গানপার রেকমেন্ডেড রিডিং

গানপার রেকমেন্ডেড রিডিং

আমরা গানপারে লেখা আপ্লোড করি নিয়মিত; বলতে গেলে এভরিডে। এর মধ্যে যেমন রয়েছে তাৎক্ষণিক প্রাসঙ্গিকতাবাহী রচনা, আছে দূরগামী ইশারা বহনকারী রচনাও। শুধু একবৈষয়িক গানবাজনাকেন্দ্রী নিউজভিয়্যুজ নয়, ইন-ফ্যাক্ট নিউজ আমরা কাভার করি না, চাই বহুবৈষয়িক বিশ্লেষণ ও সম্পর্কের প্রতিপাদন পড়তে এবং সম্ভব হলে সংলগ্নজনেরে পড়াতে। সেই ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায় রেকমেন্ডেড রিডিং। অনুচ্চ গলায় ডিক্লেয়ার করি যে এখন থেকে অন্তত হপ্তায় একবার হলেও মৈফজখানায় রাখা রচনাগুলো পুনরায় পাঠকনজরে আনব এবং অসম্ভব-নয়-এমন একটা আশাও করব যে লেখাগুলা পাদপ্রদীপের আলোয় যাবে এবং যার যার যোগ্য আশ্রয়/পাঠক পাবে।

সেহেতু নয়া, আজকে থেকেই এক সেন্সে, এই ইনিশিয়েটিভ শুরু হতে চলল। গানপার রেকমেন্ডেড রিডিং পোস্টগুলায় আমরা বারবার বা আরেকবার পড়া যায় এমন রচনাগুলো প্রমোট করব ওয়াদা রাখছি। বিশেষ আর কিছু না।

কাজেই, ‘স্মরণ-বিস্মরণের আর্কাইভ : হাওয়া  সিনেমার গান ও অন্য কিছু কথানামের রচনাটা আমরা যারা গানপারে এরই মধ্যে পড়ে ফেলেছি তারাও পড়তে চাইব পুনরায়। রেকমেন্ডেবল রচনাটি লিখেছেন মৌসুমী ভৌমিক, যিনি নিজে খ্যাতকীর্ত সিঙ্গার-স্যংরাইটার ও অনেক শ্রোতানন্দিত গান উপহার দিয়েছেন তিনি আমাদেরে।

মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত ‘হাওয়া’ ছায়াছবির গানের ছুঁতা ধরে এই লেখাটা আরম্ভ হলেও একসময় তা ছাড়ায়া যায়। সিনেমায় ব্যবহৃত ‘আটটা বাজে দেরি করিস না’ গানের অরিজিন্যাল গীতিকার ও সুরকার নিয়া সামাজিক সংযোগ মাধ্যমে উত্থাপিত আলাপের ধারাবাহিকতায় লেখক আরও অগ্রসর হয়ে একই সিনেমার অন্য গান ও দ্য ট্র্যাভেলিং আর্কাইভ সঞ্চালনের সুবাদে লেখকের লব্ধ অভিজ্ঞতায় অরিজিন্যাল কন্টেন্টের অ্যাক্নোলেজমেন্ট নিয়া ‘হাওয়া’ ছায়াছবির নির্মাতা ও ভোক্তাশ্রেণি এবং বাউল-ফকিরদের মধ্যে চেতনা ও আদবকেতার পৃথকতা দেখান যখন, লেখাটা আরও বড় জায়গায় ভাবায়। “কীভাবে সিনেমা থেকে বাউল ফকির মহলে এক একটা গান এসে পৌঁছয়, কীভাবে পথে ঘুরতে ঘুরতে গানটি বিবর্তিত হতে থাকে, কীভাবে আবার তা সিনেমায় ফিরে যায় অন্য রূপে” – এমন গহন পথে লেখাটা নিয়া যাইতে চায়। কিংবা লেখাটা ধরে এগোলে এমন পর্যবেক্ষণের দেখা পাওয়া যায় “নাম থাকলেও বিভ্রান্তি হয়। ধরা যাক কার্তিক দাস বাউল। মনিরুদ্দিন আমেদ বলেন, কার্তিক দাস বাউল ওঁর ‘আটটা বাজে’ গানটি গেয়েছেন। বাসুদেব দাসও বলেন সেই কথা। আমি যে-কার্তিককে চিনি, গুসকরার কার্তিক, জর্জ লুনোর সংস অফ দ্য ম্যাডমেন (১৯৭৯) থেকে মিঠুন চক্রবর্তীর বিগ বস-এর দীর্ঘ পথে যাত্রা করা কার্তিক, যার সঙ্গে আমরা বাউল ফকির উৎসব করেছি বছরের পর বছর কলকাতার যাদবপুর-শক্তিগড়ে, সে আমাদের বন্ধু। তাকে ফোন করি। কার্তিক খানিক তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, ‘আটটা বাজে? না দিদি, ও অন্য কার্তিক দাস, লাবপুরের’। আমাদের কার্তিক তারপর বলে, ‘এখন দিনকাল অন্যরকম হয়ে গেছে, শ্রোতারা বলে, একটা মহাজনের পদ গাও। কোন পদ? না, সাদা সাদা কালা কালা’।  তা তো ঠিকই। হাশিম মাহমুদ তো আর ‘মহাজন’ নন। আবার তিনি মনিরুদ্দিনও নন। মনিরুদ্দিনের সমাজও ভিন্ন, গানও ভিন্ন, গানের শ্রোতাও ভিন্ন। আমরা কলকাতা বা ঢাকাকে কেন্দ্র ভাবি বলে মনে হয় মনিরুদ্দিন বুঝি প্রান্তিক, কিন্তু  কলকাতা-ঢাকা-চট্টগ্রাম-শান্তিনিকেতন-সিলেট-লন্ডনের বাইরেও তো অনেক দুনিয়া আছে। আমার মনিরুদ্দিনকে ওঁর জগতে দিব্যি আনন্দে আছেন বলেই মনে হয়েছে। তুলনায় হাশিম মাহমুদকে বিষণ্ণ লাগে। তিনি তির্যক, সাবভার্সিভ, তাঁকে ধরা যায় না, তিনি ধরা পড়তে চানও না। ‘তোমায় আমি খেলতে পারি বাজি’ গানটি গাইবার সময় তাঁর গভীর কালো চোখে কৌতুক ঝিলিক দিয়ে যায়। কিন্তু কোথাও একটা ব্যথাও রাখা আছে হাশিম মাহমুদের ভিতরে, সেটা অনুভব করা যায়। যেমন ব্যথা রাখা আছে আমাদের শহর আর সময়ের বুকে। উঠতি যুবকের ঝাঁক বা পুরনো ব্যান্ডমেট বা শ্রোতা ছাড়া হাশিম মাহমুদ কিন্তু অসম্পূর্ণ। হাওয়ার জন্য সুমন তাঁকে খুঁজে পান যখন, তখন তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ। সুমন আমায় বলছিলেন, ‘এইসব ক্যাম্পাসে যারা গান করে, তাদের কী হয়? একবার হারিয়ে গেলে কেউ জানে না। তার বাসায় কেউ যায় নাই, সে কোথা থেকে আসছে… এই শহরটা কী অদ্ভুত না? কেউ একজন হারায়ে গেলে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। চিন্তা করেন যে, যে-মানুষটার সাথে আমার সাত আট বছর কেটে গেছিল, সেই মানুষটার বাসা কোথায় আমি জানতেও চাই নাই’। সুমনের কথায় আমারও বিষণ্ণ লাগে আর আমি নিজের স্মরণ-বিস্মরণের আর্কাইভের ভিতরে হাবরা অশোকনগর থেকে আসা ভক্তদাসকে খুঁজি।” কিন্তু খুঁজে পেলেন কি না ভক্তদাস বাউলকে, বা ধীরাজ ফকিরকে, জানতে চাইলে পুরা লেখাটা পড়তে হয়। বাউলতালাশের এই নিরুপম অভিযানে লেখকের সঙ্গে জয়েন করতে হয় পাঠককেও। কেননা আর-দশটা বাউলতল্লাশমূলক রচনায় যেমন ভুলশুদ্ধ নিরূপণ আর বাউলের গরিবি জীবনসংগ্রাম নিয়া কাঠনিরেট তথ্যচয়নিকা ফাঁদা হয়, এই রচনা তা না। অ্যাডভেঞ্চারপূর্ণ রচনা বললেও অত্যুক্তি হয় না অবশ্য। বরং বলতে হয়, এ-ধরনের রচনায় অ্যাডভেঞ্চারটা নিখোঁজ ব্যক্তি/বস্তু খুঁজিয়া পাওয়া/না-পাওয়ায় থাকে না, অ্যাডভেঞ্চার থাকে গোটা সার্চ/খোঁজপ্রক্রিয়ায়। এখানে লেখকের খোঁজাখুঁজির প্রসেস ডকুমেন্টেশন বিধৃত রইল রচনাটায়। কেবল প্রসঙ্গের অনুবর্তন নয়, লেখাটার নানা জায়গায় জ্যান্ত অভিজ্ঞতার আওয়াজ শোনার পাশাপাশি প্রসঙ্গাতিরিক্ত ও প্রসঙ্গপূরক অনেক মহার্ঘ লভ্য। ধরা যাক, এই যে, এই কথাটুকু : “লকডাউনের পর আমাদের নতুন কোনো অধ্যায় শুরুও হলো না, কিছু শেষও হলো না, কোনো closure হলো না।” পাঠ কন্টিনিউ করে গেলে এমন অনেক কথা পাওয়া যায় যা বাউলসংক্রান্ত রচনাধারায় আর-দশটা বাউলগবেষকের অতিচর্চিত মরাটে লেখার ফর্ম্যাট থেকে একে আলাদা করে এবং ফলে লেখাটা হয়ে ওঠে অ্যালাইভ, সমুজ্জ্বল, সুবাতাসময়।


গানপার রেকমেন্ডেড রচনা ১
গানপারে মৌসুমী ভৌমিক 

COMMENTS

error: