নিজ পরিবারের সকলের জন্য আব্বার ছিল প্রচণ্ড দরদ। নিজের বাবা-মা, ভাইবেরাদর-আত্মীয়স্বজন তো আছেই, এমনকি নামকাওয়াস্তেও যারা আত্মীয়তার সূত্রে বাঁধা তাদের জন্যও আব্বা একেবারে নিবেদিত প্রাণ। ফলে আমাদের আড়াই রূমের ছোট বাসাতে কুটুম্বদের ভিড় লেগেই থাকত। আজ এ আসছে তো কাল ও। যারা আসছে তাদের আবার যাওয়ার নামটিও নাই। মাসের পর মাস আরামআয়েশ করে তারা আমাদের বাসাটাকে একেবারে ধর্মশালা বানিয়ে ফেলত! অতিথি-মেমানের জ্বালায় আমি কোনোদিন খাটে ঘুমানোর সুযোগ পেতাম না। আমাকে ফ্লোরে বিছানা পেতে ঘুমাতে হতো।
এদিকে আব্বার এই-রকম ভীষণ আবেগ আর পরোপকারী স্বভাবের জন্য আমাদের টালমাটাল অবস্থা। আমরা এ বাসা আর ও বাসা করে বেড়াই। আম্মা ঘুম থেকে উঠেই চলে যায় চাচাজানের বাসায়। সেখানে একান্নে ধুমসে রান্নাবান্না চলে। আম্মা সারাদিন যোগালির কাজ করে। রান্না অবশ্য বড়চাচিমাই করে। ব্যাগ উপচিয়ে বাজার-সওদা আসে। আমরা আট-দশ ব্যঞ্জন দিয়ে মহা সমারোহে খাওয়াদাওয়া করি। আব্বার উপর আম্মার কোনো কথা বলার উপায় ছিল না। আব্বা ছিল প্রচণ্ড বদরাগী ও ডিক্টেটর টাইপের মানুষ। কিন্তু অজ্ঞান ছিল না কোনোকিছুতেই, সব বিষয়েই তার আত্মসম্মান ছিল প্রখর! জ্ঞানের নাড়ি ছিল টনটনে। আব্বার উপরে আম্মার কথা বলার উপায় ছিল না — এর মানে তেমনও নয় যে, আব্বা আম্মাকে অত্যাচার করত। বরং আমরা দেখতাম আব্বা আম্মাকে আলাদা রকম সম্মান দিত। আম্মার জন্য আব্বার অঢেল প্রণয় ও স্নেহশীল আচরণ ছিল। আব্বার হাত দিয়ে আম্মার জন্য কোনো কমদামি উপহার আসত না। বা আব্বা কোনোদিন আম্মাকে গালিগালাজও করত না। গায়ে হাত তোলার তো প্রশ্নই ওঠে না। এসব নোংরা আচরণ আমরা আমাদের বাড়ির কোনো পুরুষকেই করতে দেখিনি।
আমরা যখন করটিয়া ছেড়ে সিলেটে আসি তখন থেকেই বড়চাচিমাকে দেখেছি ঘনঘন বমি করতে। আমরা বাচ্চারা তেমন কিছু বুঝিটুঝি না। কেউ জিজ্ঞেস করলে বড়চাচিমা বলত —
‘আমার কিরমি হইছে।’
সিলেট চলে আসার কয়েক মাস পরেই বড়চাচিমার পেট ফুলে একদম ঢোল হয়ে উঠল। দুপুরে বা সকালে আম্মা-বড়চাচিমার সামান্য অবসর মিললে দেখতাম ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে দুইজনে কীসব ফিসফাস করছে। এসব হয়তো আমিই দেখতাম। অন্যেরাও দেখত কি না আমি জানি না। বাতাসে হঠাৎ দরজার পর্দা উড়ে গেলে দেখতাম, আম্মা বহু যত্নে বড়চাচিমার পেটে তেল মালিশ দিচ্ছে। বড়চাচিমার পেটটা ঠিক উপুড়-করে-রাখা মাটির কলসির মতো ঢাউস ও গোলাকার। আম্মার মোলায়েম হাত ঘুরে ঘুরে সেই কলসিতে সর্ষের তেল মেখে দিচ্ছে। বড়চাচিমার প্রায় সব কাজবাজ, ফুটফরমাশ আম্মাকে নীরবে করতে দেখেছি। আম্মা ছিল একেবারে মাটির প্রতিমার মতো বোবা আর নিস্পলক তাকিয়ে-থাকা এক নারী, যার কোনো চাওয়াপাওয়া ছিল না। বা কোনোকিছু অসহ্য লাগলেও বলার মতো কোনো শক্তি ছিল না। কিংবা হতে পারে তখন বলার ইচ্ছেও হয়তো তার ছিল না। পরবর্তীতে আম্মার এইসব নীরবে-সবকিছুই-মেনে-নেয়া বা সহ্য করার ঝাল আমার উপর দিয়েই বহুভাবে গড়িয়ে গিয়েছে। দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার এই পৃথিবীতে নতুন কোনো ঘটনা নয়।
এর কয়েক মাস বাদেই বড়চাচিমার একটা পুত্রসন্তান হলো। কীভাবে বা কখন হলো সেসবের আমি কিছুই বুঝলাম না। যা-কিছুই হলো তার সবই হলো বদ্ধ দরজার ভেতরে। দক্ষ দাই এল পানগুয়াচুন খেতে খেতে। তার চুল টানটান করে চূড়ো বাঁধা। আম্মাকে দেখলাম গরম জলের গামলা নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটছে। সমস্ত বাসা জুড়ে ডেটলের তীব্র গন্ধ। এর মাঝে একজন শাদা ইউনিফর্মের নার্সকেও দেখলাম। সে এসেই বদ্ধ দরজা সামান্য ঘুচিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। খানিক বাদে আম্মাকে দেখলাম একটা ধপধপে চিনির মতো শাদা পুতুলকে গরমজলের গামলায় গোসল করাচ্ছে!
তারপর থেকে আম্মা ওই চিনির পুতুল নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তাকে দুধের ফিডার ধুয়ে খাওয়ানো। মায়ের কোলে তুলে দিয়ে মায়ের দুধ খাওয়ানো। তেল মালিশ থেকে শুরু করে হাগুমুতুর কাঁথা ধুয়ে দেয়া সবই আম্মা এক হাতেই করত।
বাচ্চার যত্নের পাশাপাশি আম্মা বড়চাচিমার যত্নও করত। বড়চাচিমার খাবার টাইমলি তৈরি করে দেয়া, এমনকি বাথরুমে যাওয়ার সময় বদনার গরমজলে ডেটল মিশিয়েও দিত আম্মা। মা-বাচ্চার যত্নের পাশপাশি সাংসারিক অন্যান্য কাজও আম্মাকেই করতে হতো। ঠিকে ঝি শুধুমাত্র বড়দের কাপড় কেঁচে আর ঘরদোর মুছে দিয়ে যেত।
এর মাঝে একদিন ছোট একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। বড়চাচিমার বদনায় গরমজল ঢালতে গিয়ে আম্মার হাত ফসকে হাড়ি মেঝেতে ছিটকে পড়ল। বড়চাচিমার ত্রাহি চিৎকারে আমরা সবাই পড়িমড়ি করে ছুটে গেলাম। বড়চাচিমার শাড়ি-পেটিকোট ভেদ করে উরুতে গরমজল পড়েছে। আমরা দেখলাম বড়চাচিমার উরু বেশ লাল হয়ে উঠেছে। তড়িঘড়ি কাঁচা ডিম ভেঙে সেখানে লাগিয়ে দেয়া হলো। পরে ফার্মেসি থেকে বার্নল এনে লাগানো হলো। এদিকে আম্মা বেচারা লজ্জায় একেবারে চুপসে গেছে। যেন কী একটা ভয়ানক অপরাধ করে ফেলেছে সে! আম্মার বাম চোখের পাতায় গরম জল ছিটকে পড়েছে, কিন্তু আম্মা তা কাউকেই বলছে না! মুখ নিচু করে লজ্জিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে! যেন সে কোনো খুনের মামলার আসামী! পালিয়ে যাওয়ার সময় এইমাত্রই যাকে ধরা হয়েছে।
