আমার প্রিয় প্লেয়ার নন তিনি। কিংবা আর্জেন্টিনাও নয় ফেব্রিট আমার কাছে। সেই অর্থে খেলোয়াড় তথা স্পোর্টসপার্সনদের লাগিয়া আমার দিল-চস্পি নাই, স্বীকার কর্তব্য, নিজে ছেলেবেলা থেকেই ঠিক অসামাজিক না-হলেও স্পোর্টসগ্রাউন্ডে যেয়ে যেমনতর সোশ্যালাইজেশন প্রক্রিয়া অনুশীলন করে একজন মনুষ্যশাবককে বেড়ে উঠতে হয়, আমার ক্ষেত্রে সেইটা ঠিক ঘটে ওঠে নাই। নানা কারণেই এইটা হয় নাই। বিকশিত হওয়ার ব্যাপারটাও আধুরা রয়ে গেছে তাই। কিন্তু ওইসব গুঁড়োদুগ্ধালাপ করবার জায়গা বা সময় এইটা না। কোনোদিন কোনো পয়সার মটকা ব্যাংকের গভর্নর হইলে পরে সেই কিসসা গাওয়া যাবে। যেইরূপ অবস্থা দাঁড়িয়েছে, দেশের ও দশের এস্ট্যাব্লিশমেন্টগুলোতে যেইধারা স্ট্যাটাস-ক্যু, মনে হয় না আপনি-আমি গভর্নর হওয়ার চান্স পাবো জন্মের এই প্রান্তিকে। বুড়াধুড়ারা আসনপিঁড়ি ছেড়ে একমুহূর্তও টলবে বলে ভরসা আর নাই। ডিরেক্ট এই দেশ ও দশের সেবা করার, পাইকারী সেবাকার্যক্রমের বাইরে যেয়ে কিছুটা আপন খেয়ালে একটাকিছু ক্রিয়েটিভলি ডিজাইন করবার, নিজস্ব ম্যাকানিজম এস্তেমালপূর্বক প্রকাশ্য দিবালোকে আপনার করণকীর্তি ইম্প্লিমেন্ট করবার, মোদ্দা কথা আপনার স্বোদ্ভাবিত ফর্মেশনে খেলবার মওকাটা আপনি জিন্দিগিতে পেলেননাকো। বুড়াধুড়াদের তাবেদার হইয়াই জিন্দিগি কাটিয়া যাইল। অবশ্য মোটা মাইনের পিয়ন-চাপরাশি কিংবা ক্যাশিয়ার অথবা বড়জোর ব্র্যাঞ্চম্যানেজার পর্যন্ত কেরানিহৃদয় চাইতে পারে, পেয়েও যায় টিপটপ বাড়ি-গাড়ি-বউ, মোল্লার দৌড় যথা মসজিদ তক, এর বেশি না। পার্টির প্রেসিডিয়াম বা পোলিটব্যুরো মেম্বার হইতে গেলেও বনেদ তথা খান্দান লাগে। তা তো লাগবেই। দেশটা আপনার-আমার বাপের নাকি! অ্যানিওয়ে, সে-যা-ই-হোক, ধর্মের কলগুলা পারিবারিক পবনে এমনিভাবেই চিরকাল নড়ুকচড়ুক।
বলছিলাম দিয়াগো নিয়া। মারাদোনা। দিয়াগো আর্মান্দো মারাদোনা। বছর-চুয়ান্ন বয়সী। মানে, এই দুই-হাজার-চোদ্দ ওয়ার্ল্ডকাপ চলাকালে ম্যাজিশিয়্যান মারাদোনার উমর পাক্কা চুয়ান্নই। তিনি আমার ফেব্রিট স্পোর্টসপার্সন কোনোদিনই নন। সেই অর্থে কেউই নন, কোনো বলখেলোয়াড় তো নন অথবা রাগবি কি ক্রিকেটার, যতটা প্রেমাসনে একজন অভিনেতা বা গায়ক আমার কাছে বিরাজেন ততটা কোনো স্পোর্টসপার্সন কদাপি নন। ওইভাবে খেলাধুলার প্রতি ফেসিনেইটেড না আমি। কিন্তু খবর রাখি খেলোয়াড়দের নানাবিধ আখ্যানের, অ্যানেকডোট্যাল খুব টানে আমারে, এন্তার কাহিনি পেটের ভেতর নিয়া রামকৃষ্ণের ন্যায় রসেবশে কাল কাটায়া যাওয়াও কম কথা না। আর্জেন্টিনা আমার প্রেমগানের প্রতিপাদ্য কোনোদিনই ছিল না, আজও নয়, ব্রাজিল বরং ফ্রম মাই আর্লি ডেইজ অবসেশন অনেকটা। আজকাল মনে হয়, এই ব্রাজিলপ্রীতিও যতটা-না খেলার কারণে, এরচেয়ে বেশি জড়িত অন্যান্য কারণাদি। বিস্তারে বলার সুযোগ তো জনাব আপনারা আমারে দিবেন না। সাম্বা আমার ব্রাজিলপ্রীতির একটা ছোট্ট অথচ জনগুরুত্বপূর্ণ কারণ। কবেকার সেই নিগূঢ় শৈশবে এই নৃত্যকলা হেরিয়া নয়নে ও মনে ঝিলমিল লাগিয়া গিয়াছে, গুস্তাকি মাফ-কি-জিয়ে, ব্যান্ড চন্দ্রবিন্দুর একটা গান আছে — ‘গাধা ’ অ্যালবামে — একটু শুনে দেখতে পারেন : “সূর্যের দিকে চেয়ো না, চোখে ঝিলমিল লেগে যাবে / সূর্যগ্রহণের দিকে চেয়ো না, চোখে ঝিলমিল লেগে যাবে / সন্ত যোহনের দিকে চেয়ো না, চোখে ঝিলমিল লেগে যাবে … পাখপাখালির দিকে চেয়ো না, গায়ে ঝিলমিল লেগে যাবে / রাতে মা-কালীর দিকে চেয়ো না, মনে ঝিলমিল লেগে যাবে / উগ্র আকালীর দিকে চেয়ো না, বুকে ঝিলমিল লেগে যাবে” … ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু হায়, এই গান চন্দ্রবিন্দু গেয়েছে আমাদের ফুলফুটন্ত বয়সে, তদ্দিনে পেকে আমরা নারিকেল হয়ে গেছি। বিলকুল ঝুনা নাইড়লই হয়েছি। নিষিদ্ধ সমস্ত কম্ম করে ও দেখে ও শুনে ও বুঝে তেরা বাপ বুড্ডা হো গিয়া রে অভি! এখন চন্দ্রবিন্দু আওড়াইলে তো হবেনানে, এখন বিসর্গতে দুঃখই সই, সাব্বে সাত্তা সুখিতা আত্মা ভবন্তু অথবা শাহাদুজ্জামানের সেই উপন্যাসের প্রোট্যাগোনিস্ট শফিকের ন্যায় ‘একটু বিপজ্জনকভাবে’ বেঁচে থাকার অভিপ্রায়, একটু ডেস্পারেইটলি বাঁচবার অভিযান শুধু। মন্দ নয়।
কাজেই মারাদোনা। ট্র্যাজিক হিরো ছাড়া দুনিয়ায় কোনো মহাকাব্য সম্ভবিয়াছে বলিয়া আজও সংবাদ পাওয়া যায় নাই। ইন দ্যাট সেন্স আমরা প্রত্যেকেই তা-ই, জীবনানন্দকথিত কবির সংজ্ঞানুযায়ী সেই কেউ কেউ ছাড়া, আমরা বেশিরভাগই তো মহাকাব্যের জ্যান্ত উপাদান একেকটা বা একেকজন। প্রত্যেকেই মারাদোনা আমরা, কেউ কেউ অবশ্য এডসন অরন্তেস দো নসিমেন্তো উর্ফে পেলে, একের-পর-এক ফিফার পার্ডিয়ামে-পয়সায় পালিতপোষিত সভায়-প্রেসমিটে পেস্ট্রিপেটিস্ খেয়ে হৃষ্টপুষ্ট খুশ্যহাস্য বুড়ো, নতুন দিনের কর্পোরেটবাতাসে পেলেদেরই সংখ্যাধিক্য। উপন্যাসে বলুন অথবা গানে-সিনেমায় কি কবিতায় বা হাডুডুময়দানে। সবখানেই এস্ট্যাব্লিশমেন্ট খুশিকরণের একচ্ছত্র হুল্লোড়। আই ল্যভ ব্রাজিল, বাট নেভার ল্যভড পেলে, এরচেয়ে বেশি কিছু নাই-বা বললুম দাদা, আই নেভার এভার ল্যভ অরন্তেস দো নসিমেন্তো পেলে। এইটুকু দুর্বিনয় লিপিবদ্ধ রইতেই পারে। একহাজার গোলের গালগপ্পোওয়ালা চ্যাপ্টার ইশকুলের বাংলা পাঠ্যবইতে পড়েও উনার ফ্যান আমি হইতে পারি নাই, সিন্স মাই বিগিনিং ডেইজ, ঠিক তখনও মারাদোনা মাঠ গড়িয়ে আমাদের কান পর্যন্ত ওঠেন নাই যদিও, অচিরেই উঠে যাবেন আমাদের শ্রবণেন্দ্রীয় ছাড়াও এক্সার্সাইজ খাতার মলাটে এবং স্কুলবন্ধুবান্ধবীদের জমানো ভিয়্যুকার্ডে। অ্যানিওয়ে। এইসব শোনার জন্য তো আর আপনি কিয়্যু দিবেন না আমার কাউন্টারে। এদিকে আপনেরে শোনানোর জোখা গানের স্টকও তো অল্প আমার। কাজেই মারাদোনা।
