হারাম হালাল গানের ভাসান : পলাশ নুর ও আলী হাসান || আহমদ মিনহাজ

হারাম হালাল গানের ভাসান : পলাশ নুর ও আলী হাসান || আহমদ মিনহাজ

দ্রুতলয়ের বাংলা গানে নতুন মাত্রা যোগ করা আলী হাসানের হারাম-হালাল বিষয়ক কথাবার্তার জের ধরে নেটপাড়ায় হইচই হচ্ছে বেশ। আরজে কিবরিয়ার সঙ্গে সওয়াল-জওয়াবের চাপান-উতোরে হাসান রাখঢাক না করে বলেছেন :

গান-বাজনার টাকা হারাম। এত হাদিস চলবে না। যেটা হারাম, হারামই। আমার অটো বিজনেসের টাকা হালাল। সংগীত থেকে আয় হচ্ছে হারাম। এজন্য ব্যবসার টাকায় (হালাল আয়) বাজার-সদায় করি, আর মিডিয়ার টাকায় (হারাম আয়) বিল্ডিং তৈরি করি। মিলাই-ঝিলাই করতেছি।

গায়কের সরল ও সদম্ভে  জাহির করা কথাগুলো স্ববিরোধী সন্দেহ নেই। এখন এর কার্যকারণ ঠার করতে জনমনে ইসলামি আচার-বিশ্বাসের প্রভাব আমলে নেওয়া প্রয়োজন। ইসলাম ধর্মের সাংস্কৃতিক বয়ান গড়ে ওঠার ধাতটি নিজ গুণে প্রাসঙ্গিক সেখানে। ইসলামভীতির চিরাচরিত বাতিকে অটল থেকে কি আর এসব আলাপ সম্ভব? দুইহাজার চব্বিশ চলে এখন। আমরা কেউ বিগত শতকে পড়ে নেই যে মুখস্থ বুলির ওপর ভর দিয়ে নিজেকে প্রগতির ঝাণ্ডাবাহক ভেবে ফাল পাড়ব। নতুন শতকে পা রাখার আগে এসব কমবেশি বাজার পেয়েছে কিন্তু গত দুই দশক ধরে সিনারি বদলাতে দেখছি হামেশা।

গানবাজনাকে যদি হারাম জানেন তাহলে কেন করছেন? এরকম প্রশ্নের উত্তরে স্ববিরোধী বক্তব্য আলী হাসান একা দিচ্ছেন এমন নয়। ওয়ারফেজ  ব্যান্ডের লিড ভোকালিস্ট পলাশের মধ্যে একই প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি। আপাদমস্তক সজ্জন পলাশ অকপটে জানাচ্ছেন, গানবাজনা তিনি অন্যলোকের জন্য করেন। তাঁর মন মসজিদে পড়ে থাকে। গোটা জীবন মসজিদে আজান দিয়ে পার করতে পারলে ঢের সুখী বোধ করতেন…ইত্যাদি। যমুনা টিভিতে সম্প্রচারিত ছুটির রাতের গানআড্ডায় দিব্যি সাবলীল পলাশের সঙ্গে মসজিদে আজান দিতে আকুল পলাশকে এযাত্রা মিলানো কঠিন। গায়ক ও মুয়াজ্জিন সত্তার দড়ি টানাটানি তাঁকে কুরে-কুরে খাচ্ছে সেটি আন্দাজ করতে কারো বেগ পাওয়ার কথা নয়।

ক্যাট স্টিভেন্সের মতো গানবাজনায় একপ্রকার ইতি টেনে কিংবা পরে দীন প্রচারের মিশনে একে কাজে লাগানোর ভাবনায় পলাশ এখনো পৌঁছাতে পারেননি। মনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছে। দোটানায় খাবি খাচ্ছেন বেশ! জীববিজ্ঞানী জেরেমি গ্রিফিথের ভাষায় বলতে হয়, কুড়ি লক্ষ বছর ধরে মানবপ্রজাতির সচেতনসত্তায় সক্রিয় মনোবৈকল্য  বা Psychological Upset অদ্য ওয়ারফেজ  ব্যান্ডের নবীন গায়কের ওপর চড়াও হয়েছে। তাঁকে শাসন করছে নিয়মমাফিক। ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীর জন্য গানবাজনা হারাম জেনেও চালিয়ে যাচ্ছেন। কেন যাচ্ছেন? প্রশ্নটি তাঁকে জ্বালিয়ে মারছে। দীনপাবন্দ সত্তার সঙ্গে গানপাবন্দ সত্তার জবরদস্ত দোটানায় স্ববিরোধী কথাবার্তা মুখ ফসকে বেরিয়ে আসছে হুটহাট। এখন এর জন্য বেচারাকে গালাগাল করে কী ফায়দা সেটি মাথায় ঢুকছে না!

দীনপাবন্দ ও গানপাবন্দ সত্তা থেকে একজনকে বেছে নেওয়ার পয়লা কদমে নিজেকে দুটি ভাগে পৃথক করে দেখছেন পলাশ। গায়কসত্তাটি হচ্ছে অপর  আর আজান দিতে আকুল সত্তা তাঁর নিজবিবেচনায় প্রকৃত  বা ইসলামানুগ। ইসলামি পরিভাষায় গায়কসত্তাকে পলাশের নফসমধ্যে প্রবিষ্ট খন্নাস  ভাবা যেতে পারে। খন্নাসটি চড়া লয়ের বাদ্যবাজনায় তাঁকে জব্দ রেখেছে। গায়ক পরিচয়ে মানুষকে বিনোদিত ও ইসলামের জন্য প্রতিকূল সমাজে করে খাওয়ার সুযোগ দিচ্ছে। গানবাজনায় এভাবে পড়ে থাকা তাঁর জন্য স্বস্তিকর এমন নয়। হারাম-হালাল দ্বন্দ্বে জেরবার শিল্পী হয়তো মনে-মনে ভাবছেন, গানবাজনার মতো হারাম কাজে লিপ্ত সত্তা তাঁর প্রকৃত সত্তাকে ঠুনকো করে দিয়েছে। অপরসত্তা  হিসেবে তাকে পৃথক ভাবতে না পারলে খন্নাসটান  থেকে ইহজীবনে রেহাই মিলবে না।

