকার অনুবাদের কসরতটুকু যথাসাধ্য কম করা। আমরা কেউ কেউ ছোটবেলায়, মেট্রিক-ইন্টার্মিডিয়েইটকালে, এমনকিছু বোকামো করেছি যে একেকটি ইংরিজি গান শুনে সেইটা আধাছাদা বুঝিয়া বা না-বুঝিয়া বাংলায় লিখে রেখেছি অনেকটা সত্যেন্দ্রনাথ দত্তীয় ছন্দে বা বড়জোর রবীন্দ্রনাথীয় ধরনে। ডেনভারের গান থেকে এ-মতো কয়েক উদাহরণ দিয়ে দেখানো যাক টেক্সট্যুয়্যাল ট্র্যান্সল্যাশনের ব্যর্থতা।
‘অ্যানির গান’, ‘অ্যানির আরেকটা গান’, ‘কাঁধের ওপর রোদের কিরণ’, ‘জ্যাকারে এবং জেনিফার’, ‘বাড়ি নিয়া যাও আমায় ধানদূর্বার ঘেসো পথ’ — এই গানপঞ্চক জন্ ডেনভারের কোন গানগুলো থেকে, এ নিশ্চয় না-বললেও হবে। এতই শ্রোতাপ্রিয় বঙ্গে এবং সর্বদেশে সর্বভাষে সর্বতরঙ্গে এই গানগুলো — শুধু ডেনভারের পালিত পুত্র-কন্যা নিয়ে একটা ছোট্ট লিরিকের ‘জ্যাকারে এবং জেনিফার’ শীর্ষক গানটা হয়তো অত শ্রুত নয় — মূল ইংলিশ শীর্ষনামা বা সূচনালাইন না-বললেও বুঝে নেয়া যায় চেষ্টাগুলো কোন গানের অবলম্বনে করা হতেছে। এছাড়া কান্ট্রিমিউজিকের এই শিল্পী বাংলাদেশে ব্যাপক পরিচিত বলা যায় হলফ করেই। কিন্তু মধ্যযুগীয় বাংলা কবিতা হিশেবে এইগুলো — বর্তমান তর্জমাগুলো — হজম করা গেলেও চিরসবুজ সুরের আবহমান গান হিশেবে এই টেক্সটগুলো মনেহয় মেনে নেয়া মুশকিল। অবশ্য শ্রোতাভেদে থাকতে পারে মতভিন্নতাও।
উল্লেখ কর্তব্য, জন্ ডেনভারের গান বাংলাদেশে এবং ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গে বেশকিছু অনূদিত হয়েছেও। অঞ্জন দত্ত জন ডেনভারের কয়েকটা গান অবলম্বনে টিউন করেছেন, — সেগুলো সুরের আখর ধরে চেনা যায় ডেনভার বলে, কিন্তু লিরিক্স একদম অনুরূপ ডেনভার নয়। ‘এই বুড়ো পুরনো গিটার’ গানটার পাশাপাশি ‘দিস্ ওল্ড গিটার’ শুনে/পড়ে দেখার প্রস্তাব করা যেতে পারে, কিংবা ‘টিভি দেখো না’ গানটার পাশে রেখে ‘ব্লো আপ য়্যুর টিভি’ শুনে দেখুন বা পড়ে, একদম কোনো মিল নাই বলছি না, তবে বেশ কতিপয় থিম্যাটিক সাদৃশ্যের ব্যাপার ছাড়া গানে তেমন অবিকল অর্থদ্যোতনা ব্যঞ্জিত হয়েছে বলা দুষ্কর।
