উমবার্তো একো সেভাবে জনপ্রিয় ও আলোচিত হতে পারেননি। তাঁর পাঠকভাগ্যও ঈর্ষণীয় হয়নি। কারণ, তিনি সময় ও বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের বোধের মনোজগৎকে লেখার বিষয় করে তুলেছেন। টিএস এলিয়ট বা স্য জন পার্সের সময়ভাবনার বাতিককে গল্প ও আখ্যানে নবআঙ্গিকে প্রাসঙ্গিক হতে বাধ্য করেছেন। সময়ের জটিল আবর্তকে চিন্তার অধীন করেছেন একো। তাঁর ভাষা তাই চিন্তাকে বর্ণনা করে। আখ্যানের বীজাধার চিন্তার সঙ্গে সংলাপ সারে। বোধের জগতে বিপর্যয় ঘটার মতো হেঁয়ালি তৈরি করায়। সমকালের দ্বন্দ্বসংকুল জগতকে কূলকিনারহীন আগামীর দিকে ধাবিত করায়। সাধারণের পক্ষে এই কাহিনিবিহীন কাহিনির নাগাল ধরা যে-কারণে মুশকিল মনে হয়। এর ভাষা অনুবাদ করা কঠিন। একো বহু-অনূদিত লেখক নন। তিনি সেই লেখক যিনি বিজ্ঞানীদের চিন্তা ও ভাষার জগতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমানে ছুটেছেন। গল্প বলার কাঠামোকে নতুন আঙ্গিকে পালটে দিতে চেয়েছেন। এ-যুগের লেখকদের জন্য এর তাৎপর্য অসীম। গল্পভাষা নিয়ে ভাবতে বসে নমস্য এই লেখককে তাই মনে রাখতেই হচ্ছে।
আমাদের আগামী সময় দেশ-কাল-জাতীয়তার সকল ঘেরাওর মধ্যে ঘূর্ণিরত হওয়ার পরেও ক্রমশ দেশ-কাল-জাতীয়তাবিহীন অখণ্ড বিশ্বায়নের দিকে ছুটবে। সেখানে সময়ের চোরাগতি ও টানাপোড়েন স্বয়ং আখ্যানের চরিত্রে কথা কইতে ব্যাকুল হবে। বোর্হেস বা একো-র মতো জটিলাঙ্গের লেখকরা সেখানে অমোঘ ও প্রাসঙ্গিক বলে বিবেচিত হবেন। বর্তমান ও আগামীর লেখাপত্র হয়তো অণু-আখ্যান থেকে বৃহৎ-আখ্যানের সকলপ্রকার আঙ্গিক ও ভাষশৈলীকে লেখকদের জন্য নিরীক্ষার বিষয় করে তুলবে। উমবার্তো একো যেমন আগস্ট মন্তেটেরেসো-র The Dinosaur নামক এক-বাক্যের অণুগল্প (“সে যখন ঘুম থেকে জেগে উঠল, ডাইনোসর তখনও সেখানেই ছিল।”) বিষয়ের অভিঘাত বিবেচনায় আখ্যানের মর্যাদা দিতে তিলেক দ্বিধা বোধ করেননি। একো-র হয়তো মনে হয়েছে এমন একটি বাক্য লেখক লিখেছেন যেটি কল্পনার বুদবুদকে নিমিষে জাগিয়ে তোলে। এই একটি বাক্যই যথেষ্ট সেই পাঠকের জন্য যে এটিকে উৎসমুখ হিসেবে পড়ে নিতে পেরেছে। যেটি হয়তো প্রকারান্তরে সেই পাঠককে আখ্যানে বিস্তারিত হওয়ার মতো ভাষাবিশ্ব রচনায় প্ররোচিত করতেও পারে। এটি হলো সেই মুক্তক্রীড়া যেখানে রচয়িতা আপনাকে নতুন কোনও প্লট ছকে নবীন ভাষাপ্রকৌশল তৈরির সুযোগ করে দিচ্ছেন।
আপাতভাবে এটি খেলা কিন্তু প্রকারান্তরে এভাবে একটি ক্ষীণকায় বাক্য থেকে দীর্ঘায়তন বয়ান রচিত হওয়া সম্ভব। ঘুম থেকে জেগে ওঠা ও ডাইনোসরকে জেগে থাকতে দেখার মধ্যে যে বিষম বৈপরীত্য ঘটে, প্রাগ-ইতিহাস ও সমকালীনতার যে-বিষমানুপাত মনকে উদ্বিগ্ন করে তোলে, সেই অভিজ্ঞতা প্রকারান্তরে আমাদের ইতিহাসবোধকে বিপন্ন করে। বাস্তবে বিরাজিত বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত অভ্যস্ততা অথবা যেভাবে ‘সবকিছু ঠিকঠাক আছে’ মনে করে আমরা নিশ্চিন্তে ঘুম যাই, অতঃপর জেগে উঠার পর ডাইনোসরকে জীবনানন্দের উটের গ্রীবার মতো বাড়ির জানালার পাশে গলা বাড়িয়ে জেগে থাকতে দেখি, — এই চমক নিমিষে সব বোধ-অনুভূতিকে ছারখার করে দিয়ে যায়। মনে হয় রদ্দিকালের সেই হ্যামলেট খাপে তলোয়ার ঢুকিয়ে “To be, or not to be, that is the question: / Whether ’tis nobler in the mind to suffer / The slings and arrows of outrageous fortune, / Or to take arms against a sea of troubles/And by opposing end them. To die-o sleep,..” ইত্যাদি বলে দীর্ঘ বক্তিমা দিতে শুরু করেছে।
মিতকথনে ইঙ্গিতসূত্র ধরিয়ে দেওয়ার এই খেলাটি থেকে অনেকদূর গমন সম্ভব এবং একেই জাঁ বদ্রিলার হাইপাররিয়্যাল বলে দাগাঙ্কিত করেন। চারপাশের অজস্র চিহ্নসূত্র থেকে উৎসমুখ বেছে নেওয়া এবং সেখান থেকে নতুন Abstraction তৈরির খেলায় মেতে ওঠা। সাহিত্যের সামাজিক দায়ফায় তাই আমার মগজে আজকাল আর সেভাবে ক্রিয়া করে না। আমরা বসবাস করি মানুষের বানানো এক অধিবিশ্বে। এই বিশ্বের সঙ্গে প্রকৃতিরচিত বিশ্বের মিলন ও সংঘাত দুয়ে মিলে অজস্র চিহ্নসূত্র জন্ম নিচ্ছে প্রতিক্ষণ। দেয়ালে পোকা গলাধঃকরণে তৎপর টিকটিকি হয়তো আপনার মনে বিজ্ঞানের সমর্থনবিহীন কোনও দ্বিরাভাস জাগিয়ে তুলতে পারে। আপনার মনে হতে পারে টিকটিকিটি ডাইনোসরে রূপ নিতে চলেছে অথবা আপনি আসলে টিকটিকি নয় আদ্যিকালের টেরোডেকটাইলকে আকাশে পাক খাওয়ার পরিবর্তে দেয়ালে সেঁটে যেতে দেখছেন। আপাত সংযোগবিহীন এই বিভ্রম থেকে কাফকার পোকা হওয়ার কাহিনি জন্ম নেয়, যেটি সমাজকেও পরোক্ষ ইঙ্গিতে পরিষ্কার দেখিয়ে দেয়।
কিংবা ধরুন, রেনে ম্যাগ্রিট টোব্যাকো পাইপের ছবি এঁকে ক্যাপশন জুড়ে দিয়েছেন : — This is not a pipe. এই সূত্রে জানিয়ে রাখি ম্যাগ্রিটের ক্যানভাসে চিত্রায়িত পাইপকাহিনি নিয়ে ফুকোঁ-র This is not a pipe নামক একশ’ পৃষ্ঠার রচনাটি এককথায় দুর্দান্ত। সময় করে দেখে নিয়েন। আপনার মনোজগতের কাঠামোকে ধন্ধে ফেলে দেওয়ার জন্য এই বাক্যখানাই যথেষ্ট। অতঃপর সেটি থেকে কীভাবে আপনি বিস্তারে যাবেন, এর থেকে নিস্তার কী করে জুটবে, নতুন কোনও Abstraction ফেঁদে কীভাবে প্রমাণ করবেন ম্যাগ্রিটের পাইপখান বাস্তবের নকলি অথবা সেটি অন্য কিছু, এমনকিছু যেটি টোব্যাকোপাইপ যদি কোনওদিন জগৎ থেকে বিলুপ্তও হয়, এই চিত্রের বদৌলতে সে নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়ে যাবে ইত্যাদি। ভাষা ও কাহিনি বলতে আমি (হয়তো আমার ভাবনা ভুলে ভরা) এখন এসবই বুঝি। তার বদৌলতে কিছু কথামালা কাঠামোছকে স্বীকৃত গল্প বা আখ্যানে বলার চেষ্টা করি। এই আফসোস মনে রেখে যে, — শেষতক কাজের কাজ কিছুই হয়নি, তবে দেখা যাক পরেরবার যদি কিছু হয়!