ব্যাখ্যাটি কানে উদ্ভট শোনাতে পারে কিন্তু হাদিসশাসিত ইসলামের সমাজপ্রভাব আমলে নিলে মানতে হবে, আলী হাসান ও পলাশের মতো গায়করা ইহকালের জীবন পুরোমাত্রায় উপভোগ করলেও তাঁদের মনোজগতে এর অভিঘাত প্রবল নয়। দেহ গত হলে সব শূন্য বা নিরাকারে বিলীন হওয়ার থিয়োরিতে দুজনের আস্থা নেই। উক্ত বিষয়ে তাঁদেরকে কনভিন্স  করা কঠিন। বিকল্প ভাবতে বসে মরণ পরবর্তী জগতে সত্তার পুনরুত্থান ও যাপনে নিজ ইমান তাঁরা গচ্ছিত রেখেছেন। ইসলামি পরিভাষায় একে ইহকাল বা দুনিয়াবির অবসান এবং এর জের ধরে আখিরাত ও পরকালের শুরুয়াত নামে সকলে জানেন। মরণে সবকিছুর অন্ত ঘটছে না। সময় হলে পরকালে তাঁরা সক্রিয় হবেন। ইহকাল ও পরকালের যিনি রূপকার তাঁর কাছে পাপপুণ্যের হিসাব ও জবাবদিহি করতে হবে। মাপের দাড়িপাল্লায় নেকির ওজন বেশি হলে জান্নাতে যাবেন। ওজনে কম হলে জাহান্নামে গমন ছাড়া উপায় থাকছে না। অনেকে আবার জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যবর্তী পরিসর আরা’ফ-এ লটকে থাকবেন। জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি পাওয়ার আশায় কাটবে দিন। মনের ওপর চাপ তৈরিতে এটুকু বিবরণ বোধ করি যথেষ্ট!

ফ্যান্টাসিসমান বয়ানটি প্রমাণ-অপ্রমাণ ছাপিয়ে যুগ-যুগান্তর ধরে মানবমনে রাজ করছে। তাকে সত্য প্রমাণ করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে মিথ্যা ভেবে খারিজ করা সমান দুরূহ। স্রষ্টা ও সৃষ্টি বিষয়ক নিযুত মাথাধরানো ক্যাচাল এই সাক্ষ্যই দিচ্ছে। ক্যাচালে জড়াতে অনিচ্ছুক আলী হাসান ও পলাশের জীবনে অতিকল্পনায় রঙিন বয়ানের প্রাসঙ্গিকতা তাই অমলিন। পরকালের সুখ ভোগ করতে হলে ইহকালে মানবজাতির কর্তব্য কেমন হওয়া উচিত? উত্তর পাওয়ার আশায় যে-ব্যক্তি কোরান-হাদিস নির্ভর ইসলামি শাস্ত্রের বিধান শর্তহীন মেনে নিলেন তার কাছে হারাম-হালালের মামলা কোনো মজাক নয়। এর একজরাতা  বরখেলাপ তাকে ধর্মসংকটের খাদে নিক্ষেপ করতে পারে। তিনি কি হারাম খাবেন অথবা হারামের ফাঁস কেটে বেরিয়ে আসবেন…ইত্যাদির ফয়সালা সেখানে গুরুত্ব রাখে। পলাশ ও আলী হাসান নিজ দায়িত্বে চাপটি ঘাড়ে নিয়েছেন। গানবাজনা চালিয়ে যাওয়ার মামলায় ধর্মসংকট কাজেই সাপ হয়ে তাঁদেরকে দংশন করছে। একটি সিদ্ধান্তে স্থির হওয়া ছাড়া বৈকল্য থেকে মুক্তি নেই দুজনের। আলী হাসানের তুলনায় পলাশের কেসটি এখানে অধিক জটিল। হাসান হয়তো সহসা গানবাজনায় ইস্তফা দিয়ে অটো ব্যবসায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করবেন। দীনের রাস্তা খুঁজে নেবেন যথাবিহিত। গানবাজনার ব্যাপক পরিসরে সম্পৃক্ত পলাশের সুশীল মনের পক্ষে দীনপাবন্দির বেদিতে রাতারাতি গায়কসত্তার বলিদান মনে হচ্ছে না অনায়াস হবে।

শিল্পীযুগলের ওপর চড়াও বৈকল্য, জেরেমি গ্রিফিথের ভাষায় Psychological Upset, এটি কিন্তু তিন-চার দশক আগে গানবাজনায় লিপ্ত লোকজনকে নিয়ে দেশের সোজাসরল মানুষের মনে যেসব প্রহিবিশন  কাজ করত, তার সঙ্গে একে মিলানো যাবে না। দুজনের বৈকল্যপ্রসূত কথাবার্তায় হালফিল ইসলামি বয়ানকে ছায়া বিস্তার করতে দেখছি। বয়ানগুলোর সত্যমিথ্যা যাচাইয়ের ভাবনায় যদিও তাঁদেরকে উতলা মনে হয়নি। কাজটি কঠিন। বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশে ইসলামচর্চার ধাঁচ, বিশেষ করে ওয়াজবাহিত বয়ানে তার যে-স্বরূপ দেখতে পাই, একে এখন তলিয়ে দেখার ভাবনা কারো মনে উঁকি দিলে সমূহ বিপদ! কোরান-হাদিসকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিচিত্র পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যায় বেচারাকে রাতদিন পড়ে থাকতে হবে। যে-পরিমাণ ঘাঁটাঘাঁটি করা লাগবে তার মানসিক চাপ কিন্তু বিরাট! ধৈর্যে অটল না হলে সামলানো শক্ত কাজ! কাণ্ডজ্ঞান ও অনুধ্যানের শক্তি থাকলেই হচ্ছে না, প্রাতিষ্ঠানিক ইসলাম যদি দেখে ওই ব্যক্তির ইসলাম বিষয়ক ব্যাখ্যা তার মতের সঙ্গে মিলছে না তাহলে একশো উপায়ে একে জেরায় জর্জরিত করবে। লঙ্কাকাণ্ড শেষে দেখা যাবে দ্বন্দ্বে পেরেশান মন সঠিক নোঙর খুঁজে পায়নি! জ্ঞানের পথে ধর্মসংকটের সুরাহা সদা অনিশ্চিত। সকলের জন্য নয়। হাতে গোনা দু-চারজন হয়তো এই পথে লেগে থাকার হ্যাডম রাখেন।

