ললিতকলা শিক্ষণ ও শিখনের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বেশিরভাগই ব্যক্তি-উদ্যোগে আয়োজিত, সংগঠিত ও সচল থাকতে দেখা যায়। তাই এইসব প্রতিষ্ঠান যখন বারো বছর বা আমরা যাকে একযুগপূর্তি বলি তা অতিক্রম করে, সেইটা আলাদাভাবেই দ্রষ্টব্য হয় নিশ্চয়। বেশিদিন দম ধরিয়া রাখতে না পারাই নিয়তি আমাদের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের, সেখানে চিত্রন চারুশিক্ষালয় আজও অদম্য ধরে রেখেছে দম ও উদ্যম। চিত্রন পার করছে একযুগের পূর্তিমুহূর্ত। যুগপূর্তি উপলক্ষে উৎসবও হচ্ছে। এই পটভূমিতে চিত্রনের আগের উৎসবগুলোর কিছু খণ্ডছবি ফিরে দেখব আমরা এই নিবন্ধে। এ-বছরের যুগপূর্তি উৎসব এই নিবন্ধের প্রতিপাদ্য নয়, আগের বছরগুলোর মধ্যে বিশেষত ২০১৪ সনের উৎসব ও তৎপারিপার্শ্বিক কিছু উৎসবদিনের কথাবার্তা এই নিবন্ধে দলিলায়িত।
অনুশীলনরত চিত্রকলাশিক্ষার্থীদের কাজ নিয়ে একটা অ্যানুয়্যাল প্রদর্শনীর আয়োজন করে থাকে চিত্রন চারুশিক্ষালয়। সিলেটে এই শিক্ষায়তনের বৎসরান্তিক প্রদর্শনীটি চলাকালে ফেস্টিভ্যালের রূপ পরিগ্রহ করে শিক্ষার্থী, অভিভাবক আর চিত্রকলানুধ্যায়ী সংস্কৃতিকর্মকদের সম্মিলনে। সাধারণত দুই/তিনদিনের সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত উৎসবে প্রদর্শনী ছাড়াও থাকে সাংগীতিক অনুষ্ঠান, শোভাযাত্রা, পার্ফোর্মিং আর্টসের নানাবিধ অনুষঙ্গের মঞ্চপ্রযোজনা। সিলেটের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো তাদের প্রযোজনা নিয়া হাজির হয় বাদ-মাগ্রেব উন্মুক্ত উৎসবমঞ্চে। এবং প্রদর্শনী তো অব্যাহতভাবে সচল থাকেই। দিনগুলো সব মিলিয়ে শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের কলরবে মুখর হয়েই থাকে যা-হোক।
সত্যজিৎ রাজন এই ইশকুলের পরিচালক। নিজে পেশাজীবী চিত্রশিল্পী হওয়ার শুরুতেই তিনি ইশকুল পরিচালনায় এসেছিলেন সতীর্থ চিত্রীবন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে। সেইটা ২০০৭ সনের ঘটনা। তারপর বন্ধুরা সবাই কেউ ব্যাংকে কেউ প্রজাতন্ত্রের সেবায় কেউবা অ্যাকাডেমিয়ায় ক্যারিয়ার গড়েছেন, সত্যজিৎ পেইন্টিঙের প্রতি নিষ্ঠা আরও বাড়িয়েছেন ক্রমশ। প্রদর্শনী হয়েছে শিল্পীর নিজের একক, দেশে এবং বিদেশেও, বছরান্তরে চিত্রনের প্রদর্শনীগুলো তবু সত্যজিৎ রাজনের মনোযোগের কেন্দ্র দখল করে রাখে। এইসব জানা গেল চিত্রনপরিচালক সত্যজিৎ রাজনের সঙ্গে আলাপ করতে যেয়ে।
দেখতে দেখতে এই ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে এসে চিত্রন পা রাখল যুগপূর্তির চৌকাঠে। এই নিবন্ধকার চিত্রন চারুশিক্ষালয়ের প্রায় জন্মলগ্ন থেকে এখন অব্দি শিক্ষাবর্ষশেষের প্রত্যেকটা উৎসবে হাজির ছিল। ফলে একযুগ অতিক্রমণের এই ক্রান্তিক্ষণে একবার ফিরে দেখা যায় আগের উৎসবগুলোর কিছু ঝলকানি। বিস্তারিত নয় মোটেও, প্রতিবেদকের নোটস্ থেকে বেছে বেছে জটছাড়ানো কতিপয় ফেস্টিভিটিই শুধু।
২০১৪ সনে চিত্রনের অষ্টম বর্ষপূর্তি ছিল। অতিথি হয়ে এসেছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এমপি। ছিলেন আরও অনেকেই মন্ত্রীর পাশে মঞ্চে, তা তো বলা বাহুল্যই। কিংবা তার পরের একটা উৎসবে এসেছিলেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ এমপি। কিন্তু মন্ত্রীমিনিস্টার আইলেই যে অনুষ্ঠান সাফল্যমণ্ডিত হয়ে গেল তা বলার সুযোগ অতটা নাই আজকাল। বরং মন্ত্রী ঘিরে যে মোচ্ছব বসে, সেই মোচ্ছবের হ্যাপা সামলাইতে হিমশিম খাইতে হয় আয়োজকদের। তবু স্টুডেন্টরা আর তাদের গার্ডিয়ানরা আশা করেন মন্ত্রীর হাত থেকে তার সন্তান পুরস্কার নিক, নিদেনপক্ষে সেল্ফিটা তো উঠুক। গ্রুপ ফোটোসেশন তো আছেই। ইত্যাদি।
চিত্রনের উৎসবগুলো প্রত্যেকবারই উৎরে যায় সিন্ডিকেটবিহীন একটা উদার অবারিত উদ্যোগের কারণে। ক্যাওস খুব-একটা বাধা হয়ে উঠতে পারে না শেষমেশ। শুরুর দিকে চিত্রন চারুশিক্ষালয় তাদের ইশকুলভবনের উঠানে উৎসবের আয়োজন করত। পরে স্থান সংকুলানের অসুবিধা কাটিয়ে উঠবার গরজে কমার্শিয়্যাল ভেন্যু রেন্ট নিয়া উৎসব আয়োজন শুরু করে। এর মধ্যে সিলেটের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে একবার হয়েছিল উৎসব, অন্য বছরগুলোয় শহিদ সোলেমান মিলনায়তনে কিংবা সিলেটের সেন্ট্রাল অডিটোরিয়ামে ভেন্যু নির্ধারণ করা হয়। যুগপূর্তি উৎসব ২০১৯ আয়োজন করা হয়েছে ঐতিহ্যবাহী শ্রীহট্ট সংস্কৃত কলেজ বিদ্যাপীঠে।
এইবার আমরা আগের বছরের উৎসবগুলো থেকে একটির প্রতিবেদন নিচে দেখতে পাবো। ২০১৪ সনের চিত্রন উৎসব প্রতিবেদন। প্রতিবেদকের ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ জুড়ে দেয়ার কারণে এই নিবন্ধ ঠিক সাংবাদিকী রিপোর্ট হয়েই থাকেনি, কিছুটা অনুষ্ঠানরিভিয়্যু হয়ে উঠেছে, বা বলা ভালো হয়ে উঠতে চেয়েছে। দেখি :
