পুত্রগণ
আষাঢ়ের ঠা ঠা রোদ আর ঘামে-গরমে দুনিয়াটা তেলেভাজা কড়াইয়ের মতো ছ্যাঁক ছ্যাঁক করছে। গ্রামের খালে-ডোবায় আগারেপাগারে জমে থাকা পচা পেঁক-পানি থেকে বাজে গন্ধ উঠছে ভকভক করে। মাইলকে মাইল সবুজ পাটক্ষেতের অরণ্যের মাঝে আজব আর গোঁয়ার কিসিমের একদল মানুষের হাসি-টিটকারিতে হিন্দুপাড়ার আখড়ার চাতালটা হকচকিয়ে ওঠে। চোখে-মুখে হাসিমাখা রাধাকৃষ্ণ মূর্তি দুইটাও বুঝি নদীপারের মন্দির থেকে একবার আচান্নক চোখে সেদিকে তাকায় : কালো কালো মানুষগুলার হাতে সড়কি-বল্লম, রামদা, তির-ধনুক, ঢোল, বাঁশি। তাদের চুলে-গোঁফে জলুশের অন্ত নাই। বেহিসাবি ফুর্তিতে আজ তারা সবাই ফুরফুরা। তাই কাদুর হা হা হাসিতে আখড়ার বরুণগাছে গাইতে থাকা পাখিটাও হঠাৎ চুপসে যায়।
ঘাটুদলের সবচে তরুণ আর সাহসী খেলা মানু মিয়ার দিকে দুই কদম এগিয়ে এসে অবনত মস্তকে কুর্নিশ করতে করতে পালাগানের মঞ্চের আদলে ডায়ালগ দিয়ে বলে : অধমের কসুর নিবেন না জাহাঁপনা, আজকের এই উৎসবে চেমন নগরের মহাবিক্রমশালী রাজাধিরাজের ললাটে চিন্তার ভাঁজ একটুও মানায় না।
ঘাটুদলের কর্তা মানু মিয়া চিকন গোঁফের আড়ালে একটু মুচকি হাসে। কলসির মতো তার ভূঁড়িটা একবার সামান্য কেঁপে ওঠে। তাবাদে বেলের মতো ছোট মাথাটা নাড়তে নাড়তে বলে, — ওহু…ত্যাও সাবধান থাহা ভালা।
পাশেই ছিল কাদু। সে দশবছর ধরে পালাগানের মঞ্চে রাজার পাঠ করে। তার আগে সে উজিরের পাঠ করেছে সাত বছর। পাটক্ষেতের সার-গোবরের মতো ঘাটুগান আর পালাগান তার রক্তে মিশে গেছে সেই কবে। তাই আশপাশের পরিস্থিতি খাপছাড়া না হলে সে দলের লোকজনের সাথে রাজার ভঙ্গিতেই কথা বলতে ভালোবাসে। তাদের ঘাটুদলের রীতিতে পালাগানের রাজাকে দলের সকলে রাজার মতোই সমীহ করে। দলের সকল বিষয়াশয়ে রাজার মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে। তাই এখন দলের কর্তা মানু মিয়ার কথায় খেলা রাজার দিকে তাকায়। রাজারূপী কাদু দলের কর্তাকে আরেকবার দেখে। চতুর মানু মিয়ার ধূর্ত চোখ দুইটা সবসময় ঝিলঝিল করে। লোকটা হাড়ে-গোশ্তে যতটা অর্থলোভী ও লুচ্চা ঠিক ততটাই ছোট নজরের মানুষ। এই জীবনে সে নিজের স্বার্থ আর মাগী ছাড়া কিচ্ছু চিনে না। তাই মানু মিয়ার ‘সাবধান থাহা’ কথাটাকে রাজারূপী কাদু একটুও গতরে মাখে না। পেঁক-পানি-রোদ আর খোরাকি-কষ্টের সাথে সারাজীবন লড়তে লড়তে কাদু শিখেছে, মানুষের জীবন কোনোদিন আগাম কথায় চলে না। তাই মানু মিয়ার প্রতি ঘেন্নায় রাজারূপী কাদু নিজের মাথাটা বার-কয় ওপর-নিচে ঝাঁকায়। ঘাটুদলের কর্তাকে বুঝতে না দিয়ে খামাখাই হা-হা