মারাদোনা আনবাউন্ড : যে কাহিনির ইতি নাই || আহমদ মিনহাজ

মারাদোনা আনবাউন্ড : যে কাহিনির ইতি নাই || আহমদ মিনহাজ

মারাদোনা সশরীরে আর বেঁচে নেই কিন্তু ওর খ্যাপাটে ইমোশনের মাঝে সক্রিয় হৃদয় আসলে কোনও মাপে ধরা পড়ে না।

আজকাল চোখ দিয়ে জল সহজে গড়াতে চায় না। মারাদোনা আর নেই শুনে অধমের চোখ ভিজে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল ওর সঙ্গে কামরাঙাঘন এক নাবাল কিশোর যেন হারিয়ে গেল নিরুদ্দেশের খাতায়। ছিয়াশি কী করে ভুলি! বিরাশি থেকেই বিটিভির কল্যাণে বিশ্বকাপের সঙ্গে সহবত। জিকো-সক্রেটিসের ব্রাজিল কিংবা প্লাতিনির ফ্রান্স … এই নামগুলো ততদিনে মগজে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু ছিয়াশি ছিল এক বুনো ঝড়, যা এক কিশোরের রক্তে জাদুগিরকে দেখার শিহরণ এনে দিয়েছিল।  মারাদোনা নামটি তাই আমার কিশোর থেকে তরুণ হওয়ার সমগ্র পর্ব জুড়ে লতার মতো বিছানো ছিল। ও ফুটবলের বড় শিল্পী তাতে সন্দেহ নেই কিন্তু মানুষটি যে আরও বৃহৎ! তার সবকিছু বৃহৎ ছিল। জীবনের প্রতি পদে সংঘটিত ভুলগুলো বৃহৎ, খ্যাপামিরা বৃহৎ, আবেগে শরীর দোলানোটা সে-রকমই বৃহৎ আর শিশুর মতো কান্না করাটাও অবিশ্বাস্য সারল্যে বৃহৎ ছিল। মানুষটি ভণিতাভরা যুগে কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে নিজের খেয়ালখুশির জোরে দাপটের সঙ্গে ধরায় দিন কাটিয়ে গেল! কজন তা পারে সে এক বিস্ময় বটে!

ফুটবলার মারাদোনার কীর্তি খেলাটি যতদিন ধরায় টিকে থাকবে ততদিন অবধি লোকে হয়তো এ-নিয়ে কথা বলবে। বিশ্বজুড়ে আমজনতা থেকে বিশেষজ্ঞরা কমবেশি এ-নিয়ে বলেছেনও। ভবিষ্যতে বলাটা অমোঘই থাকবে মনে হয়। আক্ষরিক অর্থে ভিনগ্রহের এক ফুটবলার ছিল। কিন্তু মানুষ মারাদোনা তার ফুটবলার সত্তাকে ছাড়িয়ে আরও ব্যাপক ঘূর্ণি। এমির কাস্তোরিকার ‘মারাদোনা’ ছবিতে ওর সত্তার এই দিকগুলো আসি-আসি করেও কেন যেন আসেনি, ‘মারাদোনা আনবাউন্ড’ সেদিকে গমন করায় পড়তে ভালো লেগেছে। যদিও আমি যদি লিখতাম তবে সেইসব গল্পই হয়তো লিখতাম যা এক নাবাল কিশোরের চোখ দিয়ে জাদুগিরকে দেখার বিস্ময় ও তাকে ঘিরে তৈরি হওয়া স্মৃতিকাতরতা মনে পড়ায়।

মারাদোনা নেই মানে অনেককিছু না-থাকা। পা টেনে-টেনে সার্জারিকক্ষে ঢুকছে। সার্জারি শেষে হাসপাতাল ছাড়ার সময় হল্লা করে গান গাইছে যে-লোক তাকে দেখে কে বলবে সে ইতোমধ্যে কবরে এক-পা সেঁধিয়ে বসে আছে! রাতের পার্টিতে শিশুর আদরে অতিথিদের বুকের মাঝে ধা করে টেনে-নেওয়া ও চুমু-খাওয়া লোকটিকে আর দেখা যাবে না। ড্রেসিংরুমে খেলোয়াড়দের মাথার চুল নেড়ে একাকার করে দেওয়ার আমুদে দৃশ্যগুলো ভাইরাল হবে না। সিগার ফোঁকা গাট্টাগোট্টা বেঁটে লোকটির বাহুতে চে-গেভারার উল্কি কারও হয়তো মনেই পড়বে না। তো সব মিলিয়ে একটি জ্বলজ্বলে যুগ যেন অস্ত গেল, যার সঙ্গে তামাদি হলো সেইসব ইমোশন যা হিসাবি এই যুগে দুর্লভ বস্তু হতে যাচ্ছে।

ও সকল কালের সাহিত্যের জন্য এক মস্ত খোরাকি। দূর ভবিষ্যতে কেউ হয়তো সেটি লিখবেন বা সিনেমায় জীবিত করবেন Live is life গানের পঙক্তিতে সচল এক মারাদোনাকে। সেদিন যদি বেঁচে থাকি তবে সেটি আগ্রহভরে পড়ব, যেমনটা ‘মারাদোনা আনবাউন্ড’ পড়েছি।


আহমদ মিনহাজ তাৎক্ষণিকামালা
গানপারে লেখকের অন্যান্য রচনা

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you