…
উমবার্তো একো তাঁর নিজের বই পড়া ও না-পড়া সম্পর্কে যে-কথাগুলো ইঙ্গিতসূত্রে বলেছেন, সন্দেহ নেই কমবেশি সকল লেখক-পাঠকের জন্য সেটি প্রযোজ্য। আমাদের প্রত্যোকের ভাণ্ডারে এ-রকম বহু বই যত্নে পড়ে থাকে কিন্তু ফিরে পড়া হয়ে ওঠে না, অথবা পড়তে গিয়ে পড়ার ইচ্ছে মরে যায়। আবার না-পড়ে নিদান হাঁকা সম্পর্কে যে-কথাগুলো আপনার লেখায় (দেখতে চাইলে https://gaanpaar.com/umberto-eco-obituary-by-zahed-ahmed/ এই লিঙ্কটি দেখুন। — গানপার) একো-প্রসঙ্গে উঠে এসেছে সেটা অসত্য নয় মোটেও। এ-ধরনের কম্মো যারা ঘটান তাদের সমালোচনা সে-কারণে স্বাভাবিক মনে করি। কথা হলো এই প্রবণতা দেশে-বিদেশে অনেক লেখকদের মধ্যে কমবেশি রয়েছে। কিন্তু বিষয়টি কেন ঘটে সেই তদন্ত যদি আপনার লেখায় আরও বিশদ হতো তবে আখেরে পাঠক উপকৃত হতেন। সে-জায়গায় বোধহয় খানিক ঘাটতি রয়ে গেল। কথাটি এ-জন্য বলছি, বহুল চর্চিত, অনূদিত ও পরিচিত ইত্যাদি শব্দগুলো আসলে স্ববিরোধী। আমরা এই শব্দগুলো গুণী কোনও ব্যক্তি বা লেখকের কৃতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে অহরহ প্রয়োগ করি। কবুল করছি আমি নিজেও তার বাইরে নই। কিন্তু এই শব্দগুলো আমার মনে স্ববিরোধ জাগায়, যখন ভাবি, ‘চর্চিত, অনূদিত ও পরিচিত’ এইসব অভিধার মাপখানা আসলে কী? কী দিয়ে নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব একজন একো বা বোর্হেস সত্যি বহুলপঠিত বা অনূদিত?
যেমন ধরুন, বোর্হেস কয়েক দশক ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে অনুবাদের সূত্রে দেশে-বিদেশে চর্চিত হয়ে আসছেন। তারপরেও কেন মনে হয় তাঁর লেখাপত্র (আমার যৎসামান্য পাঠসূত্রে) আদতে পাঠশূন্যতার মরুভুমিকেই নির্দেশ করে! বোর্হেস তাঁর প্যারাবলে যেসব প্রসঙ্গের সূত্রপাত ঘটান তা অনূদিত হয়ে চলেছে সত্য, কিন্তু এর মধ্যে নিহিত দ্বিরাভাসের সাহিত্যিক প্রয়োগ কি ব্যাপক হয়েছে কখনও? আমার ঠিক জানা নেই। বোর্হেস নিয়ে এন্তার বইপত্র লেখা হয়েছে। সিনেপর্দায়ও জায়গা মিলেছে তাঁর। বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে চর্চাও কম হয়নি। কিন্তু সাহিত্যের যেটি মূল লক্ষ্য, ভিন্নমাত্রায় কথা কইছে এমন সাহিত্যভাষাকে গণের বোধগম্য করে তোলা, সেই চর্চা কি সত্যি ব্যাপক? যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে বোর্হেসের লাতিন আমেরিকার সাহিত্য ছাড়িয়ে বিরাট প্রভাববিস্তারী এক বৈশ্বিক ঘটনা হওয়া অনিবার্য ছিল। আমার ক্ষুদ্র পর্যবেক্ষণে এর সমর্থন পাই না। সাহিত্য বা সাহিত্যের রস থেকে সৃষ্ট যে–কোনও সৃজনশীল মাধ্যম, আমার ব্যক্তিগত বিবেচনায় বিশেষজ্ঞের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকার বস্তু নয়। এর