করে বিদ্রুপের হাসি হাসে। দলের রাজা হাসতে হাসতে মাথা নাড়িয়ে তার কথায় সায় দিচ্ছে দেখে মানু মিয়াও মনে মনে খুশি হয়। এদিকে কাদুর কাঁচা-পাকা বাবরিটা হয়ে উঠেছে এলোমেলো, রুক্ষ। নিজের অজান্তেই তার পোক্ত গতরটাতে বারবার খেলে যাচ্ছে একটা বাদশাহি ভঙ্গি। তাই সে রাতের মঞ্চের আদলে ডায়ালগ দেয় : উজিরেআলা, আপনি খামাখা দুর্ভাবনায় আছেন। আমরা পথ চলব নৃত্যগীতের সুরে সুরে, আর যদি আমাদের চিরশত্রু কুখাবনগরের রাজা আমাজাদ ঢালীর (পাশের গ্রামের অন্য একটি ঘাটুদলের দলপতি) পরিকে হরণ করার মতিভ্রম হয়। এবং তার দুর্ভাগ্য যদি আমাদের সামনে তাকে নিয়ে আসে, তাহলে আমরা তাকে দু-পায়ে পিষে, রাজপথ দিয়ে চলে যাব সোজা পরিস্থানের দিকে।
কাদুর এই উত্তেজক পয়গামে দলের তরুণরা লাফিয়ে ওঠে। তারা একসাথে চিৎকার দিয়ে রাজার কথায় সায় দেয়, — ভালো কত্তা ভা, অ হারে হে…
দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও চৌকস ঘাটুছেরা ছিনতাইয়ের জন্য এই অঞ্চলে আমজাদ ঢালীই সেরা। তাই তাদের এত সড়কি-বল্লম, এত আয়োজন ও সর্তকতা। তারা আজ ঘাটুগান গাইতে গাইতে যাবে রথের মেলায়। মানু মিয়া জানে ঢালী লোকটা অপরিণামদর্শী। মারদাঙ্গা না থাকলে বুঝি তার ভালো ঘুম হয় না ! তাবাদে টাকার অভাব পড়লে দুম করে এক-দুইটা ক্ষেত বিক্রি করে দেয়। এইসব ভাবনায় মানু মিয়ার গর্ব হয়। সে ঘাটুদল করে উনিশ বছর। দলে কর্তাগিরি করছে তেরো বছর। ঘাটুদলের কর্তা হওয়াটা তার নিয়তি। বলা যায় কর্তা হওয়ার পর থেকে সে বহুত নিরাপদে আছে। তার মতো জোদ্দারদের শত্রুর কোনো অভাব নাই। জোদ্দারের কব্জিতে জোর না থাকলে ধনে-প্রাণে টিকে থাকা দায়। সাধে কী আর মানুষ বলে :
লাঠি যার মাটি তার।
লাঠি যার মাগী তার।
গত উনিশ বছরে মানু মিয়া কত জমি কিনেছে! কৃষি ছাড়াও ফাগুন-চৈত্র মাসে আখের গুড় মজুদ করে রাখার কারবার আছে তার। ভালুকা-মল্লিকবাড়ি-শ্রীপুর থেকে সে গুড় কিনে নিজের বাড়িতে মজুদ করে। গ্রামদেশের ষোলোআনা মানুষ গুড়ের ভক্ত। সাদা চিনি তারা জীবনে ছুঁয়েও দেখে না। তাই আষাঢ়-শ্রাবণ মাস এলে গুড়ের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। গত বছর একশ মণ আখের গুড়ের লাভ দিয়ে সে আট কাঠার একটা ক্ষেত কিনেছে। এখন মানু মিয়া গৌরব করে সেই ক্ষেতটাকে ডাকে ‘চিনিক্ষেত।’ মাঝে মাঝে যখন সে কামলাকে হুকুম দেয়, — এই কলিমদ্দি আইয়ে কাইল তুই চিনিক্ষেতে হাল লইয়া যাইবে; — তখন তার বুকটা তৃপ্তিতে ভরে যায়।
মানুর বিচারে কাদু-কালুরা এখন তার ‘সাবধান’ কথাটার মর্ম কী করে বুঝবে?