মায়ের দুধের পাশাপাশি ওই চিনির পুতুলকে কৌটার দুধও খাওয়ানো হতো। ডানো দুধের পাঁচ পাউন্ডের বড় বড় টিন আনা হতো। এই ডানো দুধের প্রতি আমরাও সবাই কমবেশি লোভী ছিলাম। কারণ এই দুধপাউডার এমনিতে খেতেও ভারি সুস্বাদু ছিল। বাসায় চা বানাতেও এই দুধ ব্যবহার করা হতো। কিন্তু চায়ের দুধের টিন আলাদা করে কেনা হতো।
টিনের দুধ খেয়ে খেয়ে বড়চাচিমার চিনির পুতুল লাগাতার হাগুমুতু করত। সারাদিনে গামলা-কে-গামলা হাগুর কাঁথা জমে যেত। আম্মাকে দেখতাম সেইসব নোংরা কাঁথা অক্লেশে ধুয়ে দিচ্ছে। জল গরম করে কাঁথায় শুকিয়ে-থাকা হাগু পরিষ্কার করে রোদে মেলে দিচ্ছে। এতসব কাজবাজ করেও আম্মা ওই শিশুটির শরীরে নিয়ম করে সর্ষের তেল মালিশ করে দিত। হারিকেনের আগুনে পুরাতন কাপড়ের নরম ত্যানা গরম করে সেঁক দিয়ে দিত। ওই চিনির পুতলাকে আমরাও অত্যন্ত ভালোবাসতাম। কারণ বহুদিন বাদে আমরা খেলার জন্য একটা জীবন্ত পুতুল হাতের নাগালে পেয়েছিলাম।
আম্মা অজস্র চুমকুড়িতে ওই পুতুলের মুখ-চোখ-কপাল ভরিয়ে দিত। যত্ন করে নিজের বুকের ওমে রাখতে রাখতে বলত —
এই পোলার নাড়ি আমিই কাটছি।
শুনে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। ‘নাড়ি’ কী জিনিস? আমি তো ‘নাড়ি’ চিনি না!
আম্মা ওই শিশুকে দুইহাতে দোলাতে দোলাতে বলত —
নার্স আমারেই বলল নাড়ি কাটতে। সে সুতা দিয়া নাড়ি বাইন্ধা দিলে আমিই কাটলাম। কাইটা কোলে তুইল্যা নিলাম।
পরবর্তীতে আব্বা যখন চাচাজানের সংসার থেকে নিজের সংসার আলাদা করে ফেলল আম্মা টানা দুইদিন নাকচোখ রক্তজবা করে কেঁদেছিল। আমি জানি, আম্মা কেঁদেছিল ওই শিশুটিকে প্রতিদিন কাছে না-পাবার দুঃখে। দেখতে না-পাওয়ার বেদনায়। বড়চাচিমার ওই ছেলেটাও আম্মার খুব ন্যাওটা হয়েছিল। আমার আম্মাকে সে বলত — ‘ও বাস আম্মা’। মানে ‘ওই বাসার আম্মা।’
সংসারের নানান কূটনীতি আর অকারণ ক্ষুদ্রতায় মানুষ বড় অসহায়। মানুষ বড় বিপন্ন আর পরাধীন। ফলে ওই শিশুটিও একদিন আমার আম্মাকে ‘আম্মা’ ডাকা ছেড়ে দিলো। বড় হতে হতে দীর্ঘদিন সে আমার আম্মাকে কিছু বলেই সম্বোধন করে নাই। বোবা চোখে ঘাড় কাত করে আম্মার দিকে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত…!
ব্যানারে ব্যবহৃত ছবিকাজের শিল্পী আহমদ সায়েম
- সুরমাসায়র ১২ || পাপড়ি রহমান - July 8, 2020
- সুরমাসায়র ১১ || পাপড়ি রহমান - July 2, 2020
- সুরমাসায়র ১০ || পাপড়ি রহমান - June 23, 2020
COMMENTS