বাংলাদেশের একটা ব্যান্ড ‘সুমন ও অর্থহীন’ নামে, সেই ব্যান্ডের ভোক্যাল-কাম্-ব্যান্ডলিডার সাইদুস সালেহীন সুমন, ব্যাজগিটার ভালো বাজাতে পারেন বলে বেশ বিখ্যাত যিনি, একটা গোটা অ্যালবামই করেছিলেন ডেনভারগান নিয়ে, সেইখানে ‘অ্যানির গান’ ইত্যাদিও ছিল, টেক্সট্যুয়্যাল দিক থেকেও যথেষ্ট মূলানুগ ছিল অবশ্য, মন্দ হয় নাই। কিন্তু সব-মিলিয়ে এইটা একটা ব্যাপার ধর্তব্য যে, গানের ধ্বনিগত অনুবাদ হলেও কথাগত অনুবাদ সত্যিই ডিফিকাল্ট। অসম্ভব হয়তো নয়, ভালো হাতে পড়ে বেশ উৎরে যেতেও পারে, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাণীমঞ্জরির অনুবাদ সুখশ্রাব্য/সুখপাঠ্য হয় না। আবার ভুয়া বাংলায়নও মায়েস্ত্রো মিউজিশিয়ানের হাতে পড়ে মহাজাগতিক সুরের অভিজ্ঞতা হয়ে-ওঠাও বিচিত্র কিছু নয়।
এখন বলবার কথাটা এ-ই যে গানে কি আদৌ বক্তব্য থাকে? যতই লিরিক্স থাকুক, গানে কি আদৌ ‘কথাবার্তা’ থাকে? হ্যাঁ, গানের সংজ্ঞাতালাশে না-লেগে জীবনানন্দের বহুলোদ্ধৃত কবিতাকথার সেই নিরুক্তিসদৃশ সুভাষণ মনে রেখে বলা যেতে পারে যে গান অনেকরকম; হতে পারে বক্তব্যমূলক গান, প্রচারণাগান, তর্ক ও তরজামূলক গানও হতে পারে, যেমন মরমিয়া বা আরও সহস্র ধরনধারণের গানও রয়েছে দুনিয়ায়। কিন্তু সত্যিকার অর্থে একটা ভালো গানে আমরা সুরের এক্কাগাড়িতে চড়ে ছবি দেখে বেড়াই, দেখি চলচ্চিত্র, রৌদ্রছায়াছবি; এই ছবি কোনো অন্তরীক্ষছবি কিংবা ভূমিচিত্র নয়, এইটে অনুভূতিচিত্র, মনশ্ছবি। গানের সত্যিমিথ্যা এবং গানের যুক্তিবিদ্যা, যেমন কবিতারও, দুনিয়াবি সত্যিমিথ্যা-যুক্তিবিদ্যা থেকে আলাদা; গানের ব্যাপারস্যাপার এমনকি কবিতার ব্যাপারস্যাপার থেকেও অনেকটা আলাদা। না, মালার্মে বা আরও-আরও প্রতীকবাদী কবির কথা না-জানলেও চোখ বুঁজে এই কথাটা মানতে বেশি বেগ পেতে হয় না। কাজেই অনুভবছবি তর্জমা/ভাষান্তর করবেন কী করে! গান বঙ্গানুবাদিত হতে যেয়ে হামেশা বাংলান্তরিত হতেই দেখব আমরা, বাংলা হইতে বিতাড়িত, গানের পাঠকৃতিগত অনুবাদনের এই এক বিপদ ও বিপত্তির দিক, বাংলায় মেহমান-গানকে নেমন্তন্ন জানায়ে আনতে যেয়ে যেন আমরা বাংলাছাড়া না-করি বেচারিকে, এই অনুবাদগোছায় ঠিক এমনই বিচ্ছেদকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে সন্দেহ নাই।