পরীকে (ঘাটুদলের প্রধান ছেরা ফজলু। গফুর বাদশা পালাগানে সে বানেছাপরীর চরিত্রে অভিনয় করে এমন বিখ্যাত হয়েছে যে, চারপাশের দশগ্রামের সকলে তাকে আদর করে পরী ডাকে) খেলা একমাস ঘুরে, তিনমাসের আগাম বেতন নিজের পকেট থেকে দিয়ে, তবে-না উজান দেশ থেকে এনেছে। তাই পরীর ওপর খেলার হক সবচে বেশি। এই হিসাবে গত দুই বছর ধরে দলের প্রধান ঘাটুছেরা খেলার কাছেই থাকে। থাকুক। দশগ্রামের কে না জানে, ঘরে একটা ঘাটুছেরা রাখা আর হাতি রাখা সমান কথা। কিন্তু দলের কর্তা হিসাবে মানু মিয়াকেও তো সবদিকে কড়া নজর রাখতে হয়। কাদু-কালুরা তো সময়-অসময় বোঝে না; খালি ‘উজিরেআলা’ আর ‘জাহাঁপনা …জাহাঁপনা’র জো খোঁজে।
পাশাপাশি কান্দি আর নেওকা, দুই গ্রামে দুইটা ঘাটুদল। আষাঢ়-শাওন-ভাদ্দর এই তিনমাস তারা বিল আর গাঙের ঘাটে ঘাটে ঘাটু নাচায়। অকর্মা দিনগুলা ঢোল-হারমোনির উচ্চতালের সাথে, জোরে জোরে বাবরি দুলিয়ে, ‘ভালো কত্তা ভা’ বলে চিৎকার দিতে দিতে চোখদুইটাকে করে ফেলে লালকুক্কা। মাঝে মাঝে রোদের জেল্লায় রামদা, সড়কি, বল্লমের চকচকে শরীর ঝলমল করে ওঠে। তাবাদে আশ্বিনের নীল আকাশে সাদা মেঘ উড়াল দিতেই মনমতো একটা পালা বাঁধে। তখন কাদু-কালুরা থাকে বেকার। তাদের ঘরে ঘরে কুখাবনগরের (রাক্ষসের দেশ) রাক্ষুসে অভাব। তাই পায়ে পায়ে সবাই চলে আসে মানু মিয়ার বিলপারের চালাঘরে। ঘণ্টাখানেকর মধ্যে কম-বেশি সবাই জড়ো হয়ে যায়। তখন আসরটা সত্যিই গরম হয়ে ওঠে। বিকাশবাবু তাদের পালামাস্টার কাম প্রমটার। ছোটখাটো শরীরের চিরকুমার বিকাশবাবু অ্যাজমার রোগী। মাসে এক-দুইবার শ্বাসের কষ্টে পড়ে। সে বেত হাতে উঠে দাঁড়ায়, — এই যে অহাকালু, তুমি এবার গুপ্ত ঘাতকের রোলটা একটু করে দেখাও।
ছয়ফুট/সাড়ে-ছয়ফুট লম্বা অহাকালুর গলাটা বকের গলার মতো লম্বা। বসন্তের দাগে ভরা খাউদা খাউদা মুখ। একটা চোখ বসন্তে গলে গিয়ে গর্ত হয়ে গেছে। সেই গর্তের মাঝে সবসময় হলুদ কেতুর লেগে থাকে। বেছুরত লম্বা আর হাড়গিলা গতরটার জন্য কালুকে গ্রামের দশজনে অহাকালু ডাকে।