‘চিত্রন’ চারুশিক্ষালয়ের আট নাম্বার বর্ষপূর্তি উদযাপন উপলক্ষে উৎসব হয়েছিল তিনদিনব্যাপী, যেখানে শিক্ষার্থী কিশোর-তরুণ শিল্পীদের শতাধিক চিত্রকর্ম প্রদর্শন করা হয়। ৩-৫ এপ্রিল স্থানীয় শহিদ সোলেমান হল্ সিলেটে ছিল উৎসবভেন্যু। প্রচুর দর্শক সমাগম ঘটেছিল প্রদর্শনীতে, বলা বাহুল্য। এর আগে আরও প্রদর্শনী আয়োজন করেছে ‘চিত্রন’ কর্তৃপক্ষ। কয়েকটি স্থিরচিত্র ভ্রমণের ভেতর দিয়ে একটা আন্দাজ পাওয়া যাবে প্রদর্শনীটি সম্পর্কে। এখানে একটি স্থিরচিত্রসংকলিকার লিঙ্ক রাখা যাচ্ছে নিচে। এই চিত্রগুলোর ধারক এনায়েত ইউএস ইসলাম। স্থিরচিত্রগুলো দেখার জন্যে একটি লিঙ্ক :
খুব ভালো দলিলায়ন হয়েছে এই স্থিরচিত্রগুলোর মধ্য দিয়া। আমি নিজেও গিয়েছিলাম প্রদর্শনীটিতে, বহুকাল পরে কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়া ইন-ফ্যাক্ট, এবং উপভোগ করেছি সার্বিক আয়োজন। কিন্তু যেটা হয় আর-কি, স্থানীয় চিত্রপ্রদর্শনী বা এইরকম অনুষ্ঠানগুলোতে গেলে সোশ্যালাইজেশনটাই ঘটে, আসল কাজ তথা দৃষ্টিনিবিষ্ট উপভোগের কাজটাই ব্যাহত হয়। এছাড়াও প্রদর্শনীবান্ধব পরিবেশ না-থাকার কারণে এই-ধাঁচের আয়োজনগুলো অনেকটা ব্যাহতই হয়, বিশেষত রাজধানীর বাইরে জেলাশহরগুলোতে। যেসব জায়গায় এক্সিবিশন হয়ে থাকে, সেগুলো হয় আকারে খুব বড় অথবা খুব ছোট। সচরাচর হলরুমগুলো মঞ্চমুখো, মঞ্চ-উপযোগী আসনব্যবস্থা ও দণ্ডায়মানস্থল। ফলে নয়েজ একটা বাধা। লাইন ধরিয়ে রাখা সার সার ছবির ঘিঞ্জি ভিড়ে দেখার আনন্দ অনেকটাই উবে যায়। ছবিগুলো ঝোলানো হয় এই গিভেন কন্টেক্সট ও অ্যাভেইলেবল ফ্যাসিলিটিজ মাথায় রেখে। বেশিকিছু করার থাকে না কাজেই অর্গ্যানাইজারদের, তাদের কসুর অল্পই এক্ষেত্রে। অ্যানিওয়ে। এইসব কারণে চিত্রভোগ কম হয়ে থাকে অন দ্য স্পট। তদুপরি ইনোগারেশন ও ক্লোজিং সেরেমোনিয়্যাল ইভেন্ট ছাড়াও অর্নামেন্টাল নানান সেশন সাজিয়ে বসেন মহামহিম আয়োজকগণ, ফলে পেইন্টিং দেখাদেখি মুখ্য থাকে না আর, আয়োজকদের ভাবভঙ্গিতেও তাদের নিজেদেরই অগোচরে ফুটে ওঠে অন্য বার্তা, যেখানে পেইন্টিং গৌণ ও দূরের দিল্লি বলিয়া আমরা বুঝিয়া লই। এইসবের পেছনে প্র্যাক্টিক্যাল নানান বিবেচনা কাজ করে থাকে অবশ্য, দোষও দেই না আয়োজকদিগেরে, সার্ভাইভ করাটা তো দরকার যুগের ধামাকার সঙ্গে, বাঁচিয়া থাকিলে পেইন্টিং প্রভৃতি শিল্পমামলা বাদ-মে দেখা যায়ে-গা। যা-হোক, চিত্রনোৎসব এইসব সংকট ও সীমার মধ্যে থেকে, এইসব দোষঘাট করেও, বেশ ভালো একটা আয়োজন করে থাকে বলতে হবে। এক নয় দুই নয় তিনদিনব্যাপী চিত্রপ্রদর্শনী হিম্মতের ব্যাপারই তো বটে। একটা ব্যাপার ভেবে বের করতে হবে কেবল যে, কেমন করে পেইন্টিংপ্রদর্শনীতে মন্ত্রী ও মাইক্রোফোন নিরুৎসাহিত করা যায় এবং ইন-দ্যাট-কেইস এসবের অল্টার্নেটিভ কি হইতে পারে এইটা সাজেস্ট করাও জরুর। তো, অবস্থা ও পরিস্থিতির বিবরণ শেষ করি ধীরে। অ্যানিওয়ে। সেইভাবে দেখতে পারিনি শিশুশিল্পীদের চিত্রকর্মকল্পনাগুলো শান্তিতে, কেবল বলবার কথা ছিল এইটে। এই স্থিরচিত্রসঞ্চিতায় — এই অ্যালবামে — সেই আক্ষেপ, সরেজমিন অকুস্থলে ভালো করে খুঁটিয়ে না-দেখার খেদ, ভোলা গেল। অনেকটাই রিক্যাপ বা ফিরে-দেখার কাজটা হয়ে যায় এই ফটোসঞ্চয়িতায় একবার চোখ বুলিয়ে গেলে। আমি নজর ডুবিয়ে দেখেছি এর প্রতিটি ছবি, প্রতিটি ফ্রেম। খুব ভালো করেছেন স্থিরচিত্রী। এবং কাজটা কম ঝক্কির নয় আমরা জানি। গ্যালারি ঘুরে ঘুরে ক্যাপ্চারযোগ্য ছবি নির্বাচন ও অল্প আলোতে কসরতপূর্বক শাটার টেপা ইত্যাদি, স্থিরচিত্রশিল্পী স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই কাজটুকু করেছেন বলে এখানে বিশেষ ধন্যবাদ জানাই আমরা। আমি যদ্দুর জানি, ‘চিত্রন’ নামে একটা লাইকপেইজ আছে, সেইখানে এইগুলো সঞ্চালক-সমন্বয়কগণ নিশ্চয় রিলোড করে রেখেছেন স্থিরচিত্রশিল্পীর অনুমতি নিয়ে। প্রোক্ত লাইকপেইজের হদিস নিচে দেয়া গেল :
https://www.facebook.com/pages/Chitron/519939968118443
শুরু হয়ে ফের শেষও হয়ে গেল উৎসব ২০১৪, আঁকিয়ে ও আঁক-দেখিয়েদের, ‘চিত্রন চারুশিক্ষালয়’ আয়োজিত ৩ দিনব্যাপী চিত্রপ্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক সৌহার্দ্য উদযাপনের এই শুভযাত্রা উদ্বোধন করেন বর্ষীয়ান চিত্রশিল্পী ও চিত্রকলাশিক্ষক অরবিন্দ দাসগুপ্ত। উদ্বোধনী অধিবেশনে বিশেষ অতিথি ছিলেন অ্যাডভোকেইট শহীদুল ইসলাম শহীদ, উপাধ্যক্ষ, মেট্রোপলিটন য়্যুনিভার্সিটি, এবং ছিলেন আরও সমিক সহিদ জাহান, সহযোগী পরিচালক, এফআইভিডিবি। শতাধিক অনুরাগী চিত্রপ্রেমীদের বহর নিয়ে প্রেক্ষাগৃহ প্রদক্ষিণপূর্বক প্রদর্শনীতে-অন্তর্ভূত ছবিগুলো খুঁটিয়ে দেখেন উদ্বোধক অতিথিবৃন্দ। প্রদর্শনের জন্য মনোনয়ন-পাওয়া কাজগুলোর শিল্পী শিশুকিশোরদের সঙ্গে কথা বলেন, অতিথি-প্রদর্শনার্থীবৃন্দ যার যার মতো অভিমতপ্রতিক্রিয়া জানান উপস্থিত জনসমাগম লক্ষ করে, এবং মন্তব্যবইয়ের পৃষ্ঠায় নিজেদের অনুভূতি লিপিবদ্ধ করেন। উল্লেখ্য, উৎসব ৩ এপ্রিল বৃহস্পতি বেলা সাড়েতিনে শুরু হয়ে ৫ এপ্রিল রাত ০৮:৩০ অব্দি শহিদ সোলেমান স্মৃতিমিলনায়তনে সকাল-সন্ধ্যা সর্বসাধারণ প্রদর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। শতাধিক চিত্রী শিশু-কিশোরদের প্রায় দেড়শো অথবা তারও অধিক চিত্রকর্ম প্রদর্শনীতে দেখানো হয়েছে। সমাপনী দিনে পরিকল্পিত একটি বিশেষ মূল্যায়নমূলক অধিবেশন ও আলঙ্কারিক পর্বে প্রধান অতিথি হিশেবে উপস্থিত থেকেছেন জাতীয় সংসদ সদস্য ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অধিকন্তু ছিল সমাজচেতনাপ্রভাবক একটি সাংস্কৃতিক অধিবেশন সমাপনী দিনের অনুষ্ঠানমালায়।
‘চিত্রন চারুশিক্ষালয়’ আহূত এই চিত্রপ্রদর্শনী এবং শিক্ষানবিশ শিশু-কিশোরদের মিথস্ক্রিয়ামূলক ও অর্জিত অভিজ্ঞতা বিনিময়্ধর্মী উৎসব প্রতিবছর পালিত হয় বেশ সুন্দরভাবে। এই বছর ২০১৪ মে মাসের ৩ থেকে ৫ তথা বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবারে উৎসব সম্পন্ন হয়েছে। ভেন্যু শহিদ সোলেমান হল্। লোকসমাগমও মন্দ না। সমাপনী দিনের একটি বিশেষ অধিবেশনের প্রধান অতিথি সম্মানিত সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী, অর্থ মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিত। উৎসবের এই বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় অন্তিম দিন শনিবার সকাল ১০:০০ ঘটিকায়। উৎসব-অভিভাষণ শোনার পাশাপাশি সিলেটের একটা কালচারাল অ্যাক্টিভিস্ট গ্রুপ নগরনাট-এর গান শোনা গেল।
এমনিতেই তো ছুটির দিন। তদুপরি ভিজে মেঘবাদলিমুখর হাওয়াবাতাসের অপরাহ্ন। কোনো-এক ফুরসতে একটু ঢুঁ মেরে একবার তামশা দেখতে তো যাওয়াই যায়। একটু উদ্যোগী ও চিত্রানুরাগী হইলে একটু উৎসবমণ্ডপে যাইতে গররাজি হবার কথা না। এবং শিশু-কিশোরদের আঁকা ছবির শিল্পছোঁয়ায় নিজেকে চাঙ্গা করে ফেরা যাবে। এইসব ভাবতে ভাবতে বেরোলাম ঘর হইতে দুইপা ফেলিয়া রাস্তায়। সড়ক-ভেজানি বৃষ্টিনিশীথে উৎসব থেকে ফিরে এসে এন্ট্রি লিখতে বসলাম।
সম্পন্ন হলো উৎসবের দ্বিতীয় দিন। সফলভাবেই সম্পন্ন হলো বলতে হবে। ছুটিদিন ছিল বিধায় চিত্রদর্শনার্থীদের সমাগম ঘটেছিল যথেষ্ট। মফস্বল জেলাশহরে এরচেয়ে বেশি দর্শকসাড়া আশা করা আদৌ সমীচীনও তো হয় না। যাকে বলে উপচে-পড়া ভিড়, তা তো ঠিক প্রত্যাশিত নয় এখানে। এবং এইটাও ঠিক যে, একটি চিত্রপ্রদর্শনীতে ভিড় যখন উপচে পড়ে, যদিও সেটা দিবাস্বপ্ন, বুঝতে হবে সেই ভিড়ে-ভিড়াক্কার প্রদর্শনী কোনো মহানায়ক অথবা মহানায়িকার বিভিন্ন মুহূর্তের আবয়বিক ও শরীর-সংস্থানিক স্থিরচিত্রের। কিন্তু সত্যিকার-অর্থে পেইন্টিং এক্সিবিশনের দর্শকগোত্র, কবিতাপাঠকের মতো, বরাবর খুব বেশি গণনীয় নয়। এইসব বিবেচনায় নিঃসন্দেহ বলা যাইতে পারে যে শিশুকিশোরদের আঁক নিয়া আস্ত একটা এক্সিবিশন আয়োজন ও পরিচালন — গোটা ব্যাপারটাই হিম্মতের বটে। এখনও জয়নুল আবেদীন বা কামরুল হাসান অপরিচিতপ্রায় যে-দেশের গরিষ্ঠাংশ জনগোষ্ঠীর কাছে, সেই দেশে একটি চিত্রপ্রদর্শনীতে দিনপ্রতি অন-অ্যান-অ্যাভারেজ শ-তিনেক লোকের গমনাগমন, দর্শনদারি ও কলরবমুখরতা, আনাগোনা আশাব্যঞ্জক নিশ্চয়ই। চিত্রন উৎসবে গেল-দুইদিনে সহস্রাধিক লোকের সমাগম ঘটেছে, এরচেয়ে বেশি নয়, কিংবা এরচেয়ে বাড়িয়ে বা কমিয়ে বলারও কিছু নেই। কিন্তু দর্শকাগম ওইভাবে ঠিক গণনাপূর্বক পরিসংখ্যান উপস্থাপন করার তো কোনো উপায় নাই, চিত্রপ্রদর্শনীতে-সমাগত দর্শকের ধরন মোটের ওপর ভ্রাম্যমাণ যেহেতু এবং এই ধরনের আয়োজনে নাম-নিবন্ধন প্রভৃতির কোনো লৌকিকতা বা বাঁধাধরা মাথা-কাউন্টিং প্রক্রিয়া রাখা হয় না। বাকি থাকে একটাই পথ, দর্শকাগম সম্পর্কে একটা আইডিয়া লাম্-সাম্ ধরে নেবার, যেমন আজকে এই দ্বিতীয় দিনে প্রেক্ষাগৃহকর্নারে-রাখা খাতায় চিত্র-দর্শনোত্তর মন্তব্য-টুকে-যাওয়া চারুকলাবান্ধব দর্শকের সংখ্যা সাকুল্যে তেত্রিশ জন। মন্তব্যখাতা অন-ফিল্ড জরিপ করেই ফিগারটা জানানো হলো। প্রথমদিন তো অর্ধেকে ছিল মন্তব্যখাতার ভুক্তিসংখ্যা। আবার এইটাও মনে রাখা চাই যে, আমাদের অঞ্চলে এখনও মন্তব্যবইতে এক-কলম লিখিয়া ভালোলাগা-খারাপলাগা জানানোর ন্যায় নিষ্ঠাবান নাগরিক কয়জন হবে আর — এইসব তো অনুমেয় ও উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। যা-ই হোক, এইসব ভাবতে ভাবতে, এইসব নিয়া আলাপ করতে করতে, লেইট নাইট বাড়ি ফিরবার রাস্তা ধরছিলেন ‘চিত্রন চারুশিক্ষালয়’-র নয়জন নিরলস শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রী, পরবর্তী দিনটিতে আজকের তুলনায় আরও অনেক অধিক জমায়েত হবে এমন খোয়াব দেখতে দেখতে। শেষ ভালো যার, সব ভালো তার — প্রবাদবাক্যটা অদৃষ্টবাদী হলেও মন্দ তো নয় — যেন ভালো হয় শেষটুকু। তবে এইটাও ঠিক যে, উৎসবের শেষ মানেই তো সব শেষ নয়, ব্যর্থ অথবা সফল যে-যা-ই বলুক, বরং উৎসব শেষ করেই আসে সত্যিকারের কাজের শপথ। সকলে মিলে মেলামেলির পরিবেশ-পরিচিতির ভেতর দিয়া বাহিত হওয়া।
‘চিত্রন চারুশিক্ষালয়’ একটা আঁকজোখ শেখাবার গুরুগৃহ। শহরেই, সিলেটে, এর লোকেশন। দুইটা ক্যাম্পাস ছিল আগে, এখন বড়সড় পরিসর জুড়ে একত্র-অখণ্ড ক্যাম্পাস। সত্যজিৎ রাজন, প্যাশনে-পেশায় পেইন্টার, স্কুলের পত্তনি করার পরে এ-পর্যন্ত ৯/১০ জন সহশিল্পী নিয়ে এইটা হাজারও হ্যাপা-হুজ্জোত সয়ে বেশ চালিয়ে চলেছেন। গত ১০/১২ বছর ধরে এরা তাদের অ্যানিভার্স্যারি আয়োজন করে আসছেন। সেই সুবাদে বেশ লোকজানাজানি হয়। এদ্দিনে স্থানীয় পরিসরে এই অনুষ্ঠান যথেষ্ট গোনাগ্রাহ্যি হচ্ছেও বটে। এমনকি বিশেষ অতিথির আসনক্রমিক সিক্যোয়েন্স নিয়াও টেনশন ক্রিয়েট হয় লোক্যাল পোকাদষ্ট বুদ্ধিভনভন বইদোকানি-শিক্ষকাধ্যক্ষকণ্টকিত লোকসমাজে। এতে করে এইটাই, অতএব, প্রতীয়মান হয় যে চিত্রনোৎসব জম্পেশ হচ্ছে। বেশ তো।
২০১৯ খ্রিস্টাব্দে একযুগপূর্তি চিত্রন উৎসব শ্রীহট্ট সংস্কৃত কলেজের ভবন এবং চত্বর জুড়ে মুখরিত। প্রদর্শনীর জন্য মিলনায়তন ও বারান্দাগুলো ব্যবহৃত হলেও উঠানের ঘাসবিছানো অর্জুনগাছতলার সুসজ্জিত মঞ্চে যাবতীয় সংগীত-নৃত্য ইত্যাদি পরিবেশনার জন্য বরাদ্দ। সিলেটের সাংস্কৃতিক দলগুলো ছাড়াও বর্ষীয়ান-উদীয়মান বাউল ঘরানার শিল্পীদের নির্ভরযোগ্য পরিবেশনা শোনার একটা জায়গা হয়ে উঠেছে চিত্রনের বার্ষিক উৎসবগুলো। শুধুই চিত্রপ্রদর্শনী নয়, শিক্ষার্থীদের এবং সমাজের সার্বিক বিকাশের জন্যে দরকার সাংস্কৃতিক সক্রিয়তা এবং তাই চিত্রন চায় শিক্ষার্থীদের কাছে প্রতিবছর উৎসবমুখোশে নিজেরে প্রেজেন্ট করতে। এই কথাগুলো উৎসবকর্ণধারদের সঙ্গে সান্ধ্য চাচক্রের আলাপে উঠে এল।
যুগপূর্তি চিত্রন উৎসবের উদ্বোধনী দিনে গেস্ট হয়ে এসেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অধ্যাপক জামাল আহমেদ ও অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। দুইজনেই চিত্রশিল্পী হবার কারণে এক্সিবিশন তাদের বক্তব্য-অভিভাষণে গুরুত্ব পেয়েছে। হ্যারল্ড রশীদ ছিলেন মঞ্চে উপবিষ্ট অতিথিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, যিনি সিলেটেরই ব্যক্তি এবং দেশের একজন বরেণ্য মিউজিশিয়্যান ও পেইন্টার। চিত্রনপরিচালক সত্যজিৎ রাজন ছাড়াও মঞ্চাসীন হ্যারল্ড রশীদের বক্তব্যে হোস্টদের বিনয় এবং আন্তরিক উষ্ণতা ফুটে উঠেছিল উদ্বোধনী অধিবেশনটায়।
প্রতিবেদন : সুবিনয় ইসলাম
… …
- গোপালটিলায় গানসন্ধ্যা - February 2, 2021
- গান ও গঞ্জনা - December 1, 2019
- নগরনাট সঞ্জীবস্মরণ - November 21, 2019
COMMENTS