“গল্পটা একজন খেলোয়াড়ের। যার হৃদয় এবং ইতিহাস হাজার বছরের। ফলে কখনো চেনা চৌহদ্দি থেকে অতীত বা আগামী শতাব্দী পেরোতে দ্বিধা হয়নি। যত মারাদোনাকে দেখি, তত মনে হয় মানুষজন্মই বাঁচার। আহত, পদদলিত বা উপেক্ষিত হয়েও। প্রকৃতির সর্বত্র বাঁচার ঘণ্টা ঢং ঢং। বল গড়িয়ে যাচ্ছে, গ্যালারি থেকে ঘাসে, ঘাস থেকে মহাআকাশ। ড্রিবল করতে করতে স্বচ্ছন্দে হেসে গড়িয়ে পড়ছে হাজার শিশুর বাফুন, ঘোড়ামুখো, ওই আমার চিরন্তন খেলোয়াড়। ওই সরে সরে যাচ্ছে ম্যাজিক রাবারের উড়ন্ত গোলপোস্ট। গোল — গো-ও-ও-ল, কখনও কি শেষ কথা হতে পারে, লক্ষ্য! ফলে প্রচণ্ড অসুস্থতার মধ্যেও মারাদোনা লিখতে লিখতে — আর যেন শরীরে ব্যাধি না ঢোকে! এ লেখার লাল, নীল, সবুজ যদি পাঠকের জিভে, চোখে, গালে লাগে, ধন্য হই।”
প্রিয় খেলোয়াড় নন মারাদোনা, মানে সেই-অর্থে কেউই তো নন বলেছি কিয়ৎ পূর্বে, সাংঘাতিক প্রিয় একটা বই আছে এই নামে আমার। উপন্যাস, বা আসলে আমরা যেমনভাবে লেখা হইলে পরে একটা বইকে কবিতার বা গল্পের বই বা ধরুন উপন্যাস বলি, এইটা সেই অর্থে তেমন উপন্যাসও না। এইটা পড়ে আপনার দুই ধরনের প্রতিক্রিয়ার যে-কোনো একটা হতে পারে, তৃতীয় কোনো প্রতিক্রিয়া বাগিন্দ্রিয়ে না-সম্ভবে, একটা প্রতিক্রিয়া : “আরে ধুর! ফুঃ! অভিনব কিছু তো না!” — আরেকটা হতে পারে এমন : “ওএমজি! ইনকন্সিভ্যাবল!” — আর তৃতীয় প্রতিক্রিয়ার কথা তো বললামই, বাগিন্দ্রিয়ে না-সম্ভবে। এই বইটা পাঠোত্তর আমার প্রতিক্রিয়া ছিল ওই গ্রেড থ্রি, তৃতীয় ক্যাট্যাগোরি, ইন্ডেস্ক্রাইব্যাবল, ইনেক্সপ্রেসিবল। বাগিন্দ্রিয়ে না-সম্ভবে। এখন আপনে বলতে পারেন, তুমি মিয়া একটা পাঠক, আর তেলাপোকাও যেমন পাখি, তোমার আবার বাগিন্দ্রিয়! সে-যা-হোক।
কমল চক্রবর্তী। লিখেছেন বইটা। মারাদোনা। আটাশি পৃষ্ঠা সাকুল্যে। এইটিয়েইট পেইজেস্। ১৯৯৪ সাল। বিশ্বকাপ ফুটবল। আমরা, আমার মতো দুনিয়ার অনেকে, এসএসসি পাশ করেছি যেই বছরটায়। দিয়াগো আর্মান্দো মারাদোনা মাইর খেয়ে চলেছে ধুমিয়ে। আমরা, আমি অন্তত, দেখে ভাবছিলাম এই-সমস্তই সিলি ট্রিক্স। ভং ধরে খেলায় বেনিফিট অফ ডাউট নিতে চায় মামায়। বিরক্তির একশেষ। সেই বছরেই ছিল তার লাস্ট ওয়ার্ল্ডকাপ। আর আমি ওই বছর প্রথম পূর্ণাঙ্গ ওয়ার্ল্ডকাপ খেলি ইশকুল-ডিঙানো কলেজদিনের বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে। ডেব্যু অবশ্য আগেই গিয়েছিল হয়ে, মেক্সিকো এইটিসিক্সে, কেবল ফাইন্যালটা ওইবার, নাইন্টিন-নাইন্টিতে বাপচাচাবেষ্টিত হয়ে দেখেছি ক্লাস-সেভেনে-পড়া ঘুমে ঢুলতে-ঢুলতে। আমাদের আপন টেলিভিশন ছিল না আটাশির আগ পর্যন্ত। মনে তার নিত্য আসা-যাওয়া ছিল আগে থেকেই, টিভির, ঘরেতে আসেন তিনি ছিয়াশি বিশ্বকাপের দু-বছর পর। মক্কা ও মদিনা শরিফ থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত পবিত্র হজ্ নয়নে হেরিবার অসিলায় তিনির গৃহপ্রবেশ।
চুরানব্বইয়ের বিশ্বকাপে তো ডোপ স্ক্যান্ডাল করে খেলতেই পারলেন না মারাদোনা দুইটা ম্যাচের পর। এইটুকু মনে পড়ে। সেই চুরানব্বইয়ের বিশ্বকাপের পর কমল চক্রবর্তী লিখে ওঠেন অত্যাশ্চর্য এই ‘মারাদোনা’ আখ্যানভাগ। ‘কৌরব’ পত্রিকায় এইটা ছাপা হয় প্রথম, কমল নিজে সেই পত্রিকার সম্পাদক, বিহারের জামশেদপুর থেকে এই পত্রিকা প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে বেরোচ্ছে। এর পরের বছর, ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে, বই হিশেবে এইটা বাজারে বেরোয় সেই কৌরব প্রকাশনীর ব্যানারে। শাদা ও সাধারণ নিরাভরণ মলাটে একটা বই। লাল কালিতে কেবল বক্র হস্তাক্ষর দিয়ে লেখা মারাদোনা ও তারপর বিলো-অ্যালাইনমেন্টে লেখকনাম সেই লাল কালিরই হস্তলেখা। বারুদঠাসা ভেতর্মহল। তখন-তখনই হাতে পেয়েছি এমন নয়, সো-ফার আই রিমেম্বার ছিয়ানব্বই সালে প্রবেশিকা পারানোর পর খরিদ করি কিতাবখানা। তারপর থেকে এইটা খুলে বছরের এ-মাথা ও-মাথা নানা সময়ে নিজে পড়ি, রিসাইট করি, বিভিন্ন মহলের লোকেদেরে পড়ে শোনাই কিংবা পাঠের জন্য কর্জ দেই। ইত্যাকার প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়া যাইতে লেগে একাধিকবার তারে হারাই ও নবোদ্যমে ফের ঘরে ফেরাই তনখা খর্চে। বেশি না, গায়ের দাম পঁচিশ কলকাত্তাইয়া টাকা, আগে কিনতাম ওয়ান-পয়েন্ট-থ্রিতে, ইন্ডিয়ান বইগুলো, বর্ধিত হইতে হইতে এখন মুদ্রাবদলের অঙ্কটা জাস্ট ডাবল। পঁচিশের বই পঞ্চাশে। অ্যাফোর্ডেবল, অ্যানিওয়ে, এখন, এখনও। বই কিনে — উস্তাদের লেসন — কেউ দেউলিয়া হয় না। ঘাপলাটা অন্যত্র। সেই ফার্স্ট এডিশন চলতেসিল সর্বশেষ চোখাচোখি পর্যন্ত। যদ্দুর জানা যায় এর ছাপা নাই দীর্ঘদিন। উইকীটদষ্ট দুইয়েকটা মিলবে না ভাবলে বেশি ভাবা হয়ে যায়। রেকর্ড থাকুক যে, সেই নাইন্টিফাইভের এডিশনটাই চলতেসে এখনোব্দি। নিউজটা কারই-বা অজানা যে, বাংলা পাঠক খুবই লক্ষ্মী সোনামণি চিরদিনই।
ডিয়ার ভিয়্যুয়ার্স, কমল চক্রবর্তী প্রণীত ‘মারাদোনা’ মহাকাব্যের অন্তর্গত কয়েকটা লাইন দেখিয়া লই :
“মারাদোনা খেলোয়াড়। কখনও দেখা হয়েছে। একসঙ্গে ড্রাগ নিতুম। একই বেনোজলে ভাসতে ভাসতে কত শত সবুজ মাঠ।
এই অলীক যুবকের সঙ্গে স্বপ্নে যথেচ্ছ কথোপকথন। ও হোল গিয়ে শিশু প্রেমিক, ভালোবাসার প্রচারক।
ফলে একদল যুদ্ধবাজ, মাফিয়া, রেফারি, কালান্তক যম জাগে। ছিটিয়ে দেয় ষড়যন্ত্র, অশুভ মাতামাতি, কলঙ্ক। বল নয় তখন মারাদোনা এ-পোস্ট থেকে ও-পোস্টের জালে।
চোখের জল, বেদনা, একাকীত্ব, প্রেম, তার কবচকুণ্ডল। চাঁদনী রাতে গাঙের জল। টিভিপর্দায়, ইটালির সুঁড়িপথে, স্পার্টাকাসের কবরে, তার কান্না। শিশু কাঁদছে।
আন্ডিজের উঁচু-নিচু ঢালে, মারাদোনার নামে কত গান। ল্যাটিন বাউল হাওয়ায় মিশিয়ে দেয় অনন্ত প্রেম ও মহানায়কের গাথা।
আন্ডিজ পাহাড়ে এক পাখির বাসা ছিল
সেখানে এক সোনার ঈগল ডিম পেড়েছিল
ডিমের থেকে বেরিয়ে এল রাজকুমার চাষা
মারাদোনা, মারাদোনা, পাগল ভালোবাসা …
এ হোল ডিম-ভাঙা রাজকুমারের আখ্যান। তার মহাপতনের ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা। ধ্বংস ও না-ভালোবাসা পৃথিবীর ষড়যন্ত্র। এ-কাহিনির একটি মাত্র চরিত্র। যেহেতু ট্র্যাজেডি-নায়ক নিজেই নিজের পরিহাস ও পরিত্রাণ। এবং কাহিনি।”
বিগিনিং পেইজের বয়ান থেকে পেশ করা হলো উপরাংশ। তারও উপরের উদ্ধৃতি প্রিন্টার্সলাইনের পরবর্তী পৃষ্ঠায় দেয়া লেখকের মুখবন্ধ। মূল গাড়ি ফ্যুলস্যুইং চলতে শুরু করবে এর পরের পেইজ থেকে, যেখানে মারাদোনা তার প্রথমা ক্লাউদিয়ার সঙ্গে সংলাপরত, ক্লাউদিয়া প্রায় হিস্টিরিয়াক্রান্ত উন্মাদের ন্যায় ব্লেইম করতেসে একের-পর-এক পাগলা মারাদোনাকে, সেই পরিচ্ছেদের নাম ‘ক্লাউদিয়া ক্লাউদিয়া’, থার্ড ব্র্যাকেটে উপশিরোনাম : ‘১৯৯৪, মাঠ থেকে বিতাড়িত মারাদোনা। পেচ্ছাবে সর্দির ওষুধ।’ তবে এইটাও বলে নেয়া ভালো, কমল চক্রবর্তীর গদ্যধরনের সঙ্গে যারা পরিচিত — অন্তত কৌরব নিয়মিত অথবা অনিয়মিত পড়ার সুবাদে যারা তার সেই দুর্ধর্ষ ‘পাঠক শিরোনামা’ আন্ডারে এডিটোরিয়ালগুলোর পাগলা ভালোবাসাকে চেনেন, তারা জানেনই তো যে কমল চক্কোত্তির গদ্য উদ্দাম, সিন্ট্যাক্সিং প্রায়শ অসম্পূর্ণ, উল্টাপাল্টা জায়গায় যতিচিহ্ন বসানো, ঝড়ো শুরু ও ঝড়ো সমাপ্তির প্যারাগ্র্যাফিং, সমস্তকিছুই সচেতনভাবে অসচেতন প্রয়াস যেন, কেয়ার্লেস্লি কেয়ার্ফুল ট্রিটমেন্ট। এই সবকিছুই স্পিড-আপ করে কমলের প্রোজটাকে। এবং কখনো কোনো বাক্যে তিনি ক্রিয়াপদ উহ্য রেখে দেন, কখনো অন্য কোনো পদ, কখনো কোনো কোনো পদক্রম গুবলেট করে দেন বুঝে ওঠার আগে, ইত্যাদি তার কমন স্ট্রোক। যেমন, একটা উদাহরণ, শুরুর পেইজটা শেষ করতেসেন তিনি একটা প্যারাগ্রাফে, যেখানে দুইটা মাত্র বাক্য, প্রথম বাক্য চার শব্দে, শেষ বাক্য শেষযতিহীন ও ক্রিয়াপদ লোপাট, দেখা যাক :
“মারাদোনা এক চিরকালীন খেলোয়াড়। যাকে আলো, নীল আকাশ, ঘাসে দিগন্ত, লাফিয়ে-ওঠা বল, গ্যালারির ওয়েভ, রিক্ত মানুষ, পরাজিত জনতা, হাসতে ভুলে যাওয়া, পথ হারানো, না-বৃষ্টির ভূগোল, তীরবিদ্ধ হরিণ, হানাবাড়ির চাঁদ, দুঃখী কবি, মাতালের মর্ম, দাবানল, ঐতিহাসিক ভিয়েতনাম, সিজার দ্য গ্রেট, অশান্ত লাইলাক, জড়া পাহাড়ের মেঘ, চটকলের শ্রমিক, পল রোবসন, পীট সীগার”
ঠিক ওইখানেই ওইভাবে শেষ হয়েছে পয়লা চ্যাপ্টার। হুবহু। কমলপ্রোজের কমন স্ট্রোক এইটা। স্টাইল কমলগদ্যের। সমস্ত উপন্যাসেই — ‘ভিক্তর কুজুর’, ‘ব্রহ্মভার্গব পুরাণ’, ‘অলীক গস্পেল’ ইত্যাদি সর্বত্র — এই স্টাইল সুলভ। তবে এইসব কোনো কারণ নয় এই বইটা প্রিয় হয়ে উঠবার পেছনে। কেন ও কোন কোন কারণে এইটা প্রিয়, ইস্তারাসে ইন্ট্যারোগেইট করলে তো জবান বন্দ্ হো যায়েগা ইয়ার! তাছাড়া খেলার সিজন চলতেসে দুনিয়ায়, পড়ার সময় পড়া, খেলার সময় খেলা। এইবেলা পাঠবৈঠক আয়োজন তো উচিত নয়কো। তথাস্তু। আইজ্ঞা। তা, ছবির হাট ভাঙাভাঙির দেশে লেখালেখি বলুন, পড়াপড়ি আর করাকরি আর সরাসরি ইন্টার্ভিয়্যু-টকশো-গণপ্রজন্মজাগরণ যত-যা-ই বলুন, সবই তো মনোজ্ঞ ক্রীড়া বৈ কিছুই না। “রাজার হয়েই শিঙেয় ফোঁক / ভোটগুলি সব রাজার হোক / বলুক সবাই সেলাম করে বুলবুলিটা রাজার লোক / — তাল যদি দিস ঠিক তালে / অন্য সবাই পস্তালে / রাজার থালের এঁটো চেটেই করবি সুখে মাতলামি।” কিন্তু আপাতত অফ। এইবেলা খেলা। মারাদোনা।
আহিস্তা, আহিস্তা।
বইটার একটা উপশিরোনাম লক্ষ করবেন আপনি ইনার-পেইজের গায়ে, টপ অ্যালাইনমেন্টে, মারাদোনা শব্দটির নিচে ছোট্ট হরফে লেখা আরও দুইটা শব্দ : ‘ঘোড়ামুখো বাফুন’, মনে পড়বে আমাদিগের যে, একটা সময় বেচারা মারাদোনাকে এই গালি ও এমনতর অজস্র আরও-আরও বকাবাদ্য শুনতে হয়েছে ওয়ার্ল্ডোয়াইড টোয়েন্টিফোর-আওয়ার্স। সব দোষ বর্তায় যেয়ে মিডিয়ার ওপর, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রোনিক্যালি ভিশ্যুয়াল মিডিয়া, এদের দাপট ও দৌরাত্ম্য দেখনযোগ্য ধন্য। যদিও অত সরল নয়, সিরাতুল মুস্তাকিম নয়, এই মিডিয়াবাজিবিকলনমত্ত দুনিয়ার হিসাবকিতাব। গণমাধ্যম বলিয়া যাহা আমরা জানি, পেছনে তার কতকিছু রয়েছে লেজে-ও-লজেন্সে জড়িয়ে, মিডিয়াহাউজগুলো বস্তুত অন্য অনেককিছুর বর্ম ও ঢাল, ক্যামোফ্ল্যাজ, আড়াল নেবার গরজেই মিডিয়া ব্যবহৃত হয়, ব্যবহার করে দুনিয়াদানবগুলো, শিশুহত্যা ঢাকা দিতে যেয়ে ব্যবহার করে তারা তাদিগের মিডিয়ামেশিনগুলোকে, ২০০৩ সালে সংঘটিত গণহত্যার হোতাকে আমরা ইন-অ্যাকশন দেখতে পাই মিডিয়ার কল্যাণে, সেই হত্যানায়ককে ২০১৪ সালে দেখি মিডিয়াই মহামানব অবতার বানায়। আমরা ভুলিয়া যাই দ্বিসহস্রাধিক মানুষখুনের জ্যান্ত দৃশ্যগুলো। গুজরাট কিলিং সাক্সেসফ্যুলি সমাধা করে অ্যাওয়ার্ডেড হয় নরেন্দ্র মোদি। টেলিভিশনপর্দাগুলো রাষ্ট্রপ্রধানের মুখনিঃসৃত অমৃতবচন সম্প্রচারে মনোনিবেশ করে এইবার। ইয়ে হ্যায় মিডিয়া, মেরি ইয়ার! সে প্রতিদিন মোড়কসুন্দর মায়াবী পণ্য হয়ে এসে ঢুকতেসে হেঁশেলে এবং চানঘরে এবং নিরন্তর পাছা আহত করে চলতেসে তোমার। আর তুমি দিন-কে-দিন হয়ে উঠছ আরও মর্ষকামী। মিডিয়া হাজার বাহানা ও বাহারে এসে তোমারে মেরে যাচ্ছে পেছন থেকে, ফেসবুক ও ব্লগ-স্মার্টঅ্যাপ্স কত্ত কত্ত নব-কলেবর ভনিতা তার, তুমি যারপরনাই খুশি। কিচ্ছুটি-না-লিখে স্রেফ নিউজপ্রেজেন্টার হিশেবে অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করতে এসে বেলুন কিনে বইমেলা থেকে ফেরার প্রাক্কালে হে-শাড়িবিজুলিঝিলিকানো-খুকি, কী বিউটিফ্যুল, তুমি পেয়ে গেসো কবি-কাম-লেখকের ডিগ্নিটি! মিডিয়া তোমার পরম সখা, প্রাণবন্ধু শ্যামকালিয়া, বাকি জিন্দেগি তোমারে সে এক কুতর্কনায়ক কবিক্রিটিকের অঙ্কশায়িনী হিশেবে দেখতে চায়। সে তোমারে ব্রেইক দিতে চায় একটা শাড়ি কিংবা বডি-ডিয়োডোরান্টের টিভিসিতে, টেলিভিশন-কমার্শিয়্যালের বাথটাবে ফেনায়িত শুইয়ে রেখে সে তোমাকে দেড়-সেকেন্ডের তরে সেলেব বানায়ে তোমার অস্তিত্বস্বজন ও দেহভাজন হইতে চায়, ব্যাপারস্যাপার বুঝে দেখো হে আমার আগমনীদিনের কবি ও শিল্পসতীর্থ, হে আমার কন্যা, হে বেলুনোচ্ছ্বল বোন, হে প্রেমিকা আমার! ইয়ে হ্যায় এস্ট্যাব্লিশমেন্ট, লো দোয়েল ও দয়িতা আমার জগদবন্ধু দয়াল, বুঝে দ্যাখো এ-ই হয় মারাদোনা-হন্তারক মিডিয়া মেরি ইয়ার!
