সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা ও আনন্দ নিকেতন

সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা ও আনন্দ নিকেতন

সব মিলিয়ে ব্যাপারটা আনন্দেরই নিশ্চয় — কিন্তু ফুর্তিফার্তার তারল্য থেকে এই আনন্দ তফাতে রেখে দেখাটা আবশ্যক — গানবাজনা, নাটক, নৃত্য ও আবৃত্তি ইত্যাদি এবং আরও যা-কিছু ললিতকলার বৃত্তিবর্গ রয়েছে সেসব নিয়াই শিখন সঞ্চারণ ও নৈপুণ্য প্রদর্শনের একটা জায়গা ‘আনন্দ নিকেতন’। শুধু বইয়ের পাতা থেকে শেখা ও পড়া বা জানাবোঝা সম্পন্ন হয় না, যাপনের যাবতীয় কর্মকলাপকৃষ্টিকৃত্য বইপত্তর থেকে শেখা যাবে এমন প্রত্যাশা করাটাও অতিপ্রত্যাশাই, ‘আনন্দ নিকেতন’ ঠিক এমন একটা প্রত্যয় থেকেই কিশোরবয়সী শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক সাক্ষরতার দিকে নিশানা তাক করেছে। দেখতে দেখতে দুই দশক হতে চলল সম্পূর্ণ জনসমাবেশনের ভিত্তিতে অবাণিজ্যিক এই শিখন-শিক্ষণের নিকেতন নবীগঞ্জের নৈসর্গিক দূরদিগন্তে আবহমান বাংলার ঐতিহ্য-আত্মপরিচয় ও সংস্কৃতিহিতৈষী মানুষগোষ্ঠীর সহযোগে রেখেছে নিজেদেরে নিয়মিত সচল। সম্প্রতি নিকেতনের ১৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনের উপলক্ষ্য সামনে রেখে একটানা দুইদিনব্যাপী ছিল উৎসব, সাংস্কৃতিক উৎসব, ১০ ও ১১ মার্চ ২০১৮ উৎসবের সম্মিলনস্থলে ব্যাপক জমায়েত দেখে যে-কোনো সংস্কৃতিকর্মক থমকে দাঁড়িয়ে একবার ভাববেন সাংস্কৃতিক অনুশীলনী ও উদ্দীপনার সঙ্গে মানুষের যোগ কতটা নাড়িঘনিষ্ঠ।

উৎসবের দ্বিতীয় ও সমাপনী দিনের উত্তীর্ণ-সন্ধ্যায় নিকেতনের আমন্ত্রণে দেশবিশ্রুত সংগীতদলগুলোর মধ্যে তিনটি দল এসে যোগ দিয়েছিল; — ‘নগরনাট’, ‘বাউলা’ ও ‘জলের গান’ সমাপনী দিনের সন্ধ্যা-উত্তর গভীর রাত পর্যন্ত মনোমুগ্ধকর পরিবেশনায় শামিয়ানাতলে সমবেত সহস্র নবীগঞ্জবাসী জনতার চিত্ত হরণ করে নিয়েছে। এই তিন দলের মঞ্চারোহণের আগে অবশ্য ঘটে গিয়েছিল আরেকটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা; —  ‘আনন্দ নিকেতন’ সম্পূর্ণ নিজেদের শিল্পী ও শিল্পশিক্ষার্থীদের সমবায়ে একটানা দেড়ঘণ্টা পার্ফোর্ম করেছে এবং উপস্থিত সকলের সমাদর ও সমীহ কুড়িয়েছে। এই রিপোর্টারের কাছে বিশেষভাবেই চিত্তাকর্ষক মনে হয়েছে নিকেতনের নৃত্য অনুষদের শিক্ষার্থীদের মঞ্চরচনাগুলো। আমন্ত্রিত সংগীতদলত্রয় নয়, এই রিপোর্ট উৎসবের হোস্ট আনন্দ নিকেতনের নিজস্ব পরিবেশনার সংক্ষিপ্ত দলিলায়ন।

সমাপনী দিনটাকে উৎসবসঞ্চালকেরা দুইটা ভাগে ভেবে নিয়েছিলেন; প্রথম অধিবেশনে সংস্কৃতিব্যক্তিত্ব ও মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এমপি-র উপস্থিতিতে একটা আলোচনা চালিত হয় বেলা প্রায় দুপুর বা পড়ন্ত দুপুরের দিকটায় এবং দ্বিতীয় অধিবেশনে বক্তিমালোচনার উপদ্রবহীন শুধুই নৃত্য আর গান আর বাদ্য আর মানুষের স্বর্গীয় উল্লাস। দুইয়েকবার হাল্কা নারকীয় উৎপাতের আভাস তৈরি হওয়া মাত্রই আয়োজকদের অবিশ্বাস্য কূটনৈতিক দক্ষতায় দর্শকসারির কেউ বুঝে ওঠার আগেই উত্যক্তকারীদের সামলানো সম্ভব হয়েছিল। প্রথম অধিবেশনেই নিকেতনের শিক্ষার্থীরা তাদের এক্সেলেন্স খানিকটা দেখিয়েছিল দুপুরের দিকটায়। সাউন্ডের আধিকারিকদের ন্যাক্কারজনক অসহযোগ সত্ত্বেও নিকেতনশিল্পীরা জাতীয় সংগীত পরিবেশন করে একদম পেশাদার কয়্যার সিম্ফনি মিউজিক ট্রুপের নৈপুণ্যে। এর ঠিক পরপর তারা ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’ গানের পঙক্তিলতানো একটি নৃত্যসৃজনের মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক উৎসবের আনুষ্ঠানিক সূচনা ত্বরান্বিত করে। নিকেতনের নৃত্যপ্রশিক্ষক প্রবীর শীল পরিচালনা করেন এই নৃত্যটা ছাড়াও অন্যান্য নৃত্যরচনাগুলো।

innter image

সন্ধ্যালগ্নে দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হয় ফের আরেকটা ড্যান্সকোরিয়োগ্র্যাফি দিয়েই, ‘মঙ্গলদীপ জ্বেলে’ গানের সঙ্গে নিকেতনশিক্ষার্থীরা পার্ফোর্ম করে দৃষ্টিনন্দন মুদ্রা আর শৃঙ্খলায়। সান্ধ্য মঞ্চে আলোক প্রক্ষেপণ ও অন্যান্য উৎসবনৈসর্গিক বাতাবরণের কারণে এই পরিবেশনা এবং এর পরবর্তী প্রায় প্রত্যেকটা পার্ফোর্ম্যান্স দর্শকচক্ষে আলাদা মাত্রা সঞ্চারিতে পেরেছে। এরপর শুরু হয় বৃন্দআবৃত্তি। নিকেতনের তিনটা ছোট-বড় আবৃত্তিদল সমবেতভাবে একে একে পরিবেশন করে কবি সুফিয়া কামালের ‘আজিকার শিশু’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘আমার পরিচয়’ এবং কাজী নজরুল ইসলামের ‘আজ সৃষ্টিসুখের উল্লাসে’ — এই তিনটি কবিতা আবৃত্ত হয় শিক্ষার্থী শিল্পার্থীদের কণ্ঠযোগে তাদের অনির্বচনীয় বাচিক পারদর্শিতায়। পার্ফোর্মারদের মধ্যে সর্বোচ্চ তেরো থেকে সর্বনিম্ন পাঁচ সংখ্যক শিল্পী ইনকর্পোরেইটেড ছিল দলগুলোতে। কেবল তবলার সহযোগে আবৃত্তিত্রয় স্টেজড-অন করার প্ল্যান অত্যন্ত সাধুবাদার্হ। অতিবাদ্য সবসময় আবৃত্তির বারোটা বাজায় যা আমাদের দেশের আবৃত্তিশিল্পী বা আবৃত্তিনির্দেশকরা আন্দাজ করতে পারেন না। আনন্দ নিকেতনের আবৃত্তিনির্দেশক কাঞ্চন বণিক এই বিবেচনায় উত্তীর্ণ গুণমানের পরিবেশনা হাজির করতে পেরেছেন। তবলায় ঝুমুর ভৌমিক পরিমিত বাজিয়েছেন। তবে বাচিক উপস্থাপনের জায়গাটা ভালো বলা যাবে না। বাংলাদেশে বাজারচালু আবৃত্তিগুলো অনুসরণ করলে যে-ব্লান্ডারটা ঘটার কথা তা-ই ঘটেছে। মেলোড্রামা হয়েছে। বিশেষ উদাহরণ মনে করা যেতে পারে ‘আমার পরিচয়’ আবৃত্তিকালীন অতিনাটকীয়তা। বাচ্চারা বাচিক অভিনয়ে যে-কোনোকিছুই উৎরে দিতে পারে, সেহেতু নির্দেশক বেঁচে গেছেন। তবে কবিতার ভাববস্তুর দিকে নজর রেখে যেন যথাসাধ্য কম কণ্ঠকসরতে আবৃত্তিটা সাধা যায়, সেদিকে নিকেতন ভবিষ্যতে খেয়াল রাখবে আব্দার করা যায়। না-বললেই নয়, এই পর্বে, শিশু-আবৃত্তিশিল্পীদের একেকটা পরিবেশনার শেষে সকলে সমস্বরে ‘ধন্যবাদ সবাইকে’ উচ্চারণধ্বনি দারুণ উজ্জীবিত করেছে সমবেত অডিয়েন্সের সবাইকে।

যে-কারণেই হোক, অনুমান অমূলক হবে না হয়তো যে শব্দপ্রক্ষেপণব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের অনিচ্ছ গাফিলতি কিংবা স্বেচ্ছাকৃত চুতিয়ামি সবচেয়ে বড় কারণ, রজনী-অন্তিমে ‘জলের গান’ ছাড়া বাকি সমস্ত সংগীত-পরিবেশনাগুলো যুৎ হয় নাই। কিন্তু সংগীতপরিবেশনায় শিল্পী-যন্ত্রীদের কোনো কমতি ছিল বলিয়া আদৌ মনে করার কারণ নাই। নিকেতন কয়েকটা গান সমবেত পরিবেশন করে একাদিক্রমে : ‘প্রিয় ফুল শাপলা ফুল’, ‘আমরা সবাই সুন্দর হব’, ‘একতারাটা বাজলে কানে শুনি’, ‘ওই উজ্জ্বল দিন ডাকে’, ‘কোন মেস্তরি নাও বানাইল’ ইত্যাদি। সব-কয়টাই বৃন্দ। কোরাস ওয়েল-ট্রেইন্ড, পুরা পরিবেশনরীতিকেতাই ডিসিপ্লিন্ড ছিল। ছোটদের গানের পাশাপাশি লিস্টের শেষ তিনটা ছিল বড়দের গান; নিকেতনের অ্যাডাল্ট ব্যাচের শিক্ষার্থীরা গানত্রয় নিয়া হাজির হয়েছিলেন। শব্দসংস্থাপক ব্যবসায়ীর বদমায়েশী পুরা ব্যাপারটা মাটি করেছে দৃশ্যতই। বৃন্দগান পরিচালনায় ছিলেন অভিমান্য দাশ, হার্মোনিয়্যমে এবং তবলায় ছিলেন যথাক্রমে অভিজিৎ দাশ ও ঝুমুর ভৌমিক।

in 3নিকেতনের এই দিনের সেরা কাজগুলো দর্শক-সমুজদাররা দেখেছে নৃত্যরচনায়। সাউন্ডওয়ালা হাজার অসহযোগ করেও নৃত্যমুদ্রাগুলো তো বরবাদ করে দিতে পারে নাই। ড্যান্সস্টেপিং, কস্টিউম, মুদ্রাসৃজন ও সার্বিক ইম্প্রোভাইজেশন ছিল আপ-টু-দ্য-মার্ক। হলুদ-খয়েরি কস্টিউমে একদম শুরুতে আদিবাসী বিহুর নাচ নিয়া হাজির হতেই অডিয়েন্স নড়েচড়ে বসে। ‘বিহুর তালে কোমর দোলে’ গানের সঙ্গে নাচটা পার্ফেক্টলি সিনক্রোনাইজড হয়েছিল। অব্যবহিত পরে একটা ঝুমুর তালের নাচেও সমান সৌকর্য ও শৈল্পিক সুষমা হাজির পাওয়া যায়। এবং সবশেষে অপেক্ষা করছিল বিস্ময়। নৃত্যনাট্য ‘মহুয়া সুন্দরী’ দিয়ে এই উৎসবের শ্রেষ্ঠ নবীন শিল্পানুশীলকের তকমাটা আনন্দ নিকেতনের এই নৃত্যাভিনয়শিল্পীরা নিয়া নিতে পারত, যদি ব্যবস্থা থাকত অভিধা দানের। কিন্তু সে-রকম অ্যাওয়ার্ডিং ব্যবস্থা ছিল না। কাজেই, নবাগত এই শিল্পীদের লাগিয়া আমরা দিলখোলা তারিফ আর তাদের উজ্জ্বল শিল্পসাফল্য কামনা করিয়া আপাতত ক্ষান্ত রইতে পারি। কিন্তু বলতেই হবে এই নৃত্যকাজের মুখ্য কারিগর যিনি, নৃত্যমুদ্রাগুলোকে যিনি পৃথক বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল রেখেও একটা সামগ্রিকতার তোড়ায় বেঁধে উড়িয়েছেন আমাদের চোখের চারিধারে, কুড়িজনেরও অধিক শিল্পী টানা আধঘণ্টা কাহিনির চিত্রকল্পায়নে টেনে রেখেছে আমাদেরে, রেকর্ডেড পাঁচালি ধাঁচের কথকতা আর গানের কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না শাব্দিক ব্যবস্থায়নের নজিরবিহীন ন্যাক্কারজনক অসুবিধায়, তা সত্ত্বেও গোটা নাচটা মানুষ মুগ্ধ হয়ে দেখেছে এবং হৃদয়ঙ্গম করেছে কেবল ইউনিভার্সাল ড্যান্সল্যাঙ্গুয়েজটা আনন্দ নিকেতনের শিল্পী-কলাকুশলীরা রাইটলি পুট টুগেদারের কারণেই। নির্দেশক প্রবীর শীল এই নৃত্যরচনাটা আয়োজনের পেছনে ব্যাপক শ্রম ও প্রেম ঢেলেছেন অনুমান করতে পারি আমরা। নির্দেশক ও কলানুশীলক শিল্পী সকলকে এই নৃত্যকর্মটার জন্য টুপিমুক্ত অভিবাদন।

in 4

গোড়ার দিকটায় বলছিলাম যে ‘আনন্দ নিকেতন’ সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা লালন, উন্নয়ন, বিকাশ ও প্রসারের লক্ষ্য নিয়ে এগোনো দুই দশকের একটা সামাজিক উদ্ভাবনার সংগঠন। এবং তারা কারো মুখাপেক্ষী নয় কেবল ঐতিহ্যমনস্ক ও উৎকর্ষাভিমুখী নিরন্তরের সহযাত্রী সাধারণ জনমানুষের হৃদয়যোগ ছাড়া। তাদের আনন্দ ফুর্তিফার্তার সাময়িকতা নয়, এই আনন্দের ভিতরে নন্দ বিরাজেন, সুন্দর বিরাজেন, স্বয়ং শান্তি বিরাজেন আনন্দ নিকেতনের নিত্যপুরাণে। এই আনন্দ হরদমের, প্রতিমুহূর্তের, আমৃত্যু-আজীবনের। সকল কাঁটা ধন্য করে এই আনন্দের প্রস্ফুটন। নবীগঞ্জের উপজেলা প্রশাসনের ইমারতসংলগ্ন প্রশস্ত ময়দানে ১১ মার্চের উৎসবসমাপনী দিনের প্রত্যেকটা মুহূর্ত মনে করিয়ে দিচ্ছিল বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সোশ্যাল ক্যাপিট্যাল তথা সামাজিক পুঁজি তার সংস্কৃতি, এখনও, হ্যাঁ, এখনও! মনুষ্যের সনে মনুষ্যের যোগ দিয়াই সম্ভব, এখনও, হ্যাঁ, এখনও! গলা থামাও, কলাকার, তোমার কলাকারি দিয়াই নিজের লড়াইটা যাও লড়িয়া। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভুলভুলাইয়ায় হারিয়ে যেও না। আইসো, হে প্রাণনাথ, আইসো! যৌবন কখনো শরীরে থাকে না, জানিয়া রাখিও! যোগ দাও নন্দধামে, এই আনন্দধারায়, এই নিরন্তরের নিরঞ্জন জয়যাত্রাপারাবারে …

স্থিরচিত্রশিল্পী : সুমন চৌধুরী ।। লেখা : মিল্টন মৃধা

… …

[metaslider id=”4162″]

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you