ভারতীয় কমার্শিয়াল সিনেমায় পিতৃহত্যার প্রতিশোধ || সত্যজিৎ সিংহ 

ভারতীয় কমার্শিয়াল সিনেমায় পিতৃহত্যার প্রতিশোধ || সত্যজিৎ সিংহ 

বিজনেসম্যান বিশ্বনাথ শর্মার এক ছেলে আর সুন্দরী স্ত্রী নিয়ে বেশ ভালোই দিন কেটে যাচ্ছিল। একদিন অফিসে এক কর্মচারী প্রতারণায় ধরা পড়লে মালিক বিশ্বনাথবাবু তাকে চাকরিচ্যুত করেন। পরে প্রতারক কর্মচারীটি সন্তান সহ না-খেয়ে মারা যাবে — এ-রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি করে কেঁদেকেটে হাতেপায়ে ধরাধরি শুরু করলে বিশ্বনাথবাবু তাকে ক্ষমা করে দেন। একদিন কর্মচারীটি মালিকের এত বেশি পরিমাণে বিশ্বাস অর্জন করে যে মালিক তার হাতে পুরো ইন্ডাস্ট্রি সঁপে দিয়ে পরিবার নিয়ে অবকাশ যাপন করতে চলে যান। সিনেমার আসল খেলা শুরু হয় তখন।

মালিক বিশ্বনাথবাবু অবকাশ থেকে ফিরে এসে দেখেন, যার হাতে তিনি সমস্ত প্রোপার্টি জিম্মায় রেখে গিয়েছিলেন, সে-ই এখন মালিক হয়ে বসে আছে। এমনকি থাকার জন্য বিশ্বনাথবাবুর ঘরটাও দখল করে রেখে দিয়েছে। ঘরবাড়ি সহায়সম্পত্তি হারিয়ে একটু আগে অবধি কোটিপতি-থাকা বিশ্বনাথবাবু এখন রাস্তায় নামা ছাড়া কোনো উপায় দেখেন না। এক-সময় বিশ্বনাথবাবু মারা যান। স্বামীহারা নারীকে প্রলোভনে ফেলার চেষ্টা করে সেই ফকির-থেকে-কোটিপতি-হয়ে-যাওয়া সাবেক কর্মচারীটি। দশবছরের এক পুত্রসন্তানকে অনেক ঝড়ঝঞ্চা সহ্য করে মানুষ করেন বিশ্বনাথবাবুর বিধবা স্ত্রী।


baazigarসিনেমার এই পর্বে বিশ্বনাথবাবুর যুবক ছেলেটিকে দেখা যায়। পৃথিবীতে মা ছাড়া তার কেউ নেই। পিতৃহত্যার চ্যালেঞ্জ সে নিতে চায়। একদিন যুবক ছেলেটি তার পিতার খুনির সন্ধান পায়। জানতে পারে তার নাম হয়ে গেছে এখন মদন চোপড়া। যুবক কৌশল করে মদন চোপড়ার ছোট মেয়ের সাথে প্রেমের খেলা খেলে। তারপর ধীরে ধীরে সে মদন চোপড়ার সাথে ভাব জমাবার চেষ্টা করে। একদিন সবার অগোচরে যুবক মদন চোপড়ার ছোট মেয়েকে বিল্ডিঙের ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করে। ছোট মেয়ের পর সে এইবার বড় মেয়েকে তার প্রেমে ফাঁসিয়ে দেয়। এইভাবে একদিন মদন চোপড়ার অফিসে যুবক প্রবেশ করে। অল্পদিনেই মালিকের বিশ্বাসভাজন হয়ে যায় সে। তার সততা আর নিষ্ঠা দেখে মালিক তাকে পুরো প্রোপার্টির হাফপার্সেন্ট শেয়ার দিয়ে দেয়। এমনকি তার অনুপস্থিতিতে প্রোপার্টির সম্পূর্ণভাগ অধিকারের ক্ষমতাও তাকে দিয়ে দেয় মালিক।

মনে হয় মদন চোপড়া এইখানে বিরাট ভুল করে বসে। একদিন অবসাদগ্রস্ত বড়মেয়েলে নিয়ে মদন চোপড়া অবকাশ যাপনে চলে যায়, ঠিক বিশবছর আগে যেভাবে তার হাতে সমস্ত প্রোপার্টি জিম্মা রেখে বিশ্বনাথবাবু অবকাশে চলে গিয়েছিলেন। সিনেমার দুর্দান্ত মুহূর্ত ওই জায়গায়, যেখানে মদন চোপড়া বাড়ি ফিরে এসে দেখে, — তার নামে কিছুই নেই! সমস্ত সম্পত্তি যুবক ভিকি তার নামে করে ফেলেছে। ভিকি তখন মদন চোপড়াকে বিশবছর আগের সেই দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।


এটা হচ্ছে নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমা ‘বাজিগর’ (Baazigar) -এর কাহিনিসংক্ষেপ। কেন জানি এই সিনেমাটার কথা আমি ভুলতে পারি না। এ নিয়ে প্রায় বিশ/একুশবার বোধহয় হবে ‘বাজিগর’ দেখেছি। যতবারই দেখি, কেবলই মনে হয়েছে আবারো নতুন করে দেখছি।

আচ্ছা, ভারতীয় সিনেমায় পিতৃহত্যার সিনেমাগুলো কেন এত জনপ্রিয় হয়েছিল? এক-সময়কার উপনিবেশশাসিত দেশগুলির মানুষগুলো কি সিনেমার পিতৃহত্যাকারীকে উপনিবেশ-প্রভুরাষ্ট্র বলে অবচেতনভাবে মনে করত! কেন প্রায় নব্বইভাগ সিনেমার প্রথমদিকে সাজানোগোছানো বাগানের মতো সমাজ-সংসারের দৃশ্য থাকে, তারপর কেন প্রায় প্রতিটি সিনেমাতেই শত্রুর আগমন ঘটে? এই সাজানো বাগান মানে কি স্বয়ংসম্পূর্ণ ভারতবর্ষ! আর শত্রু মানে কি বহিরাগত সাম্রাজ্যবাদী!


‘বাজিগর’, ‘কয়লা’ আর ‘করন অর্জুন’ — এই তিন সিনেমাকে বলা হয় দ্য রিভেঞ্জ অফ ট্রিলজি। অভিনেতা শাহরুখ খান যে আমার জীবনে কত বড় প্রভাব রেখেছিলেন এবং এখনো রাখছেন, সেটা কয়েক বাক্যে বলে শেষ করা যাবে না।

… …

COMMENTS

error: