ক্লাইটেমনেস্ত্রা, এস্কাইলাস-অ্যাগামেমনন, আরগোস, বিচারব্যবস্থা আর গ্রিক বিষাদসিন্ধু || হাসান শাহরিয়ার

ক্লাইটেমনেস্ত্রা, এস্কাইলাস-অ্যাগামেমনন, আরগোস, বিচারব্যবস্থা আর গ্রিক বিষাদসিন্ধু || হাসান শাহরিয়ার

শেয়ার করুন:

ট্রয় নগরীরে মাটিতে ধসাইয়া সুলতান অ্যাগামেমনন ট্রোজান রাজকন্যা কাসান্দ্রারে লইয়া বীরের মতো ফিইরা আসেন আরগোসে। উল্লাস আর মত্ততায় অ্যাগামেমননের বুক তখন পাহাড়ের মতো উঁচা, যেন আকাশটারে টোকা দিতেছিল যখনতখন বেপরোয়া। বিপুল অভ্যর্থনা আর জয়ধ্বনিতে কাঁপতেছিল আরগোসের পাথর, শান-শওকত। কিন্তু মহলের ভিতর যাইতেই বেগম ক্লাইটেমনেস্ত্রার আততায়ী ছুরির একের পর এক নৃশংস আঘাতে খুন হইয়া গেল সম্রাট অ্যাগামেমনন। খুবই অপ্রত্যাশিত। অবিশ্বাস্য। নিজ মহলে সুলতানের এই করুণ পতন একজন  দর্শকরে একদিকে যেমন অপ্রস্তুত আর আহাম্মক কইরা তোলে, সাথে সাথে যেন ওই দর্শকের ইগোর জায়গাটারেও টলাইয়া দেয় মুহূর্তে।

খুনের পরে এইবার ক্লাইটেমনেস্ত্রা মুখোমুখি গ্রিক সোসাইটির। মুখোমুখি গ্রিক এথিকসের। মুখোমুখি গ্রিক মোরালিটির। এইটা কি ন্যায়বিচার হইলো, ক্লাইটেমনেস্ত্রা? ক্লাইটেমনেস্ত্রার পাল্টা প্রশ্ন ন্যায়বিচার কী? অথবা দর্শক হিসাবে আপনে নিজেও কি মুখোমুখি হন না এই গ্রিক বিষাদসিন্ধুর? তাইলে প্রশ্ন করেন, এই বিষাদ কার জন্য? কার জন্য ছারখার এই সিন্ধু?

কোথায় ছিল গ্রিক বিচারব্যবস্থা যখন সম্রাট অ্যাগামেমনন তার এবং ক্লাইটেমনেস্ত্রার আদরের মেয়ে ইফিজিনিয়ারে উন্মত্ত যুদ্ধের ময়দানে নির্মমভাবে হত্যা করে? গ্রিক বিচারব্যবস্থা স্বৈরতন্ত্রের কোনো বিচার করে নাই। এইজুস্থাসের দুই ভাইকে নৃসংশভাবে খুন করা হইছে। তার আব্বারে পাবলিক ট্রায়ালে বেইজ্জতি কইরা দেশছাড়া করা হইছে। গ্রিক বিচারব্যবস্থা এইসবের কোনো বিচার করে নাই। অর্থাৎ এই বিচারব্যবস্থা নিজেরে কোনোদিন স্বৈরতন্ত্র বা জিঘাংসার মুখোমুখি করতে চায় নাই।

গ্রিক বিচারব্যবস্থা কোনোদিন যেন নৈতিকতারও মুখোমুখি হয় নাই। যখন নিজের মেয়ে ইফিজিনিয়ারে ট্রয় ধ্বংসে বলি দেওয়া হইলো অথবা ঘরে বউ থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘ দশ বছরের যুদ্ধ শেষে ট্রোজান প্রিন্সেস কাসান্দ্রারে রক্ষিতা হিসাবে আনা হইলো…একজন মা বা সুলতানের বউ হিসাবে ক্লাইটেমনেস্ত্রার মর্যাদা রইলো কই? গ্রিক নৈতিকতা কি এইসব অমানবিকতার বিচার করতে পারবে?

অ্যাগামেমনন হত্যারে জাস্টিফাই করতেছি না। অ্যাগামেমনন হত্যা কি ক্লাইটেমনেস্ত্রা বা এইজুস্থাসের রাজনীতি অথবা প্রতিশোধ? ক্ষমতার কাছে প্রতিশোধ কি একধরনের রাজনৈতিক টুল? এই প্রশ্নগুলাও এইখানে দরকারি না। বরং গ্রিক বিচারব্যবস্থার কাছে বা দর্শকের সামনে ক্লাইটেমনেস্ত্রার ছুইড়া দেওয়া প্রশ্নসমূহের দিকে নজর দিতে হবে।

এমনকি ক্লাইটেমনেস্ত্রারে দেখা যায় হেলেনরে রক্ষা করতে। শত শত বছর ধইরা ক্ষমতার খুদখোর পুরুষতান্ত্রিকতা ট্রয়-ধ্বংসে হেলেনরেই দায়ী কইরা আসতেছিল। এমন না যে এই বিদ্বেষ আরোপ আলোচ্য ট্রাজেডির অনেক পরে আধুনিক সময়ের কোনো-এক ক্ষণ থেইকা শুরু হইছে আচমকা। বরং অ্যাগামেমনন হত্যার ঠিক পরেই ক্লাইটেমনেস্ত্রারে এই প্রশ্নের মুখোমুখি হইতে হইছে শীতলভাবে। তারা বলতেছিল, এক নারীতে ধ্বংস হইলো ট্রয় এবং অন্যজনায় আরগোসের রূপালি আকাশ…

জবাবে ক্লাইটেমনেস্ত্রা ট্রোজান এলাকার সমুদ্রবন্দর দখলের কথা বা অর্থশাস্ত্রের কোনো জটিল ব্যাখ্যায় যায় নাই। বরং সে গ্রিক বিচারব্যবস্থারে মনে করাইয়া দিলো, এমনকি হেলেনের অপহরণ থেইকা কাসান্দ্রারে দখল এর মধ্যে কোথাও একটা সিঙ্গেল সিদ্ধান্তে কোনো নারীর এতটুক মতামত কেউ নেয় নাই।

অ্যানিওয়ে, ক্লাইটেমনেস্ত্রার প্রশ্ন তোলা বিচারব্যবস্থা লইয়া দু-একটা কথা বলা যাইতে পারে। এই-রকম বিচারব্যবস্থায় শাসক বা একনায়কের জারি করা একেকটা আইনরে শুধু শাসক-নাগরিক দ্বন্দ্বের শাসন হিসাবে দেখলে হবে না। বরং এইরকম আইন নাগরিক-নাগরিক দ্বন্দ্বের পারস্পরিক শোষণও হইতে পারে। যেহেতু সবাইরে এই বিচারব্যবস্থার ভিতরেই আইনি লড়াই চালাইতে হয়।

একটা আইন শুধুমাত্র আপনেরে বা সমাজরে রক্ষায় অথবা আপনেরে বা সমাজরে শায়েস্তা করার জন্য বানানো হইতে পারে ব্যাপারটা এইটুক সীমার মধ্যে না দেইখা আরেকটু বাড়াইয়া দেখা যাইতে পারে। যেমন এই-রকম বিচারব্যবস্থায় তৈরি হওয়া একেকটা আইন যে-কোনো ইস্যুতে এক নাগরিকরে অন্য নাগরিকের মুখোমুখিও খাড়া করাইয়া দিতে পারে।


হাসান শাহরিয়ার রচনারাশি

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you