মানুষের খাওয়াদাওয়া || রাহাত শাহরিয়ার

মানুষের খাওয়াদাওয়া || রাহাত শাহরিয়ার

খাওয়াদাওয়ায় আমি পারদর্শী বা সমঝদার কোনোটাই নই। রুচি কোনোকালে সমস্যা ছিল না। পেপে ভাজি আর মোরব্বা বাদ দিলে খাওয়ায় অরুচি আমার নেই বললেই চলে। আমার কৃশকায় গড়নের কারণে সম্ভবত আপনজনের ধারণা আমি ১২ মাস সিয়াম সাধনা করি। সম্প্রতি আপনজন ডাবল হয়ে যাওয়ায় হাহাকার আকাশেবাতাসে তীব্রতর হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। কাউকে বোঝানো যাচ্ছে না, না-খেয়ে বেঁচে থাকার রেকর্ড করার কোনো অভিপ্রায় আমার নাই।

যাক। বিষয় হচ্ছে আরেকটা। আমার কাছে চোখ জুড়ানোর জন্য জগতের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য মায়ের কোলে সন্তানের হাসি না, মানুষের খাওয়ার দৃশ্য। যে-কোনো বয়সের কেউ খাচ্ছে দেখলে আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখি। নজর দেবার জন্য না। আমার নজর ভরানোর জন্য।

একেকজনের খাওয়াদাওয়ার স্টাইল একেক ধরনের। কেউ এত তাড়াতাড়ি খায়, যেন ইস্রাফিলকে শিঙ্গার পাশে চেক-ইন করার পোস্টে লাইক দিয়ে এসেছে। আবার কেউ এত ধীরে ধীরে খায়, যেন এরচেয়ে ক্লান্তির আর কিছু নেই। এ-রকম আরো অনেককিছু আছে, সব বললে বাকি জীবন হয়তো একা একা বসে খেতে হবে। এটা খুব সহজ কাজ না। যার খাওয়া দেখা হচ্ছে, তাকে বুঝতে না দিয়ে সিনেমা শেষ করা খুব কঠিন। কুশীলব বিন্দুমাত্র সন্দেহ করলে অপ্রস্তুত হয়ে যেতে পারে। রেগে যেতে পারে। আমার কামনা তখন সাগরে ভাসবে।

রেস্টুরেন্টে মধ্যবয়সী এক লোক সামনে বসেছেন। আমার শিকার। তিন টেবিল দূরে আমি। খাওয়া দিয়ে গেল। তাকিয়ে দেখলেন না। তিনি ফোন ধরালেন। হেঁড়ে গলায় কথা বলছেন। কোনো কারণে উত্তেজিত। আমার কফি শেষ। বসতে হবে বলে আবার কিনে নিয়ে এলাম। কথা চলছেই। আমি আশা ছেড়ে দেবার ঠিক আগমুহূর্তে ফোন রাখলেন। এদিকে-ওদিকে তাকালেন। তারপর শুরু করলেন। ধীর গতিতে একপিস ফ্রেঞ্চফ্রাই স্যসের মধ্যে পুরোটা ডুবালেন। চুবালেন। তারপরে চিবালেন। টেবিলভর্তি খাবার। বুঝলাম এটা পূর্ণদৈর্ঘ্য হতে যাচ্ছে। আবার কফি কিনলাম। আগের জায়গায় বসলাম। খুব সতর্ক আমি। বুঝতে দেয়া যাবে না। এখন পর্যন্ত লোকটার সাথে চোখাচোখি এড়িয়ে চলেছি। ৩৫ মিনিটে ৪ পিস ফ্রাই মাত্র শহিদ হয়েছে। ভুখা খাবার দেখে হামলে পড়ে, আর এখানে খাদ্য যেন অনুরোধ করছে, প্লিজ, গরম থাকতে থাকতে আমাদের উপভোগ করে নেন!

লোকটার কন্ট্রোল অসীম। এবার খাওয়া বাদ দিয়ে পত্রিকা পড়তে শুরু করে দিলো। আমি ৩ নম্বর কফির কাপ নিয়ে এলাম। চিজ বার্গার, ফ্রাই আর কোক। সামান্য খাবার। আমি বসে আছি কখন সে বার্গার হাতে নিবে। মানুষ খাবার যখন মুখে পোরে ঠিক তখন তার চোখে দেখার মতো এক ধরনের প্রশান্তি ভাসে। আমার ইচ্ছা এটা দেখে চলে যাবার। সে মুখেই নিচ্ছে না কিছু। ভাবলাম ৪ নম্বর কফি নিয়ে আসি। উঠব, এমন সময় রেস্টুরেন্টের একটা ছেলে পেছন থেকে বলল, “উঠবেন না। এই যে আপনার কফি।” আমি বিল দিতে কার্ড বের করলাম। বলল, “বিল দেওয়া হয়ে গেছে। ওই টেবিলের লোক দিলেন। আর বললেন, প্রতি আধাঘণ্টা পর পর আপনাকে কফি দিতে।” শুনে নিজেকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছা করল। বুঝল কীভাবে!

ঝড়ের গতিতে বেরোতে লাগলাম। ওর টেবিলের পাশ দিয়ে বেরোতে হবে। কফির জন্য ধন্যবাদ দিলাম। চোখ টিপে বললো, “I won this time buddy. Better luck next time.”

… …

রাহাত শাহরিয়ার

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you