ভিতেরে যে–রসধারা বহুমাত্রায় চুঁইয়ে পড়ে তাকে ক্রমে সাধারণের নাগালে আনার মধ্যেই একজন ভিন্নমাত্রিক লেখক প্রকৃত অর্থে বহুপঠিত ও অনূদিত হয়ে ওঠেন। অন্যথায় মানুষের সৃষ্ট জ্ঞান–বিজ্ঞান–শিল্পকলার কোনও তাৎপর্য দাঁড়ায় না। গোটা বিশ্ব এখন নানা বিষয়ের চর্চায় এত বেশি ‘কতিপয়’-র মধ্যে সীমিত হয়ে পড়েছে যে সেই গণ্ডি কেটে বিষয়গুলোকে সর্বসাধারণের মনের তারে পৌঁছানোর সূত্রগুলো আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। একো-র ক্ষেত্রেও ঘটনা তা-ই।
জয়েস কিংবা আরও বহু প্রণম্য লেখকরাও সেখানে ব্যতিক্রম নন। যে-কারণে আপনি যখন বাংলা ও বিশ্বভাষায় একো চর্চার খতিয়ান তুলে ধরেন, সেটা বাহ্যত ঠিক ও সমর্থনযোগ্য মনে হলেও, একো তাঁর জীবনব্যাপী কাজের বহুধা ক্ষেত্রগুলোয় ভাষা ও ভাবনার যে বনেদ তৈরি করে গেছেন সাধারণের বিশ্বের সঙ্গে তার সংযোগ কি সত্যি ঘটাতে পেরেছেন সেইসব পাঠকরা, যারা একো–কে এস্তেমাল করেছেন বলে আমরা নিশ্চিত? বোর্হেস বা একো–র মতো লেখকরা যখন বিশেষায়িত পাঠকমহলের ঘেরে জিম্মি হয়ে পড়েন, তখন সেটা প্রকারান্তরে তাঁদের অনন্য চিন্তা ও সৃজনসূত্রকে শ্বাসরোধ করে মারে। আমরা এমন কোনও ভাষার সন্ধান এখনও করতে পারিনি, এমন কোনও গ্রন্থপ্রকাশ ও তাকে ঘিরে বহতা ব্যাখ্যানের জগৎ গড়ে তুলতে পারিনি, যেটি একো-র মতো লেখককে সাধারণের গোত্রে অন্তত গ্রহণীয় করে তুলবে। সালমান রুশদীর কথাই ধরুন। রুশদী একো-র তুলনায় সহজগম্য, সহজপাচ্যও বটে। তার বই অনুবাদে, বিপণনে এবং গ্রহণীয়তায়ও ব্যাপক। তথাপি রুশদীরই কোনও-এক সাক্ষাৎকারে (এখন নাম স্মরণ হচ্ছে না) পড়েছিলাম, সেখানে তিনি অনেকটা এ-রকম বলছিলেন : — আমার বই ভালোই বিকোয় সে আমি জানি। তবে কেন যেন সন্দেহ হয় পাঠকরা বইটি কেনেন মাত্র এবং উলটেপালটে রেখে দেন বুককেসে। তাদের ঠিক কত শতাংশ সেটি হৃদয়ঙ্গম করার জন্য পড়েন সে-নিয়ে আমি মোটেও নিশ্চিত নই।
একো রুশদীর চেয়ে এককাঠি সরেস। আমি তাঁর যৎসামান্য যেটুকু পড়ার চেষ্টা করেছি, ইন্টারন্টে বা এর বাইরে যেটুকু খোঁজখবর রাখার আগ্রহ বোধ করেছি, তাতে কখনও মনে হয়নি এই লেখকের মনোজগৎকে ব্যাখ্যা করার মতো যথেষ্ট কাজ বিশ্বে হয়েছে। যেটা হয়েছে সেটা একো–র লিখনশৈলীর বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের ব্যবচ্ছেদ, কিন্তু সেটা কেমন যেন একঘেয়ে সুরতালে বাঁধা। সেই সুরতাল অতিক্রম করে তাঁকে ব্যাপক-বোধিগম্য করার কাজটি (আমার পঠনসীমাবদ্ধতা স্বীকার করে বলছি) কি হয়েছে? সে-রকম বই ও ব্যক্তির নাম জানা থাকলে বলবেন। আমি পড়ার চেষ্টা নিঃসন্দেহে করব। সত্যি কথা বলতে কি আমাদের শিক্ষিতজনচর্চিত সাহিত্যের এটি হয়তো সীমাবদ্ধতা, এর উৎকর্ষের জায়গাগুলোকে এখন আর ব্যাপক সাধারণের নিকটে পৌঁছানোর সড়ক আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আমার সামান্য বিবেচনায়, বিজ্ঞানের ভাষাজগৎ বরং এখন এক্ষেত্রে অনেকবেশি সফল। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্বের প্রথম পাঠ বার্ট্রান্ড রাসেলের বঙ্গানুবাদসূত্রে হয়েছিল। অ্যাকাডেমিক পর্যায়ে আপেক্ষিকতার বিষয়টি আমার ঠিক বোধগম্য হয়নি তখন। বিজ্ঞানের ছাত্র হলে হয়তো চট করে বুঝে যেতাম। সেদিকে যাওয়া হয়নি বলে আপেক্ষিকতাবাদ আমার কাছে ধাঁধা মনে হতো। রাসেলকে পেয়ে ভেবেছিলাম এবার অন্তত চিন্তার গোড়াটা ধরা যাবে। যেহেতু জটিল বিষয়কে রাসেলের মতো সহজপাচ্য করে বোঝানোর ক্ষমতা খুব কম লোকেরই থাকে। অকপটে স্বীকার করছি, আমি কিন্তু একাধিকবার পড়েও আপেক্ষিকতাবাদের অ, আ, ক, খ তখন ধরতে পারিনি। রাসেলকে এই প্রথম আড়ষ্ট মনে হয়েছিল। বিষয়টি অনেক সহজভাবে বুঝে ফেলা গেল হকিংয়ে এসে। আর এখন তো এটি এতটাই চর্চিত যে বিজ্ঞানে বিশেষ দড় না হয়েও ইন্টার্নেট ঘাঁটলে এর মূল চিন্তাসূত্রকে বুঝে ফেলা সম্ভব। যদিও এটিকে ঘিরে নতুনতর চিন্তার দিকে যেতে হলে বা যারা এখন যাচ্ছেন, সেই ক্ষেত্রে উৎসাহী পাঠকের বিজ্ঞানের রকমারি বইপত্র ও ডিজিটাল ডকুমেন্ট ঘাঁটা আবশ্যক।
একো বা বোর্হেসের বেলায় সে-রকম কোনও ঘটনার নজির আমার জানা নেই। বোর্হেসের ছোট্ট প্যারাবল On Exactitude in Science থেকে বদ্রিলার সিমুলাক্রামের মতো বিরাট তত্ত্ব ফাঁদার রসদ পেয়েছেন এবং এভাবেই বড় লেখকরা কালের ধারায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। কিন্তু সেই বোর্হেসকে অনুধাবনের ক্ষেত্রে সাহিত্যপাঠকদের (এমনকি অনেক বড় লেখক) মধ্যে একধরনের অস্বস্তি কাজ করে। কারণ বোর্হেসের লেখাপত্র দর্শনের অন্তঃমূলে প্রোথিত। যার ফলে এ-সম্পর্কে খোঁজখবর ভালো জানা না থাকলে তাঁর সাহিত্যের রস ও শক্তির জায়গাটি ধরা মুশকিল। যেমন, রাজু আলাউদ্দিন আমাদের একজন অগ্রগণ্য অনুবাদক। লাতিন সাহিত্যের অনুবাদে তাঁর দক্ষতা ও কুশলতা বিদিত সর্বজনে। ভদ্রলোক সম্ভবত ইংরেজি ও স্প্যানিশ দুটো ভাষায় দক্ষ। কিন্তু On Exactitude in Science-এ তাঁর অনুবাদ পড়ে আমি হোঁচট খেয়েছিলাম। অনুবাদে ভুলচুক ঘটেছে ঘটনা এমন নয়। তবে তাঁর বাক্যচয়নের মধ্যে সেই বিষয়টি ছিল না যেটি বোর্হেস ওই ছোট্ট ধাঁধায় তীব্র করে তুলতে চেয়েছেন, যেটি বদ্রিলারকে নিয়ে যাচ্ছে সাইমুলেশন ও হাইপাররিয়্যালের মতো তাত্ত্বিক ভাবনার দিকে। বরং অশ্রুকুমার সিকদারের অনুবাদটি আমার কাছে নিকটবর্তী ও প্রাণবন্ত ঠেকেছিল। রাজু আলাউদ্দিনের সমস্যা এখানে যে, তিনি সাহিত্যিক বয়ান হিসেবে একে পড়েছেন, সাহিত্যের সমতলে এর ভিতরে লুকিয়ে–থাকা দার্শনিক অনুভূমিকে আশ্রয় করে যে–ধাঁধার সূত্রপাত সেটা পড়ে উঠতে পারেননি।
