নৌকাবাইচকে সিলেটে নাওদৌড়, খেলনাদৌড়, খেন্নাদৌড় এবং খেলুয়াদৌড়ও বলা হয়। ‘ছুব’ শব্দটা নৌকাবাইচের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। ছুব অর্থ হচ্ছে সর্বশক্তি দিয়ে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতা।
খেলনা নাওয়ে চার স্তরের পাইক থাকে। এক কাড়ালি, থাবা (যারা দাঁড়িয়ে বৈঠা মারে), তারপরে পাইকল (যারা বসে বৈঠা মারে)। সবার আগে থাকেন একজন, যাকে অনুসরণ করে পাইকলরা বৈঠা মারে।
বাইচের নৌকা প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে আসার পরে দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য নৌকার পাইকরা গান গেয়ে গেয়ে ওয়ার্ম-আপ করে যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ফেরি। ফেরি দেওয়ার পরেই নৌকা চলে যায় ছুব শুরু হওয়ার সীমানায়। ছুব নিয়ে আব্দুল করিম তার নৌকাবাইচের গানে বলছেন, “হারি জিতি ছুবের বেলা কার পানে কে চায়” … অর্থাৎ ছুব শুরু হলে পাইকলদের অন্য নৌকার দিকে তাকানো নিষেধ। তারা শুধু নৌকায়-থাকা মন্দিরাবাদক এবং সবার সামনে থাকা পাইকের নির্দেশনা মোতাবেক দ্রুত বৈঠা মারবে।
যতটুকু মনে আছে বাইচের নৌকা সাধারণত তিন প্রকার : ‘চুখা গলই’, ‘চ্যাপ্টা গলই’, আর ‘বইয়া খাউরি’। ‘চুখা গলই’ নৌকা অনেক লম্বা আর সুঁচের মতো চিকন এবং অনেক লম্বা গলুই হয়। ‘চ্যাপ্টা গলই’ নৌকার গলুই চ্যাপ্টা এবং খাটো থাকে। আর ‘বইয়া খাউরি’ খুব চিকন এবং ছোটখাটো নৌকা। এই নৌকা যদি একবার আগে চলে যায় তবে তারে ধরা কঠিন। আর ‘চ্যাপ্টা গলই’ হচ্ছে সবচেয়ে ভয়াবহ নৌকা। একবার যদি প্রতিপক্ষকে পেছনে ফেলতে পারে তবে তার ঢেউ ভেঙে হাজার ছুবেও প্রতিপক্ষের এগিয়ে যাওয়া অনেক কঠিন। ব্যক্তিগতভাবে আমি ‘চুখা গলই’ নৌকার ফ্যান। ‘বইয়া খাউরি’ নৌকার সামনের গলুইযে কোনো ময়ূর না থাকলেও বাকি দুই প্রকারের নৌকায় ময়ূর থাকে।
খেলুয়া দৌড়ের লাল ফিতা দিয়ে যে-জায়গাকে গন্তব্য হিসাবে ধরা হয় এই এলাকাকে বলে গুট্টাঘর। “গুট্টাঘরের সামনে নাও শূন্যে দিলো উড়া” – এ-রকম একটা গানও আছে। তবে যে-নৌকার পাইকলের মধ্যে ছন্দ বেশি সেই নৌকাই জয়ী হয়।
আমাদের ছোটবেলায় আমাদের এলাকায় অনেক দৌড়ের নৌকা ছিল, এর মধ্যে আমাদের গ্রামের একটা এবং কালিজুরী, ফেঞ্চুগঞ্জ এবং বাউশি নামক জায়গার তিনটা চুখা গলই নৌকা। সম্ভবত মোগলাবাজারের কাছে হাওরের মাঝখানের কটালপুরের বটলের নাও এবং ইনাতআলীপুর এবং মির্জানগর গ্রামের এবং বাঘা এলাকার চ্যাপ্টা গলই নৌকা ছিল।
