নজরুল তো শ্যামাসংগীত রচনা করেছেন। গজলও গেয়েছেন। তিনি হলেন উপমহাদেশের বড় বিপ্লবী। তার মতো দ্বিতীয় লোকটি বিরল তো বাংলা সাহিত্যে। নজরুল যত-না সেক্যুলারিটির জায়গা থেকে এগুলো গেয়েছেন তার থেকে এইচএমভির পূজার রেকর্ডের বাজারমূল্যের কথাই বেশি ভেবেছেন বোধহয়। আপনি মূল্যের বিনিময়ে যা গাইবেন তা ফরমায়েশি। নজরুলের গজলও তা-ই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে অর্থাভাবে গজল লিখে গাইতে হয়নি। তিনি অর্থাভাবের বাইরে এগুলো করতে পারলে তার তথাকথিত প্রগতিশীলতার উচ্চতা আরো বাড়ত?
পেটের দায়ে করা কাজ আর মনের আনন্দে করা কাজের মূল্য সমান না। সেই অসম মূল্যের বাজারে রবীন্দ্রনাথের গজলটা কই? তিনি তার গণ্ডীর বাইরে আসতে ভয় পেতেন। না, আসলে সেটা সমস্যা না। আসতে পারলে সমাজের পরিবর্তনটা অন্যরকম হতো। কে কী করবে বা লিখবে তা আমরা ঠিক করে দিতে পারি না। তবে কে কী লিখলে কী হতে পারত তার বিচার তো করাই যায়। সেটা দোষের হবে না। নিশ্চিত তার মতো জমিদার ব্রাহ্মের কাছ থেকে কৌলিন্যনির্ভর ভারতবাসী গজল শুনতে প্রস্তুত ছিল না। তিনি বৈষ্ণবী আর শ্যামাগীতির বাইরে যাননি। বঙ্কিমের ‘বন্দে মাতারম’ বাংলায় ‘করি মায়ের বন্দনা’। মা, দশভূজা মা, তারপর দেশমাতৃকা। মাইকেল মধুসূদন দত্ত? ব্রাহ্মণ্যবাদ থেকে আমাদের বাংলা ভাষার বড় বড় ব্রাহ্মণরা বের হতে পারেননি। হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিদ্রোহ হিসাবে এখানে মুসলিম জাতীয়তাবাদ জন্ম নিয়েছে। তার দায় কারা কারা নিবে?
গান্ধীর অখণ্ড ভারতকে বিশ্বাস করার কিছু ছিল না। এমন একটা সমাজব্যবস্থার মধ্যে ১৫% লোককে সংখ্যালঘু হিসাবে জন্ম দেওয়ার বাজে পরিকল্পনা ছাড়া তেমন কী ছিল আর! বিজেপির ভারতের দিকে তাকান না আপনারা। আগে ছিল জাতিগত নিপীড়ন। সামাজিক নিপীড়ন রবীন্দ্রনাথের মতো প্রমুখদের ভুল পথ নির্দেশনে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের রূপ নিয়েছে। সমাজের প্রিভিলেজড গোষ্ঠী হিসাবে তাদের দায়িত্বটা বেশি ছিল। তা তারা পালন করলেন কই? তাদের যা করার তা-ই করলেন। আমরা আমাদের বিচার করতে থেমে থাকব কেন আজ!
নজরুলের মতো একই কারণে লালনকে হিন্দু আর মুসলিমের জন্য গান গাইতে হয় সমাজে তাদের জীবনযাপনটাকে নিশ্চিত রাখার জন্য। দুই ধর্মের গান গেয়ে তারা মূলত সমাজে হিন্দু-মুসলিমের মিলন ঘটান নাই। নিজেদের অবস্থানটা নিশ্চিত করেছেন। বুদ্ধ ধর্মের বিলোপ হয় ব্রাহ্মণ্যবাদের হাতে। সমাজের জাতিগত নিপীড়ন মাত্রাহীন হয়ে পড়ে। নেড়া ঠাকুররা দেশ ছেড়ে পালিয়ে বেঁচেছে। বাউলরা কোণঠাসা, ঘৃণিত, ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজে। মুসলমানরা ভারতের পশ্চিম দিয়ে পূর্বমুখী হয়েছে। ইসলাম ধর্মের প্রভাব পড়েছে চারপাশে। নদীয়ার শ্রীচৈতন্য, নিত্যানন্দ, অদ্বৈতের হাতে বৈষ্ণব ধর্ম সমাজে গৃহীত হয়। বিজাতকে তারা জাত দেয় দৌড়ে গিয়ে। মুসলিম একেশ্বরবাদের প্রভাব, বুদ্ধ ধর্মের জ্ঞান আর সনাতনের ভক্তি নিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। জাতপাত ভুলে মানুষের একটা আশ্রয়, বিকল্প দরকার ছিল। তান্ত্রিক বুদ্ধধর্ম ও কৌলিন্যনির্ভর সমাজে বিকল্প হিসাবে বৈষ্ণবধর্ম জন্ম নেয়। এটা মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার একটা উপায় ছিল। বাউলেরা বৈষ্ণবী ধারার। তারা হিন্দু-মুসলমানের গান গাইলেন হিন্দুবাড়ি ও মুসলিমবাড়িতে তাদের যাতায়াতটা বজায় রাখার জন্য। হিন্দুর বাড়ি মুসলমানের নবির গান কে শুনবে! মুসলমানের বাড়ি রাধাকৃষ্ণের গান!
মুষ্টি ছাড়া বাউলসমাজ চলে না। এই যে বাউলের সেক্যুলারিটি তা-ও তো পেটের দায়। পেটের দায় থেকে উদ্ভূত সেক্যুলারিটি সমাজে কাজ করে। রবীন্দ্র বা বঙ্কিমের পেটের দায়হীন জ্ঞানভিত্তিক জাতীয়তাবাদী সমাজ মস্ত বড় এক গহ্বর আমাদের জন্য। নজরুলের আর লালনের পেটের দায় নিয়ে জাতীয়তাবাদকে পরিবর্তন করতে হবে। পেটের চিন্তাকে খারাপ হিসাবে দেখার কিছু নাই। মানুষের ব্যাসিক ইনস্টিংক্ট পোষ মানে পেটের কাছে। জ্ঞানভিত্তিক মার্ক্সীয় সমাজও রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্কিমের মতো কৌলিন্যনির্ভর, একপেশে। তারা শুধু দরিদ্রের মুক্তি চায় যেমন পুঁজিপতিরা শুধু ফিটেস্টকে সার্ভাইভ করায়। এই সমাজে পেটের দায়গ্রস্ত লালন আর নজরুল হলো বড় বিপ্লবী।
… …
- কায়মাসুদ : মাসুদ খানের জড়সাধনা || মৃদুল মাহবুব - February 15, 2020
- মুখোমুখি গুন্টার গ্রাস || মৃদুল মাহবুব - January 6, 2020
- হেমিংওয়ে, তোমার চিঠি এসেছে || মৃদুল মাহবুব - December 15, 2019
COMMENTS