একো-র বাংলা অনুবাদ সম্পর্কে আমি সত্যি জানি না। অনেকদিন ধরে সাহিত্য পাঠের ধারা আমার জীবনে সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে অন্য বিষয়ের চাপে। তবে একো-র রোজ বা ফুকো–র দোলক যেটুকু পড়েছি তাতে তাঁর লেখনীর ধারার সঙ্গে অন্যভাবে স্তানিস্লভ লেম প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন। সেইসঙ্গে সেমিওটিকসের দর্শন ও বিজ্ঞান প্রসূত অধুনা অ্যানালিটিক্যাল ধারাগুলো প্রাসঙ্গিক হয়। সেটাকে মাথায় রেখে পড়লে অনুবাদ হবে একরকম। ওটা গৌণ করে দিলে উইট, হিউমার ও থ্রিলারের আমেজ জাগবে বটে, তবে সেটা মূল ভাববস্তুর (যেহেতু ইতালিয় ভাষায় যাওয়ার উপায় নেই বহুভাষা জানা না থাকার সীমাবদ্ধতার কারণে এবং সেক্ষেত্রে ইংরেজিসূত্রে যা পাওয়া গেল তাকে মান ধরে নিয়ে) প্রতি কতটা সুবিচার করতে পেরেছে সেই প্রশ্নটি উঠবে। এ–বিষয়ে আপনার মন্তব্য চাইব এ–কারণে যে একো আমার কাছে তীব্র ও ক্ষুরধার এক লেখক, যাঁকে পড়তে পরিশ্রম হয় অঢেল। আমি যৎসামান্য ঘেঁটেছি এবং মনে হয়েছে তাঁকে বুঝতে হলে আরও নানা বিষয়ে সফরটা জরুরি। অন্যথায় Super Structure-এ মন পড়ে থাকে। এটাও দারুণ, তবে একো আরও বেশি দাবি করেন। সেই অর্থে তাঁর পঠিত হওয়ার বিষয়টি কেমন যেন সন্দেহজনক ঠেকে। আমার সামান্য পাঠে রুশদীর একটি নিবন্ধে ( দুঃখিত বেশ আগে পড়া এবং নাম ভুলে গেছি) একো নিয়ে কিছু ব্যাখ্যা পেয়েছিলাম যেটি তাঁকে ধরতে সাহায্য করেছিল।
যা-হোক, এসব বলার অর্থ কিন্তু কোনওভাবেই আপনার লেখার মূল বক্তব্যের বিরোধিতা নয়। আপনি নিজের জায়গা থেকে সঠিক কথাগুলোই বলেছেন। তবে সাহিত্য (আমার ভুলও হতে পারে) যেভাবে বিশেষায়িত কন্টেন্ট হয়ে উঠছে, তার নানামুখী ইন্টারপ্রিটেশন ছাড়া একো বা বোর্হেসের মতো লেখকদের সৃজনকৌশলের দিকে গণপাঠকের আগ্রহ তৈয়ার করা কঠিন মনে হচ্ছে। মনে রাখতে হচ্ছে, ভার্জিনিয়া উলফের মতো লেখক (যদি ভুল স্মরণ করে না থাকি) জয়েসের ইউলিসিসপাঠে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তাঁর কাছে সংলাপ ও বিবরণ-আঙ্গিকে চলমান দার্শনিকতাকে সাহিত্যরসের পক্ষে ব্যাঘাত মনে হয়েছিল। তো, সেই জয়েসকে পাঠ করতে গেলে এই স্বীকৃতি আগে প্রয়োজন ‘চিন্তা ও ভাবুকতা’-র তীব্র চাপকে আমরা সাহিত্যের একটি অন্যতর আয়তনে স্বীকার করতে সম্মত কি না। ‘বহুলচর্চিত’ অভিধাকে সেভাবে বিবেচেনা করার সুযোগ রয়েছে। আমার বক্তব্যে কোনও ভুল থাকলে শুধরে দেবেন। ফিরে ভাবার সুযোগ হয়তো পাবো।
উমবের্তো একো প্রয়াণের অব্যবহিত পরে লেখকের সঙ্গে ইমেইল কনভার্সেশনের একাংশ এই তাৎক্ষণিকা। — গানপার
… …
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS