একটা বই একেবারেই না পড়ে সেটি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের মতামত রাখা আজকাল বোধগম্য কারণেই অসম্ভব কিছু নয়। সর্বকালেই মিথ্যাবাদী একশ্রেণির পাঠক থাকে, এদের দৌরাত্ম্য ধরার আগেই কালক্ষেপণ হয়ে যায় অনেক। ফলে মিথ্যা পাঠে এবং মিছেমিছি পাঠোত্তর প্রতিক্রিয়ায় ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে যায় মিথ্যাচার সনাক্ত করার ঢের আগে। একটা সময় ছিল যখন কেবল অন্যের মুখে শোনা বা বড়জোর বইয়ের মলাটে পরিচিতিমূলক বাক্যরচনাগুলো পড়ে বইটি সম্পর্কে বেশ ‘জ্ঞান’ অর্জন করত ওই মিথ্যাবাদী/মিথ্যাচারভরা পাঠকেরা। আজকাল প্রযুক্তিস্ফীতির ফলে নানাভাবে একটা বইয়ের ভালোমন্দ চাউর হয় চারপাশে। মূল বই না পড়ে কারো সাক্ষাৎকার বা ব্লগ ইত্যাদি থেকে একটা বই সম্পর্কে বেশ সহজেই জেনে যায় ওই চৌকস মিথ্যাপাঠকেরা। তার মানে আগের যে-কোনো সময়ের তুলনায় এই সময়টা পাঠামোদীদের জন্য অধিক জটিল ও বিভ্রান্তিবিস্তৃত সময়। মিথ্যাচারী পাঠকের পায়াভারী পদচারণায় পীড়িত ও পর্যুদস্ত সত্যিকারের নিরিবিলি পাঠকভুবন। সত্যিপাঠকের কোণঠাসা হালত পরিবর্তনের পরিবেশ যদি ফেরে কোনোদিন, কোনো সৌভাগ্যরজনীদিনে, দারুণ হবে তখন। আপাতত সান্ত্বনা এ-ই যে, সেই মহান পাঠক পড়বেন স্রেফ নিজের সংবেদন তৃপ্ত করার গরজে, দেখানোপনার জন্য নয়।
উমবের্তো একো ওই পড়া/না-পড়া বা পঠন-অপঠন নিয়ে একেবারে চমকে দেয়ার মতো অভিমত প্রকাশ করেছেন, সেদিন একটা ছোট্ট রচনা চোখে পড়ল উমবের্তোর ঠিক এ-সংক্রান্ত। হুবহু লেখাটা সামনে নেই, স্মৃতি থেকে টেনে বের করছি এখন। মোদ্দা বক্তব্যটা হলো, উমবের্তো বলছেন, তিনি তার আলমিরায় ছিৎরে-থাকা বিচিত্র সব গ্রন্থাবলির ভেতর থেকে অতি কিয়দংশই পড়েছেন। বেশিরভাগ বই খুলেও দেখা হয় নাই, যদিও যত্নে সেগুলো সংরক্ষিত তার ব্যক্তিগত গ্রন্থঘরে তিন-চার দশক ধরে। আবার তিনি এ-ও বলছেন, বইগুলো তার না-পড়া/অপঠিত নয় একেবারে। কেননা একটা বই একবারও পৃষ্ঠা না উল্টে পড়ে ফেলার বহু পথ রয়েছে, একো জানাচ্ছেন। একটা পথ, ওই বইটি সম্পর্কে বিভিন্ন আলোচনা থেকে, যেমন বুকরিভিয়্যু প্রভৃতির মাধ্যমে, বেশ জেনে ফেলা যায়। অপরাপর লেখক বা পাঠকের নানান প্রতিক্রিয়া থেকে এটি খুবই সম্ভব কোনো-একটা বইয়ের গুণাগুণ আন্দাজ করে ফেলা। এটি আরও সম্ভব রেফারেন্স-টীকাটিপ্পনী পড়তে যেয়ে ফ্যুটনোটে এর সম্পর্কে বেশ ইশারা-ইঙ্গিত ইত্যাদি পেয়ে যাওয়া। ফলে বেশিরভাগ বই সম্পর্কেই আমাদের কাজোপযোগী ভালো বোঝাপড়া একটা হয়েই যায় সেসব বই একবারটি না-খুলেও।
পড়া/না-পড়া বিষয়ে একোর সেই লেখাটা ‘সাময়িকী’ নামের একটা ওয়েবপত্রিকায় বেশ-অনেক বছর আগে বেরিয়েছিল বঙ্গানূদিত হয়ে; এখন ওই ওয়েবক্ষেত্রটা কার্যত লুপ্ত-লিঙ্কবিচ্ছিন্ন বলে ঘেঁটে বের করা যাবে না আর। কাজেই ওই রাস্তা মাড়ানো সম্ভব নয়। নিবন্ধকারের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে সেই কোটেশনটুকু পুনরুদ্ধার করা যেতে পারে। এই রচনাটাতে রয়েছে একো-র বইপাঠাভ্যাস বিষয়ক অটোবায়োগ্র্যাফিক অভিমত। সচরাচর লেখকেরা তাদের বইপাঠের অভ্যাস ও প্রবণতা বিষয়ে বলতে যেয়ে যেমন উচ্চাঙ্গকণ্ঠী হয়ে ওঠেন, উমবের্তোর এই একপ্যারা স্বীকারোক্তি বিপরীতস্বর এবং ইন্ট্রেস্টিং। এখানে লেখাটা আরেকবার পড়া যাক, পুরোটাই, ছোট্ট রচনাটার বঙ্গানুবাদক মাহবুব মোর্শেদ।
“দুনিয়ায় পড়ার মতো যত বই, সময় তার চাইতে অনেক কম। ফলে আমরা না-পড়া বইগুলা দিয়া গভীরভাবে প্রভাবিত হই — যে পড়ার সময় আমাদের নাই। কে ‘ফিনেগান্স্ ওয়েক’ শুরু থিকা শেষ পর্যন্ত আসলেই পড়ছে? কিংবা কে বাইবেলের ‘জেনেসিস’ থিকা ‘অ্যাপোক্যালিপ্স্’ পর্যন্ত পড়ছে? তারপরও যে-বইগুলা আমি পড়ি নাই সেইগুলা সম্পর্কে আমার সন্তোষজনক ও সঠিক ধারণা আছে। অস্বীকার করব না যে ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস্’ আমি ৪০ বছর বয়সে পড়ছি। কিন্তু এ-বইয়ের মূল ব্যাপারগুলা এর আগে থিকাই আমার জানা আছিল। ‘মহাভারত’ আমি কখনোই পড়ি নাই, তারপরও আমার কালেকশনে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় মহাভারতের তিনটা সংস্করণ আছে। কে সত্যিকার অর্থে ‘কামসূত্র’ পড়ছে? তারপরও সবাই এই নিয়া কথা বলে, কিছু লোক তো চর্চাও করে। আমরা দেখি দুনিয়াটা না-পড়া বইয়ে ভরা, তবু আমাদের জানাশোনা ভালোই। এখন একটা না-পড়া বই হাতে তুইলা নিলে যে আমরা দেখি বিষয়টা আমাদের জানা, কেমনে এইটা ঘটে? প্রথমত বুঝনেঅলাদের ব্যাখ্যা — আমি না-চাইতে ওই বই থিকা কিছু তরঙ্গ হয়তো আমার মধ্যে আইসা ঢুকছে। দ্বিতীয়ত, এইটা হয়তো ঠিক না যে বইটা আমি কখনোই খুলি নাই। সময়ের পরিক্রমায় আমি তো বাধ্যগতভাবেই বইটা এক জায়গা থিকা আরেক জায়গায় নিয়া গেছি, জায়গা বদলের সময় হয়তো পাতা উল্টাইছি। কিন্তু পাতা যে উল্টাইছি, সেইটা পরে ভুইলা গেছি। তৃতীয়ত, বছর বছর আমি যে বইগুলা পড়ছি তাতে এই বইটার উল্লেখ হইছে। ওইভাবে বইটা আমার চেনা হয়ে উঠছে। যখন লোকে আমারে জিগায় যে অমুক কি তমুক বইটা আমি পড়ছি নিকি, আমি একটা নিরাপদ উত্তর দেই। বলি, আপনে তো জানেন আমি লেখক, পাঠক না। এমনে লোকের মুখ বন্ধ হয়। তারপরও কিছু প্রশ্ন সময়ে সময়ে ঘুইরা ফিইরা আসতে থাকে। যেমন, আপনে কি থ্যাকারের ভ্যানিটি ফেয়ার উপন্যাসটা পড়ছেন? উত্তর দিতে দিতে হতাশ হয়া বইটা তিনটা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আমি তুইলা নিছিলাম, পড়ার চেষ্টাও করছি। কিন্তু দেখলাম, বইটা ভয়ানক বাজে।”
একো-র এহেন অভিব্যক্তি কতটুকু গুরুত্বের সঙ্গে নেব, প্রশ্ন বটে। এখানে তথ্য হিশেবে এটুকু উল্লেখ করা যাক, ষাটের দশকের শুরুতে একো মশাই ইতালির একটা সাহিত্যপত্রিকায় ব্যঙ্গকৌতুকভরা মাসিক কলাম লিখতে শুরু করেন, যার বেশকিছু রচনা বাছাইপূর্বক জনৈক উইলিয়াম ওয়েভার ‘মিসরিডিংস্’ নামে ইংরেজি ভাষান্তর করেন। কোনো-এক প্রকাশনা সংস্থার পক্ষে এডিটর হিশেবে নিযুক্ত উমবের্তো ওই কলামে পেশাদার পাঠকের পরামর্শমূলক প্রতিক্রিয়ার আদলে দুর্ধর্ষ মজাদার কিছু রচনা লিখেছিলেন, বাংলায় এর সঙ্গে তুলনীয় রচনার মধ্যে এ-মুহূর্তে মনে পড়ছে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের না-কাহিনিমূলক লেখাগুলোর কথা, যার অধিকাংশ ধরা রয়েছে ‘আগুন, মুখোশ পরচুলা ইত্যাদি’ বইটিতে। একো-র এই রচনাগুলোর কথা প্রথম জেনেছিলাম মঈন চৌধুরী সম্পাদিত প্রান্ত ১৯৯৩ সংখ্যায়। এখন তো গ্যুগলসার্চ দিয়ে এই বই, ইংরেজি ‘মিসরিডিংস্’, ইচ্ছেমতো পড়ে নেয়া যায় যে-কোনো সময়। এখন প্রশ্ন যদি ওঠে একো-র বক্তব্য কতটা গ্রাহ্য, খুঁজতে দেরি হলেও জবাব পেতে দেরি হবে না আশা করি। বিশেষ করে এখানে লেখকদের বা কবিদের উদাহরণ পেশ প্রাসঙ্গিক হবে। এমনটা প্রায় ব্যতিক্রমহীন লক্ষ করা যায় যে, লেখার ভেতর দরকারে-বেদরকারে এক বা একাধিক গ্রন্থের অনুষঙ্গ যখন টানতে হয় একজন কবি কিংবা লেখককে, এমনভাবে তারা তা টানেন যে পড়ে মনে হবে সেই গ্রন্থ/গ্রন্থগুলো পূর্ণাঙ্গপ্রত্যঙ্গ পঠিত তাদের। কিন্তু পুরোটাই ধাপ্পা, প্রায় ব্যতিক্রমহীন ধাপ্পাবাজি পুরোটাই, আসলে একটা ‘রামায়ণ’ একটা ‘মহাভারত’ একটা ‘ইডিপাস’ একটা ‘অডিসি’ একটা ‘বেউল্ফ্’ পূর্ণাঙ্গের সিকিভাগও না পড়ে একজন লেখক সেসব গ্রন্থ থেকে এক-আধলা উদ্ধৃতি এমনভাবে চয়ন করেন যেন ওইসব সমস্তই তার আদ্যোপান্ত পড়া। ভীষণ ভান একটা। আসলে তিনি ওইসব উদ্ধৃতির উৎস বই/বইগুলোর কিয়দংশও পড়েন নাই। কিন্তু কথা শুনে মনে হবে বা তার ন্যারেটিভ ধরে এগোলে মনে হতে পারে যেন মাতৃগর্ভে ভ্রুণাবস্থার আগে থেকেই ওইসব বইপত্র পড়া তার, যেন তিনি পুরাণবিশারদ, জাতিস্মর! বলে দিলেই তো হয় একটা বইয়ের একাংশ-আধাংশ পড়ে এবং অধিকাংশ না পড়ে নানাভাবে উদ্ধৃতি সংগ্রহ করে লেখাটা তৈরি করেছেন লেখক। পড়া মানে বাধ্যতামূলকভাবে একটা বই আদি থেকে অন্ত-উপান্ত পর্যন্ত পড়ে যাওয়া নয় নিশ্চয়ই, কিন্তু বেশিরভাগ সময় লেখকেরা পাঠকদেরকে কেন জানি মিছেমিছি ইম্প্রেসড করবার চেষ্টায় থাকেন, সর্বগ্রন্থপাঠক বলে জাহির করতে চান নিজেদেরকে। এর তো কোনো দরকার নাই। কিন্তু এ-রকম অস্বচ্ছতা সর্বদেশে সর্বকালে লেখকেরা আশ্রয় করে থাকেন দেখতে পাই। সম্ভবত এই অস্বচ্ছতাটুকু লেখালেখি প্রক্রিয়ারই অংশ। সৃজনের অন্ধকার দিক বলতে এটাকেই মিন করা হয় কি না? আসল কথাটা হলো, উমবের্তো বলে দিয়েছেন আগেই, না-পড়েও একটা বই সম্পর্কে নানাভাবেই বুঝসমুজ করে নেয়া যায়। লেখক তার পড়া জাহির করেন, রচনার শরীরে, কিন্তু না-পড়া আড়াল করেন কেন? লুকোচুরি কি ধরা যায় না? নাকি গোপন থাকে আখেরে এই লুকোছাপা? পাঠক ঠিকই ধরে ফেলে লেখকের পড়া/না-পড়ার দৌড়। হয়তো সকলের দৌড় সমান অবিলম্বে/অনতিবিলম্বে ধরা যায় না সবসময়, কিন্তু ধরা তাকে খেতেই হয়। কাজেই, সাধু কেন খানিক সেয়ানা হবেন না, মিছেমিছি কেন ধাপ্পা মারবেন এই উইকিপিডিয়াপাণ্ডিত্যের নৈপুণ্যদুনিয়ায়?
একো সম্পর্কে এক-দুইটা বাক্য অপ্রাসঙ্গিক/অতিপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে এমনটা আশঙ্কা সত্ত্বেও বলে ফেলা যাক। বাংলায় একো মোটামুটি বিখ্যাতই বলতে হবে। এই চিহ্নতাত্ত্বিক উপন্যাসকারের লেখাপত্তর বাংলাদেশের বইদোকানগুলোতে বেশ সুলভ বলা যায়। বিশেষভাবে একো-র নিবন্ধপ্রবন্ধের অ্যান্থোলোজিগুলো যথেষ্ট জনপ্রিয়ও। পড়া, না-পড়া, বোঝা, না-বোঝা, ব্যাখ্যা, অতিব্যাখ্যা, বয়ান, অতিবয়ান প্রভৃতি বিষয় নিয়া তার উদয়াস্ত উঠাবসা-নাড়াচাড়ার কারণে পোস্টমডার্ন পড়াপড়ির জগতে একো সমাদৃত। উমবের্তো একো উপন্যাস লিখেছেন সেমিয়োটিক্স নিয়া তার পাণ্ডিত্য দুনিয়াজোড়া পাঠকমহলে প্রশংসা লাভ ও লব্ধপ্রতিষ্ঠার ঢের পরে ১৯৮০ সালে এসে। জেমস জয়েস নিয়া আলোচনা করেছেন সাহিত্যতাত্ত্বিক আতশকাচ প্রয়োগপূর্বক। চিহ্নবিজ্ঞানের তত্ত্ব, চিহ্নবিজ্ঞান ও ভাষার দর্শন, পাঠকের ভূমিকা প্রভৃতি শিরোনামে একোর বইগুলো নব্বই-পরবর্তী বিশ্বে পাঠকাদৃত। উপন্যাসকার হিশেবে একো-র অভিষেক ‘দ্য নেইম অফ দ্য রোজ’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে; এরপর ‘ফ্যুকো-র পেন্ডুলাম’ নামে একটা আখ্যান। প্রথমোক্ত বইটা ইংরেজি থেকে জি.এইচ হাবীব, যদ্দুর মনে পড়ে, বাংলায় এনেছেন। মজার ব্যাপার হলো, উপন্যাসের ভেতরে একো চিহ্নতত্ত্বীয় দর্শনটাই কীর্ণ করেছেন দেখতে পাই; রিডিং, মিসরিডিং, রিজিডিটি অফ রিডিং, স্যুপার্স্টিশন অফ রিডিং ইত্যাদি বিষয় নিয়েই ডিল্ করেছেন ‘গোলাপটার নাম’ উপন্যাসে; মিথ অফ রিডিং বলে যেতে যেতে ডিমিথিফাই করেছেন গোটা রিডিং কাণ্ডটাকে। ‘ফ্যুকো-র পেন্ডুলাম’ অবশ্য নজরে হেরি নাই, কিন্তু প্লট আবর্তিত হয়েছে ওই একই ফিলোসোফি ঘিরে — এইটুকু তথ্য জেনেছি রিভিয়্যু পড়ে। একটা প্রাচীন ইতালীয় মঠের চৌহদ্দিতে একের-পর-এক কয়েকটা অ্যাসাসিনেশনের রহস্যভেদ ‘গোলাপটার নাম’ উপন্যাসের উপজীব্য। অনুসন্ধানকারী হিশেবে ইংল্যান্ডের পরিব্রাজক-সন্ন্যাসী উইলিয়্যমের ইনভেস্টিগেশন ও সেমিয়োটিক্স চাবিকাঠির সহযোগে রহস্যজাল ছিন্নকরণের থ্রিলিং কাহিনি আমরা জানতে পারি ইনভেস্টিগেটরের তরুণ সঙ্গী শিক্ষানবিশ অ্যাডসো-র জবানিতে। এক গ্রন্থাগারিকের গোঁড়া সংস্কার ও ক্ষমতালিপ্সা আবিষ্কারের পরতে পরতে পাওয়া যায় চিহ্নবিজ্ঞানেরই থ্রিল ও সাস্পেন্সভরা অ্যাডভেঞ্চার। এই ধরনের বইয়ের কাহিনিটা খোলস মাত্র, অন্তরাত্মা বা শাঁস তো খোলস খোলাসা করে দেখানো সম্ভব না। যা সম্ভব, এই ধাঁচা না-কাহিনিপ্রধান বই পড়ে যা পাঠকের পক্ষে সম্ভব, তা হচ্ছে একের-পর-এক উত্থাপিত প্রসঙ্গসূত্র/ইন্টার্প্রিটেশন রি-ইন্টার্প্রেট করা। না, ইয়েস্তেন গার্ডারের ‘সোফির জগৎ’-আদলে একো উপন্যাস লেখেন নাই; কিংবা ড্যান ব্রাউনের বেস্টসেলার ‘দ্য ভিঞ্চি কোড’ মোটেও নয়। চিহ্নব্যাখ্যার এক অনেকান্ত ও অনিয়ত ন্যাচারের কথাই যেন উমবের্তো একো বলতে চেয়েছেন তার ফিকশন ও ননফিকশন রচনারাজিতে। একটাকিছু পড়া মানেই হলো অনাদিঅন্ত বয়ান/ইন্টার্প্রিটেশন থেকে একটামাত্রই ইন্টার্প্রিটেশন অ্যাক্সেস্ করা; আর পড়া মানেই হলো অনন্ত না-পড়া; আর ভুলপড়া দার্শনিকার্থে এক্সিস্ট করে না আদতে; ভুল যদি কিছু থাকে জগতে, একো-র পয়েন্ট-অফ-ভিয়্যু থেকে, সেইটে একটা-কোনো বয়ান/ব্যাখ্যা/ইন্টার্প্রিটেশন ব্রহ্ম বলিয়া জ্ঞান করা। এইটাই ইন্টার্প্রিটেশন হিশেবে অ্যাপ্রোপ্রিয়েইট, অন্যান্য সমস্ত বয়ানাদি মিসিন্টার্প্রিটেশন — ভুল বলি বা বোকাপাঁঠার দম্ভ বলি এইটাই। বাংলা সাহিত্যে এই ভুল/বোকাপাঁঠাভ্যাভ্যা বাগানস্থ ফুল হিশেবেই নিরবধি ফুটিয়া যাইতে দেখি।
রিডিং ইজ অলোয়েজ নেসেসারিলি মিসরিডিং, — বলেছিলেন প্যল দ্য ম্যন। কথাটা রিভার্স করলেও অসত্য হবে কি? মিসরিডিং ইজ অলোয়েজ নেসেসারিলি রিডিং , — মনে হয় না? আপসাইড ডাউন যাকে বলে, একদমই ইনভার্টেড পজিশন থেকে দেখলেও ভুলপড়া ছাড়া আদৌ পড়ার অস্তিত্বও রয় না। কাজেই রিডিং এবং মিসরিডিং উভয়েরই কিনারা যাপিত জীবনে একাট্টা, গায়ে গা লাগানো, সংলগ্ন ও সন্নিহিত। একবারটা ভাবুন দিকিনি, মিসরিডিং অ্যালাও না-করলে এত এত গুচ্ছগাদার বাংলা সাময়িকী নিবন্ধপ্রবন্ধাদির চল্লিশা খাবে কে এসে, — ভূতে? কে এসে এই মিসরিডআউট অযথাদীর্ঘ রচনাখানিরে একটা আচ্ছাসে ঠ্যাঙানি দেবে, ভবিষ্যতে?
একো চুরাশি বছর বয়সে এন্তেকাল করলেন। দুনিয়াদারি থেকে প্রস্থানের জন্য পরিণত বয়স বলতে হবে। কেবল বিদায়বিউগল বাজাইবার উপযুক্ত সময় এইটা নয়। সারাদুনিয়ায় প্যান্ডেমিকের প্রসারতা থামাইবার জন্য চলছে লকডাউন। ফলে এই সময়ে যারা যাত্রা করছেন অগস্ত্য পথে, তাদের প্রোপার সৎকারটাও করা সম্ভব হচ্ছে না। তালাশি দিলেই দেখা যাবে একো অত্যন্ত সফল জীবনযাপন করেছেন। অধ্যাপনায়, অ্যাকাডেমিক গবেষণায়, সাহিত্যক্ষেত্র ও সম্পাদনায় বিস্তর কাজ করে গেছেন একো। দুনিয়াজোড়া সাহিত্যসমালোচনার জায়গায় বিগত শতকের আশির দশকে সাহিত্যতত্ত্বের আলোকে টেক্সট পুনর্বিবেচনার যে-ট্রেন্ড শুরু হয়েছিল, উমবের্তো একো ওই সময়টায় বলতে গেলে জনপ্রিয় তাত্ত্বিক হয়ে ওঠেন। মধ্যযুগীয় নন্দনতত্ত্ব নিয়া তার কাজ প্রণিধানযোগ্য। রচনাস্টাইলে চিহ্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণপ্রক্রিয়ার অত্যন্ত পরিমিত, শাণিত ও উইটি বিস্তার ঘটিয়েছিলেন একো। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ অংশের লিটলম্যাগকেন্দ্রী প্রকাশনায় দেরিদা এবং পোস্টমডার্নিজম নিয়া আলাপালোচনা চলবার সময় একো প্রসঙ্গক্রমে এসেছেন উল্লেখযোগ্য অনেক জায়গায়। জি.এইচ হাবিব ‘দি নেইম অফ দি রৌজ্’ বইটা আগাগোড়া বাংলায় অনুবাদ করেছেন, সম্প্রতি ২০২০ ফেব্রুয়ারিতে সেইটা পাব্লিশ হয়েছে বইয়ের আদলে। একাধারে উপন্যাসকার, লিটারেরি ক্রিটিক, ফিলোসোফার, সেমিয়োটিশিয়্যান এবং য়্যুনিভার্সিটিপ্রোফেস্যর একো মৃত্যুকালে মোটমাট সাতটা উপন্যাস, দুইডজনের মতো ননফিকশন বই এবং অন্যান্য অ্যাকাডেমিক-নন্যাকাডেমিক রচনাপত্র রেখে গেছেন। মহান এই ইট্যালিয়্যান ভাষার লেখক দুনিয়া জুড়েই বিখ্যাত। বলতে গেলে একোর সমস্ত লেখাপত্রই ইংরেজি অনুবাদবাহিত হয়ে বিশ্বজোড়া পাঠকগ্রাহ্য হয়েছে।
লেখা / জাহেদ আহমদ
… …
- শিরোনাম রাষ্ট্রসংস্কার - September 6, 2024
- হাসিনাপতন : পাঠোত্তর প্রতিক্রিয়া ও তাৎক্ষণিক সংযোজন || মোস্তাফিজুর রহমান জাভেদ - September 4, 2024
- শিক্ষকের পদ || পূজা শর্মা - August 27, 2024
COMMENTS