২০১৬ সনের অগাস্টের মাঝামাঝি ‘প্রোজেক্ট লন্ডন ১৯৭১’-এর পয়লা আলোকচিত্র ও স্মারকবস্তু সংগ্রহের প্রদর্শনী আয়োজিত হয় বাংলাদেশের শিল্পকলা অ্যাকাডেমির জাতীয় চিত্রশালায়। প্রথম প্রদর্শনীটি ইতিহাসের অনুরাগী চিত্রসমুজদার দেশী-বিদেশী বীক্ষক-দর্শক সকলেরই তারিফ কুড়ায়। সেই ধারাবাহিকতায় এরপরে একাদিক্রমে সিলেটে এবং চট্টগ্রামে প্রদর্শনী হয়। এছাড়া ঢাকায় ব্রিটিশ কাউন্সিল ভবনের উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে একটানা মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় একটি বিশেষ প্রদর্শনী। পর্যায়ক্রমে যুক্তরাজ্যের লন্ডন ও বার্মিংহ্যাম ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে এক্সিবিশনটা আয়োজনের প্রাথমিক পরিকল্পনা এবং তৎপরতা চালু রয়েছে। এর পাশাপাশি ইন্ট্যারেক্টিভ এই এক্সিবিশনটি বিশ্বের নানা শহরে আয়োজনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে এবং এইটা আমাদের প্রোজেক্টের কোর্ কাজগুলোর মধ্যেই ইনক্লুডেড বলতে হবে।
সেই গরিমার দিনগুলোতে দেশে যেমন তেমনি বিদেশেও অসংখ্য মানুষের অবিরত লড়াই ছিল জাগরুক। সেই সময়ের বীরযোদ্ধারা যারা জীবিত তাদের কাছ থেকে এবং তাদের পরিবারপক্ষ থেকে প্রাপ্ত ছবি ও স্মারকগুলো সমৃদ্ধ করেছে আমাদের সংগ্রহ। ‘প্রোজেক্ট লন্ডন ১৯৭১’-এর নানা আয়োজনে তাদের উপস্থিতি এবং সহযোগিতা আমাদের কাজটুকু ত্বরান্বিত করছে। আমরা ছবিগুলো নিয়ে প্রদর্শনী আয়োজনের পাশাপাশি ছবির মানুষদের কথাগুলো রেকর্ড করে চলেছি। বিগত দিনগুলোতে আয়োজিত অনুষ্ঠানচারটায় মানুষের সপ্রাণ উপস্থিতি আমাদের আশাবাদী করেছে।
একবছরেরও কম সময়ের মধ্যে এহেন অপ্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের চার-চারটে আয়োজন প্রমাণ করে এ-ধরনের উদ্যোগের উপযোগিতা। মানুষ চায় ইতিহাসের আন্তঃক্রিয়াধর্মী বিভিন্নমুখী ইনিশিয়েটিভ। শুধু কয়েকটা চেনা ছকে ইতিহাসের উপস্থাপন করার মধ্য দিয়া আজকের প্রযুক্তিস্ফীত মিডিয়াযুগের প্রজন্মকে ইতিহাসাগ্রহী করে তোলা আদতেই ডিফিকাল্ট। দরকার হিস্ট্রির চেনা ন্যারেটিভগুলোকেও নতুন আলোয় নয়া আদরায় প্রেজেন্টেশন। ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সুলুক সন্ধান ছাড়া আমরা তো প্রত্যাশামাত্রায় আগাইতেও পারব না। আমরা সকলের সঙ্গে আলাপালোচনার ভিত্তিতে এই ইতিহাস উপস্থাপনাগত নবপ্রকরণ নিয়া ভাবতে চাই।
এই লক্ষ্যেই, এবং এমনতর কিছু লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়ে, ‘ট্রেজার ১৯৭১’ নামে একটা সাংগঠনিক উদ্যোগ সম্প্রতি শুরু করেছি। ‘প্রোজেক্ট লন্ডন ১৯৭১’-এর মতো দুনিয়ার সমস্ত বড় শহরগুলোতে একাত্তরকালীন জনসমাবেশন ও তৎপরতা নিয়া আলাদা চ্যাপ্টার ওপেন হবে এবং সেসব চ্যাপ্টার ‘ট্রেজার ১৯৭১’-এর আম্ব্রেলায় আর্কাইভড থাকবে। এরই মধ্যে ‘ক্যানাডা চ্যাপ্টার’ প্রবর্তনার মাধ্যমে একটা স্বাধীনতা উৎসবের আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে সেখানকার টরোন্টো শহরে এবং অত্যন্ত সফলভাবেই তা সম্পন্ন হয়েছে। সেখানে এক্সিবিশনের পাশাপাশি ছিল কোমেমোরেইটিভ নানাবিধ পার্ফোর্ম্যান্সেস। বাংলাদেশের এবং ক্যানাডার সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিদের পাশাপাশি ডায়াস্পোরা সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো উৎসবে অংশ নিয়েছিল।