কিছুক্ষণ আগে একজায়গায় বলছিলাম যে জন্ ডেনভারের ৯টা গান বাংলায় গেয়েছেন সুমন। বাংলাদেশে ‘সুমন ও অর্থহীন’ ব্যান্ডের ব্যাজবাবাখ্যাত সুমন তথা সাইদুস সালেহীন সুমন বেশকিছু সুন্দর-সুষ্ঠু সংগীত উপহার দিয়েছেন বাদ্যযন্ত্র বাজানোর বাইরে নিজের লিরিক্সে স্বকণ্ঠে গাইতে যেয়ে। এমনিতে সেগুলো উচ্ছ্বসিত হবার মতো সুর-উদ্ভাবনা বা গীতিকবিতা না-হলেও ওই সময়ের কন্টেক্সটে উল্লেখযোগ্য ছিল। সুমন যখন ‘সুমন ও অর্থহীন’ ব্যানারে অ্যালবাম রিলিজ্ শুরু করেন, তখন বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতে মিক্সড্ অ্যালবাম ইত্যাদির অপপ্রভাবে হোক কিংবা আর-কোনো কারণে চলছিল ধুমধাড়াক্কা খিচুড়ি লিরিক্স ও মিউজিকের মোচ্ছব। অন্যদিকে কলকাতাকেন্দ্রী মিউজিকে বেশ ভালো সুর ও কথাখচিত সংগীতের সুসময় এসেছিল সমনামী আরেকজনের কল্যাণে। এহেন সময়ে বাংলাদেশের সুমন মোটামুটি নিরিবিলি লিরিক্যাল্ কথাভাগে সুর বসিয়ে গিটারে টেনে টেনে যখন গাইতে শুরু করেন, অঞ্জনাচ্ছন্নতা বা কান্ট্রিমিউজিকের সরাসরি ছাপ সত্ত্বেও শুনতে মন্দ লাগত না। শান্ত-সমাহিত স্বরে এবং পরিমিত বাদ্যযোজনায় নিচু স্কেলে রেখে সুমনের গায়ন তখন অনেককে আশান্বিতও করেছিল নতুন মোড়ের মুখে দাঁড়াতে, উঠতি গাইয়েদের অনেকেই গিটার আর ড্রামস্ খানিকটা ভাবনাচিন্তা করে একটু রয়েসয়ে সামলেসুমলে আরও সৃজনী বিস্তার দিয়ে বাজাবার পথ ঢুঁড়তে শুরু করেছিলেন। পরের দশকে এসেই বিচিত্রবিস্তৃত ফলও ফলেছে এর, সো-ফার আমার দেখাদেখি দিয়া অনুমিত, অর্ণব ও অন্যান্য থরে-বিথরে বাংলাদেশের গানে বুদ্ধিদীপ্ত বৈচিত্র্যের হাওয়া লেগেছে ক্রমে।
এইখানে ডেনভার প্রসঙ্গে সুমনের একটা অ্যালবাম হাতে নিয়া আমরা কথা চালাতে লেগেছি। নিজের মিউজিক-ক্যারিয়ারের রজত-জয়ন্তীলগ্নে সুমন একটা অ্যালবাম করেছিলেন, সোলো উদযোগের সঙ্গে এলিটা নামের এক শিল্পীকে ফিচার করা হয়েছিল ওই অ্যালবামে যিনি পরবর্তীকালে গেয়ে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন, গোটা অ্যালবামটা ছিল ডেনভারের নয়টা গানের বঙ্গানুবাদের উপস্থাপন। বছর-বারো আগে, ২০০৫ সালে, অ্যালবামটা বেরিয়েছিল ‘জি সিরিজ্’ থেকে; অ্যালবাম মার্কেটিং করেছিল গীতাঞ্জলী। ইন্ ফ্যাক্ট, দশটা গান অ্যালবামে থাকলেও আদতে অ্যানি’স্ স্যং গানটা দুইবার করা হয়েছিল; একবার সুমন-এলিটা রেগ্যুলার বিটে এবং অন্যবার টেম্পো পাল্টে জে-মিক্স। মন্দ হয় নাই গোটা ব্যাপারটা। আর মন্দ হয় নাই বলেই তো মনে আছে; এবং মন্দ হলে এখন এই কথাবার্তাও বলার দরকার হতো না। যা-হোক, অ্যালবামের টাইট্যল্ ‘মেঘের দেশে’ এবং উপশিরোনামায় ‘অ্যা ট্রিবিউট টু জন ডেনভার’ কথাটা কাভারমুখে লেখা রাখা ছিল। প্রত্যেকটা গানের সঙ্গে মূল ইংরেজি শিরোনাম ব্র্যাকেটে এবং বঙ্গানুবাদিত শিরোনাম বোল্ড হরফে ছাপানো হয়েছিল। সব-কয়টা গানের অনুবাদক সুমন। বাজিয়েছেন জেমস থেকে শুরু করে জুয়েল এবং অনেকেই। গিটার্স, ড্রামস্, কিবোর্ডস্, পার্কাশন্ ইত্যাদি দিয়াই মিউজিকট্র্যাকগুলো যোজিত। সবই ঠিক আছে। এরপরও অস্বস্তির জায়গাটা ভারি ভুগিয়েছিল শ্রোতা হিশেবে আমাদেরে এবং আজও অভিজ্ঞতাটা ইয়াদ আছে। একটু পরেই বলছি সেইটা।
গানগুলো ছিল সর্বজনপ্রিয় কয়েকটার মধ্যে উল্লেখস্থানীয়; জন্ ডেনভারের শ্রোতা মাত্রেই লিরিকগুলো ওষ্ঠস্থ রাখেন। যথা — অ্যানি’স্ স্যং, লিভিং অন অ্যা জেটপ্লেন, টেইক মি হোম কান্ট্রিরোড, ড্রিমল্যান্ড এক্সপ্রেস, পোয়েমস প্রেয়ার্স অ্যান্ড প্রোমিজেস্, গার্ডেন স্যং, দিস্ ওল্ড গিটার, ফ্লাই অ্যাওয়ে, এবং পারহ্যাপ্স ল্যভ। সুমনের বঙ্গানুবাদে ডেনভার-মিউজিক শুনতে শুনতে একসময় খেয়াল হয়, আরে! একটা গানই যেন শুনছি ফিরে ফিরে! এইটা কেন হবে? ডেনভারের গানগুলো সিগ্নেচারমার্ক সত্ত্বেও তো মনে হয় না যে একঘেয়ে বা একটা গানই শুনছি, তাহলে এখানে এমন হচ্ছে কেন? ঘটনাটা মনে হয় সুমনের গায়কী-সীমাবদ্ধতার কারণে যতটা-না তারচেয়ে বেশি গানানুবাদের কারণেই। মিউজিকের অনুবাদ হয় না, ‘মেঘের দেশে’ অ্যালবামের সুমন-কম্পোজিত সুর-কথানুবাদগুলো শুনে এই অভিজ্ঞতাটা আমাদের হয়েছিল তখন। যদিও কথার অনুবাদ হতে পারে, হয় আকছার, যেমন কবিতার বিশ্বস্ত টেক্সট্যুয়াল ট্র্যান্সফর্ম/ট্র্যান্সল্যাশন্ হয়। বিশ্বস্ত যতই হোক, তবু অনুবাদে যা হারায় তা-ই কবিতা — আমরা জানি এবং মানি। কিন্তু গানের ক্ষেত্রে বোধহয় ট্র্যান্সল্যাশনে কিছুই প্রায় থাকে না। আস্ত লোপাট হয়ে যায় ভাবের বা অনুভবের। ব্যাপারটা হয় তখন না-ঘরকা না-ঘাটকা।
গানের ছায়ানুসারে গান হতে পারে। গান ভেঙে গান হতে পারে। এই দুই প্রক্রিয়াই আসলে গানের বিশ্বস্ত সঞ্চারপ্রক্রিয়া। গান-টু-গান অনুবাদ আসলে হয় না। কাব্যানুবাদ বা গদ্যানুবাদ যদিও সম্ভব লিরিক্সের, কিন্তু সুরের-সংগীতের অনুবাদ! মনুষ্য অসাধ্য। অসুন্দরও। সুমনের ডেনভারগানের অনুবাদচেষ্টা ট্রিবিউট হিশেবে বেশ, সংগীত-অভিজ্ঞতার বিচারে এইটা যাচ্ছেতাই।