তবে সব থেকে ভয়ঙ্কর নৌকা ছিল রাজনগর থানার কাউয়াদীঘি এলাকার গ্রাম অন্তেহরীর অজ্ঞান ঠাকুরের নৌকা। অজ্ঞান ঠাকুর নাকি খুব বড় কবিরাজ এবং গুনিন ছিলেন। উনার নৌকার সাথে ফাইনালে যে-নৌকা যেত সেই নৌকাকে তিনি গুন্ করে আটকিয়ে দিতেন। সেই নৌকার পাইকেরা নাকি আগের দিন রাতে ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখত। উনার নৌকার পাইকদের একটা গান ছিল, – “সবে বলো হরি হরি , অজ্ঞান ঠাকুরের নাও যাইত অন্তেহরী” …
শুধু অজ্ঞান ঠাকুর নয়, প্রায় সব নৌকাই বাইচের আগে একটু-আধটু তুকতাক করত। তবে ছুবের দিন নৌকার তলায় অনেক চালতা ঘষানো হতো যাতে চালতা থেকে বের-হওয়া পিচ্ছিল জাতীয় আঠা তলানিতে লেগে থাকে। এই পিচ্ছিল আঠা নাকি ছুবের সময় পানির সাথে লেগে নৌকার গতি বৃদ্ধি করে।
আমাদের গ্রামের নৌকার কর্তালী (মন্দিরাবাদক) ছিলেন আমার কাকা। পরবর্তীকালে আমাদের গ্রামের নৌকা ভেঙে গেলে আমার জেঠাতো ভাই উদ্যোগী হয়ে আমাদের বাড়ির মালিকানায় তৈরি হয় একশবিশ লম্বা চুখা গলই নৌকা, এলাকায় ব্যাপক পরিচিতি পায় ঠাকুরবাড়ির নৌকা হিসাবে। ফেঞ্চুগঞ্জ, সিলেট সহ বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক পুরস্কার এবং সুনাম অর্জন করে।
নৌকাবাইচের গানগুলোও খুব অন্যরকম হয়। গিয়ান উদ্দিনের একটা গান আছে – “নাওয়ে নাইরল লইয়া যায়, ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে সোনামিয়ার নায়” …
আরকুম শাহ রচনা করেন “রঙ্গিলা বাড়ৈয়ে দিছইন খেলুয়া বানাইয়া রে …।” তবে ট্র্যাডিশন্যাল খেলুয়াদৌড়ের গানগুলো একটু আলাদা।
যেমন একটা গান মনে পড়ছে, “কালা চাঁন, চাঁন রে মালা দিলো তোর মায়ে তিলক দিলো কে …।”
নৌকাবাইচ আমার শৈশব এবং কৈশোরজীবনে ছিল এক অনন্য আনন্দের খোরাক। আমার ধারণা আমার সমবয়েসী যারা সিলেটে বড় হয়েছি তাদের কাছে নৌকাবাইচ ছিল শৈশবের অন্যতম উৎসব। মা যেতে দিতে চাইতেন না। কিন্তু নৌকাবাইচের আগের দিন অনেক বেশি পড়াশোনা করে মাকে রাজি করাতাম নৌকাবাইচে যাওয়ার জন্য। সিলেটের গ্রামেগঞ্জে এখনো নৌকাবাইচ হয়। আগে যে-বাইচ হতো শিল্ড আর নারকেল দিয়ে এখন সেই নৌকাবাইচ হয় রঙিন টিভি, খাসি আর গরু পুরস্কার নিয়ে। যুগ বদলেছে , সময় গড়িয়েছে অনেক, কিন্তু সিলেটের প্রত্যন্ত এলাকার নৌকাবাইচের প্রাণোন্মাদনা আছে আগেরই মতো। কিন্তু বইয়ের বোঝা কাঁধে নিয়ে ক্লান্ত শহরের কিশোরটি কোনোদিনও জানবে না নৌকাবাইচ শেষে চাঁদনি রাতে বাড়ি-ফিরতি শত শত নৌকার সাথে ছুব বেয়ে বাড়ি ফিরার আনন্দ।
বি.দ্র. পুরাতন সব শব্দ অনেকটাই ভুলে গেছি। সংযোজন-বিয়োজন স্বাগতম। – লেখক।
… …
- দিবারাত্র দুর্গাপুজো || অসীম চক্রবর্তী - October 5, 2019
- ঠাকুরবন্দনা || অসীম চক্রবর্তী - August 9, 2019
- জলধামাইল || অসীম চক্রবর্তী - August 1, 2019
COMMENTS