এত সোজাসাপ্টা না হিসাবটা, মারাদোনা আখ্যানের লাইনে-লাইনে সেই কজমিক স্পাইডারওয়েব খুলে দেখাতে লেগেছেন বাবু কমল চক্কোত্তি, মারাদোনাকে দমিয়ে রাখার ইতিহাস জানলেই আপনি জেনে উঠবেন দুনিয়ার আদি থেকে এতাবধি সৃজনোদ্যমী সাহসী ও একরোখা মানবজাতির অগ্রগমন ও পশ্চাদপসরণের ইতিহাস। কমল চক্রবর্তী প্রণীত — যদিও বইয়ের শুরুতে বইনাম লিখে লেখকনামের আগে প্রণীত শব্দটির পরিবর্তে লেখা হয়েছে ‘অনুগত’ শব্দটি, ভাবুন একবার, মারাদোনানুগত কমল চক্রবর্তী, যিনি বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার ভিতর দিয়ে একটি জীবন কাটিয়েছেন লেখায় ও লিভিঙে, তিনি তো হবেনই মারাদোনানুগত, যে-মারাদোনা হ্যাভালাঞ্জ নামের প্রতিষ্ঠানপ্রথাবৃদ্ধ এক ফিফাকেরানি কিংবা মতান্তরে প্রেসিডেন্ট অফ দি ইন্টার্ন্যাশন্যাল ফ্যুটবল ফেডারেশন জোয়াও হ্যাভালাঞ্জকে সটান অনামিকা দেখায়, একের-পর-এক সংবাদদানো সংস্থাগুলোকে খিস্তি করে যায়, যে-মারাদোনা রাইফেল তাক করে প্রতিষ্ঠানের দিকে, যে-মারাদোনা ফিফার সঙ্গে ইতিহাসে এই প্রথম ও সম্ভবত অনাদিআবহমানকালের মতো এই শেষবার কোনো মনুষ্যসন্তান ফিফামাফিয়ার সঙ্গে প্রকাশ্য বিরোধে জড়াল, ঘটিমাটিচাটি খুইয়েও শুয়োরক্রোধী মারাদোনাকে একইঞ্চিও টলানো গেল না, এহেন মারাদোনানুগত শুধু কমল চক্রবর্তী কেন এমনকি আপনিও তো হবেন, যদিও ছাপোষা আপনি, যদিও প্রতিষ্ঠান আপনার রক্তচোষা ড্রাকুলাবাপ, যদিও আপনি মেনে নিতে নিতে এবং মানিয়ে নিতে নিতে ন্যুব্জ ও ডরপুক, যদিও উত্থানরহিত যৌবন আপনার স্রেফ প্রতিষ্ঠানের পার্ভার্ট প্রভুর ডমিনোট্রিক্স হইতে যেয়ে, এস্ট্যাব্লিশমেন্টের স্যাডিস্টিক রোল ইন স্যাডোম্যাসোকিস্টিক সেকশ্যুয়াল অ্যাক্টিভিটিসে আপনি ক্লান্ত ও পর্যুদস্ত, মারাদোনা তো আপনারও নায়ক। যদিও মারাদোনা আমার প্রিয় স্পোর্টসপার্সন নন, জগতের মধ্যে এক নাদিয়া কোমানিচি আর স্টেফি গ্রাফ ছাড়া কারো প্রতি দীর্ঘকাল প্রেম অটুট থাকেনি আমার, মাঝখানে জেনিফার ক্যাপ্রিয়াতিকে একটু শুরু করেছিলাম বাসতে ভালো, ইদানীং যেমন ইসিনবায়েভা, তা, এইসব তো অন্য বিবেচনা। মারাদোনা আমার কাছে সেই-অর্থে আগ্রহবস্তু ছিলেন না কোনোদিনই, কিন্তু কমল চক্রবর্তী যে-মারাদোনার সঙ্গে আমাকে করমর্দন করায়া দিসেন, সেই মারাদোনা আমার জীবনযাপনের সঙ্গে যুক্ত অনুষঙ্গাবলির একটা অংশ। আমার সমূহ আপোস ও ভীরুতার বিপরীতে দাঁড়ানো আমারই অল্টার। আমার মাথা তোলা আর মাথা নুয়ানোর মধ্যবর্তী অনুপ্রেরণা।
মারাদোনা আখ্যানের একাংশ পড়ি এখন, যদি আপনি ইজাজত দেন, যেখানে বচসারত দুই কুশীলব মারাদোনা আর ক্লাউদিয়া। টাইমফ্রেম নাইন্টিন-নাইন্টিফোর, যখন পেচ্ছাবে এফিড্রিন নামের এক নিরীহ সর্দিনিবারক ড্রাগ সনাক্ত করেন ফিফাডাক্তাররা, মারাদোনাকে মাঠ থেকে বের করে দেয়া হয়, দুনিয়া জুড়ে দুয়োধ্বনি দিয়ে চলেছে মাফিয়া-মদদপুষ্ট মিডিয়াগুলা, আর মারাদোনা কলে-পড়া জন্তুর মতো খাবি খাচ্ছে এখানে-ওখানে, কোকেনে-মারিজুয়ানায় ধ্বংস করে ফেলতে চাইছে স্বর্গমর্ত্যবসুন্ধরাপাতাল। পুরো আখ্যানভাগ জুড়ে এমন সংলাপ-কোলাজ-ফ্যাক্ট-ফিকশন-ব্রিকোলাজ নানাকিছু জুড়ে দিয়ে এমন একটা ব্যাপার বানিয়েছেন কমল, যা আদতে চিরকেলে মানুষেরই জয়পরাজয়গাথা, যা আদতে নচিকেতাখ্যান, যা আদতে সংশপ্তকচিত্র।
- যেদিন তোমাকে ভালোবাসব না, সেদিন আর খেলব না। এটা কি বোঝো! ঘৃণা, হতাশা, নোংরামি, ষড়যন্ত্র দিয়ে খেলা যায় না। যে-কোনো নির্মাণ একটা পিওর, মানে শুদ্ধ ভালোবাসা। ওহ্ ক্লাউদিয়া!
- আমি যেখানেই থাকি, [একটু থামল, ভাস্-এ সাজানো ফুল ঘাঁটল, অ্যালবামে আঁটা মেয়েদের ছবি, জোরে নিঃশ্বাস] বিশ্বাস করতে পারো তোমাদের মুখই সর্বদা আমাকে সুস্থ, স্বাভাবিক রাখে।
- চুপ করো! তুমি একটা ভণ্ড, ঠগ, হিপোক্রিট, মিথ্যেবাদী। [ক্লাউদিয়া ভাস্ দেয়ালে ছুঁড়ল। ফুল ছড়িয়ে যাচ্ছে সামুদ্রিক হাওয়ায়।]
- কেন এসব বলছ ক্লাউদিয়া? আমার চোখের জল কি তোমারও প্রিয়! গোটা পৃথিবীর সকলের প্রিয় জানতুম। তোমার কাছেই আমার জল মোছার জায়গা। সেটাও কি তুমি কেড়ে নেবে? আমার হতাশা সবারই প্রয়োজন?
- তুমি কোনো খেলোয়াড়ই না। তোমার থেকে পেলে অনেক অনেক বড়। বড় মানুষের মুখ মনে করতে গেলে পেলে মনে পড়ে। আর খারাপ লোকের মুখ, তুমি। তুমি মিথ্যে কথা বলেছ, তার শাস্তি। বলেছিলে ড্রাগ নেবে না, ফের ড্রাগ, কি বলব আমার মেয়েদের? তাদের বাবা ড্রাগ নিয়ে নির্বাসিত। ওদের আঙ্গুল দেখিয়ে লোকে বলবে ওই যে মেয়েটি ডালমা ওটা একজন হামবাগ, নেশাড়ুর মেয়ে। কী মজা না!
- ক্লাউদিয়া, তুমি বুঝবে না। আমাকে এইভাবে ছেড়ে যাবে ভাবিনি।
- আমি ভাবিনি তোমার মতো একটা খেলোয়াড়ের খপ্পরে পড়ব। আমার জীবন ছিল অনেক সুন্দর, অন্যরকম। আরও ভালো হবারই কথা ছিল। ছিঃ ছিঃ!
- ক্লাউদিয়া, জানি আমার থেকে সবাই বড়, পুস্কাস, গ্যারিঞ্চা, কারেকা, ম্যাথাউস, ব্যাজ্জো। পেলে তো বটেই। আমি একটা থার্ড গ্রেড খেলোয়াড়। যে হাত দিয়ে গোল দেয়। যার একটা পা কাঠের। যে নেশা করে, সাংবাদিকদের দিকে বন্দুক চালায়। জানি, জানব না কেন। কারও সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক নেই। আমি একজন খুব খারাপ ব্যবহার জানা মানুষ। পি-আর-ও ভীষণ খারাপ। মানুষ বুঝে, সমীহ করে কথা বলতে পারি না। সব ঠিক! কিন্তু তোমাকে যে ভালোবাসি সেটা ভুল নয়। তুমি আমাকে ভুল বুঝো না।
- ভুল! তুমি অসংখ্য মেয়েদের সঙ্গে থেকেছ, নিষেধ সত্ত্বেও কোকেনের কারবার করেছ, নিজে নানারকম ড্রাগ নিয়েছ। তোমার কোনটা বলব, কোনটা ভালো! [ঘৃণা, অবহেলায় বিকৃত ফর্শা মুখ]
- আমার একটাই ভালো, সেটা আমার চোখের জল। দেখ আমি এখন কাঁদছি। মারাদোনা তোমার মারাদোনা কাঁদছে। তোমার জন্য। কোনোদিন ভেবে দেখো আমার ,মেয়েদের আমি কতটা ভালোবাসি। মেয়েরা না বললে এবার আমি খেলতুম? এতটা কষ্ট!
- তুমি খেলেছ সেটা তোমার ইগো, লোক-দেখানো অহংকার। নিজেকে জাহির করার গর্ব। কিন্তু কি করলে? মেয়েরা কিভাবে মুখ দেখাবে! ভালোবাসা কথাটা তোমার মুখে বেমানান। আমাকে কম কষ্ট দিচ্ছে না! এতগুলো বছর কেবল নেশা-ভাঙ, তামাশা, সার্কাস! করে একটা বাফুন! আমার থেকে দূরে থেকেছ। যাও আমাকে ছোঁবে না। ঘোড়ামুখো জোকার! কেন ক্রিস্টিনা সিনাগ্রা, তুমি ওর ছেলের বাবা, কেস করেছে। কোর্ট রায় দিয়েছে মাসে মাসে ৩২০০ ডলার!
- প্লিজ প্লিজ! ক্লাউদিয়া, ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু নেই। আমি যখন খেলি তখন ভালোবেসেই খেলি। ঘৃণা? ছিঃ! মানুষ তোমাকে আমার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছে; যাতে আমার শিল্প থেমে যায়। যাতে, আমার বাইরেটা গেছে, এবার ঘরটাও। তবেই দুঃখে কষ্টে আমার শিল্প শেষ হবে। ভেবে দেখো আমি ভালোবেসে মাঠে নামি, সহজ ঘাসের পৃথিবীতে, আমার ফাউলের ইতিহাস নেই বললেই চলে। আমাকেই লোকে হাতে পায়ে কোমরে পাছায় লাথি মেরেছে, বারবার। যতবার সুযোগ পেয়েছে। তুমি দেখেছ, কত বন্ধুকে, কত পাশের মানুষকে টেনেছি। আজ তুমি আমাকে একটা অপদার্থ, হিপোক্রিট বলছ! বলো! ড্রাগে গোল দেওয়া যায়! ড্রাগে শিল্প হয় ক্লাউদিয়া! আমার মেয়েরা কি কখনো বড় হবে না, তারা কি বুঝবে না তাদের বাবা মিথ্যেবাদী নয়! এসব সাজানো হয়েছে। আমাকে ব্যর্থ প্রমাণিত করার জন্য। আমাকে মাঠের বাইরে বার করার জন্য। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি জনতার কাছে হেয় করার জন্য, ওই ছিল ওদের শেষ অস্ত্র। মানে তোমাকেও কেড়ে নিতে চাইছে। তোমার সঙ্গে আমার ব্যবধান, শেষ অস্ত্র। আমার সমস্ত ছাই করে দেবে।
- চুপ করো! আমি তোমার সব জানি। কেন? কেন তুমি এফিড্রিন নিলে? ভাবছ বুঝি না, ভেবেছিলে এবারও পার পেয়ে যাবে। অথচ আমাদের বারবার বলেছ, একবার হয়ে গেছে, ভুল হয়ে গেছে, ভুল হয়েছে, আর কখনো হবে না। তুমি একটা ঠগ, মিথ্যেবাদী — ক্লাউদিয়া মারাদোনার টিশার্ট ছিঁড়ে, — দেখ দেখ সব মিথ্যে কি না, সব তোমার সাজানো। — [খটখটে শুকনো চোখে লাল ছিটে, রুখে-দাঁড়ানো বাঘিনী]।
- মারাদোনা অসহায় শিশু। চোখের জল সত্যি। সত্যিই একজন নক্ষত্র চূর্ণ হচ্ছে। পৃথিবীর ঘূর্ণায়মান গোলকে নক্ষত্র আছড়ে পড়ল, হায়! এই সেই মায়াবন্দর যেখানে জাহাজ থামে না।
- মারাদোনা অসুখী জীবনের। সে শিল্পের মিকেল এঞ্জেলো, লিওনার্দো। আধুনিক পৃথিবীর ভালোবাসা। হারিয়ে-যাওয়া ধূসর পৃথিবীর শেষ নক্ষত্র। যে ঘৃণা নয় ভালোবাসা বিশ্বাস করে। যার খেলোয়াড় প্রেমে জাগে। আর কখনও জাগবে না, জাগবে না, জাগতে দেবে না, ভেবে পৃথিবীর মাতব্বররা তাকে নির্বাসন দণ্ড। কারণ ভালোবাসা ফিরলে এই ‘না-ভালোবাসা’ পৃথিবীর মহাসমারোহ। না-ভালোবাসার মায়াজাল। জেতো হ্যাভালাঞ্জ, জেতো!
- আমি পা দিয়ে ভালোবাসা প্রচার করি। আমার বাঁ-পা ভালোবাসার। শিশু ভালোবাসার।
এই সংলাপিকা আপনি শুনতেসেন যখন, এর সাউন্ডট্র্যাক হিশেবে খুব সফ্টকোর কোনো ইনস্ট্রুমেন্টাল বা বিষাদী প্রেম-ও-পরমারাধ্যা গান কল্পনা করে নেয়া অভিপ্রেত, নট নেসেসারিলি বাখ-বিতোফেন-চাইকোফস্কি ইত্যাদি কিছু হইতেই হবে, যে-কোনো গান যা আপনার ভেতরটাকে মেদুর করে তোলে। যেমন ধরুন চন্দ্রবিন্দুর ‘নতজানু’ গানটা : “তোমারই সামনে নতজানু আমি দুইহাত-প্রসারিত / যদি অস্ফুটে ভালোবাসাঠোঁট আড়ালেতে ডেকে নিত / রোদ্দুরমাখা হৈ-হুল্লোড়ে অকারণ কিছু শব্দের ভিড়ে আড়ালেতে ডেকে নিত / জমে-ওঠা সেই আড্ডার মাঝে শীতে-কেঁপে-ওঠা বোবা ছেলেটিকে আড়ালেতে ডেকে নিত / মাফলারে-ঢাকা চুপকথাগুলো নিমিষেই তবে হয়ে যেত রূপকথা” — গানের ইন্টার্লিউডে কিন্নরকণ্ঠী হামিং করে যাবে দেবগায়িকারা, আর চারপাশে একটা শ্রাবণশোভন আবহ বিরাজিবে। এই সংলাপিকা, এবং এই বইয়ে-থাকা আরও কয়েকগুচ্ছ সংলাপিকা এমনতর, শুনতে শুনতে আপনার চোখে একটা আধিভৌতিক পোকা কোত্থেকে এসে হামলে পড়বে যে আপনি অনভ্যস্ত হস্তে বহুদিন বাদে টিশ্যুপেইপার চোখে চেপে ধরবেন। আপনার স্মরণ হবে বহুদিন বাদে, একদিন আপনিও প্রেমিক ছিলেন, মনে পড়বে আপনার যে প্রেম বলিয়া আজব এক জিনিশ রহিয়াছে এই-না রঙিনা দালানের দুনিয়ায়, এবং বহুদিন আপনি এর সংস্পর্শবিচ্যূত, আপনি এখন দেশহিতৈষী, বিহারি-মারা খাঁটি বাংলাদেশি আপনি, শবেবরাতের দিবাগত রজনীতে আপনি বাজি না পুড়ায়া মানুষ পোড়ানো শুরু করসেন, গোদুগ্ধে ভেজাল থাকতে পারে মগর আপনার বাংলাদেশিত্বে ভেজাল নাই এইটা আপনি প্রুফ করসেন আপনারই নিকট আশ্রিতা মানুষগুলোকে মেরে এই ২০১৪ পবিত্র রজনীতে, এই অগ্নিদগ্ধ শবেবরাতে, আপনি কামিয়াব হোন দোয়া করি।
কিন্তু একটা ব্যাপার ভেবে দেখবার, এই সংলাপিকা শুনতে শুনতে, আপনি কিসের লাগিয়া জিন্দেগিতেও কোয়ালিফাই করতে পারেন না বড় কোনো শিল্পের আসরে, বিশ্বকাপ ফ্যুটবলে বা ডোভার্লেইন মিউজিক কনফারেন্সে। কথাটা কৌট করি আবার : “ঘৃণা, হতাশা, নোংরামি, ষড়যন্ত্র দিয়ে খেলা যায় না। যে-কোনো নির্মাণ একটা পিওর, মানে শুদ্ধ ভালোবাসা।” কাজেই আপনার চেতনা নিয়া, আপনার ইসলাম-অনৈসলাম নিয়া আপনি জিন্দেগিভর ফাকড-আপ হয়াই রইবেন। কবি হইবেন আপনি শনৈ শনৈ, বই বেরোবে আপনার ফোরকালার বছর বছর, কবিতা আপনার হাতে পড়ে ফার্স ক্রিয়েট করবে কেবল, লোকে এমনকি আপনাকে দেখে হাসিঠাট্টাও তো করে না দেখি, কবি সম্বোধন দিয়া আপনারে খুশি করিয়া আপদ বিদেয় করে নগদে। এভাবে হয় না, মায়েস্ত্রো হে বাংলার কলেজমাশটার, এইভাবে প্রেম ও পদ্য হয়নাকো। হিংসায় নিকষিত হেম কদাপি নির্মিত হয়নি ভুবনে। শিল্পের সঙ্গে সংসার চিরকাল হিংসা-অহিংসার উর্ধ্বের ব্যাপার। ভেতো বাঙালিরা খালি হিংসা খায়, হিংসা হাগে, হিংসানুশীলনেই বইয়ে দেয় সে তার গোটা জীবনটারে। এর মধ্যেও তো থাকে কেউ কেউ, যার বাঁ-পা ভালোবাসার, যেমন মারাদোনা, আমূল বুকে বিদ্ধ ছুরিকা নিয়েও যে সেই ছুরিচালক বন্ধুটিকে গানে গানে ডেকে আনে কিবোর্ডে কিংবা তার খাতার পাতায়, “আমার এ-ঘর ভাঙিয়াছে যে-বা আমি বাঁধি তার ঘর” গাইতে পারে এমন লোকও তো অলভ্য নয়, “শেষ হয়ে যাওয়া প্রেম, বিষ হয়ে যাওয়া বন্ধুত্বকে” যে ডেকে যায় মৃত্যুঝুঁকি নিয়েও, পুনরায় সেই বন্ধুটির হাতে ছুরিকাহত হবে বলে পেতে দেয় বুক, সিনা চিতায়া দাঁড়ায় নিরীহ প্রতিবেশীর নিরাপত্তা চেয়ে।
জেতো, উত্তরোত্তর জিতিয়া যাও, জোয়াও হ্যাভালাঞ্জ! যুগ যুগ জিয়ো হে বেঙ্গলি হিংসুটে কবি! হে হেফাজত হে গণহুজুগপ্রজন্ম! দুনিয়া জিনিতে পারিবে নিশ্চয়, কিন্তু শুধু মারাদোনাদের মাথাটা জিনিতে পারিবেক না — এইখানেই তোমার সমস্ত জারিজুরি-ব্যাটাগিরি ফুট্টুশ। ফুঃ! তুমি পয়্দায়া যাও হাজারেবিজারে হিংসাগান, হিংসাবই, হিংসাদৈনিকী। কিন্তু কমল চক্রবর্তী তো তোমার হিংসাফ্যাক্টোরির বাইরে জন্মাবেই। জ-ন্মা-বে-ই! মারাদোনা তো যুগে যুগে লেখা হবেই, তোমাদের এইসব ফ্রিক লিট্রেচারের ফাঁকফোকরে মারাদোনা চিরকাল বিরাজিবেই।
কিন্তু প্রতিষ্ঠানের পৃথিবীতে বেঁচে থেকে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজের কাজটা ঠিকঠাক করে যেয়ে প্রতিষ্ঠানের প্রতিপক্ষ হয়ে লড়াই চালাইতে গেলে ঢের বেশি স্ট্র্যাটেজিক হইতে হয়, ঢের দম ধরে রাখতে হয়, লোকে বলে যে প্রয়োজনে ধূর্তও হইতে হয়, মাগার অভিমানী হইলে একেবারেই ডাইলে-চাউলে খিচুড়ি। অভিমান বড়জোর অপর্ণা সেন পর্যন্ত নন্দনগ্রাহ্য, তথাপি অপর্ণাকেও তো পর্দায় টেক্নিক হিশেবে দর্শকমজানো অভিমান অবয়বে রেখে সটান অথচ ঋজু কৌশলে এগোতে হয় ইন্ডাস্ট্রি বাগে এনে নিজের যথাব্রত শৈল্পিক মিশনটা ম্যাটেরিয়্যালাইজ করার অভিপ্রায়ে। এত অভিমান আপনি যে দেখাইবেন, হোন আপনি মারাদোনা বা সাকিব আল হাসান, প্রতিষ্ঠান তো অভিমানভাষা বোঝে না ভায়া! আপনি বলবেন, বুঝাইতে আমার বয়েই গেল, মিঞা, আমি প্রতিভাবান, দ্যাখো মোর পাগলামো। ওয়েল দ্যান, মাদারির মায়ের খেইল আপনি যাতে তেঁড়েফুঁড়ে শুরু করেন, প্রতিষ্ঠান তো ওইটাই কায়্মনোবাক্যে চাইতেসিল হে! এক্কেরে ক্লাউন-জোকার বনিলেন আপনি প্রতিষ্ঠানের ফার্সের ফাঁদে পা হড়কায়ে। এরপরও বলবেন আপনি, জনগণ আমারে মাথায় তুলিয়া রাখিবেক, নয়তো জনগণ ঠকিবেক! দুনিয়াবাসীদিগেরে ঝলক-দিখলা-যা হাঁকিয়া যাইলাম, না-শুনিলে কী করিবার আছে মম! ওয়েল ওয়েল ওয়েল (অ্যাঞ্জেলিনা জোলি স্টারিং ম্যুভির ডায়ালগ ওয়েল ওয়েল ওয়েল না এইটা), প্রতিভা এক প্রতিষ্ঠান, জনগণ এক ভ্যাগ প্রতিষ্ঠান, দুনিয়া আরেক মহা বাইঞ্চোৎ প্রতিষ্ঠান বৈ কিছুই তো না। আপনার রাগ, আপনার গোস্বা, আপনার অ্যাঙ্গার ব্লা ব্লা আখেরে প্রতিষ্ঠানেরই তো পুষ্টিসামগ্রী। কাজেই এত অভিমানদগ্ধ জোশ ও জজবা লইয়া আপনে জেহাদটা কার হিন্দিভাষার চুল ফালাইতে করলেন — যদি সেই প্রতিষ্ঠান মামুজির মদতই দিলেন — জনগণ অত ভোদাই পাঁঠা না যে সেইসব কন্সিডার করে দেখব। অত টাইম নাই দুনিয়ার। বউয়ের লগে যে-আচরণ রোম্যান্স বলিয়া গ্রাহ্য — যথা অভিমানাচরণ — বসের লগে উহা রামগড়ুরের গান্ডুগিরি। মিঞা, ভাইয়ো ঔর বেহনো, বুটলাগানিয়া পাও দিয়া ফ্যুটবলে দুইটা উষ্টাউষ্টি কিংবা ব্যাটের হাতলে ক্রিকেটবলের গায়ে আঙুলটিপ রেখে একটু ডাঙ্গুলি খেলাটা সামগ্রিক লড়াইয়ের একটা অংশ মাত্র, পুরো লড়াই তো না। থামতে জানতে হয়, যে-কোনো কলাকার এইটা জানেন, নইলে পুরা ব্যাপারটা যা হয় তার নাম কালোয়াতি। ঠিক একইভাবে সময়মতো তুলতে হয় আলাপ-ঝালা-তান-জোড়-মিড় ও সপাট তানের ঝড়। সমুজদার-কে-লিয়ে ইয়ে সবকুচ জিয়াদা কাফি হ্যায়, লেকিন কাভি নেহি গিমিক-গিটকিরি। মানুন বা না-মানুন, যুদ্ধ তো আপনার মর্জিমাফিক সাজানো থাকবেক না, আপনাকেই ব্যাটলফিল্ড সাজায়ে নিতে হবে তো, অন্যথায় কিসের উস্তাদজি, কিসের মায়েস্ত্রো আপনে! প্রতিভাবানের পায়ের তলার ফুলগালিচা হইব দুনিয়াটা — মামার বাড়ির আব্দার আর-কি! আর আখেরি দম ফুরানির আগে তক তো আপনে স্রেফ প্রতিভাবানের প্রোপ্যাগ্যান্ডা, দোলনা হইতে কব্বরে হান্দাইবার ঠিক আগক্ষণ পর্যন্ত তো প্রতিটি মুহূর্ত আপনি নিজেরে প্রমাণিবেন, জ্যান্ত আপনে স্রেফ প্রতিভার বিজ্ঞাপনী ইল্যুশন।
এইসব বাহাস পাশ কাটায়ে যেয়ে দেখুন কমল চক্রবর্তী কী নিমগ্ন ভালোবাসায় ডেপিক্ট করতেসেন মারাদোনামুখ! কৌরব নামে একটা বাংলা সাহিত্যপত্রিকা টানা চল্লিশ বছরেরও বেশি কালব্যাপী যিনি চালায়েসেন অদম্য ভালোবাসার পাশাপাশি বিদ্রোহ বজায় রেখে, সেই কমল চক্রবর্তী আঁকতেসেন আরেক ভালোবাসাশিল্পী বিদ্রোহভাস্করের মুখ, এ এক ঘটনা পাঠকের জন্য। প্রতিষ্ঠানের করোটি-হৃদয়হীন কবন্ধ কুচক্রশকুনি কীভাবে ফুঁসলাতেসে এক শিল্পোন্মাদ মারাদোনাকে, যেমন ফুঁসলায় সে যুগে যুগে যুগান্তরের মারাদোনাদেরে, কেমন করে মারাদোনা বীভৎস প্রতিষ্ঠানের কাছে করজোড়ে মাগতেসেন শিল্পসৃজনের সুযোগ, আহ্! আমাদের মনে পড়ে যাবে একটি উপন্যাসচরিত্রের মুখে সেই-এক সংলাপ — মাল্যবান সেই উপন্যাসের নাম, সেই-আরেক প্রতিষ্ঠানপ্রতিক্রিয়াশীলতা পাশ কাটায়ে মহীরুহ-হয়া-ওঠা জীবনানন্দ দাশ : “কারুবাসনা আমাকে নষ্ট করে দিয়েছে; সবসময় শিল্প সৃষ্টি করবার আগ্রহ, তৃষ্ণা — কারুকর্মীর এই জন্মগত অভিশাপ আমার জাগতিক সব সফলতা চিরতরে ধ্বংস করেছে।” ইত্যাদি। শুনি মারাদোনা, বা কমল চক্কোত্তি, আবার :
“আমার প্রিয় একুশ সতীর্থের রক্তে আমি কিলার ইন্সটিংক্ট দেখাব! হাঃ হাঃ হাঃ! কত ভুল লক্ষ্যে মানুষ গড়ে উঠেছে। শিল্পের সঙ্গে হত্যা, মৃত্যু জুড়ে দিয়েছে, বুদ্ধিমান মানুষ। তাই এত হতাশা, এত মারামারি। শিল্পের সাইকোলজি বিচার করতে গিয়ে বুদ্ধিজীবীরা খুনোখুনি জুড়েছে। শিল্পীকে গোপন শিক্ষা ও ষড়যন্ত্র শেখানো হলো। তাহলে তার সারল্য? ঘৃণাই সব!
আমাকে নিয়ে গোড়া থেকে কোচের সমস্যা হচ্ছিল। তারা আমাকে বোঝাতে চাইছিল কিলার ইন্সটিংক্ট। … প্রতিপক্ষকে শেষ করো, ধ্বংস করো। অ্যারেনায় গ্ল্যাডিয়েটর। … জয়ই মানুষের অনিবার্য লক্ষ্য। আমার ভালোবাসা, শিশু। আজও বুকে ডালমা, পিঠে গিয়ানিনির ছবি শিল্পী এঁকে দিলে তবে খেলতে নামি। …
হত্যাকারী হওয়ার আদর্শ কখনো বোধ করিনি। কারণ খেলা আমার কাছে কখনো হত্যাকারীর ভূমিকায়, নো। … হয়তো ওদের মধ্যে জেগে উঠেছে বিশাল বিশাল সব কিলার। …
কিন্তু অনায়াসে মনে হয়েছে, ওরা আমার জন্যই আজ এত কাছাকাছি। এমন কি বিশ্বাস হবে, মাঠে বাকি একুশ জন আমাকে বল এগিয়ে দিচ্ছে। ম্যাজিক রোমিও-জুলিয়েট, নব্বই মিনিটের মধ্যে! …
ওরা একুশজন বন্ধু, ওরা আমার জন্য মাঠের দুরূহ কোনো কোণ থেকে ছুটে ছুটে বল আনছে। ঠা ঠা রোদে ঘেমে নেয়ে উঠছে একেকটা ছেলে, এমন তো কতদিনই হয়েছে, ডাইনে চাইছি, বল। ডান দিকে নয় বাঁয়ে, বেশ বাঁয়ে। শূন্যে চাই, শূন্যে। ফাঁকায় চাই, তথাস্তু।
কতদিন লক্ষ করেছি, মাঠে, যাদের দর্শক প্রতিপক্ষ বলে, তারা আমার পায়ে বল তুলে কি করি দেখছে, ভালোবেসে মুগ্ধ নয়নে, আমার দিকে। আমার পক্ষে তাকে হত্যা করা সম্ভব! একজন মুগ্ধ, মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা, আমার গা ঘেঁষে অবাক, তাকে আমি মারব, দাঁত খিঁচিয়ে ছুটে যাব!
আমার কোনো যুদ্ধ কখনো ছিল না। ছিল ঘোড়দৌড়ের মাঠ। নীলাভ টার্ফ এবং লালচে সবুজ আকাশ, আবহসংগীতের মূর্ছনা …
তাই কাউকে কখনো ফাউল! ভাবিনি। কারণ আমার ছিল না ল্যাং-মারা বিচ্ছিন্ন প্রতিভা বা সময় বা ধৈর্য। …”
ছড়ায়াছিটায়া রয়েছে এইরকম আরও অজস্র বিপন্ন-বিস্ময়কর স্যলিল্যকি। স্বগতোক্তি। মারাদোনার। কমল চক্কোত্তির। আমার। আপনার। আমরা যারা মাতব্বরের খেয়ালখুশি সামলেসুমলে খেয়ালখুশির বাইরে একটা আপন ভুবন চাই। আমাদের। “পাঁচশ চল্লিশ দিনের জন্য মাতব্বররা আমায় নির্বাসন। এইখানে বলে রাখি, এরপর পৃথিবীতে ফেরা কদাচিৎ সম্ভব। হয় না বলব না। তবে প্রায় অসম্ভবও। মাতব্বরদের খুশি করেনি বলে কত প্রতিভা এইভাবে জেলখানায়। ওহ্, হেঁটে দেখছি, চারদিকে গরাদ। কে আছো!” নো, কোথাও কেউ নেই, প্রিয়তম, কেউ নেই কোত্থাও। তোমাকে বাঁচাবার কেউ নেই, তোমারে বধিবে যারা তারা গর্ত হইতে সময়মতো ঠিক বেরিয়ে আসে পিলপিল জোয়ারের ন্যায়। হে খেলোয়াড়, ডিভাইন স্পোর্টসপার্সন, তোমার মতো আমরাও তো, প্রতিষ্ঠানপুরোহিতদিগের পুংটামির শিকার প্রতিদিন পদে পদে, ভিক্টিম আমরাও অসহায়। কিন্তু হাল তো ছাড়িনি তবু। মুঠিবজ্র ধরে রেখেছি হাল, তুলি পাল আমরাও আমাদের স্বপ্নের ডিঙির, চাঁদবেনে আমরা তোমারই মতন, মনসার পুজো দিতে অনীহ, ক্ষয়ক্ষতি স্বীকারিয়াও, সমূহ ধ্বংস জেনেও সর্পদেবীর কৃপাপ্রার্থী হইনি তো তবু, পুজো যদি দিতেই হয় তো নেহায়েত বামহস্তে নমঃনমঃ।
“ভিডিও দেখে যুদ্ধপদ্ধতি! তৈরি হচ্ছে কম্প্যুটারগেইম। পৃথিবীর যাবতীয় গুণীমানীর প্লাস-মাইনাসে ফুলে উঠেছে যন্ত্রের পেট। ওহ্ ইলেক্ট্রোনিক মাস্তানি! মানুষ দেখে দেখে, দেশ দেখে দেখে যুদ্ধপদ্ধতি! এবং আমাকে আমার কোচ বলে যাচ্ছিল, দেখ হে, কে কতটা লড়ছে। … গো ডিয়ার গো ইনসাইড। তুমি গ্রেট, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম অভিজ্ঞতাগুলো দেখ। শেখ। না-হলে তোমার কিছু হবে না — রিপ্লে, রিরিড মাইনিউটলি। বারে বারে পড়। দুর্বলের দুর্বলতা এবং সক্ষমের ক্ষমতা ভালোভাবে বুঝতে হবে, এটাই একজন বড় মাপের মানুষ হয়ে ওঠার চিরাচরিত পদ্ধতি। হাস্যকর, এসব আমাকে বিন্দুমাত্র ভাবাত না। কারণ, আবার সেই কথাই বলতে হয়, কখনো কারো দুর্বল স্থানে আঘাত বা দুর্বলের জন্য সবল ক্যাল্কুলেশন বা শক্তিধরের শক্তির উৎস খোঁজা, এসব খুবই কষ্টকর বা ক্লান্তিকর। নাড়িভুঁড়ি পুঁজরক্ত ঘেঁটে সময়। ওহ্ এত কম সময় জীবনের আরও কম ক্রিয়েটিভিটির! তাও সবল দুর্বল দেখে, ভেবে, প্যাঁচ কষে যদি যায় তো কেমনে যাওয়া! …
