কাশ্যপার মনে হইলো সৎ ভাই মোজ্ঞাল্লানার চেয়ে তার যোগ্যতা বেশি। রাজমুকুট তার অধিকার। কিন্তু কাশ্যপা কনকুবাইনের ছেলে। রাজা ধাতুসেনার অবৈধ সন্তান। রাজা কীভাবে কাশ্যপারে রাজমুকুট দিবে? বৈধ সন্তান মোজ্ঞাল্লানা হবে রাজার উত্তরাধিকার। এইটাই রাজার নীতি।
কাশ্যপা কিছুতেই এই সিদ্ধান্ত মাইনা নিতে পারলো না। সে বিদ্রোহ করলো। নিজের বাপ রাজা ধাতুসেনারে জ্যান্ত কবর দিলো মহলের গোপন দেয়ালে। সৎ ভাই মোজ্ঞাল্লানারে করলো রাজ্যছাড়া। রাজমুকুট দখলের পর কাশ্যপা হইয়া উঠলো এক অদ্বিতীয়। প্রতিষ্ঠা করলো তার স্বপ্নের রাষ্ট্র। বেহেস্তের মতো সিগিরিয়া ফোট্রেস।
কাশ্যপা জানতো রাজমুকুটের দখল নিতে একদিন সৎ ভাই ফিইরা আসবে। তাই সিগিরিয়া পাহাড়ের গহিন বুকে সে গইড়া তুললো এক দুর্ভেদ্য ফোর্ট। দূর্গের ভিতর নিরাপদ কাশ্যপা। কিন্তু কাশ্যপা কি নিঃসঙ্গ?
প্রাসাদের দেয়ালে-দেয়ালে পানিরঙে-রাঙা নকশার মাতম তুললো কাশ্যপা। মন্ত্রমুগ্ধ সুন্দরের ভিতর সমস্ত নিঃসঙ্গতা মুইছা ফেলতে চায় কাশ্যপা। পারছিল কি? সিগিরিয়া পাহাড়, পাহাড়ের অমাময়ী ঝর্ণা, পাখির ডাক, অন্ধকারে নেকড়ের জ্বলজ্বলে ধ্রুপদী হিংস্র চোখ, দূর্গের নিরাপদ দেয়াল, দেয়ালে আঁকা রূপসী হুর — সব সুন্দর আস্তে আস্তে কাশ্যপারে শুধু বিষণ্ণ করতেছিল। সব সুন্দর কেন তার কাছে অর্থহীন হইয়া উঠতে থাকে?
কাশ্যপা অমরত্ব চায় নাই। সে তার অধিকার বুইঝা নিছিলো মাত্র। সে তার নিয়তির হুকুম হইতে চাইছিল। আর তারপর হয়ত সে এইটাও বুঝতে পারতেছিল, মৃত্যু এমন এক নিয়তি — গহিন সুন্দর আর নিখাদ নিরাপত্তার ভিতর সে আরো মোহময় হইয়া ওঠে।
আঠারো বছর পর এইবার আক্রমণে প্রস্তুত মোজ্ঞাল্লানা। বিশাল সৈন্যসামন্ত লইয়া কাশ্যপার সিগিরিয়া পাহাড় ঘিইরা হুঙ্কার দিলো সে। যদিও মোজ্ঞাল্লানার পক্ষে কখনোই সম্ভব ছিল না পাহাড়ের উপর এই বিশাল দূর্গ ভাইঙ্গা কাশ্যপারে ধরাশায়ী করা। কিন্তু বিপুল ঐশ্বর্য আর সুন্দরের ভিতর এতদিনে ক্লান্ত কাশ্যপা। অথবা তার নিয়তি। দূর্গ ছাইড়া এইবার সে নিচে নাইমা আসে। কী ভাবছিল সে? কাপুরুষ মোজ্ঞাল্লানা কীভাবে তার মৃত্যু হইতে পারে? অথবা মৃত্যু ওই দূর্গের মতো নিরাপদ আশ্রয়? মৃত্যু কি সিগিরিয়ার সুন্দরের মতো মায়াবী?