পালামাস্টার বিকাশবাবুই পালা ঠিক করে, কাহিনি ও ডায়ালগ লেখে। তারপর রিহার্সাল। বিকাশ বেত হাতে নিয়ে জনে জনে সংলাপ মুখস্ত করায়, অভিনয়ের ভঙ্গিভাঙ্গা রপ্ত করায়। প্রতিদিন ফজরের পরে ঘাটুছেরাকে গাঙের গলা-পানিতে দাঁড় করিয়ে, বেত হাতে নিয়ে বিচ্ছেদের ট্রেনিং দেয়। পালার নায়ক-নায়িকা দশআনা রেডি হলে সে পালাতে হাত দেয়। সেটা আলোমতি-প্রেমকুমার, গফুর বাদশা, রূপবান কিংবা কাজলরেখার মতো একটা পালা। দুর্গাপূজা থেকে চৈত্রসংক্রান্তি পর্যন্ত গ্রামে গ্রামে বায়না পড়ে। সারা শীতের সিজনটা পালা হয়। গ্রামের সকলে সারারাত জেগে জেগে হ্যাজাকবাতির কড়া পসরে পালাগান দেখে। বুড়ারাও বাদ যায় না। ঝুনা চাষা, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি কিংবা গ্রামের বিচার-সালিশ করনেওয়ালা কূটিল মুরুব্বিরাও আসে। অবশ্য তার আগে মুরুব্বিরা গামছায় ভালোমতো মুখ-দাড়ি বেঁধে নেয়। শুধু চোখদুইটা খোলা থাকে। একবার ভিড়ের মাঝে টুপ করে বসে গেলে কে কাকে দেখে? সবদিক বিচারে পালাটা মনমতো হলে স্বচ্ছলরা নিজেদের নাম গোপন রেখে, দুই-একটাকা বখশিশও দেয়। ঘাটুছেরা বখশিশ পেলে দলের সবার মুখ উজ্জ্বল হয়।
ঘাটুছেরার ডৌল-গড়ন, সুরখাত আর অভিনয়ের জন্য যে-দলটা যে-বছর বিখ্যাত হয়ে ওঠে তার দুশমনের কোনো অন্ত থাকে না। তখন দশগ্রামের মাঝে যত ঘাটুদল আছে সবাই চেষ্টা করে বিখ্যাত-হয়ে-ওঠা ঘাটুছেরাটাকে লুটে নিতে। কোনো কোনো বছর নেয়ও। তখনি লাগে লাঠালাঠি। এতে দু-দশজনের রক্ত মাঠে-ঘাটে গড়ালেও মামলা হয় না। কোনো দলই কোনো বিচার-সালিশ ডাকে না। যে-দলটা মার খায়, তলে তলে তারা ঘোঁট পাকায়। তক্কে তক্কে হাঁটে। ফাঁকমতো পেলে মনের ঝালও মিটিয়ে নেয়। বছর-কা-বছর তাদের মাঝে এই লেনদেন চলতেই থাকে।
এখন খেলারা আখড়া-মন্দিরের সামনে বরুণতলায় দাঁড়িয়ে। সবাই হাউঘাউ করে কথা বলছে, হাসছে, ঘামছে দরদর করে। গাঙের ঘাটে নবী শেখের তিনশমণি নৌকাটা বাঁধা। আষাঢ়ের ভরা গাঙ খল্লর খল্লর করে ডাকছে। ঘাটে বাঁধা নায়ের পেটে গাঙের অসহিষ্ণু ঢেউগুলা ছল্লাৎ ছল্লাৎ আছাড় খেয়ে মাথা ভাঙছে! খেলা একবার ঘাটের দিকে তাকায়। তাবাদে পরীকে দেখে। ওর লাল টসটসা গাল দুইটা ভেজা ভেজা। পরীর মেকাপটা সে সবসময় নিজে করে দেয়। তার এত কষ্টের মেকাপটা আজ মনে হয় ঘামেই ভেসে যাবে !