কিন্তু অন্যদিকে এই কথাটা তো সৌরালোকের মতো ট্রু যে দেশে দেশে গানের অনুবাদই হয় আসলে। দেশে দেশে, যুগে যুগে, কালে ও কালান্তরে। সেই প্রক্রিয়াটা লক্ষণীয়। সাইদুস সালেহীন সুমনের প্রক্রিয়ায় সেইটা সম্ভব না। ঠাকুরের প্রক্রিয়ায় সেইটা সম্ভব, কাজীর প্রক্রিয়ায় সেইটা সম্ভব, এবং সম্ভব কবীরের প্রক্রিয়ায়। এইখানে কবীর বলতে আমরা বলছি কবীর সুমন। বাংলা গানে একটা হাওয়া এনেছিলেন সুমন কোন প্রক্রিয়ায়, এইটা আমরা আজ পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করতে পারি বোধহয়। এই জিনিশটা কবীর সুমনের কাছ থেকে আমরা শিখিয়া রাখতে পারি।
কিন্তু শ্রদ্ধার্ঘ্য হিশেবে ‘মেঘের দেশে’ অ্যালবামটা আসলেই সুন্দর। ফর অ্যা চেইঞ্জ এমনটা আরও হতে পারে অন্যান্য মায়েস্ত্রোদের ক্ষেত্রে। যদিও অর্থহীনখ্যাত সুমন ইংরেজি গানের কথাগুলো সুরের সঙ্গে সংগতিবিধানে যেয়ে ল্যাবগ্যাবে করে ফেলেছেন, আপোস করতে করতে একেবারে নার্সারিশিক্ষার্থীর বাংলা করে ফেলেছেন, এবং শুনতে বেশ লাগলেও পড়ার অভিজ্ঞতা হয় ভীষণ বদখত। মূল গানের স্মার্টনেস্, মূল গানের মেলোডি, কথায় একদমই নিখোঁজ।
ফিতার যুগের ক্যাসেট তখন অন্তিমে। ফ্ল্যাপকথন থাকত ক্যাসেটগুলোর সঙ্গে। ‘মেঘের দেশে’ ক্যাসেটের খাপে ডেনভারের ৯টা গানের অনুবাদক সুমন অনুবাদের অন্তরালের অভিজ্ঞতাও বিনিময় করেছিলেন অল্পভাষে। অ্যালবাম রিলিজের বছর ২০০৫।
পল্লিগীতি কিংবা দেশাত্মবোধক গানেই শুধু নয়, প্রেমের গানে ডেনভার কতটা কেমন চেনা যায় প্রথম-প্রণয়িনী এবং পরবর্তীকালে পত্নী অ্যানি মার্টেল উপজীব্য করে লেখা তার অসম্ভব জনপ্রিয় সুর ও সংগীতায়োজনের গানটায়। অ্যানির আরেকটা গানও হয়েছিল পরে এবং সেইটাও সুশ্রাব্য সুন্দর। এই কিস্তিতে ডেনভারের পাঁচটা গান আমরা বাংলায় চেষ্টা করে দেখব পড়া যায় কি না। গানগুলোর মধ্যে তিনটার গীতিকার এককভাবে ডেনভার; সেগুলো হচ্ছে অ্যানি’স্ স্যং, অ্যানি’স্ অ্যানাদার স্যং এবং জ্যাকারে অ্যান্ড জেনিফার। অন্য দুইটা গানে ডেনভার সহগীতিকারদের একজন, সানশাইন অন মাই শোল্ডার্স এবং টেইক মি হোম কান্ট্রিরোডস্ হচ্ছে সামবায়িক প্রক্রিয়ায় লিখিত কথাগীতি; গানদ্বয়ে জন ডেনভারের কো-অথারেরা হচ্ছেন মাইক্ ট্যাইলার, ডিক নিস্, বিল ড্যানোফ এবং ট্যাফি ড্যানোফ।
__________
অ্যানির গান ও অন্যান্য :: জন্ ডেনভার