কাশ্যপা এইবার মৃত্যুর দখল লইতে চায়। সিগিরিয়ার প্রাসাদ, তিলোত্তমা বাগান, জলরঙা নকশা, ভীষণ মায়ার প্রকৃতি এবং সম্ভবত নিজের ‘কুন ফায়া কুন’ হুকুমের ভিতর এতদিন কাশ্যপা বন্দি হইয়া ছিল। দূর্গের ভিতর পাথরের মতো ক্যাপ্টিভিটি — আর মাইনা নিতে পারতেছিল না কাশ্যপা। যেন মৃত্যু হইয়া উঠলো তার ওয়ে-আউট। মুক্তি।
শ্রীলঙ্কান রাইটার রোমেশ গুনেসেকেরার ‘মঙ্কফিশ মুন’ বইয়ের একটা গল্প ক্যাপ্টিভস। গল্পের বিষয় বন্দিদশা। হোটেলমালিক উদাভিরা বা হোটেলবয় নিমাল অথবা পশ্চিমা ট্যুরিস্ট মিস্টার অ্যান্ড মিসেস হর্নিম্যান — সবার বন্দিত্বের খাঁচাটায় টোকা দেন গুনেসেকেরা। কোনো সুন্দর, কোনো বিচ্ছেদ অথবা কোনো বিদ্রোহই এই ক্যাপ্টিভিটির খাঁচা খুলতে পারতেছে না যেন।
২.
‘মঙ্কফিশ মুন’ গল্পের নায়ক পিটার। শ্রীলঙ্কায় পিটার একজন সফল বিজনেসম্যান। যে-কোনো পরিস্থিতিতে বিজনেস স্ট্র্যাটেজি পাল্টাইয়া ফেলতে পারে সে। পিটার বুদ্ধিমান। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। পরিস্থিতি পিটাররে নাস্তানাবুদ করতে পারে না। দেশের ভিতর তামিল আর সিনহলিদের মধ্যে চলতে থাকা দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ অথবা প্যান্ডেমিক — কিছুই তার ব্যবসায় বাধা হইয়া দাঁড়াইতে পারে নাই। পিটার পলিটিক্যাল ফিগার না। কিন্তু ব্যবসাতে রাজনীতির ঘোড়ারে সে ভালোমতো ছুটাইতে পারে।
গুনেসেকেরার গল্পে শ্রীলঙ্কায় বিভিন্ন সময়ে ঘইটা যাওয়া অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে পিটারের লওয়া স্ট্র্যাটেজি নিয়া মোটেও কোনো আলোচনা নাই। শুধু দ্যাট পিটার ইজ টাফ অ্যান্ড হাইলি ক্যাপাবল, এইরকম এক নিরেট ইশারা আছে।
আমি মাঝেমধ্যে পিটাররে লইয়া ভাবি। প্যান্ডেমিকে কী ধরনের স্ট্র্যাটেজি নিয়া বিজনেস চালাইতো পিটার অথবা পলিটিক্সের কোন ল্যাঙ্গুয়েজরে সে আপহোল্ড করতো, মার্কেটাইজ করতো — গুনেসেকেরার মতো এইসবে আমারও তেমন আগ্রহ নাই, ডার্লিং। বরং আমার সমস্ত আগ্রহ পিটারের ওই নৈশব্দে। মনের অসুখে।
ক্যাপিটাল বা পলিটিক্সে মনের অসুখও একটা প্রোডাক্ট অথবা একটা ইস্যু। তোমার মনের ওই আতঙ্কটাও প্রোডাক্ট বা ইস্যুর বাইরে কিছু না এইখানে। অতএব কাবুলিওয়ালার হৃদয় দিয়া তুমি কি এরে বুঝতে পারবা, প্রিয়তমা? তবুও তোমারে ভালবাইসা এই টিলার শহরে — সন্ধ্যাবেলায় — ট্রাকের হেডলাইটে — সবকিছু গোপন করতে চাই। নাছোড়বান্দা আমি! আহ, বেহেস্তের শুকনা আঙ্গুর আমার …
গুনেসেকেরার পিটার থলথলে। বিশাল শরীর। দেখতে যেন নর্থইস্ট আটলান্টিকের দানব মাছ মঙ্কফিশের মতো। কিন্তু এই পূর্ণিমা রাতে পিটাররে দার্শনিকের মতো লাগে। মনে হয়, চাঁদের আলোয় ভাইসা যাইতেছে রহস্যময় এক সফেদ সন্ন্যাসী।
পিটারের বেদনার কথা ভাবি। তার নিঃসঙ্গতার কথা ভাবি। পিটার কি মৃত্যুহীন হইতে চায়? কোথায় আবে-হায়াত? বুড়া হইয়া যাইতেছে পিটার। আস্তে আস্তে ভারী হইয়া উঠতেছে সময় — অভিজ্ঞতার ভারে অথবা হারতে না পারার পরাজয়ে। পিটার, সিগিরিয়ার আনত পাথর বাইতে বাইতে এই মুখচোরা পূর্ণিমায় তোমার বিরহের তুমুল উৎসবে আমি…
মার্চ ২০২১
COMMENTS