একটা ব্যাপার লক্ষ করবেন নিশ্চয় যে, এই স্থিরচিত্রালেখ্য প্রদর্শনীটি ঠিক মুক্তিযুদ্ধের আদ্যোপান্ত ইতিহাস বলছে না, এই প্রদর্শনীটি বিশেষ সেই সময়ে একটি/একেকটি বিশেষ শহরে অবস্থানরত গণমানুষের তৎপরতার কথা বলতে চাইছে। সেদিক থেকে এটি অত্যন্ত ফোকাসড একটা প্রোগ্র্যাম। ঠিক এইভাবে এর আগে একটিমাত্র শহর হাইলাইট করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের টেক্সট/ঘটনাবলি রিড-আউট করার চেষ্টা আমরা দেখি নাই। কিছু বইকেন্দ্রিক উদ্যোগ দেখা যায় এমন যেখানে একটা দেশ ভর করে বাংলাদেশমুক্তির লড়াইদিনগুলোর ইতিহাসপঞ্জি লিপিবদ্ধ; তবে সেইসব বই নির্মিত হয়েছে এক-দুইটা বহুল পরিচিত রাষ্ট্র/রাজ্য উপজীব্য করে, বেশিরভাগই ইংল্যান্ড ঘিরে। বেশকিছু কূটনৈতিক টালবাহানা নিয়া আমেরিকার রাষ্ট্রযান্ত্রিক প্রকাশ্য ও সংগুপ্ত বাংলাদেশবিরোধিতার দলিলদস্তাবেজ নিয়া বাংলায় এবং ইংরেজিতে বই রয়েছে, সেসবও তথ্যবহুল হলেও বহুমাত্রিক ব্যাখ্যাবৈচিত্র্যের দিক থেকে এ-ধরনের বইয়ের প্রাচুর্য দরকার। কত অজস্র দিক থেকে অজস্র কৌণিকতায় একাত্তর কালখণ্ডটিকে দেখা আজও বাকি। নিশ্চয় সেই অদেখা কোণগুলো অচিরে দ্রষ্টব্য হয়ে উঠবে।
এই কাজে পুরোদমে নামার আগে যে-একটা সংশয় ছিল খোদ আমাদেরই ভিতরে যে ব্যাপারটা আদৌ জনগুরুত্ববহ হয়ে উঠবে কি না, আজকে এই আটবছরের গোছগাছ শেষে প্রাথমিক কয়েকটা আউটকাম দেখে মনে হচ্ছে যে ব্যাপারটার সঙ্গে মানুষের সংবেদনা যুক্ত হতে পারছে। গেল কয়েকটা শো থেকে যে সাড়া আমরা পেয়েছি ইশকুল-বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও সমস্ত বয়সসীমার সর্বস্তরের পেশাগোষ্ঠীর ইতিহাসচিত্রদর্শনার্থী এবং ইতিহাসপাঠকদের, আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মস্পৃহা তাতে ব্যাপক বেড়ে গিয়েছে।
আমরা চাইছি লিখিত বইপত্তরের পাশাপাশি ইতিহাস যেন সরাসরি মানুষের সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে পারে। যেন সক্রিয় হয় ইতিহাস মানুষের মাঝখানে যেয়ে সশরীরে। একটা বই কিংবা টেলিভিশন শোয়ের মাধ্যমে ইতিহাস প্রচারের সময় রিডার বা ভিয়্যুয়ারের মধ্যে এক-ধরনের অক্রিয়তা কাজ করে, অডিয়েন্স সেখানে প্যাসিভ থাকে মোস্টলি, এইখানেই আমাদের কাজটার ইউনিক্নেস গড়ে উঠতে পারে বলে আমরা মনে করছি। মানে, অডিয়েন্স এখানে অ্যাক্টিভ থাকছে। এর মধ্য দিয়ে একটা ইন্ট্যারেকশন ঘটছে দৃশ্যবস্তুর/দ্রষ্টব্যের সঙ্গে দর্শকের। সেই ইন্ট্যারেকশন আমরা ডক্যুমেন্টেড রাখছি আমাদের সীমিত রিসোর্স দিয়ে। সেইটা সাক্ষাৎকার, মন্তব্যখাতা, অডিও-ভিডিও রেকর্ডার ইত্যাদি নানাভাবে আমরা শো চলাকালীন এবং শোয়ের বাইরে যেয়ে চেষ্টা চালাচ্ছি ধারণ করতে।
এইভাবে কাজের ফলে দুইটা জিনিশ ক্রমে বেরিয়ে আসছে; এক হচ্ছে, মানুষের ওরাল স্টেটমেন্টের মাধ্যমে ইতিহাসের নতুনপাঠ তৈয়ার হচ্ছে, এবং দুই, যেসব অবদায়ক সেইসময়ের তৎপরতায় নানাভাবে নিয়োজিত ছিলেন অথচ কোনো অ্যাক্নোলেজমেন্ট পান নাই তারা অন্তত জনসমক্ষে আসছেন। পরে, একটা সার্টেন মোমেন্টে যেয়ে, এই ইতিহাসলগ্ন নবতর উদ্ভাসনগুলোর ব্যাপারে নিশ্চয় আমরা ঠিক করে নিতে পারব আমাদের কর্তব্য।