অ্যানির গান (Annie’s Song), অ্যানির আরেকটা গান (Annie’s Other Song), কাঁধের ওপর রোদের কিরণ (Sunshine On My Shoulders), জ্যাকারে এবং জেনিফার (Zachary And Jennifer), বাড়ি নিয়া যাও আমায় ধানদূর্বার ঘেসো পথ (Take Me Home, Country Roads)
ভূমিকা ও তর্জমা : জাহেদ আহমদ
__________
অ্যানির গান
তুমি ভরেছ আমায় আদরে-মায়ায়, নিশীথে যেমন সঘন-গহন রজনীতৃপ্ত বন
পর্বত যথা গাছভারানত ভরা বসন্তে, যেমন বরিষনদিনে বৃষ্টিতে হণ্টন
মরুভূমি যথা বালিতে বিপুলা, সাগরে যেমন ঘুমের নীলাঞ্জন
তেমন করেই দিয়াছ ভরিয়া আমারে এমন অশেষ অবশতায়
এসো এসো ওগো পুনরায় এসে পূর্ণ করো আমায়
ভালোবাসিবারে দাও অবসর, দিতে দাও এই জীবনের সবটুকু
ডুবিবারে দাও তোমার হাসিতে, মরিবার আগে হতে দাও তুমিমুখো
বসিয়া থাকিতে দাও পাশটাতে, লেপ্টিয়া থাকি দিবারাত তব সঙ্গ-নিঃসঙ্গতায়
বেসে যেতে দাও, ভালোবাসা নাও, তোমার আদরে পূর্ণ করো আমায়
তুমি ভরেছ আমায় আদরে-মায়ায়, নিশীথে যেমন সঘন-গহন রজনীতৃপ্ত বন
পর্বত যথা গাছভারানত ভরা বসন্তে, যেমন বরিষনদিনে বৃষ্টিতে হণ্টন
মরুভূমি যথা বালিতে বিপুলা, সাগরে যেমন ঘুমের নীলাঞ্জন
তেমন করেই দিয়াছ ভরিয়া আমারে এমন অশেষ অবশতায়
এসো এসো ওগো পুনরায় এসে পূর্ণ করো আমায়
অ্যানির আরেকটা গান
ফিরিতেছি বাড়ি, ফিরায়া আনছি আবার আমায়
দিচ্ছি তুলিয়া তোমারই দুহাতে আমারে আবার
এইটুকুনই তো দিতে পারি আমি, দিচ্ছি তোমায় সবটুকু আমার
আমার জীবন, প্রেমের দহন, আমার পরান সমস্তটা
ভাগেযোগে এসো দুজনে কাটাই জীবনের বাদবাকিটা
কাটায়েছি বেলা দারুণ শহরে মাস্তি মেরেছি কত
নয়া জায়গায় নাচে আর গানে আনন্দ অবিরত
পুনরায় একা হাবাগোবা আমি আবার নেমেছি পথে
বেজে চলিয়াছি নিশীথিনী গীতে চন্দ্রের সঙ্গতে
দ্যাখো চড়িয়াছি গিরিপর্বতে শান্ত সুনির্জন
ধরা পড়ে গেছি তারাদের কাছে ক্যাবলাকান্ত মন
ঈদে বা পূজায় যে-কোনো ছুঁতায় ফিরি তো তোমারই কাছে
যেটুকু সময় নিরিবিলি তাতে তোমার ভূমিকা আছে
একান্ত যবে দেহের নিকটে থাকি বসে দুইজনা
ভালোবেসে তুমি ভাসাও আমারে করে তোলো উন্মনা
সারাটি জীবন তোমারই সঙ্গে থাকিবারে চাই প্রিয়
অঙ্গে অঙ্গ তোমারই সঙ্গ স্বপ্নের উত্তরীয়
তুমিই নির্বাচিতা হে প্রেয়সী নিকটে রইতে দিও
তোমারেই আমি নিয়াছি বাছিয়া, ভালোবাসা জানিও
কাঁধের ওপর রোদের কিরণ
কাঁধের ওপর রোদের ছোঁয়ায় ভালো হয়ে যায় মন
চক্ষে যখন রৌদ্র তখন আনন্দক্রন্দন
রোদের রেণুতে নদীনালাখালে ঝিলিমিলি-করা পানি
