প্যারা ৫ || শেখ লুৎফর

প্যারা ৫ || শেখ লুৎফর

বন্ধু তুই আতরের গন্ধ


যে-কোনো মানুষই আমার কাছে একটা আস্ত পৃথিবী। তাই লেখার মাঝে বারবার নতুন কিছু আবিষ্কারের চেষ্টা করি, জীবনকে নতুনভাবে পাঠ করি। চর্মচোখে যতটা দেখি তারচে অনেক বেশি দেখতে চেষ্টা করি মনের নয়নে। এই যুক্তিতে আমি যা দেখি তা লিখি। লেখা শেষ হলে পড়ে দেখি, আমি যা দেখেছিলাম শুধু তার খোলসটাই এসেছে। কিন্তু যা দেখতে চেয়েছিলাম তার প্রায় অর্ধেকটাই এসে গেছে। এই অর্ধেকটা কী?

মানুষটার মনের দ্বন্দ্ব, দাহ আর দীর্ঘশ্বাসগুলো পষ্ট শুনতে পাওয়ার মতো না-হওয়া তক লেখায় বারবার কাটাকুটি করি। হোক সেটা একটা ছোট্ট অনুচ্ছেদ।

আমি নিজেকে সাহিত্যিক ভাবি না। তাই আমি সাহিত্য রচনা করব বলে বিরাট দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে লেখতে বসি না। চব্বিশ ঘণ্টাই তো মনে-পরানে লেখালেখির ঘরকন্না করি। তবু সন্ধ্যাটা উতরে যেতেই আমি স্বল্পবাক হতে শুরু করি। বউ বলে আমি বাচাল। কিন্তু সন্ধ্যার পর কোনো-কোনোদিন তাকেই আমার বাচাল বলে মনে হয়।

খাওয়ার আগেই জ্বরের ঘোরের মতো একটা নেশা নেশা ঘোর শুরু হয়। মনের কষ্ট, ক্লান্তি নাই হয়ে যেতে থাকে। কম্পিউটারটা আমার দেহ-মনকে চুম্বকের মতো টানতে থাকে। তাই গপগপ করে গিলতে শুরু করলে বউ কপাল কুঁচকায়। মেয়ে বলে, — আব্বু আরেকটু আস্তে খাও।

একটা অতল ঘোর থেকে জেগে উঠলেও আমার ভিতরটা থামে না। সে মাকড়শার মতো একটু-একটু জাল বুনছেই। আমি হাত ধুতে ধুতে মন থেকে আরেকটা দিনের সব প্যারা ধুয়ে ফেলি।

লেখাটা আমার কাছে বুকের ক্ষতে মলম লাগানো কিংবা স্ত্রী সহবাসের মতো। এই নিয়েই আমি বেঁচে আছি। তাই সবচে বেশি আমার নিজেকে লিখি। লেখতে লেখতে নিজের দুঃস্থ-দুঃখী হৃদয়টা দেখি, বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজি।

এইসব খুঁতখুঁতানির জন্য আমার দরকারি মানুষটাকে বারবার দেখি। তার সিগারেট ধরাবার ভঙ্গি, পেশাব থেকে উঠে আরামে রোমাঞ্চিত হওয়ার সুখ, গালিতে শব্দের ব্যবহার কিংবা যখন আর পারে না তখন সে কীভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে শূন্যচোখে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে।

আজ বিকালে মাদরাসা বাজারের কমিউনিটি ক্লিনিকের সামনে আমরা চারজন বসেছিলাম। গ্রামটা পাহাড়ী ঢলে বছর বছর বন্যাতে ডুবে যায়। তাই উঁচু পিলারের উপর কমিউনিটি ক্লিনিকটার সামনের জায়গাটাও সিঁড়ির মাথায় বেশ উঁচু আর ছোট। তাই আমরা মাটির পৃথিবীর একটু উপরে, গোল হয়ে চাপাচাপি করে বসেছিলাম। এত চাপাচাপি যে আমার নাকে-মুখে ডবলমাস্ক থাকার পরও আমি তাদের ঘাম আর নিঃশ্বাসের গন্ধ পাচ্ছি।

আমাদের বন্ধুত্ব এ-বছর সতেরোতে পড়েছে। একজন কাঠমিস্ত্রি, একজন ভাঙাচোরা একটা চাখানার সাবেক মালিক। একজন নাম-কা-ওয়াস্তে একটা রিকশাগ্যারেজের মালিক। ত্রিশটা রিকশা থেকে কমতে কমতে এখন আটটায় এসে তার ভবতরী ঠেকে গেছে।

কাঠমিস্ত্রিটার রীতিমতো খাবার জোটে না। সে একটুও অলস কিংবা বোকা না। ছোটখাটো চেহারার ছিমছাম মানুষ; কথা বলে ভেবেচিন্তে এবং শিক্ষিত মানুষের মতো। তাই তাকে গ্রামের লোকজন ব্যারিস্টার ডাকে। আমরাও ডাকি। সে কাজে নিপুণ ও নিরলস তবু এই চার সন্তানের জনককে গড়ে বছরের অর্ধেকটা সময় বেকার থাকতে হয়।

অপরজনের নাম তালই। হালকা-পাতলা গড়নের লোকটা বেশ লম্বা। লম্বা আর বড় বড় দাঁতে মুখ ভরতি। তার ঝি-পুত মিলে পাঁচজনের সংসার। সরল বিশ্বাসী মানুষটা বরাবরই উদার। তাই ঠকতে ঠকতে প্রায় পথের ফকির। ঠিক এইমতো সময়ে তার ক্যান্সার ধরা পড়ে। আমি চাই সে আরো চল্লিশ বছর বেঁচে থাকুক। যেহেতু রোগটা ক্যান্সার তাই আমি যেন তাকে শেষবারের মতো দেখতে গেছি ছাতক শহরের উত্তরে, মাদরাসা বাজারে।

তাদের পরনের কাপড়চোপড়, মনের ভাব, মুখের হাসি ও ভাষায় কিন্তু রোগশোক-দারিদ্র্যের লক্ষণ খুব-একটা নাই। কারণ আমি জানি তারা গরিব হলেও মনের দিক থেকে মহাজন। বাউল ঘরানার চিন্তায় চালিত এই মানুষগুলাকে এইজন্যই ভালোবাসি।

ভাবছেন এদের সাথে আমার বন্ধুত্বটা আজব? আমার বউও বলে। এবং মাঝে মাঝে উছিলা পেলে আমাকে সে খোঁচা মেরে কথা বলে। আমি হাসি। শুধু নীরবে হাসি। বোকা আর ব্যর্থ মানুষের হাসিটাই সম্বল।

আমরা ক্যান্সারের রোগীকে সাথে নিয়ে আড্ডা দিচ্ছি। চুল-দাড়ি ঝরে পড়ার জন্য তাকে শিশুশিশু লাগছে। কিমোথেরাপির গুণে ফোলাফোলা গতরের চামড়াটাও শিশুর মতো নরম আর চিকন। আমার বুকের ভিতর একটা কঠিন কান্না একবার পাক দিয়ে উঠতে চায়। তবু আমি কথা বলার সময় মিটিমিটি হাসছি, সীমারের ছুরি মুখে গলা পেতে কারবালায় যেভাবে হোসেন হেসেছিলেন আজ তালইয়ের ঠোঁটেও সেইরকম একটা হাসি। হাসছে আজাদ আর ব্যারিস্টারও। কারণ আমাদের বয়স ও অভিজ্ঞায় জেনেছি, জীবন বড় বিচিত্র জিনিস। হাসি-কান্নার ধূলাবালি নিয়ে এখানে আমরা সবাই খেলা করি।

এই প্রথম আমি বুঝতে পারি, আমাদের মতো মানুষকে এইভাবেই কাঁদতে মানায়।

ডাক্তার তালইয়ের হাতে পরকালের টিকিট ধরিয়ে দিয়েছে। তবু আগের অভ্যাসমতো আমাদের ইহকালের আড্ডাটা একটা গম্ভীর অথচ চাপা আমোদের বাতাবরন পেয়ে গেছে।