বাংলা গানের নবীন দুই তুর্কি সংগত কারণে শর্টকাট নিয়েছেন। ধর্মসংকটের সুরাহায় ইসলামের বাজারকাটতি সংস্করণকে আপনা করেছেন দুজন। নিজের ইমানকে যেসব বয়ানের হাতে তাঁরা জিম্মি হতে দিয়েছেন সেগুলো কোরান-হাদিসকে ঘিরে আবর্তিত ইসলামি শাস্ত্রের খোলস নিয়ে পড়ে থাকে। এর গভীরে শায়িত আত্মাকে কদাপি আমলে নেয় না। আচারনিষ্ঠ এক দীনের ছবি বিশ্বাসীর মানসপটে তারা জাগিয়ে তোলে। প্রকৃত ইমানদারের জন্য জরুরি আধ্যাত্মিক নির্যাসের মাধুর্য যেখানে খুঁজে পাওয়ার নয়! স্মরণ রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশের আনাচ-কানাচে বছরে তিনশো পঁয়ষট্টি দিন বাজতে থাকা ওয়াজি হুজুরদের বয়ানকৌশল এই একটি কারণদোষে সদা হিংস্র হয়ে থাকে। ভীতিকর দণ্ড বিধানে তৎপর স্রষ্টার ভয়াল ছবি বিশ্বাসীর মনে অকাট্য করার খেলাটি পুরাতন হলেও সময়ের পালাবদলে তাতে অবিরত নতুন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে। কারো যদি প্রখর কাণ্ডজ্ঞান থাকে অথবা সোজাসরল অজ্ঞতাকে হাতিয়ার করতে পারে তাহলে কেবল এর ফাঁদ তার পক্ষে এড়ানো সম্ভব। পলাশ ও আলী হাসানকে মারণাস্ত্র দুটির ব্যাপারে সচেতন মনে হয়নি।

ইসলামে গানবাজনা কি খোদাবন্দ সত্যি হারাম করেছেন? গানবাজনায় মজে থাকার দোষে ইমান কি হালকা হয়ে যায়? প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার মামলায় দুজনের কাণ্ডজ্ঞানে ঘাটতি চোখে পড়ছে। হারাম-হালালের দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তির উপায় ইসলামে সচরাচর দুভাবে ঘটে থাকে। এক, কোরানের ওপর গভীর জ্ঞান ও তার তফসিরকে কাণ্ডজ্ঞানসহ উপলব্ধি করা। দুই, স্রষ্টা এবং প্রেরিত পুরুষদের সঙ্গে মানব প্রজাতিসহ ব্রহ্মাণ্ডের নিগূঢ় সম্পর্ক গভীর কল্পানুভূতির সাহায্যে অবলোকন। ইসলামে রুহানিয়াত ও নফস পৃথক দুই আধার হলেও তাদের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে। ইসলামবিশ্বাসী ব্যক্তি কোন রাহায় গমন করে রুহের প্রকৃতি চিনবেন ও রুহানুগ করতে নফসকে তলব করবেন ইত্যাদির ওপর তার ইমান-আকিদা নির্ভর করে। শরিয়তের রাস্তায় তলব করলে এর স্বরূপ একভাবে ধরা পড়বে। মারফতের রাহায় গমন করলে উক্ত শরিয়ত অন্য চেহারায় ধরা দেবে চেতনায়। ইসলামি দীন আমলের ইতিহাস বলছে আমাদের সমাজে দুটি ধারা কমবেশি প্রভাববিস্তারী ছিল। ঐতিহাসিক সুবাদে পাওয়া স্থানিক সংস্কৃতির বিচিত্র তরঙ্গে তার অবগাহন ও সন্ধি মোটের ওপর বহাল থেকেছে সদা। বিদআতের দোহাই দিয়ে স্থানিক সংস্কৃতির অনেক অভ্যাসকে আঘাত করলেও এর সঙ্গে সহাবস্থান তাকে মেনে নিতে হয়েছে। জনমনে তখনকার হারাম-হালাল বিষয়ক দ্বন্দ্বের প্রকৃতি যারপরনাই সরল ও নির্বিষ ছিল। পরিবেশটি এখন আর বেঁচে নেই। দেশের মুসলমানসমাজে ওহাবি প্রভাব গভীর হওয়ার ফলে স্থানিক সংস্কৃতির শত উপাচারের সঙ্গে ইসলামি আচার-বিশ্বাসের সংঘাত জটিল বহুকৌণিক মোড় নিয়েছে। হাই ফিভার বললে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না। পলাশ ও আলী হাসানরা হয় স্বেচ্ছায় নয়তো অজ্ঞাতসারে এই সংঘাতজ্বরে ভুগছেন এখন।

দুনিয়া ও আখিরাতের আন্তঃসম্পর্ক ওহাবি কনটেক্সট আমলে নিলে নতুন মনে হবে। এর বীজ ইংরেজ আমলে পোঁতা হলেও গতি সম্প্রতি দুর্নিবার হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে কোনো জনগোষ্ঠী স্থানিক সংস্কৃতিদেহে নিজেকে একীভূত করে সাবালক হয়। বালেগ হওয়ার পথে ইসলামি আকিদা ও তার সাংস্কৃতিক বয়ান প্রসূত আদব বা শিষ্টাচারকে সঙ্গী করতে ভোলে না। সোজা কথায় সংমিশ্রণে বিচরণের মধ্য দিয়ে তার মানস তৈরি হয়, সাংস্কৃতিক বোধ গড়ে ওঠে। এহেন সংমিশ্রণকে এলাউ করার প্রশ্নে ওহাবি ভাবাদর্শ কট্টরপন্থী। ইসলামের বাইরে দ্বিতীয় কোনো সাংস্কৃতিক প্রপঞ্চকে সন্দেহের চোখে নিরিখ করে সে। সংমিশ্রণকে উদারচিত্তে মেনে নেওয়া তার পক্ষে শক্ত কাজ। আলী হাসান ও পলাশের মতো শিল্পীদের ধর্মবিশ্বাসে এর ছাপ গভীর হতে চলেছে।

সুন্নিপাবন্দ মাজহাবনিষ্ঠ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত, কওমি-দেওবন্দির শরিয়ত চর্চার তরিকা আর সুফি সিলসিলায় কেন্দ্রীভূত মাজার কেন্দ্রিক ইসলামচর্চা নিয়ে ওহাবির আপত্তি ও সোচ্চার বিরোধিতা একই কারণফেরে ঘটছে। নবির শানে মিলাদ, মাজার জিয়ারত, শবেবরাত, মৃতের সদগতি কামনায় শিরনির মতো লোকপ্রিয় আচারকে ইসলামের দৃষ্টিতে কেন বিদআত বলা যাবে না ইত্যাদি ফেরকায় বাকিদের সঙ্গে তার মতান্তর দেশের মুসলমানসমাজে ইসলামচর্চার ভীত যথেষ্ট নড়বড়ে করে দিয়েছে। ইমান মজবুত রাখতে আচারগুলো বর্জনের প্রবণতা ব্যাপক হতে দেখছি। স্থানিক সংস্কৃতিতে একীভূত ঐতিহাসিক ইসলামচর্চা ওহাবিঝড়ে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ায় মুসলমানসমাজের নৈতিক আপত্তি ও প্রতিক্রিয়া জানানোর ধাত অতীত দিনের মতো নমনীয় নেই। গত দুই দশকে ছবি পাল্টেছে।