মৌখিক বিবৃতি ধারণের মধ্য দিয়ে এইভাবে চেনা ইতিহাসের যেমন আরও উজ্জ্বলতর তাৎপর্য বের করে আনা সম্ভব, তেমনি অচেনা-অজানা ইতিহাসের আবিষ্কারও খুবই সম্ভব। অনুষ্ঠিত হয়ে গেল যে-কয়টা আলোকচিত্রালেখ্য প্রদর্শনী, সেগুলোর অভিজ্ঞতা এবং লব্ধ শিখন নানান ফর্মে শেয়ার করার প্ল্যানিং পর্যায়ে রয়েছি আমরা। আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে এমন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ প্রদর্শিত ছবিগুলোতে একদম ভিড়ের মধ্যে থেকে তাদের স্বজনদের খুঁজে বের করেছেন, আমাদের সঙ্গে শো চলাকালীন এবং পরে আরও ইন-ডিটেইল কথা বলেছেন, আমরা তাদের সেইসময়কার পারিবারিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারছি নানাবিধ মুক্তিযুদ্ধস্মারক সহ, এইগুলোই হচ্ছে আমাদের প্রাপ্তি। আমাদের জাতীয় গরিমার অর্জন।
‘প্রোজেক্ট লন্ডন ১৯৭১’-এর দীর্ঘ প্রচেষ্টায় দেশে-বিদেশে অগণিত বাঙালি/অবাঙালি বন্ধু, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, পেয়েছি অসংখ্য মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা আর ভালোবাসা। আমাদের বিশ্বাস,এই প্রকল্পের নানা আয়োজনের ও উদ্যোগের মধ্য দিয়ে দেশ-বিদেশের তরুণ বাঙালি প্রজন্মকে ১৯৭১ সালে ভিনদেশে অবস্থানরত বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামে তীব্র জেদী ভূমিকার কথামালা সম্পর্কে উৎসাহী হতে প্রেরণা যোগাবে, জানতে দেবে বিলেতপ্রবাসী বাঙালির গরিমাগাথা। যারা ‘প্রোজেক্ট লন্ডন ১৯৭১’-এর সঙ্গে ছিলেন নিঃস্বার্থ স্বতঃস্ফূর্ততায়, তারা ‘ট্রেজার ১৯৭১’ উদ্যোগের স্বল্পসামর্থ্য সাংগঠনিক তৎপরতার সঙ্গে নিজেদেরে লিপ্ত রাখবেন আশা করা যাচ্ছে। এবং সক্রিয়ভাবে শামিল রইবেন সত্যসন্ধানী ইতিহাসের ক্যারাভ্যানে।
এইভাবে একসময় আমরা শোগুলোর প্রাপ্ত ইন্ট্যারেকশন থেকে উঠে-আসা আচরণিক ও আবয়বিক অভিব্যক্তি, ইতিহাসসন্ধিৎসুদের আলাপসারাংশ, চিত্রার্পিত বাঙময় মানুষমুখগুলোর সাকিন-সরহদ্দি ইত্যাদি সনাক্ত করতে পারব বলিয়া আস্থা রাখছি। লিপিবদ্ধ ফর্মে অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারব বলিয়া আশা রাখছি। কিংবা আমাদের দলিলগুলো থেকে ইতিহাসগবেষক উপাদান ব্যবহার করে নতুনতর উন্মোচনের দিকে এগোতে পারবেন। সাবোল্টার্ন স্টাডিজের ধরনে আমরা চাইছি আমাদের কাজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগুক ইতিহাস জীবন্ত করার ক্ষেত্রে। একই চিত্রে একাধিক নবকৌণিক ইতিহাসোদ্ঘাটন হোক।
ইতিহাস হোক চলিষ্ণু, হোক বহমান, আমরা চাই, ইতিহাস হোক জনমানুষের আলাপের পরিসরে জ্যান্ত ও সতেজ, বদ্ধ খোপ থেকে বেরিয়ে এসে আমরা চাই ইতিহাসের হাতে হাত রেখে যেন আমাদের নেক্সট জেনারেশন হাঁটতে পারে ন্যায় ও সমতাভিত্তিক শান্তিসৃজনী নির্বিঘ্ন দুনিয়ার দিকে।
… …
- মৌলভিস্যার, মেসো, মাতৃধর্ম ও কতিপয় বেকুব || উজ্জ্বল দাশ - May 11, 2021
- বিলেতে সেই জনসভার ৫০ বছর || উজ্জ্বল দাশ - April 7, 2021
- দি ইনফর্মার ১৯৭১ || উজ্জ্বল দাশ - March 26, 2021
COMMENTS