সারাক্ষণ হাতে একটা গানের বাকশো চেয়েছিলেন শামীম কবীর। হতে চেয়েছিলেন একটা গানেরই বাকশো। কবিতায় এই ইচ্ছেটা একবার নয়, দুইবার নয়, তিন-তিনটা জায়গায় দেগে রেখে গেছেন দেখতে পাই। কিন্তু অন্যান্য কবিতার খাঁজেও থাকতে পারে এই ইচ্ছাছাপ, নজরে ঠেকে নাই এ-যাত্রা, যদিও, হয়তো কখনো পরে এক-সময় এর চতুর্থ ও পঞ্চম সিম্ফোনিও শুনতে পাবো কোনো পরবর্তী পাঠকালে। এক্ষণে যে-তিনটা জায়গা গোচরে এসেছে, সেই তিনটারে দেখাই। কিন্তু সংখ্যায় তিন হলেও অভিন এর এসেন্সটুকু; অন্যভাবে এই তিনটা ভার্শনেই ডিফ্রেন্ট তিনটা শেইড লক্ষ করা যায়। এখানে এক্সাম্পলগুলো টুকে রেখে দেই।
প্রথম ভার্শন পাওয়া যায় একদম শুরুর কবিতাটায়, ‘শামীম কবীর সমগ্র’ বইয়ের একেবারে প্রথম কবিতা, ‘মা-র সঙ্গে বাক্যালাপ’ কবিতাশিরোনাম, অনেক দীর্ঘ কবিতার খণ্ডবিভাজিত কোনো-এক খণ্ড যার উপশীর্ষ ‘দেহ পেয়ে গাইবার জন্য গান’, সেইখানে এইটা সুলভ। দ্বিতীয় রূপটা আমরা পাই ১৪৩ পৃষ্ঠায় যেয়ে, ‘দেহ পেয়ে গাইবার জন্য গান’ শিরোনামে ‘আস্থায়ী’ ও ‘স্থায়ী’ দ্বিবিভাগে বিন্যাস্ত কবিতা সেইটা। তৃতীয় পাঠান্তর পাবো বইয়ের ২৩১ পৃষ্ঠায় যেয়ে ‘খড়মের আওয়াজ ও খড় / কোনো কিন্তু নেই’ শীর্ষক দুইলাইন শিরোনামা কবিতার স্ট্রার্ট স্ট্যাঞ্জা হিশেবে। দেখি পরপর :
—ভার্শন ১—
সারাক্ষণ হাতে চাই গানের বাকশো
যেতে যেতে গান গাবো
তাই
সারাক্ষণ হাতে চাই গানের বাকশো
যেতে যেতে গান গেতে গেতে
নানা রঙের উদগ্র আকৃতিঅলা ফাটাফাটি গান
—ভার্শন ২—
সারাক্ষণ হাতে চাই চাই গানের বাকশো
কত রঙের ঢঙের আকৃতিঅলা ফাটাফাটি গান
…
আকৃতি বিশেষ নয়
যখন যা মনে হয় তাই হয়
প্রথাভাঙা দেহ পেয়ে গাইবার জন্য যা যা গান
যে সবই সতেজ হবে
কাঁখে বাকশো ও আকণ্ঠ পান
সারাক্ষণ হাতে চাই গানের বাকশোখান
…
দিবাগত রাত্রবেলা বিকিরিত কাটা তান শুনে
পুড়ে যেতে যেতে সোনাভান
বলেছিল, “এই চাঁদ আঁটো হয় গলে
অন্য একটা ছোট বদলে দেবে?” বলে বলে
তবু আমি চাঁদে চাঁদে গান নিয়ে আরও যাব চলে
—ভার্শন ৩—
যেতে যেতে গান গাবো তাই
খুব, বড় ব্যগ্র গাড়ি খোঁজ করেছিলাম বাহিরে
যেতে হবে গান গেতে গেতে