ইসলামের পটভূমি বিবেচনায় ওহাবি ভাবাদর্শের উদর থেকে বেরিয়ে আসা বয়ানকে অযৌক্তিক ভাবা কঠিন। মানে অবশ্য এই নয় ওহাবিপন্থা সাক্ষাৎ আচারবিরোধী। বিদআত নামে যেসব আচার-বিচারে তার আপত্তি রয়েছে সেগুলোর ক্ষতি পুষিয়ে দিতে আরব সংস্কৃতিদেহে অবিচ্ছেদ্য জীবনাচারকে দেশের মাটিতে সে বপণ করছে। স্থানিক সংস্কৃতিতে পল্লবিত ইসলামচর্চায় অভ্যস্ত মুসলমানকে কোরান-হাদিসের দোহাই দিয়ে ডমিনেট করার তরিকা সেক্ষেত্রে যথেষ্ট অভিনব। দেখে মনে হবে, দেশের মুসলমানসমাজ যেসব আচার-উৎসবে নিজেকে একীভূত ভাবতেন তার সবটাই বিদআত। এগুলোকে যদি নির্মূল করা যায় তাহলে প্রকৃত ইসলামে তারা ফেরত যেতে পারবেন। পুঁজিবাদের মতো ওহাবি ভাবাদর্শ প্রকারান্তরে প্রভাববিস্তারী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রতীক। পলাশরা বিষয়টি ঠার করতে ব্যর্থ অথবা আমলে নিতে অনিচ্ছুক।

আধ্যাত্মিক স্ফুরণ ওহাবি ভাবাদর্শের লক্ষ্য নয়, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মুখ্য সেখানে। এমন এক আগ্রাসন যেটি কিনা দুনিয়াবি ও আখিরাতে সহাবস্থান তৈরির বাহানায় ইসলামি দীন আমলে উতলা লোকজনকে বেনিফিট অব ডাউট পাইয়ে দিতে অবদান রাখছে। কীভাবে? বিষয়টি উপলব্ধির খাতিরে শায়খ আহমাদুল্লাহর ওয়াজগুলোর দিকে একবার তাকানো যেতে পারে। ওয়াজে উনি লোকজনের বিচিত্র প্রশ্নের ঝটপট আনসার দিয়ে থাকেন। এরকম এক ওয়াজে মন্দ বা অসৎ কাজে লিপ্ত লোকের ইবাদত-বন্দেগি আল্লাহ কবুল করবেন কিনা এই প্রশ্নটি কেউ একজন হুজুর বরাবরে পেশ করেছিলেন। প্রশ্নের উত্তরে হুজুর রায় দিলেন, তার মন্দ কাজের হিসাব মন্দ কাজের জায়গায় লেখা থাকবে। ইবাদতের হিসাব ইবাদতে যাবে। সোজাসরল মানে দাঁড়াচ্ছে, আকাম-কুকাম করলেও বেনিজির-মতিউরদের মতো লোকের ইবাদত বৃথা যাবে না। খোদা তাদের ইবাদত-বন্দেগি ও দানখয়রাতকে আমলে নেবেন।

আহমাদুল্লাহ হুজুরের বয়ান হাদিসশাসিত ইসলাম বিবেচনায় অবশ্যই খেলো নয় কিন্তু জনমানসে বদ্ধমূল ধারণার সঙ্গে যুক্তিটি সাংঘর্ষিক। ঘুষ-চুরি-বাটপারি-রাহাজানির মতো কাজে অবিকারচিত্তে লিপ্ত ব্যক্তির ইবাদত-বন্দেগি ও খোদার শানে মাফ চাওয়া নিস্ফল গণ্য হওয়া স্বাভাবিক। এসব কাজের মধ্য দিয়ে খোদাসৃষ্ট ইনসানকে সে কষ্ট দিচ্ছে। দুর্ভোগ ও অবিচার সইতে বাধ্য করছে। ইবাদত নামক প্যারামিটারের বিনিময়ে এইসব লোকজনকে হুজুর এখন বেনিফিট অব ডাউট পাইয়ে দিচ্ছেন। মন্দ কাজে বহাল থাকা অথবা পুনরাবৃত্তির ব্যাপারে জনমানসে নৈতিক আপত্তির তীব্রতা এই সুবাদে কমজোর হয়ে পড়ছে। আহমাদুল্লাহর মতো হুজুরদের প্রভাব সমাজে গভীর ক্রমশ। আলী হাসানদের মনে চাউর ধর্মসংকট ও স্ববিরোধী স্টান্ট গ্রহণের নেপথ্যে উনাদের দৃশ্যত কোনো ভূমিকা নেই এমনটি বোধহয় হলফ করে বলা কঠিন।

হারাম-হালাল প্রশ্নে ওহাবি হয়তো বলবেন, গান করতে পারো তবে ইবাদত-বন্দেগির নৈতিক দায় বহন করতে হবে। নফসকে তুমি বশে রাখতে পারোনি। কী আর করা যাবে বলো, গাইতে থাকো এই মন নিয়ে যে তুমি হারাম খাচ্ছো, সেইসঙ্গে আল্লাহর কাছে মাফ চাও আর ইবাদতে লেগে থাকো। পাপের ভার তাতে কমবে না কিন্তু কিছুটা হালকা হবে। হারামচক্র থেকে বেরিয়ে আসার ইমানি মনোবল জাগবে একদিন। পলাশ ও আলী হাসান, আমি নিশ্চিত, এরকম বয়ান-প্রভাবে গানবাজনা আপাতত চালিয়ে নিচ্ছেন। সময় বুঝে ছেড়ে দিবেন। ছাড়তে যদি না পারেন তাহলে খালি গলায় ইসলামি হামদ-নাত গাইবেন দুজন।

সুন্নি মাজহাব আর মাজার কেন্দ্রিক ইসলামি আচার যাপনে অভ্যস্ত বাংলাদেশের মুসলমানসমাজে হারাম-হালাল দ্বন্দ্ব ওহাবিপ্রভাবে নুতন মোড় নিয়েছে। তারা বহুকৌণিক। যুগপ্রাসঙ্গিক। বাকিরা মোটের ওপর সরলরৈখিক। প্রাগৈতিহাসিক বললে ভুল হয় না। উনাদের বয়ানে সুদ, মদ্যপান, গানবাজনা ইত্যাদি হারাম মানে তো সাফ-সাফ হারাম। বড়োজোর খালি গলায় খোদা ও নবি বন্দেগি চলতে পারে…তার বেশি নয়। যুগের চাল মাথায় রেখে ওহাবিরা বেনিফিট অব ডাউটের পরিসরটি সেখানে সুকৌশলে জিইয়ে রাখছেন। উভয় পক্ষ কোরান-হাদিসকে সাক্ষী মানলেও ব্যাখ্যার তরিকা ভিন্ন। বিশ্বাসীভেদে ইফেক্ট পৃথক। বাংলাদেশের সমাজ ও কায়েনিয়াত ইসলামে একীভূত হওয়ার নাম করে দল-উপদলে বিভক্ত। গ্রাম থেকে শহর সর্বত্র একই সিনারিও। পলাশ বা আলী হাসানদের স্ববিরোধকে যারা উপহাস করলেন তারা এদিকটা ভেবে দেখেননি। ইসলামে সক্রিয় সরলরৈখিক ও বহুকৌণিক ভাবাদর্শ থেকে সৃষ্ট বয়ানগুলোর সাংঘর্ষিক অবস্থান দেশের মুসলমানসমাজে একদা জীবিত সহনশীল মনোভাব সম্পূর্ণ বিনষ্ট করে দিয়েছে। পলাশ বা হাসান সেখানে ভিনগ্রহের কোনো জীব নয়। তাঁদের হালত এই নিরিখে ভেবে দেখা ও বৈকল্যেদোষের কার্যকারণগুলো আপামর সাধারণের নজরে আনা যেত বোধ করি।


ইতরবিশেষ বাদ দিলে আলী হাসানদের মতো সরল বিশ্বাসীর মনে পাপবোধ আর হাবিয়া দোজখে জ্বলেপুড়ে ছারখার হওয়ার ভীতি আগের চেয়ে গভীর। নিকট অতীতে আমরা একে উপেক্ষা করেছি। হুজুরকুল প্রণীত ভীতি জাগানিয়া বয়ানকে নসিহত নামের খাউজানি ভেবে রঙ্গরস করতে বুক কাঁপেনি। আলী হাসানদের যুগবিশ্ব ভিন্ন। খাউজানিকে এখন কালচার বা সাংস্কৃতিক অভিঘাতে মোড় নিতে দেখছি। বাংলাদেশে মুসলমানসমাজ ইসলামি সংস্কৃতির নামে কীসে একীভূত হতে চাইছেন এই প্রশ্নটি যেখানে উঠানো প্রয়োজন। ইসলামি আচার-বিশ্বাস ও সংস্কৃতির বাহানায় আরব জাতীয়তাবাদে দেশের মুসলমান সমাজ অবগাহন করতে মরিয়া কিনা তার ময়নাতদন্ত জরুরি।

সাম্প্রতিক নজির থেকে পরিষ্কার, দেশের মুসলমানমাজ ইসলামি আচার-বিশ্বাসে একীভূত হওয়ার নাম করে আরব কালচারে নিজেদের শহিদ করতে চলেছেন। আরব জাতীয়তাবাদের বাতিল ভাবধারায় মাথা মোড়ানোর রাজনৈতিক মিশনকে যেটি এগিয়ে নিতে সাহায্য করছে। খোদ আরববিশ্ব এই ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে প্রাণিপাত করলেও আমাদের এখানে তার বীজ পোঁতার পাঁয়তারা খতম করা যাচ্ছে না। ঘটনাটি মিশরে একদা ঘটেছিল, যার সঙ্গে সেখানকার ইসলামপন্থী ও প্রগতিপন্থীর বিরোধ আজতক হ্রাস পায়নি। আলী হাসান ও পলাশমনে সক্রিয় বৈকল্যের সুলুক করতে এগুলোকে বিবেচনায় রাখার সময় নজদিক মনে হচ্ছে।

পরিষ্কার শিরক অথবা বিদআত যদি না হয় সেক্ষেত্রে স্থানিক সংস্কৃতির সঙ্গে ইসলামি আচার-বিশ্বাসের বিরোধ নেই। তাকে প্রতিহত করার চেষ্টা বরং ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে। খোদা যে-অপার বৈচিত্র্য ও ভিন্নতাকে অনুমোদন করলেন তাকে সে তখন অস্বীকার করে;—শরিয়তনিষ্ঠ দীনপ্রচারক নোমান আলী খান সম্প্রতি কথাগুলো স্পষ্ট করলেও পলাশদের যারা দুষছেন তারা এই বক্তব্যকে আমলে নেওয়ার জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। প্রতিপক্ষের কথা অনেকসময় মারণাস্ত্র হতে পারে;—বোধটাই সেখানে মিসিং! বাংলাদেশে যারা নিজেকে প্রগতির ঠিকাদার ভাবেন তাদের এ্যাক্টিভিজমকে যে-কারণে ধর্মভীতির (মতান্তরে ইসলামভীতি) পশ্চিমা সংস্করণের নকলি ছাড়া দ্বিতীয় কিছু গণ্য করা কঠিন হয়।

আমাদের ভাবা উচিত, সমস্যাটি ব্যক্তি আলী হাসান অথবা পলাশের নয়। সমাজে গভীর শিকড় ছড়ানো একরাশ পরস্পরবিরোধী ভাবাদর্শে বিচরণে বাধ্য এক আলী হাসান হারাম-হালাল বিষয়ে নিজের অবস্থান ক্লিয়ার করছেন এখানে। ইসলাম স্বয়ং ওইসব ভাবাদর্শের কোপে খণ্ডবিখণ্ড প্রপঞ্চ মাত্র! হারাম-হালাল দূরে থাক, কোরান-এ গানবাজনা নিয়ে একটি বাক্য খর্চা করা হয়নি। পরস্পরবিরোধী একগুচ্ছ হাদিসের ওপর মুসলমানের ইমান-আকিদাকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বাস ও আচারের যুগলবন্দি স্বরূপ হাদিসশাস্ত্রে গমন করলে মিলছে। নবিকে দোহাই মেনে দুনিয়া ও আখিরাতের রূপরেখা এঁকেছেন হাদিস সংকলক। দুনিয়াবির সঙ্গে আখিরাতের ভারসাম্য বজায় রাখাকে অমোঘ করে তোলা হয়েছে। মুসলমানের জন্য কোনটা বৈধ আর কী অবৈধ তার সলিড বয়ান কিচ্ছার আদলে সাজানো। গানবাজনাকে আরো অনেককিছুর সঙ্গে এই ছকে হারাম-হালালের গোত্রে গড় করা হয়েছিল। ইসলামবীক্ষণে এসব নিয়ে সবিস্তার লিখেছি, কাজেই কথা বাড়াচ্ছি না।