আমাদের একপাশে শুকিয়ে-যাওয়া খালের বুকে সবুজ ঘাসের নরম গালিচা, যেটা এখন শেষ বিকালের খুশিতে রঙিন কাচের মতো চকচক করছে। অনেক নিচে, আমাদের সামনে খটখটা শুকনা বোরোক্ষেত। ধানগুলো থোর গলায় নিয়ে পানির অভাবে মরছে। মাথার উপর একটা বিশাল চাম্বল গাছ। গাছটা দারুণ! তবু আমি বেজার মনে হাওর অঞ্চলের গাছ খুঁজি : হিজল, তমাল, জারুল। একেবারে নিদেনপক্ষে একটা করচ গাছ মাথার উপর থাকলে আত্মাটা মায়ের শরীরের পরশ পায়। মা যদি বেঁচে থাকতেন তবে আমি নিশ্চিত যে, নেলকাটার দিয়ে তাঁর হাত-পায়ের শক্ত শক্ত নখ কেটে দিতে দিতে আব্দার করতাম, — তুমি নামাজ শেষে তালইয়ের জন্য খোদার কাছে একটু আয়ু চাও-না মা!

প্রথমে আমরা অনাবৃষ্টি ও হাওরের পোড়া ধান নিয়ে কথা বললাম। ফেহাজতে ইসলামের কথাও ফাঁকমতো একবার উঁকি মারতে চাইছিল দেখে আমি পাশ কাটাতে বলি, — দূর্বিণ শাহ-র শেষকালটা বড় কষ্টে গেছে।
ব্যারিস্টার বলল, — এইরকমই অয়।
আজাদ বলল, — রবীন্দ্রনাথের পুত রবীন্দ্রনাথ অয় না।
এইসব হাওয়ার মতো উঠল আর বাতাসের মতো মিলিয়ে গেল। আজ আলাপ বুঝি জমতে চায় না। এইটুকু ভাবতেই তালই বলে, — দূর্বিণ শাহ মেট্টিক পাশ আছিন।
আজাদ বলে, — ট্যাহার অভাবে দূর্বিণ শাহ বিনাচিকিৎসায় মরছিন।

তারপরে আমাদের আলাপ শেষ হয়ে যায়। কথা বলার মতো বিষয়ও খুঁজে পাই না। আমরা চারজন চুপচাপ বসে থাকি। আমরা যেন নীরবে পরস্পরের হৃদয় দেখি, দেখি তালইয়ের বিদীর্ণ-বিধুর বুকটাও। আমাদের মাথার অনেক উপরে একটা চিল বিরামহীন চক্কর দিতেছে। দূরে একটা অচেনা পাখি ডাকছে। সুরটা বড় করুণ! আমি মনে মনে ফিরে আসার কথা ভাবছি। এই শেষবেলায় পথ দিলেও ঘরে ফিরতে অন্তত রাত দশটা বাজবে। আরও দুই ঘণ্টা পরে রওনা দিলেও পথে যানবাহন মিলবে এই কথা ভেবে আমি উদাসভাবে বসে থাকি। এইসময় তালই আমার দুই হাত চেপে ধরে, — ভুলটুল ক্ষমা কৈর…।

আমি আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দুইহাতে তার হাতদুটো শক্ত করে চেপে ধরি, — দিবার ব্যবস্থা থাকলে তরে আমি আমার অর্ধেকটা আয়ু দ্যায়া দিতাম।
তালই হাসে। সেই হাসি শিশুর মতো নিষ্পাপ। আমি মনে মনে ভাবি, — আমাদের মতো মানুষদের কেউ কেউ মৃত্যুর মাঝে আছান খোঁজে।
তালই আমার কথায় জোরে হেসে ওঠে। তার মুখের বড় বড় দাঁতগুলা সব বেরিয়ে আসে। তালইয়ের এইরকম বেমানান দাঁত দেখতে এখন আমার একটুও খারাপ লাগছে না। আগেও লেগেছে কি না মনে করতে পারছি না। তালইকে ছাড়া যদি আমরা ভবিষ্যতে আড্ডাতে বসি তবে তার শান্ত, সরল আর বন্ধুপ্রিয় হাসিটা আমার মনে পড়বেই।

ফিরে আসবার সময় আমি তালইকে একটু বেশি জোরে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরেছিলাম। আগে তার গতর থেকে ঘামের গন্ধ পেলেও আজ পেলাম দামি আতরের মতো হাল্কা একটা সুঘ্রাণ। এই আতর পৃথিবীবিখ্যাত কোনো কোম্পানি না বানালেও আমাদের চারজনের বুকে গত সতেরো বছর ধরে সুবাস ছড়াচ্ছে।

ইসহাকপুর / ২৭.০৩.২০২১


প্যারা ৪

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you