এই তো মহামাঠ, এই মহাসাগর, মহাদেশ, মহা আকাশ, এখানে একটা কিছু তৈরি করব বলেই মেতেছি। মাতোয়ারা হে জীবন।
আচ্ছা এভাবে কখনো একজন সত্যিকারের মানুষ কিছু করতে পারে! সাবধানে হিসেবে চলে কে? কে, বলো! কে ভিডিও দেখে যুদ্ধে বেরোবে? আমি! আমাকে তোমরা কি পেয়েছ! আমার শরীরে তো ঘোড়ার রক্ত।…”
সত্যি বলতে, এ এক অনন্য কৌশল, মন্ত্রগুপ্তি, শিরদাঁড়া টান করে রাখবার, বাঁচবার। মারাদোনার দেখানো, অসংখ্য মারাদোনার দেখানো, কমল-বাৎলানো বাঁচনকৌশল। তরিকা মাথা খাড়া রাখবার। গরিমার, বাঁচবার। তোমাকে ভেতরে-বাইরে একইসঙ্গে লড়াইটা চালাতে হবে। কেননা আদরে আদরে তোমার আকাঙ্ক্ষা বাড়াইবার ফন্দি নিয়ে এসেছে ওরা। ফাঁদে ধরা দিলে শিল্প খতম, শান-শওকাতের অঢেল ছড়াছড়ি, ধরা না-দিলে শিল্প নাই শান-শওকাত নাই, জিনা হারাম হো যায়েগা তেরা, মারাদোনা! মর্না ভি হারাম হো যায়েগা। দ্যাখো, ফুঁসলাইছে তোমাকে :
“কি হবে, আজ বা কাল তোমার পায়ের জোর কমে যাবে। থাকতে থাকতে তুমি মডেল হয়ে যাও। মানুষের বিশ্বাস নিয়ে কারবার করো। টাকাই সব খোকা। তোমার মিথ্যা কথা দারুণ চলবে। কারণ লোকে তোমার পা দেখতে অভ্যস্ত। তারা ভাবতে পারবে না তুমি মিথ্যে বলো, চুরি করো। অপরাধের এই সুযোগ নাও। তুমি এখন হিরো। … এই তোমার সময় মারাদোনা। তুমি পৃথিবী দেখো। দু-পাঁচটা নিজের প্লেন রাখো। দু-চারটে রোলস রয়েস। দু-চারটে কারখানা। না, তোমায় চালাতে হবে না। আমরা কেন আছি। আমাদের দায়িত্ব তোমার গ্ল্যামার কাজে লাগানো। …”
মনে রেখো, লোভার্ত বসুন্ধরা, মারাদোনা কান দেয় নাই এইসব ফুঁসলানি মন্তরে। এই কথাটি মনে রেখো, পতন বন্ধুর পথের পৃথিবী, মারাদোনা মডেল হয় নাই। মারাদোনা দুইটাকায় দুইহাজারটাকার ফায়দা-প্রোফিটের গান গাহিবারে রাজি হয় নাই। মিটিঙে-প্রেসমিটে যেয়ে ফিফামাফিয়ার ঢোল পেটায়ে মোটা খাম বাগানোর জীবন মারাদোনা বেছে নেয় নাই। মারাদোনা এক একলষেঁড়ে গোঁয়ারের নাম। সবসময় বিপজ্জনকভাবে বেঁচে থেকেছে। এই কথাটি মনে রেখো, ধরিত্রীপ্রিয়া, আমি যে গান গেয়েছিলাম মনে রেখো, গরিলার গানহীন জীবন আমি নিই নাই বেছে, হে পৃথিবী, মনে রেখো! আমিই আমার অমল-ধবল প্রতিষ্ঠান, আমিই আমার মুক্তিদাতা মুহূর্মুহূ, আমি কোনো ভজকট সিন্ডিকেটে নাই, আমি মারাদোনা, একটাকিছু তৈরি করব বলে এসেছি এই ভবে, ব্যর্থ হই কিংবা সাক্সেসফ্যুল সেইটা আলাদা হিসাব, তৈরি করার খেলা আমার ফুরাবে না হে ফিফা হে মাফিয়াবান্ধব কমার্শিয়্যাল দুনিয়া, আমি মারাদোনা, আমিই সিন্ডিকেট আমার নিজের, আমি প্রতিষ্ঠান আমার একলার, আমাকে মনে রেখো।
হুলিও গ্রন্দোনা, আর্জেন্টাইন ফ্যুটবল ফেডারেশন বোর্ডের ইনফ্লুয়েনশিয়্যাল ব্যক্তি, তিন দশক ধরে যিনি আর্জেন্টাইন ফ্যুটবলের দণ্ডমুণ্ডকর্তা, মারাদোনার সঙ্গে যার বিবাদ প্রায় রেষারেষির পর্যায়ে। বয়সে মারাদোনার বাপের চেয়ে বছর-কয়েক কম হবেন যিনি, সেই গ্রন্দোনা, চান্স পাইলেই মারাদোনাকে একহাত নেন, বিদ্রুপবাণ ছোঁড়েন, হেয় করেন। ২০১৪ সালের বিশ্বফ্যুটবল প্রতিযোগিতার আসরে ইরান ভার্সাস আর্জেন্টিনা ম্যাচ চলাকালীন মারাদোনা হাজির হন গ্যালারিতে। ম্যাচ দীর্ঘক্ষণ গোলশূন্য পরিস্থিতিতে গ্যালারি ছেড়ে যেতে দেখা যায় মারাদোনাকে। এর অব্যবহিত পরে ম্যাচনির্ধারণী একমাত্র গোল পায় আর্জেন্টিনা। মারাদোনার বাপোপম অশীতিপর হুলিও গ্রন্দোনা স্থূল কটাক্ষ করেন এই মর্মে যে, গ্যালারি ছেড়ে কুফা মারাদোনা উঠে যাবার পরক্ষণেই ভাগ্যবিধাতা আর্জেন্টিনাকে বর দান করিয়াছেন। হো ভগমান! মারাদোনা আর্জেন্টিনার জন্য অপয়া! আর গ্রন্দোনা বড় পয়া! বাহা রে বাহা! মারাদোনাও তো ওষ্ঠে-অধরে কম না, সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরে পাগলা যা উবাচ তা প্রকারান্তরে এ-ই যে, আমারে তো গ্রন্দোনার ন্যায় তিরিশ-অধিক বচ্ছর ব্যাপিয়া আসনপিঁড়ি পাতিয়া বসিয়া বসিয়া গোলতামাশা গুনিয়া গুনিয়া মনের হরষে ভাত খাইবার নসিব আল্লা দেন নাই, আমারে তাই ইচ্ছার বিরুদ্ধে হইলেও উঠিতে হয় পেটের লাগিয়া পাটশাক-শুঁটকিসুরুয়া পাতে তুলবার গরজে। তোমাদিগের ন্যায় গ্যাঁট হইয়া শুইয়া-বসিয়া জিন্দেগি গুজরায়া যাবার কপাল তো লইয়া আসি নাই দয়ালের এই নৃশংস সুন্দর সংসারে।
এ-ই তো, উন্মাদ ইল্যুশনিস্ট, ফ্যুটবলের আলকেমিস্ট, এ-ই সেই আনপ্রেডিক্টেবল পাগলা মারাদোনা।
কমল চক্রবর্তী, কিংবা মারাদোনা, ভালোবাসায় বাঁচেন। ভালোবাসাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে! কে বাঁচিতে চায়, এক ফিফা-হ্যাভেলাঞ্জ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানগুলা ছাড়া, হিংসা-হানাহানি-ঘৃণা-কুচক্রিতায়! কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়, ধেড়ে-ইঁদুরদিগের বাণিজ্যগড্ডালিকায়! দ্যাখো, অসম্ভব অনবদ্য মমতায় মারাদোনানুগত কমল ক্রিয়েট করেছেন একেকটা দৃশ্যপরম্পরা, একের-পর-এক মন্তাজ, গান-গল্প-কবিতা-আখ্যান-উপকথা-লোকশ্রুতি-রিপোর্টাজ প্রভৃতির মিশোল দিয়ে একটা মস্ত কোলাজ, অভাবিতপূর্ব ব্রিকোলাজ। না, বায়োগ্র্যাফি না, যাকে বলে বায়োপিক মোটেও তা না, পিরিয়ড ম্যুভিও না, এ অন্য কিছু, আলাহিদা কিছু, দিস্ ইজ সামথিং এল্স। মনে রাখতে হবে এ-কাহিনি সৃজিত হয়েছে এমন একটা কালে, যে-কালে আঙুলের একক্লিকে দুনিয়া বিহারের কল্পনাও জন্মায় নাই বাংলায়, এই বই বাইরাইসে ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে, জাস্ট ইমিডিয়েইট আফটার নাইন্টিফোর ওয়ার্ল্ডকাপ। এত এত মালমশলা, এত এত কাঠখড়-কেরোসিন-জ্বালানি জড়ো-যোগাড় করা, সেইসব ইন্টার্নালাইজ করা, তারপরে সেইসব গদ্যে অ্যাপ্লাই করা — বাবু কমল চক্রবর্তীর পক্ষেই সম্ভব, যিনি যাপন করেছেন ডিফ্রেন্ট কন্টেক্সটে এক অন্যতর মারাদোনাজীবন। শোনা যাক, লাশকাটা ঘরে আমাদেরে নিয়া যাবার আগে, একটা গান, যে-গানটা লাতিন্যামেরিকার ম্যান্ডোলিনবাদক অ্যানোনিমাস এক বাউলের, শুনি বাংলার বাউল কমলকণ্ঠে :
আন্ডিজ পাহাড়ের গায়ে বুড়ো ভামের বাসা
সেখানে এক মারাদোনা ময়দা দিয়ে ঠাসা
গতরটা তার ঘটির মতো
গাল দুটো কয়েৎ বেল
মাঠে নামলে টেডিবেয়ার জমিয়ে ছাড়ে খেল
দাঁতমাজা পেস্ট নাকে লাগায়
গালে বাতের মলম
খেলোয়াড় নয় পাকা জোকার
ম্যাজিশিয়ান চরম
আন্ডিজ পাহাড়ের গায়ে মিউজিশিয়ান হাওয়া
তারই কাছে এতোলবেতোল কুমড়োপটাশ চাওয়া