কোরানের আয়াত যদি ব্যক্তি-অবধানের বিষয় হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে ব্যক্তিভেদে তার হাজার ব্যাখ্যা দাঁড়াবে। হাদিস হাতে নিলে সম্ভাবনাটি কমে আসে। পরস্পবিরোধী নজির সেখানেও থাকছে কিন্তু মোটাদাগে কিচ্ছার আদলে প্রণীত হাদিসশাস্ত্র নবির জীবনাচারকে ডমিনেট করে ক্ষান্ত হয়নি, তার সঙ্গে কোরানকেও ডমিনেট করছে। ইসলামকে কীভাবে আমল করতে হবে, কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক, কোনটা করলে কী হবে অর্থাৎ একাধারে ব্যক্তি ও সমাজের করণীয় বলে দিচ্ছে অকপট। ধর্মব্যবসায়ীর তাতে সুবিধাই হয়েছে। ব্যক্তি ও সমাজকে একছকে গড় করার মওকা তারা ছাড়তে যাবে কোন দুঃখে? আলী হাসানরা যুগ-যুগ ধরে যার করুণ শিকার। তাকে কে বলবে,—ভাইডি, হাদিসনির্ভর ইসলামের প্যারামিটার হিসেবে কোরান তার আসন হারিয়েছে। হাদিসকে প্যারামিটার করতে একুনে হাজার বছর ধরে কোরানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এক-একটি ইসলামি ভাবধারায় মুসলমানের মগজধোলাই আজো চলছে। ইসলামি জীবনাচার ও সংস্কৃতির বনেদ নামে প্রতিষ্ঠা দানের কাজটিও মহাসমারোহে সম্পন্ন হয়েছে হাজারবর্ষী যাত্রায়!

কোরান নয় বরং কোরানের একশো পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যা নির্ধারণ করছে কেন একজন আলী হাসানকে বলতে হবে, অটোর ব্যবসা থেকে রোজগার করা টাকায় পেট চালাই আর গানবাজনায় পাওয়া হারাম টাকা দিয়ে বিল্ডিং খিঁচি। সারল্য ও সততায় অতুলনীয় এই স্টান্ট  লোকদেখানো ইমান জাহিরে মরিয়া সমাজকে ন্যাংটো করে দিয়েছে। ইসলাম নির্ধারিত হারাম-হালাল বিবেচনায় নিলে দেশে খুব কম লোক পাওয়া যাবে যারা শতভাগ হালাল রোজগার করেন। পুঁজিবাদী খন্নাসের হাজার কূটচালের পাক থেকে বেরিয়ে হালাল কামাইয়ের গরব বোধ করা আর সোনার পাথরবাটি হাতে পাওয়া সমান কথা। নৈতিক চোরাটান ঢাকতে ছুপা রুস্তম সাজেন সবাই। আলী হাসান অন্তত এদিক থেকে অকপট। ইসলাম…সময় যত গড়াচ্ছে তার দেহ থেকে সকল আধ্যাত্মিক সুবাস ছেঁটে ফেলা হচ্ছে। আলী হাসানের স্ববিরোধী বক্তব্য সত্যটি সামনে এনেছে পুনরায়। তাঁকে বিষোদগার করতে থাকা লোকজন বিষয়টি মিলাতে পারেননি।

পলাশ ও আলী হাসানকে নিয়ে আন্তর্জালে শোরগোল চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে দেশের প্রগতিপন্থীরা ইসলামকে নাকচ করতে নিজের সকল শক্তি ক্ষয় করে থাকেন। প্রাচ্যে জনমানসের বিবর্তন বিবেচনায় নিলে ধর্মকে নাকচ করার কনসেপ্ট কাজ করার কথা নয়। বিপুল সাধারণের অনুভূতি জখম হয় মাত্র। প্রগতির সপক্ষে যার অবস্থান তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। আপামর সাধারণ তাকে সন্দেহজনক ও প্রত্যাখ্যানের মতো চরিত্র ধরে নেয়। বাংলাদেশে প্রগতিপন্থীর এলেম নেই যে পুঁজিবাদী সভ্যতার একশো শয়তানি প্রতিরোধ করবেন। সমাজবাদে পুঞ্জিভূত ব্যাধি শনাক্তের সক্ষমতা তার নেই। না তিনি ধারণ করেন এমতো ইলম যেটি কেবল ইসলাম নয় বরং সকল প্রচলিত ধর্মের আন্তরনিহিত বৈশিষ্ট্য ও জনপ্রভাবকে আমলে নিতে জানে, যার মধ্য দিয়ে এর ক্ষতিকর প্রভাবকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম কাউন্টার ডিসকোর্স বা পালটা বয়ান গড়ে উঠবে!

এই প্রগতির মুখে কোনো দীপ্তি নেই! এমন কোনো উদ্ভাস নেই যাকে সমাজবদলের আয়ুধ ভেবে মানুষ পুলকিত বোধ করবে। বুকে টানতে দ্বিধা করবে না। ধর্মবিশ্বাসী কোনো শিল্পীর স্ববিরোধ চিনিয়ে দিতে তার এলেমের যে-বহর দেখতে পাই, সেটি দিয়ে আলী হাসান আর পলাশদের মনে গহিন হতে চলা ধর্মবৈকল্যকে একজরাতা  প্রভাবিত করা সম্ভব নয়।


সংযুক্তি
১.
গ্রিফিথ তাঁর The End of The Human Condition কিতাবে উক্ত মনোবৈকল্যকে কুড়ি লাখ বছর আগেকার ঘটনা হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। মানুষ তখন শিকারি যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। মাতৃতান্ত্রিক আবহে এতদিন ছিল। গ্রিফিথ যাকে মানবজাতির শৈশব বা ইনফ্যান্ট এজ বলছেন। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের তাঁবে সকলে করে খাচ্ছিল। জিনগত প্রবৃত্তি সক্রিয় থাকলেও স্নায়বিক ব্যবস্থায় ঘাপটি মেরে বসে থাকা ইন্টেলেক্ট বা সচেতনসত্তার জাগরণ তখনো ঘটেনি। তামাম প্রাণীজাহানের সঙ্গে মানব প্রজাতির অবস্থান অভিন্ন ছিল। শিকারি যুগে প্রবেশের ফেরে অভিন্নতায় বিচ্ছেদ ঘটে যায়। পশু শিকার করতে গিয়ে শক্তিমত্তা, পৌরুষ ও আগ্রাসী মনোভাব মানব তার নিজদেহে আবিষ্কার করে বসে। ইগো বা অহংয়ের অকল্পনীয় জাগরণ ঘটে তখন। খাদ্য আর কর্মবণ্টনের ধাঁচ বদলাতে শুরু করে। সরল-নির্জ্ঞান মানবসত্তা থেকে সচেতন মানবসত্তায় উত্তরণ ঘটে মানব প্রজাতির। গ্রিফিথের ভাষায়, মাতৃতান্ত্রিক খোলস ছেড়ে পিতৃতান্ত্রিক খোলসে তারা প্রবেশ করে। সেটি ছিল মনোবৈকল্যের সূত্রপাত। বৈকল্যটি পরে গ্রিফিথের বিজ্ঞান প্রসূত থিয়োরি মোতাবেক তাপ গতিবিদ্যার দ্বিতীয় নিয়ম অনুসারে ঈশ্বর ও ধর্মের যুগলবন্দি স্বরূপ নিজের সচেতনসত্তায় গড়ে নিতে মানব প্রজাতিকে প্রভাবিত করেছিল।

বনিআদম কেবল জিনের তাঁবে থাকা প্রবৃত্তির দাস নয়, যেমন অন্য প্রাণী। বাদবাকি প্রাণীকুলের প্রবৃত্তিতাড়িত সত্তায় প্রাকৃতিক নির্বাচন ও অভিযোজনের ধারায় যেটুকু ইন্টেলেক্ট-র বিকাশ, মানব প্রজাতিকে এর সঙ্গে মিলানো যাবে না। তার রয়েছে সচেতনসত্তা। আছে প্রখর অহং। তার ইন্টেলেক্টকে এটি তুরন্ত জাগাতে সক্ষম। এসব সঙ্গী করে ধরায় জন্ম নিয়েছে সে। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন ও অভিযোজনে খাপ খাওয়ানোর ঘটনায় যা তাকে অন্যদের চেয়ে অধিক সুবিধা করে দিয়েছে। বাইবেল ও কোরান বর্ণিত আদমজাহানকে উক্ত ছকে ফেলে ব্যাখ্যা করছেন গ্রিফিথ। বলছেন,—সত্তামাঝে সক্রিয় সচেতনসত্তা বিষয়ে আদম ও হাওয়া কিছু জানত না। নিজদেহে সচেতনসত্তার ভার সম্পর্কে অজ্ঞ মানব-মানবী অচেতনসত্তা রূপে ঈশ্বরের বাগানে তারা ঘোরাফিরা করছিল। সেখানে তাদের অবস্থান ছিল শিশুর মতো সরল ও নির্দোষ। জেনেটিক সেটআপের কল্যাণে ঈশ্বরের বাগানে দিব্যি ঘুরঘুর করছিল দুজন। আদমের ফল ভক্ষণের ঘটনায় ছবি নিমেষে পালটে যায়। জেনেটিক সেটআপের খোলসে লুকিয়ে থাকা ইন্টেলেক্ট বিস্ফারিত হয়। অকল্পনীয় জাগরণ ঘটে ইগোর। ঈশ্বরের নিয়মকে তারা বিপন্ন করে বসে। বিজ্ঞানীমহলের গণ্য অংশের কাছে অতীন্দ্রিয়, ভিত্তিহীন, বানোয়াট নামে দাগানো ক্রিয়েশনিজমকে জেরেমি গ্রিফিথ মনে হচ্ছে কিতাবে হাতিয়ার করেছেন ক্ষেত্রবিশেষ। যাই হোক, মানববিকাশের পরিণত অবস্থায় ফলভক্ষণের ঘটনাকে অতঃপর আদিপাপ হিসেবে মানুষ গণ্য করতে থাকে। কোরান ও বাইবেল এই ইশারা দিচ্ছে বটে!

গ্রিফিথ তাঁর কিতাবে ফলভক্ষণের জেরে আদম-হাওয়ার মর্ত্যে নির্বাসনকে আদিপাপ মানতে নারাজ। তিনি একে সচেতনসত্তার জাগরণ বলার পক্ষে। তাঁর মতে আদিপাপের ধারণাটি হচ্ছে এমতো মনোবৈকল্য যেটি আজোবধি মানব প্রজাতিকে দোটানায় রেখে দিয়েছে। নিজেকে অপাপবিদ্ধ ও নির্দোষ ভাবতে না পারার পেছনে ফলভক্ষণের স্মৃতি তাকে তাড়া করে ফিরে। ভালোমন্দ ছাপিয়ে নিছক সরল ও প্রাকৃতিক জীব রূপে নির্ণয় খোঁজা আর হয়ে ওঠে না।

ধর্মের সীমানা ছাড়িয়ে মানব প্রজাতির বিবর্তনে চোখ রাখলে কুড়ি লক্ষ বছর আগে শিকারি প্রজাতির দেহে আচমকা পৌরুষের জাগরণ ছিল এরকম এক আদি মনোবৈকল্য। পুরুষের অহংকে সে গতি দিয়েছিল। নারীমাঝে সক্রিয় অহংকে পুরুষ তার স্বকীয় অহং দিয়ে প্রভাবিত করতে থাকে। নারীঅহংকে নিজ বোধের অনুকূলে নির্দিষ্ট করে, যার জের ধরে নারী হারিয়েছে তার আপনসত্তা। পুরুষ নির্ধারিত সত্তাকে নিজসত্তা রূপে ভাবার বাতিক নারীমনে জন্ম নিয়েছে। মানব প্রজাতি নারীবাদের যুগে প্রবেশ করলে উক্ত বৈকল্য বিস্ফারিত হয়। নতুন মনোবৈকল্য যে-কারণে উভয় লিঙ্গমধ্যে এখন আর গোপন নেই।

মনোবৈকল্য, জেরেমি গ্রিফিথের ভাষায় একইসঙ্গে আশীর্বাদ ও অভিশাপ। মানব প্রজাতির নিজেকে সচেতনসত্তা হিসেবে আবিষ্কারে তার ভূমিকা অপরিসীম, বিপরীতে সকল অস্থিরতা বা ট্রমার মূলাধারও বটে! ধর্ম এই বৈকল্যকে পুঁজি করে আজো করে খাচ্ছে। ঈশ্বরকে মরমি ও মহাজাগতিক ভাবার পথ সংকীর্ণ করে তুলেছে সে। আমাদের পলাশ ও আলী হাসানরা যথাবিহিত এর নিষ্করুণ শিকার, যেমন আরো অযুত মানব।

২. ক্যাট স্টিভেন্সকে যেমন বিস্তর লড়তে হয়েছে একসময়। গান তিনি তথাপি ছাড়তে পারেননি। ক্যাট নাকি ইউসুফ কোন পরিচয়ে সত্তাকে বুঝে নেবেন এটি নিয়ে সেদিনতক জটিলতায় ভুগেছেন। কারো ওপর ফতোয়াজারি তাঁর পছন্দ নয় কিন্তু খোমেনি কর্তৃক সালমান রুশদির ওপর ফতোয়া জারির ঘটনায় তাঁর প্রতিক্রিয়া বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। পপ-রক গানে জগৎসেরা শিল্পীদের তালিকায় অনেক আগে থেকে বিবেচিত ক্যাট স্টিভেন্স ইদানীং আন্তর্জালে যেসব কাণ্ড করে বেড়ান সেখানে গায়কসত্তা ও ইসলামকে কবুল বলা সত্তায় ভারসাম্য বজায় রাখার জোর চেষ্টা চোখে পড়ে। পশ্চিমা গণমাধ্যমের ইসলামভীতি থেকে তৈরি বানোয়াট আখ্যানের চাপটি এক্ষেত্রে তাঁকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ইসলামপ্রসূত বয়ান ও তার হাজারো বিধিবিধানের চাপকে নিজের জীবনাচারে সহজ ও নমনীয় রাখতে মাঝেমধ্যে ভেক ধরছেন মনে হয়।

৩. হযরত মোহাম্মদের নবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ ও নবুয়তলাভ নিয়ে আহমাদুল্লাহপন্থী বনাম তাহেরি হুজুর ভক্তদের মার কাটকাট ক্যাচালকে এর সাম্প্রতিক নজির গণ্য করা যায়। একপক্ষের বক্তব্য হচ্ছে, চল্লিশ বছর বয়সে নবুয়ত লাভের পর থেকে হয়রত মোহাম্মদকে নবি হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। তার আগে তিনি সাধারণ মানুষ ছিলেন। আল্লাহ তাঁকে নবি হওয়ার পাঠ দিয়েছেন ওই চল্লিশ বছর ধরে। কোরান সহ হাদিসের দলিলাদি তাই বলছে। বিরোধীপক্ষ মানতে নারাজ। তাদের ভাষ্য,—সমগ্র জগৎ সৃষ্টির আগে থেকে হযরত মোহাম্মদ আল্লাহর নূরানি সিফাতের অংশ ছিলেন। কওমকে পথ দেখাতে নবি প্রেরণের ধারাবাহিক পর্যায়ে সর্বশেষ নবি রূপে তাঁকে তিনি মানব রূপে ধরায় পাঠান। মানবীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করলেও তাঁর সত্তায় সূরানি সিফাত গোড়া থেকে সক্রিয় ছিল। কোরান ও হাদিসে এই ব্যাপারে দলিলের অভাব নেই।

নিজেকে ওহাবি বা অন্য শিরোনামে পরিচয় দিতে অনীহা প্রকাশ করলেও নবুয়তের ক্যাচালসূত্রে শায়েখ আহমাদুল্লাহর গায়ে ওহাবিছাপ্পা বিরোধীপক্ষ আচ্ছামতন বসিয়ে দিয়েছেন। দুই পক্ষ মিলে তৈরি অজস্র মিম  ইউটিউবে গমন করলে মিলছে। ওহাবি ঠেকানোর ইমানি জোশে এই প্রথম বোধ করি কওমি থেকে শুরু করে সুফিপন্থীরা পারস্পরিক মতবিভেদ ভুলে তাহেরির পেছনে দাঁড়ালেন! নেপথ্যে প্রত্যেকের নিজস্ব এজেন্ডা আছে বৈকি। নবির নবুয়ত প্রাপ্তি নিয়ে মারকাট ফ্যাসাদে আধ্যাত্মিক নির্যাসের ছিটেফোঁটা না থাকলে কী হবে, মুসলমানসমাজ বিনোদন নিতে মাসাধিক নেটপাড়া গরম রেখেছিলেন।

ওহাবিঝড়ে যারা এতদিন টলমল ছিলেন, তাহেরি হুজুরের মুভটি এইবেলা তাদের পায়ের নিচে মাটি টের পেতে ভরসা দিচ্ছে মনে হলো। জাতরসিক তাহেরির ‘কেমন দিলাম’ উক্তিমাঝে যারপরনাই নিগূঢ় ঘটনা নিহিত। ওয়াজ মাহফিলে আজহারি থেকে শুরু করে আহমাদুল্লাহরা তাঁকে উপহাস করে থাকেন। তাঁর বয়ানের অসংগতি নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ নতুন ঘটনা নয়। অদ্য মওকা বুঝে শোধ তুলেছেন হুজুর। ওয়াজি হুজুরদের মধ্যে পারস্পরিক মতবিরোধ, এইসব পাল্টাপাল্টি আর শোধ তোলার খেলায় আল্লাহ ও নবি দুজনে হলেন গুঁটি। যুগের সঙ্গে নিজেকে নবীকরণের দৌড়ে পিছিয়ে থাকা সমাজে উক্ত গুঁটিবাজি মুসলমানসমাজে ঘনীভূত আঁধারকে আরো গাঢ় করছে এই যা!

প্রয়োজনীয় লিঙ্কগুলো
আলী হাসানের ইন্টার্ভিয়্যু ১
আলী হাসানের ইন্টার্ভিয়্যু ২
আলী হাসানের হারাম হালাল বিতর্ক
পলাশ নুর লিঙ্কসমূহ


আলী হাসানের গান ও বাংলাদেশের বাজার পরিস্থিতি
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
ই স লা ম বী ক্ষ ণ

Support us with a click. Your click helps our cause. Thank you!

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you