চিরদিনই প্রিয় রৌদ্রকিরণে জুড়ায় হৃদয়খানি
দীনহীন আমি নিতান্ত দুঃখী নাই কিছু সম্বল
তোমারে একটি দিন দিতে চাই রৌদ্রকরোজ্জ্বল
গলাও তো নাই গাইবার মতো ছোট্ট একটা গান
নয়তো তোমায় দিতাম রোদেলা গানের সন্নিধান
গল্পও নাই বলবার মতো তোমারে যা বলা যায়
যেই গল্পের আবেশে দেখিব হাসিমুখ জানালায়
নিতান্ত যদি দিতে পারতাম শুভেচ্ছাপ্রার্থনা
কায়মনোস্বরে অঞ্জলি ভরে ঝরাতাম মূর্ছনা
সারাদিন শুধু তোমারে ঘেরিয়া রৌদ্রনম্র বাসনা
সারাদিন শুধু রৌদ্ররমিত তোমারেই আরাধনা
জ্যাকারে এবং জেনিফার
জ্যাকারে নামেই ডাকিব পোলারে পালিব-পুষিব পাহাড়ে
নাওয়াবো হিরের ঝর্ণাধারায় হাসাবো সূর্যমাঝারে
জেনিফার নামে ডাকিব মেয়েরে নাচাবো ফুলের খামারে
গাওয়াবো গ্রীষ্মঝরোঝরো সুরে সময়ের সুধাবাহারে
বাঁচিবারে চাই চিরদিন দেখে দর্পণে ভাবীকাল
দোঁহে মিলে চাই সামলায়ে যেতে সুখ ও দুঃখের হাল।
বাড়ি নিয়া যাও আমায় ধানদূর্বার ঘেসো পথ
প্রায় বেহেশ্তি নির্জন আর নন্দিত এক গ্রাম
নদীফুলপাখি টিলা বা পাহাড়পর্বতনামে নাম
জীবন যেখানে শান্তিস্নিগ্ধ প্রত্নগন্ধমাখা
গাছেরা প্রাচীন অশ্বত্থবট অথবা পাকুড়পাখা
পাহাড়েরা তার তাগড়া জোয়ান সবুজ পল্লবিত
মন ভালো হয় এক-লহমায় হাওয়ায় রোমন্থিত
ধূলিরেণুঝরা ধানছড়াদোলা আঁকাবাঁকা গ্রামপথ
ঘরে ফেরা এক বালক হৃদয় চেপেছে তোমার রথ
নিয়া যাও বয়ে সেখানে আমায় যেখানে মাতৃমুখ
কলাগাছে ঘেরা আঙিনাপ্রান্তে একজোড়া মায়াচোখ
তারেই ঘিরিয়া আমার যাবজ্জীবনের যতকিছু
পুকুরকিনারে সুপুরিবিথারে মেঘদলা ভারি নিচু
সন্ধ্যাছায়ায় কাচপোকা আর জোনাকিরা নাচে-গায়
চাঁদমধুচাক ভাঙে টুপটাপ অশ্রুর মতো জ্যোস্নায়
ডাক দিয়া যায় নিত্য আমায় রাতামুর্গার ভোরে
রেডিয়োর গানে দ্যাশের সুবাস পল্লিগীতির সুরে
দ্যাখো অবশেষে নেমেছি নিঝুম নিজের গাঁয়ের পথে
দেরি হয়ে গেছে পথে ও বিপথে পেত্নীতে-অজভূতে
ধূলিরেণুঝরা ধানছড়াদোলা আঁকাবাঁকা গ্রামপথ
ঘরে ফেরা এক বালক হৃদয় চেপেছে তোমার রথ
নিয়া যাও বয়ে সেখানে আমায় যেখানে মাতৃমুখ
কলাগাছে ঘেরা আঙিনাপ্রান্তে একজোড়া মায়াচোখ
একই লেখকের জন্ ডেনভার বিষয়ে অন্যত্র প্রকাশিত লেখাপত্র :
জলছড়া, সানশাইনি টিলাশীর্ষ ও জন ডেনভার
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
- লঘুগুরু - November 8, 2024
COMMENTS