আমরা যারা ঘানি ঘোরাই
ন্যাকড়া পোড়াই রোজ
মারাদোনা পথ বলে দেয় ভূতের রাজার খোঁজ
এ এক আজব বই, বিলিভ ইট অর নট, স্বপ্নে-পাওয়া আকিক পাত্থর, বহুবর্ণিল, এ-বই পড়লে আপনি জানতে পারবেন “আসলে প্রতিষ্ঠান মিডিওকারের অনিবার্য আশ্রয়। প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কোনো আলো নেই। মিডিওকারেরও। তারা প্রতিনিয়ত প্রতিভাবানের আলোয় পথঘাট, জামার মাপ, কাটাপোনা, ভাজা ছোলা, বুঝে নেয়।” এই কিতাবখানা পাঠপূর্বক আপনি আরও জানতে পারবেন, “আজ যদি ১০০ জন খেলোয়াড়কে ডোপ টেস্ট করা যায়, ১০০ জনই কেলেঙ্কারীর ফসল। … ড্রাগ একদিন বিশ্বে প্রকাশ্যে ব্যবহার হতে বাধ্য। হয়তো আরও কুড়ি-পঁচিশ বছর। কিন্তু শ্রেষ্ঠকে খুন করা! মহান কে? কারণ মানুষ জানে ড্রাগ ফুটবলারের পা তৈরি করে না। … ইউরোপ, এই শতাব্দীতে মনুষ্যত্বের বধ্যভূমি। হামবাগ ইউরোপ, … মানুষ মারা অবসর বিনোদন। থার্ড-ওয়ার্ল্ডই ইউরোপের গিনিপিগ। … না–ভালোবাসা, যৌন প্রেম, অবিশ্বাস, পৃথিবীর সেরা অবলম্বন। ইউরোপ প্রাণপণ প্রচার করছে। … দিয়াগো আর্মান্দো মারাদোনা, ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি ফুটবল-ঈশ্বর। ফুটবলের নতুন ল্যাঙ্গুয়েজ, আধুনিকতার জনক। … মহাকাব্যের নায়কদের শেষ খুবই দুঃখের, এমনকি কৃষ্ণকেও ব্যাধের তিরে। মৃত্যু। অর্জুনরা পাহাড়ি পথে হতাশায়। রাম সরযূর জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা, সক্রেটিস, সীজার, গ্যালিলিও। … কানে-দুল ছেলেটা! ফুটবলে প্রথম যৌনতা আনে। … ফিদেল কাস্ত্রোর বন্ধু। কাস্ত্রোর বন্ধুত্বের মূল্য কি দিতে হলো?” … এই বই পড়লে আপনি শুনতে পাবেন মারাদোনার দ্রোহ-অনুনয়-মিনতিমেশানো কণ্ঠস্বরের বিভিন্ন মড্যুলেশন : “আমি কর্ণ। আমাকে যুদ্ধে হত্যা করো। আমার শেষ ঐটুকু। আমি যোদ্ধা। আমি বিদ্রোহী। বোঝো না কেন ঈশ্বরের কৃপাপুষ্ট ইউরোপ-আমেরিকা নই। আমরা কোপা আমেরিকা।” শুনবেন এই স্বরগ্রাম : “তোমার ভালোবাসা ছাড়া পারব না ক্লাউদিয়া। খেলা ছেড়ে দেবো। মানুষ জানতেই পারবে না লড়াই করলে জেতা যায়। … ভালোবাসা ছাড়া কোনো খেলা সম্ভব নয়। আমি-যে মাঠে দাঁড়াই কোটি কোটি মানুষ থাকে না ডার্লিং, তুমি থাকো আর আমার মেয়েরা। … আমি খেলি ভালোবাসা ফিরিয়ে আনব বলে। … সারামাঠ, তোমার কাছে যাবার দৌড়। ডালমার কাছে, গিয়ানিনি। … আমি মাত্র পাঁচ ফুট চার। কোটি কোটি শিশুর হাসি। … ওই ফিফা, শিশুদের বঞ্চিত করল। … ফিফার শাস্তি শিশুরা কখনো মকুব করবে না। … আমি-যে পেলের মতো পাব্লিক রিলেশন, ষড়যন্ত্র শিখিনি ডার্লিং। আমি একটা ছিঁচকাঁদুনে বোকা ভাঁড়। ঘোড়ামুখো স্টুপিড!” … আরও অপ্রিয় ও অনৃত অনেক ভাষণ পুনরায় শ্রবণাভিজ্ঞতার ভিতর দিয়া যাইবেন আপনি, এই কিতাব অধ্যয়নকালে; যেমন বর্ষীয়ান ফ্যুটবলনায়ক পেলে মশাইয়ের অমার্জনীয় সেই হিংসাবাক্য : “ওটাকে পুড়িয়ে দে। ওটা সাপ। ওটা জল পেলে ফের ফণা তুলবে। ভারী বুট দিয়ে আরও একটু।” অখেলোয়াড়োচিত অমানবিক এই ভাষিক সহিংসতার টার্গেট, বলা বাহুল্য, মারাদোনা। বাক্যটা ইয়াদ করিয়ে দেয়ার আগে শ্রী কমল রচনা করে নিয়েছেন এই দৃশ্যসৌন্দর্য : “আমি যুদ্ধে যাব। আমি একজন সেনাপতি স্যার। আমি ফুটবল ভালোবাসি। বিশাল কলোসিয়ামের সূর্যে ওরা এগারো জন মিলে আমার শরীরে সর্বত্র লাথি মারুক। আমি মাঠে মরে যাব। ওই ঘাসের সবুজে। ওই বলের শব্দের সঙ্গে শরীর মিলিয়ে যাবে। আমার যিসাস, আমার মেরী ওই গোলক। কার্পেট থেকে শেষবারের জন্য ফণা তোলার চেষ্টা করে। লাঠিপেটা সাপ, থ্যাঁতলানো মাথার রক্তাক্তভারে নুইয়ে যায়।” এই বই পড়লে পরে, হে জ্ঞানপিপাসু, জানাজানি-কানাকানি-শোনাশুনির বাইরেকার এক মণ্ডলে আপনি আরোহণ ও চরাফেরা করতে পারবেন। এই বই এক অনন্ত নন্দনের, অসীম বিস্ময়ের, মানুষের। এই বই এক গলিয়ঁ-কা ভিলেইনের, এক সাপ্নো-কা নায়কের, শ্রীচরণ কমলের, এই বই আমার, আপনার, আমাদের। এই বই পড়ার আগে, এই জীবনসিনেমা দর্শনাশে পপকর্নঠোঙা হাতে নিয়ে প্রেক্ষাগৃহপ্রবেশপ্রাক্কালে, ১০১ টা সাবধানসঙ্কেত মনে রাখা বাঞ্ছনীয়। তন্মধ্যে একটা এ-ই : আপনি ধীরে ধীরে আপনার মনিবের বিরাগভাজন হইতে শুরু করবেন — এহেন আশঙ্কা অত্যন্ত জোরদার।
না, মারাদোনা ভালোবাসি না আমি। কিংবা আর্জেন্টিনা আমার ফেব্রিট ফ্যুটবলটিম না। বাফুফেপ্রেমা আমি চিরদিন, জন্মসূত্রে, ম্যানেজমেন্ট-ভণ্ডামি সত্ত্বেও আমি বিসিবি, আইজ্ঞা। ব্রাজিল আমি চিরকেলে। কেন ব্রাজিল, বলতে পারি না; কেন আর্জেন্টিনা না, তাও জানি না। না তুম জানো, না হাম; কিউঁ চলতি হ্যায় পাবান / কিউঁ ঝুমে হ্যায় গাগান / কিউঁ মাচালতা হ্যায় মান / না তুম জানো, না হাম। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে এই ঘটনাটা ঘটেছে লাকি আলির কণ্ঠে।
প্রেমের — শৈশবের — বর্ণনা হয়, ব্যাখ্যা হয় না। আর আমি চাই না আমার ভিতরের মনিবক্ষ্যাপানো মারাদোনাদৈত্যটা জাগিয়া উঠুক। আপনিও তা চান না, আমি জানি। আমি আমার ভিতরের মারাদোনাটা গলা টিপে মেরে রেখে উত্তরোত্তর ছাপোষা সংঘের রেজিস্টার্ড সভ্য হইতে চাই। তিনচিমটি হিম্মৎ-মুরদওয়ালা সিন্ডিকেটের প্রাউড মেম্বার হইবারে মুই বদ্ধপরিকর। সমস্ত বৈপরীত্য-স্ববিরোধ-ভণ্ডামি-বিকলন সত্ত্বেও তবু, তবুও, হায়, কেন-যে এই ফিরে ফিরে মারাদোনা পড়ি! কিছু হয়তো কোথাও অধিকন্তু রহিয়া গেল কর্তব্য বাকি! ফিরে ফিরে পেছনপানে এহেন উঁকিঝুকি তাই। হয়তো। রয়ে গেল বুঝি কিছু মায়া … যাপিত এই জীবনের অজস্র ভুলভালের আশ্চর্য সমস্ত প্রচ্ছায়া … আপোসজীর্ণ জীবনের বিরল কোনো অবসরে সম্যক বুঝে দেখবার মারাদোনাবিদ্রোহ।
২০১৪ ওয়ার্ল্ডকাপ চলাকালে এইটা লেখা হয়েছিল। তখনকার একটা সাইটে ছাপাও হয়েছিল। অনেকদিন ধরে সেই সাইটটা লাপাতা। মারাদোনার অকাল আকস্মিক উধাওসংবাদে লেখাটা শেয়ার দিতে যেয়ে দেখি লিঙ্কটা কাজ করতেসে না। আর এই লেখাটা পুনরুদ্ধার ও পুনর্প্রকাশের সময় বেশকিছু টাইপো সংস্কার করা সম্ভব হয়েছে। বেশ কয়েকটা পাঞ্চ বাক্যও বটে।
এত অন্তর্ধানসংবাদ চারিদিকে, এত ক্ষয় এত মৃত্যু এতই নিরানন্দ, হতবিহ্বল লাগে। অ্যাদিয়্যু, দিয়েগো! পুনরায় ফিরে ফিরে দেখা হবে তোমার লগে। — লেখক
… …
- লঘুগুরু - November 8, 2024
- উলট কমল - November 7, 2024
- তথ্যপ্রযুক্তি, নিসঙ্গতা, নির্লজ্জতা, মননশীলতা ও সৃজনশীলতা - October 29, 2024
COMMENTS