কড়া রোদে নীল আসমানটা ধাঁ ধাঁ করছে। রক্ষা এই, গুমট কেটে বাতাস বইতে শুরু করছে। পাটক্ষেতের মাথায় মাথায় নাচতে নাচতে মাইলকে মাইল পেরিয়ে আসছে শনশনে বাতাস। তাই পরীর ঘামটা এখন ফোঁটা বাঁধতে পারছে না। একটু পরেই তো নাওয়ের পাটাতনে নাচের তুফান ছুটবে, তখন আর জোর বাতাসেও ঘাম সামলাতে পারবে না। খেলা পরীর দিকে চেয়েই থাকে। আজ পরীকে লাগার মতো লাগছে। আখড়ায় উপস্থিত অনেক মরদের চোখে পলক পড়ছে না। খেলার কাছে পরীর এই রূপের দাম আলাদা কিসিমের, যা শুধু একজন ঘাটুছেরাকেই মানায়। এই ভাবনায় তালকাঠের ডিঙির মতো খেলার টাইট গতরটা গর্বে শিরশির করে ওঠে।
মাগীকুদ্দুর তর সয় না। কথায় কথায় সে মুখ-নাড়া দিচ্ছে, চ্যারত করে থুতু ফালছে। তার কাঁধ-ছাড়িয়ে-যাওয়া চুলগুলা টাইট করে খোঁপা বাঁধা। দাড়ি-মুচ ওঠার পর থেকে সে পালাগানে রানির পাঠ করে। চলনে-বলনে সে রাজারূপী কাদুর ঠিক উল্টা। খুব জরুরি কিছু না হলে আলাপের মাঝে সে ডায়ালগ দেয় না। কিন্তু মেজাজ খারাপ থাকলে কথায় কথায় বেটিমানুষের মতো মুখ ঝামটা দেয়, চ্যারত করে থুতু ফেলার সাথে সাথে হাত-পা নাচায়। বেশি রাগ উঠলে চটাং চটাং করে কথা বলার সাথে পাছাও নাড়ায়। তাই গ্রামের সকলে তাকে ডাকে মাগীকুদ্দু। যেমন, এখন খেলাদের দেরি দেখে মাগীকুদ্দু গতরে একটা ঢেউ তুলে খনখন করে ওঠে, — খামাখা মানুষগুলান খালি দেরিং করে। এই…দেরিং করতাছে ক্যা?
সাহস আর গা-গতরে ডাকাতের মতো মোবারক খাঁ। গফুর বাদশার পালাতে সে বাঁশ এবং সালু কাপড় দিয়ে বানানো ঘোড়ার খোলস গতরে চেপে ঘোড়া সাজে, গফুর বাদশার ঘোড়া। গফুর বাদশা ঘোড়ার পিঠে চড়ে অড়ং জংলাতে (গভীর বন) হরিণশিকারে যায়। তাই ঘাটুদলের সকলে তাকে ঘোড়ামোবারক ডাকে। এই ডাকে সে গৌরব বোধ করে। এবং এইজন্য ঘাটুদলের অনেকে তাকে হিংসাও করে। মাগীকুদ্দুর পাশে দাঁড়ানো ঘোড়ামোবারক একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলে, — একটু রেডিমেডি না অইয়া যায় ক্যামনে?
রাগে মাগীকুদ্দু সাপের মতো ফাৎ ফাৎ করে, — খালি হেঁটা লইয়া আইছে নাকি?
দলের কর্তা মানু মিয়া চোখ ছোট ছোট করে মাগীকুদ্দু আর ঘোড়ামোবারকের দিকে একবার তাকায়। দলের কর্তার অসন্তুষ্টি দেখে ঘোড়ামোবারক আখড়ার বেলতলার দিকে সরে গিয়ে একটা বিড়ি ধরায়। মাগীকুদ্দু মানুর শীতল নজর থেকে রক্ষা পেতে তার বুকে শাড়ির আঁচলের মতো করে জড়ানো গামছাটা টেনেটুনে ঠিক করে।
গ্রামের সবাই রথের মেলার দিকে খুশি মনে হাঁটছে। কারো মাথার টুকরিতে পাকা কলার কাঁধি কিংবা শসা-কুমড়া-কাঁঠাল। এইসব বিক্রিবাট্টা শেষে ছোট ছোট ছেলেমেয়ের বায়না মেটাবে। আর ঘুরে ঘুরে মেলাটা দেখে ফেরার পথে দুই-এক সের গরম গরম জিলাপি কিনে আনবে। এই শেষ দুপুরে যারা তড়িৎ পায়ে রথের মেলা দেখতে কিংবা কলা-কাঁঠাল বেচতে যাচ্ছে তাদের বারোআনাই মুসলমান। আরো আগে উজাই মাছের মতো আণ্ডাবাচ্চা, বউ-ঝি নিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে হিন্দুরা গেছে।
সবার আগে মানু মিয়া নাওয়ে ওঠে। মাস্তুলের খুঁটি ঘেঁষে ঘাটুদলের কর্তার জন্য পেতে রাখা একমাত্র চেয়ারটায় সে আয়েশ করে বসে। বক্কিল মানু মিয়া আজ পরেছে পাঁচটাকা সাড়ে-সাতানা দামের মাস্টার কালা মিয়া লুঙ্গি। গতরে চড়িয়েছে ফিনফিনা ফতুয়া। ছোট তালুকদারের দেখাদেখি সে-ও আজ পায়ে দিয়েছে চকচকে কালো পামসু। তাবাদে চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা-টাও রাখে ছোট তালুকদারের হুবহু। রাজারূপী কাদুর গতরটা মরিচের মতো জ্বলে। এই দেখে মাগীকুদ্দু আর খেলা একপলক চোখ ঠারাঠারি করে। অহাকালু পালপাড়ার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসে। মানু মিয়ার টাকা আছে। সে চাইলে বাজারের সেড়া লুঙ্গি শুধু মাস্টার মালা মিয়া কেন, সুট-কোটও পরতে পারে। কিন্তু তার ছোট তালুকদার হওয়ার খায়েশটা কাদুর দু-চোখের বিষ। রাজারূপী কাদু ঘিন্নায় চোখ ফিরিয়ে নেয়।
খেলা আর অহাকালু পরীকে ধরে শূন্যে উঠিয়ে নাওয়ের পাটাতনে রাখে। লাল জামা-ঘাগরা আর চকচকা মেকাপে এখন সে আগুনের একটা ফুলকি। তারপর বাদশা। মানে পালাগানের গফুর বাদশা। সবশেষে দলের বাকিরা একলাফে নাওয়ে ওঠে। ঢোল, হারমোনি আর নানান জাতের অস্ত্রশস্ত্র আগেই নাওয়ে মজুদ করা আছে। দানবকালু গিয়ে নাওয়ের মাঝ ছাদে উঠে দাঁড়ায়। সে গফুর বাদশার পালাগানে দানবের পাঠ করে। তাই দলের সবাই তাকে দানবকালু ডাকে। দানবের মতো তার দেহটা বিশাল। লাল ফিরিঙ্গি বাবরিটা একটা বড়সড় গামছা দিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে টাইট করে বাঁধা। বাঁশের মুগুর দিয়ে এখন তার মাথায় একটা লাঠি মারলেও সহজে তালুটা ফাটবে না। তার প্রিয় রামদাটা কাঁধে তুলে সে দু-পা ফাঁক করে বীরের ভঙ্গিতে পজিশন নেয়।
পাছা গলুইয়ের দিকে মুখ করে নাওয়ের ছৈয়াতে অহাকালু আর মালেক পাশাপাশি বসেছে। তাদের হাতে তির-ধনুক। ছিলাতে টান তুলে এই ছাড়ে ছাড়ে অবস্থায় রেডি। সামনের দিকে মুখ করে নাওয়ের আগা ছাদে বসেছে ঘোড়ামোবারক আর মাগীকুদ্দু। তাদের হাতেও তির-ধনুক। নিচে গোল হয়ে যারা বসেছে প্রত্যেকের পাশে নিজের নিজের লাঠি, বল্লম কিংবা দা-সড়কি। নাওয়ের মাঝপাটাতনে শ-খানেক বাঁশের আড়াঙ্গি। কাঁচা বাঁশের একটু ভারী জিনিসগুলা হাত-দুইয়েক লম্বা, দুই মাথা চিকন করে কাটা। ঘাটুছেরা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য যদি ধুন্ধুমার শুরু হয় তাহলে জিনিসগুলা হ্যান্ডবোমার মতো উড়িয়ে মারার কাজে লাগাবে। এই অস্ত্র কাজ করে বন্দুকের গুলির মতো। অতীতেও খেলারা এর ফল একশতে একশ পেয়েছে।
চেয়ারে বসা মানু মিয়া তার চিকন গোঁফে তা দিতে দিতে রাজার দিকে তাকায়। রাজারূপী কাদু ভারী গলায় হুকুম দেয়, — এই নাও ছাড়!
পাছা বৈঠায় হাল ধরেছে নবী শেখ নিজে। নাওয়ের মাঝি খুঁটি থেকে আগা গলুইয়ের দড়ি খুলে, লগি দিয়ে ঠেলা দিতেই রাজারূপী কাদু জোরে চেঁচিয়ে ওঠে, — হেই আল্লা আল্লা বলো…
নাওয়ের বাকিরা গলা ভরে চিৎকার দেয়, — হেই আল্লা আল্লা…।
ভরা নদীর ভাটির টানে নাওয়ের আগা গলুইটা পাক খেয়ে রথের মেলার দিকে চলতে শুরু করে। তাবাদে ঢোল আর হারমোনির তালে পরী একটা মুচকি হাসি দিয়ে মানু মিয়ার দিকে মাথা নত করে কপালে সেলাম ঠুকে, সাথে সাথে তার ঘাগরাটা শূন্যে পাক খায় :
অ প্রাণবন্ধু রে,
অকালে পিরিতি না শিখাইয়ো
পিরিতির রস বিষে করে, সকল অঙ্গ অবশ
অ প্রাণবন্ধু রে…
দম নিতে নিতে তার পাতলা শরীরটা বাঁয়ে মোচড় লয়। নাচের তালে ঝুমঝুম করে বেজে ওঠে পায়ের ঘুঙুর। পুবাল হাওয়ায় পরনের লাল ঘাগরাটা কোমরের সমান্তরালে ঘুরছে। লাল চোষপাজামা কামড় দিয়ে ধরে আছে তার মোটা মোটা উরু দুইটাকে। ঘাটে দাঁড়ানো মানুষগুলা জ্বলজ্বলা চোখে সেই দিকে তাকিয়ে থাকে। আর বৌ-বেটিরা পরীকে দেখছে কূটিল চোখে। ঘাটের দক্ষিণ দিকে দাঁড়ানো কমবয়সী একজন ফিসফিস করে পাশের বৌটাকে বলে, — ভাবী, দ্যাহ মাগীর পাছা কত মোডা!
বিটলামি হাসিতে বৌয়ের মুখটা ভরে ওঠে, — নতুন ব্লেডের মতো চনচন করে চিকন ঠোঁটদুইটা, অইত না ক্যা? খেলা কী জান্টু-পুরুষ, নিত্ নিত্ হের লগে ঘুমায়!
নাওয়ের পাটাতনে গোল হয়ে বসা সব-কটা মানুষ ঢোলের তালে তালে গা-গতর আর মাথার বাবরি দুলাতে দুলাতে গলা ফাটিয়ে জোহার দেয়, — ভালো কত্তা ভা, অ-হারে হে…
গফুর বাদশার শরীরটা মিনতিতে নুয়ে আসে। সে পরীর দিকে দুই-কদম এগিয়ে এসে টান দেয় :
অ প্রাণসখি রে,
অমন নিঠুর কথা মুখে না আনিয়ো
আমি ভোমর তুমি ফুল হয়ে রইয়ো
অ প্রাণসখি রে…
ঢোলে যেন মুগুরের বাড়ি পড়ে আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে খেলারাও সুর করে চিৎকার তোলে, — ভালো কত্তা ভা, অ হারে…হে।
চানমোহন সাহার ঘাটে এসে মানুর নাও লগি পোঁতে। আশপাশের পাঁচ-ছ’ বাড়ির সব বৌ-ঝি, ছেলে-বুড়া এসে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে। পরীও সাহাবাড়ির সুন্দরী সুন্দরী বৌ-ঝিদের মন মজানোর জন্য পাগলা নাচের সাথে গান ধরে :
তুমি বন্ধু গাঙের ঘাটে আইয়ো
একলা আইয়ো গো সন্ধ্যার কালে,
বাদশা নাচের তালে তালে পরীর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় :
সুন্দর দুইখান কমলা আছে গো বন্ধু
আছে তোমার নবযৌবনের ডালে…
সাহাবাড়ির বৌ-বেটিরা লাল টুকটুকে হাসি আড়াল করতে মুখে আঁচল চাপা দেয়। বাড়ির বুড়ি কর্ত্রী বড়সড় একটা ডালায় তিনসের আতপ চাল, দুইকান্দা সবরি কলা আর একটাকার দুইটা নোট নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে ঘাটে দাঁড়ায়। মানু মিয়া চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আদাপের ভঙ্গিতে কপালে ডান হাতটা ঠেকায়।
চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ : আগের পর্ব
শেখ লুৎফর রচনারাশি
- চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ ৯ || শেখ লুৎফর - July 8, 2022
- চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ৮ || শেখ লুৎফর - November 20, 2021
- চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ৭ || শেখ লুৎফর - October 30, 2021
COMMENTS