গেল শতকের অন্তিম দশকে একটা গানবাকশো বা ক্যাসেটপ্লেয়ার/স্টিরিয়ো জনমনোহারি জিনিশগুলার মধ্যে ছিল শীর্ষে। এ-রকম চৌকোনা বাকশোসদৃশ একটা গানযন্ত্র ঘিরে সেইসময় আমাদের কার ভিতরে যে গেইজ ছিল না, কার ভিতরে এই মিউজিকবক্স ঘিরে ফেটিশ ছিল না, তা আয়াসসাধ্য হবে বের করা। আশি দশকের গোটা কাল জুড়ে এই স্টিরিয়োপ্লেয়ার ডিভাইসটি ছিল কমিউনিটির ম্যাজর রিক্রিয়েশন টুলগুলার মধ্যে একটি। বিনোদিত হবার আকাঙ্ক্ষা পূরণের নির্ভরযোগ্য উপায়। স্টিরিয়ো ও ভিসিয়ার। কবির মতো অনেকের তথা আমাদেরও প্রথম ঈপ্সা ক্যাসেটপ্লেয়ার। ভিসিয়ারও, তবে তা অডিয়োপ্লেয়ারের অনেক পরের ব্যাপার। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি স্টিরিয়ো যন্ত্রটি সুলভ হতে শুরু করে। ব্যক্তি পর্যায়ে এই ডিভাইসটি কিনে উয়িথ অর উয়িদাউট অ্যামপ্লিফায়ার গানশোনার সোল্লাস হিড়িকে কেটেছে আমাদের গোটা নব্বই। সিডি/ভিসিডির যুগ শুরু হয় তারপরে। এখন আর দুনোটার কোনোটাই নাই। কিংবা আছে, কবিতায়, যেমন সমস্তকিছুই মৃত্যুর পরে একটা আর্ট হয়া যাবার নিয়তি নিয়া জন্মায়। গানের বাকশোখানা শামীম কবীরের কবিতায় যেমন।
শুধু তো বাকশো নয়, গান প্রসঙ্গটি শামীমের কবিতায় ফিরে ফিরে এসেছে। যেমন এসেছে এপ্রিলের উনিশ প্রসঙ্গটি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এপ্রিল মাসের উনিশ তারিখে কবির জন্ম, বগুড়ায়। শামীম কবীরের কবিতায় পার্সোন্যাল এমন রেফ্রেন্সেস, মাকে প্রেমিকাকে বন্ধুবান্ধবকে এবং অবশ্যই নিজেকে ঘিরে একের পরে একেকটি ইমেইজ, পৌনঃপুনিক আবর্তিত হতে দেখি। কীর্ণ পঙক্তিগুলি ইয়াদ করায়া দ্যায় আমাদেরই জীবনের বিস্রস্ত বরিষনবেলাগুলির অলৌকিক ইহকালিকতা। আর তার শতেক ধারার বাহার! শামীম কবীর কত-না ভাবে রেইনফ্যল ক্যাপচার করেন কবিতায়, আষাঢ় মাসের আপরাহ্নিক লম্বাচওড়া বারিপাতের অব্যবহিত পরে দ্রষ্টব্য কর্তৃক প্রকাশিত ‘শামীম কবীর সমগ্র’ বইয়ের পাতা আলতো উল্টাই।
বৃষ্টি নিয়া বাংলা ভাষায় কাব্য ও কাব্যিকতার অন্ত নাই। কিন্তু শামীম কবীরের কবিতায় বাংলা ভাষার বৃষ্টিকাব্যের কনভেনশন ভেঙে একটি নিজস্ব বয়নের বৃষ্টিপাত লক্ষ করি। বৃষ্টিপাতের এফেক্ট মাটিতে এক-রকম, কোরোগেটেড শিটের ওপর আরেক-রকম, ইট-কাঠ-কঙ্ক্রিট-লোহালক্কড়ের আর্বেইনিটিতে এফেক্ট অফ রেইন সূক্ষ্মদৃষ্টিতে দেখতে গেলে আলাদা। ডিউরিং রেইন এক-ধরনের এফেক্ট, আবার আফটার রেইন ডিফ্রেন্ট এফেক্ট। শহরতলিতে থাকার সুবাদে রেনিডে এফেক্ট উপর্যুক্ত সব-কয়টাই আপনার পেয়ে যাবার কথা। মাল্টিলিনিয়ার বর্ষণ দর্শনের অভিজ্ঞতা আপনার এদ্দিনে হয়ে গিয়েছে এইটা ফল্স স্টেইটমেন্ট না। শামীম কবীরের কবিতায় একটা লাইন পাচ্ছি : ‘বৃষ্টি হয়ে গেলে খুব ইস্টিশন ইস্টিশন ঘ্রাণ’ — এইটা দারুণভাবে খেয়াল করবেন আপনি সিটিকর্পোরেশনের কোনো রেসিডেনশিয়্যাল অ্যারিয়ার বাসিন্দা হলে। সেমিপাকা রাস্তারেস্তোরাঁ, স্ট্রিটসাইড টিস্টল, হাফ-ওয়াল কন্সট্র্যাকশন ওয়ার্কের সাইটে যে-চিপপাত্থরস্তূপ রাখা, তার একদিকে একচিলতে ফাঁকা জায়গায় যেয়ে বর্ষণশমিত ক্ষণে দাঁড়ান, দেখবেন শামীম কবীরের লাইন অ্যাট্যাস্ট/সত্যায়ন করতে পারছেন। ঘ্রাণিন্দ্রীয়ে এইটা টের পাবেন যেমন, দর্শনিন্দ্রিয়েও।
বুদ্ধদেব বসু একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন, প্রকৃতিনিসর্গের কিচ্ছুটিই তার ভেতরে এখন আর সরাসরি ঢোকে না, সাহিত্যের তথা কোনো-না-কোনো কবিতার ভায়া হয়ে ঢোকে; ব্যাপারটা, তিনি বলেছিলেন, বাল্যকাল থেকে সাহিত্যসংলগ্ন থাকবার তথা কবিতাপাঠের কুফল। উদাহরণ দিয়ে বুদ্ধদেব বুঝায়েছিলেন ব্যাপারটা যে, মেঘলা দিনে আকাশের দিকে তাকিয়ে ‘মেঘদূতম’ থেকে শ্লোক মনে পড়ে প্রথমেই, কিংবা কালো চুলঢাল প্রেমাস্পদের, এইসব কবিতারই শয়তানি। কিছু-না-কিছুর সঙ্গে তুলনা না-করে, উপমা না-দিয়ে, মানবীয় অভিজ্ঞতার বর্ণনা/প্রকাশ দুষ্কর। সত্যি তাই, এর থেকে মানুষের তো নিস্তারও নাই। কিন্তু বুদ্ধদেব আফসোস করেছিলেন এই বলে যে, কী ভালোই-না হতো যদি বৃষ্টিদিনটেকে কোনো কবিতার সহায়তা না-নিয়ে ডিরেক্ট অভিজ্ঞতার অন্তর্গত করে নেয়া যাইত! অগত্যা।
সারাদিন থেমে থেমে বৃষ্টি। বৈশাখ যেন স্বরূপে এসেছে ঢের বিরতির পরে। যেনবা বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম। ফর্মে ফিরেছে বৈশাখ। ঝড় হচ্ছে, ফের সুনসান। আর চারপাশ ভরা শামীম কবীর। মানে শামীম কবীরের কবিতালাইন। ইস্টিশন ইস্টিশন ঘ্রাণ চারিপাশে। এই শহরে, ওই শহরে, সব শহরে। এই বৃষ্টিসিজনের প্রবেশমাসে আমরা বারোমাসী বৃষ্টিপাতের রাজ্য কবিতার কাছে যেয়ে একবার দাঁড়াই। বৃষ্টিশিল্পীও তো এই কালিদাসরিপাব্লিকে এক-দুই নয়, একশ-দুইশ কম-সে-কম। শামীম কবীর সৃজিত বৃষ্টিপাতের কয়েক ফোঁটা হাতের ডাবু দিয়া নাড়াচাড়া করে দেখি। গোটা ফর্মেশন না, হাল্কা কয়েক ড্রপ শুধু, শামীম কবীরের কয়েকটা লাইন আঙুলের ডগায় নিয়া জানালায় ফেলি চোখ, ওখানে ফের ফর্ম হচ্ছে রেইন। লেজার রশ্মি দিয়া আলোক্রীড়ার ন্যায় একটু পরেই স্টার্ট করবে রেইন শো অ্যান্ড ইট মাস্ট গো অন, যেমন শামীম কবীরের কবিতাগ্যালারি চিরপ্রবহমান বাংলা কবিতায়।
- বৃষ্টি হয়ে গেলে খুব ইস্টিশন ইস্টিশন ঘ্রাণ …
- তুমি সর্ষের ভিতরে বসে চমকাও
- মনে রয় দুপুরের দাবদপ্তরী — বলো তো ঊনিশ আমি কার!
- কে যেন কবে বলেছিল, আমার দুই চোখে দু-রকম স্থায়ী শিশির / আর তার ছবিগুলো / গতিতৎপর খুব।
- একটি আনন্দদানা গড়িয়ে গড়িয়ে যায় / কতদূর গিয়ে যাবে / যেতে যেতে কে জানে তা … / অন্তত গানের জন্য বৈপরীত্য এত মানসিক
বৃষ্টিপ্রসঙ্গে শামীম কবীর অন্বিত করে এটুকু লিখে এখন খটকা লাগছে, কেউ যদি ভেবে বসেন যে শামীম খুব রোম্যান্টিক, বা শামীমের কবিতালাইনঘাট খুব নরম, খুব কমনীয়, খুব মসৃণ ও পেলব — না, আদৌ তা না। শামীমের কবিতা আবহমান বাংলা কবিতার মেইনস্ট্রিমড আবেগাক্রান্ত বস্তুপুঞ্জ না। তাহলে কেমন কবি তিনি? মানে? কেমন কবি মানে? আপনি কি বোতলের গায়ে একটা ছাপ্পা দাগা হোক আব্দার করছেন? মেড ইজি লেবেলিং? অবিলম্বে? লেবেলটা আপনিই দিয়ে নেন, নোটক তথা এই নিবন্ধকার জাজমেন্টাল না-হয়েও কয়েক কিলোমিটার ওয়াকিং ডিস্ট্যান্স আগাতে আগাতে একটু শোভাবৈচিত্র্য সম্ভোগ করে যেতে চায়, স্প্রিন্টার না-হয়েও সহসা হাওয়ার ন্যায় ফিনফিনে রেইন এলে একটা রান দিতেও ইন্টেন্ডেড টু। কাজেই আহিস্তা, আহিস্তা …
পাদটীকা / শামীম কবীর ও তার কবিতা নিয়ে ফেসবুকে একটি নিবন্ধমালা ড্রাফট করেছিলাম ২০১৩ খ্রিস্ট অব্দে, যেইটা এখন আর নাই সেই নোটস সেকশনে, একেকটি নোটের আকারে, সেখান থেকে একগোছা গানপারে আর্কাইভড ‘শামীম কবীর সংক্ষিপ্ত : কবিতার সংকলন’ শিরোনামে, একাংশ ‘ঊনসাংসারিক বউ’ শিরোনামে শ্রী ওয়েবপত্রিকায় আর্কাইভড। আর, এইখানে এই তৃতীয়। উনিশশ পঁচানব্বই খ্রিস্ট অব্দের অক্টোবরের দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায়, মাত্র চব্বিশেই, নিজের হাতেই নিজের জীবন থামিয়ে দেন এই কবি। মৃত্যুকালে বেশকিছু ছোটকাগজে উল্লেখযোগ্য কবি হিশেবে নিজের অবস্থান তৈরি হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও কবি তিনি জীবদ্দশায় আদ্যোপান্ত অগ্রন্থিত। অকস্মাৎ আত্মহননের পরে ফেলে-যাওয়া তার শূন্যতার দেরাজে পাওয়া যায় আকরিকসমূহ। গোছগাছ করে রেখে যাওয়া পাণ্ডুলিপিগুলা, যার মধ্যে একটির নাম ‘চব্বিশ’! এই পাণ্ডুলিপিগুলা, সঙ্গে কবির দিনলিপি চিঠিপত্র ছবিকলা মিলিয়ে একটা কালেকশন বেরোয় সাতানব্বই সালে। এইটা বাইর করেছিল দ্রষ্টব্য। অনেক পরে বেরোয় দুই-দুইটি ‘নির্বাচিত কবিতা’, একটি সম্পাদনা করেন যৌথভাবে নভেরা হোসেন ও পিয়াস মজিদ; অন্যটি উড়কি প্রকাশনীর নতুন পাঠ গ্রন্থপ্রবাহের আওতায় প্রকাশিত। তবে যে-বইটা সামনে রেখে এই নিবন্ধগুচ্ছ রচিত, ‘সমগ্র’ নামধেয় দ্রষ্টব্য কর্তৃক প্রকাশিত বইটার কথা বলছি, বইটি রিপ্রিন্ট হওয়া দরকার। রিপ্রিন্টকালে এর প্রয়োজনীয় পরিমার্জন, পুনর্বিবেচন, যোজন-বিয়োজন ও সম্পাদক-সংকলক-সংগ্রাহক সকলের নাম উল্লেখপূর্বক সম্পাদনপ্রক্রিয়া থাকাটা আবশ্যক। কেন, বোধহয় তা আগের আমার রচনাদ্বয়ের কোথাও সবিশদ বলেছি। আর না বলে থাকলে নেক্সট মুসাবিদায় তা আশা করি ইনকর্পোরেইট করব। হোপ নেক্সট দি আর্লিয়েস্ট।
জাহেদ আহমদ রচনাকাল ২০১৩ গানপারপ্রকাশ জুন ২০২৫
- আত্মহন্তার অন্তরাত্মা - June 25, 2025
- আমার জয়দেব - June 19, 2025
- অজিত পান্ডে রেমিনিসেন্স - June 15, 2025
COMMENTS