মনিপুরী নৃত্য ও লোকজ সংগীতার্দ্র সন্ধ্যা   

মনিপুরী নৃত্য ও লোকজ সংগীতার্দ্র সন্ধ্যা   

গল্পটা আজকের নয়, আজ থেকে বছর-চার আগের, একটা নাচের অনুষ্ঠান দেখার গল্প। মনিপুরী নৃত্যকলার অনুষ্ঠান।  হয়েছিল অসরকারি একটা আপিশের আয়োজনে। নেমন্তন্ন জুটে গেলে সেইটা নাচের হোক বা নয়ছয়ের — ঢুঁ দিতে তো দোষ নাই। ইভনিং টি-স্ন্যাক্সের স্মেল নাকে এলে তো ঝড়তুফানেও খোকন ডরায় না। যাই, দেখে আসি। জীবনে এই একটা কাজে তো কসুর করি নাই, বিন্দু পরিমাণে হেলাফেলা বা গাফিলতি করি নাই। কী সেই কাজ? সেই কাজই হচ্ছে দেখা। নাচ হোক বা নারদের নারিংবিরিং — দেখায় ফাঁকি নাই।

নিমন্ত্রণকর্তাদের ঘরোয়া বার্ষিক আয়োজন মনে হলো। ওদের বোধহয় অ্যানুয়্যাল জেনারেল মিটিং গোছের কিছু। গোটা দিন ধরে বেচারাদের বিভিন্ন প্রতিবেদন ইত্যাদি নিয়া ঘাম ফালাইতে হয়েছে, ফ্যামিলিগেস্টদেরেও ফোকর দিয়া সামলাইতে হয়েছে, সেই বিকালঘনিষ্ঠ বেলায় লাঞ্চ করেছিল। নয়টা নাগাদ শুরু হলো মনোজ্ঞ সংগীত সন্ধ্যা ব্যানারের প্রোগ্র্যাম, সেইটা যায়া শেষ হলো সোয়া দশটায়। তারপরে একটা শাঁসালো ডিনারও বরাতে এসে গেল মুফতে। একদম ফ্যুলকোর্স ডিনার, উয়িথ অ্যা ডিলাক্স ডেজার্ট।

ভোজসভার বিবরণী লিখতে তো বসি নাই, রিডারের রেজিস্ট্রেশন পর্যাপ্ত হলে একদিন তেমন একটা ভোজসভার রিভিয়্যু রচিবার বাসনা রাখি। কিন্তু বর্তমান নিবন্ধে চেষ্টা চালাই রিক্যাপ করতে সেদিনের সেই শীতরাইতের নৃত্য ও ননপ্রোফেশন্যাল সংগীতের অনুষ্ঠান। বলব বলেই তো বসা।

আদিগন্ত কুয়াশাঝাঁপানো পৌষসন্ধ্যার কনকনে হিমের ভিতরেই সিলেটে একটি নৃত্যগীতের আসর অনুষ্ঠিত হয়ে গেল শ্রোতা-দর্শক সমুজদারদের সমবেত স্বতঃস্ফূর্ততায়। শীত ছিল সহনীয় মাত্রা ছাড়ানো, তবু দর্শকশ্রোতার সমাগম ছিল প্রেক্ষাকক্ষ উপচানো। বছরের শেষ হপ্তায়, ২৬ ডিসেম্বর শনিবার সন্ধ্যায়, ক্রিসম্যাসের আলো তখনও ফেইড আউট হয় নাই, নৃত্যগীতের মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানটি সিলেটের চা-বাগানপরিবেষ্টিত খাদিমনগর এলাকায় এফআইভিডিবি মিলনায়তন মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়। ফিফটিনের, টুথাউজ্যান্ড ফিফটিনের, গল্প এইটা।

অ্যাকাডেমি ফর মনিপুরী কালচার অ্যান্ড আর্টস্ পরিবেশিত নৃত্যকর্মের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা আবহমান সুরের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিদর্শন শুনিয়ে শ্রোতাদের মন্ত্রাবিষ্ট করে রাখেন শিল্পী প্রসূন রায় এবং শ্যামলী বসাক। উভয়ের পৃথক পরিবেশনায় একে একে হাজির হয় বাংলার দিকপাল পদকার সংগীতস্রষ্টার একগোছা গান। বিশেষভাবেই শিল্পী প্রসূন রায়ের কণ্ঠে যথাক্রমে শচিন দেব বর্মণ এবং শাহ আবদুল করিমের গান শ্রোতাদের তারিফ কুড়িয়েছে। একইসঙ্গে শ্যামলী বসাকের লোকসংগীতোপযোগী বিশেষত্ববহ গলায় রাধারমণ দত্তের সুরগুচ্ছ মূর্ছনাধারায় তীব্র করে তোলে শিশিরফোয়ারা। উভয় শিল্পীর সঙ্গেই অ্যাক্যুস্টিক্ বাদ্যযোজনা গানের প্রায়োগিক আবেদন উঁচুতারে বেঁধেছিল সন্ধ্যায়োজনটিকে। বাদ্যযন্ত্রে গোটা আয়োজনটিকে তালবন্ধনে রেখেছিলেন তবলাশিল্পী অয়ন চক্রবর্তী এবং ঢোলকশিল্পী পিয়ম বসাক। পরিবেশনাকালীন শিল্পীরা হারমোনিয়াম নিজেরা বাজিয়েছেন পরিমিত শিল্পসৌকর্য বজায় রেখে।

সান্ত্বনা দেবী পরিচালিত নৃত্যায়োজনে একাধিক খণ্ডে একগুচ্ছ মনিপুরী নৃত্যকলা নান্দনিকতায় নৃত্য-উপভোক্তাদের নজর মোহিত করে রেখেছিল। উল্লেখযোগ্য নৃত্যরচনাগুলোর মধ্যে একটি ছিল ‘মাইবি’, নৃত্যশাস্ত্র অনুসারে মাইবি হচ্ছে পূজারীদের নাচ তথা নাচের মধ্য দিয়ে দেবতাকে নিবেদিত অর্ঘ্য, নৃত্যনৈবেদ্যের মাধ্যমে দেবতাতুষ্টি অর্জন এই নৃত্যের অভীষ্ট।

‘দশাবতার’ শীর্ষক অন্য একটি নৃত্যরচনায় বিমোহিত দর্শকপ্রতিক্রিয়ায় অ্যাকাডেমি ফর মনিপুরী কালচার অ্যান্ড আর্টস্ শিল্পালয়ের নৃত্যশিল্পীদের কুশলতা ও নৈপুণ্য সপ্রশংস করতালি লাভ করে। মনিপুরী নৃত্যসাহিত্যের বয়ানে এই নৃত্যখণ্ডটিও ভক্তিরসের অবলম্বনে একটি বীরবন্দনামূলক দুর্গতিনাশন বরাভয়ের কলাকাজ। যখনই প্রথাগত ধর্মের মোড়কে গ্লানি ও হানাহানির কূটিলতায় আবিল হয়ে যায় পৃথিবীর মর্ত্যভাগ, স্বয়ং শ্রীবিষ্ণু তখন মর্ত্যভুবনের কল্যাণে এবং সজ্জনসাধু সর্বজনের রক্ষার্থে এই বিভেদরক্তার্ত ধরণীতে একলাই দশ অবতারের রূপ ধরে অবতীর্ণ হন। ‘দশাবতার’ শিরোনামক অনবদ্য কম্পোজিশনে এই দৃশ্যকোলাজটিকেই নৃত্যমুদ্রায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

এই সন্ধ্যার আরেকটি বিশেষ উপভোগ্য নৃত্যকাজ ছিল ‘মন্দিরা নৃত্য’। অত্যন্ত রোম্যান্টিক মেজাজের আঙ্গিক এই নৃত্যের গ্রথনে এনেছিল ফুরফুরে এক ফল্গুধারার আমেজ। এটি আদতে একটি উৎসবনৃত্য তথা ফেস্টিভ্যাল ড্যান্স। ঝুলন উৎসবের সময়ে রাধা-কৃষ্ণ যুগলের বিগ্রহ দোলনায় নিয়ে গোপীরা মন্দিরা বাজিয়ে এই নৃত্য করে থাকেন। ব্যুৎপত্তিবিচারে এইটুকু পরিচয় মাত্র নয়, মনিপুরী নৃত্যের শৈলীশোভা চাক্ষুষ করার ব্যাপার, বর্ণনায় এর বিভা অল্পই বিবৃত করা যায়।

এই নিবন্ধে এটুকু শুধু উল্লেখ্য সংক্ষেপে যে, সিলেটের আবহমান সংস্কৃতিতে ক্রমে ঐতিহ্যেরই অংশ হয়ে উঠেছে এই শিল্পঋদ্ধ অনন্যমাত্রিক মনিপুরী নৃত্য। অ্যাকাডেমি ফর মনিপুরী কালচার অ্যান্ড আর্টস্ এই নৃত্যানুশীলনে এবং এর প্রসারে দীর্ঘদিন ধরে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে। ইতোমধ্যে এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ও রচিত নৃত্যমালা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও প্রশংসিত হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান সঞ্চালক এবং কোরিয়োগ্র্যাফার সান্ত্বনা দেবী এফআইভিডিবি আয়োজিত অনুষ্ঠানের নৃত্যসম্ভার মঞ্চায়ন করেন। নৃত্যের বিভিন্ন রচনায় শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন চৈতী, সন্দ্বীপা, জুটিকা, পিংকী প্রমুখ।

 

স্থিরচিত্রশিল্পী / দীপক রায় ।। প্রতিবেদন / মাহি রহমান

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you