খোয়াজ মিয়া : এক নিভৃতচারী মরমি বাউল || মোহাম্মদ জায়েদ আলী

খোয়াজ মিয়া : এক নিভৃতচারী মরমি বাউল || মোহাম্মদ জায়েদ আলী

‘লাগাইয়া পিরিতের ডুরি / আলগা থাইকা টানে রে / আমার বন্ধু মহাজাদু জানে।’ — জনপ্রিয় এই গানটি কে না শুনেছেন! কিন্তু এই গানটির রচয়িতা সম্পর্কে আমরা কয়জনই-বা খবর রাখি?

উপরোক্ত গানটির রচয়িতা বাউলশিল্পী খোয়াজ মিয়া। স্রষ্টার সৃষ্টির অপার জাদুর রহস্য জানতে যুগে যুগে অসংখ্য ঋষী, মুনি, পির-আউলিয়া, বাউল, দার্শনিকের আবির্ভাব হয়েছে পৃথিবীতে। স্রষ্টা এবং তাঁর সৃষ্টিকে জানার অধ্যবসায় আজও অব্যাহত রয়েছে মানুষের মাঝে। এরকমই এক নিভৃতচারী বাউলশিল্পী খোয়াজ মিয়া; যিনি কিনা দেহতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, কামতত্ত্ব, পারঘাটাতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, শিষ্যতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব প্রভৃতি দর্শনের মধ্য দিয়ে তালাশ চালিয়ে যাচ্ছেন মহিমান্বিত স্রষ্টার অস্তিত্ব।

খোয়াজ মিয়া বাংলাদেশের বিখ্যাত মরমি সাধক, ‘জ্ঞানের সাগর’ হিশেবে সুপরিচিত দুর্বিন শাহের শিষ্যত্ব এবং ছাবাল শাহের বায়াত গ্রহণ করেছিলেন। গুরুজনে তাঁর আজও পরম ভক্তি। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১২ মার্চ সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার ৫নং দৌলতপুর ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামে এক রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে খোয়াজ মিয়ার জন্ম। বাবা আজিজুর রহমান ছিলেন একজন মৌলভি। মা আছতুরা বিবি ছিলেন গৃহিণী। বাল্যকাল থেকে খোয়াজ মিয়ার ছিল প্রবল গানের নেশা। সময়-সুযোগ পেলেই একাকী গলা চড়িয়ে গান গাইতেন, বাঁশি বাজাতেন। একসময় এই শখ নেশায় পরিণত হয়।

গান তাঁকে এতটাই তাড়া করত যে, স্কুলের পড়ালেখায় আর মন বসত না। গানের জগতের মানুষেরা তো আসলে ভাবের জগতের মানুষ। খোয়াজ মিয়াও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। ফলে, শৈশবকাল থেকেই তিনি আরও আট-দশজন ছেলেদের চেয়ে ভিন্নরূপ নিয়ে বেড়ে ওঠেন। তাঁর আচার-আচরণ ও মানসিকতা অন্যদের চাইতে ছিল ভিন্ন। সংগীতের প্রতি প্রবল এক নেশা তাঁকে সবার কাছ থেকে আস্তে আস্তে আলাদা করে ফেলে। আর এই নেশা একসময় এক ধরনের উন্মাদনায় পরিণত হলেও বাড়িতে পরিবারের লোকজনের সম্মুখে গান গাওয়াটা সম্ভব ছিল না। কারণ, তাঁর বাবা এসব অপছন্দ করতেন। এমনকি তাঁর এলাকায়ও সকলের সামনে গান গাওয়াটা সম্ভব ছিল না। কারণ, পিতার কানে গেলে মুশকিল হয়ে যাবে। তাই তাঁকে গান গাইতে হতো দূরে নির্জনে কোথাও, লোকচক্ষুর অন্তরালে।

পৃথিবীর অনেক দার্শনিক, কবি কিংবা ভাববাদীদের জীবনী পড়লে এই সাদৃশ্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আমরা সকলের মাঝেই খুঁজে পাই। বেশিরভাগ সময়ই মানুষের সান্নিধ্য এড়িয়ে এঁরা ডুবে থাকতে চান তাঁদের নিজস্ব চিন্তার জগতে, ভাবনাবিলাসে। খোয়াজ মিয়াও গানের মাঝে ডুবে থাকতেন নির্জনে, নিরালায়। এছাড়াও, বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সুযোগ পেলেই ছুটে যেতেন বিভিন্ন গ্রামে গানের আসরে। বাঁশি বাজাতে পছন্দ করতেন। গানের প্রতি অতি আকর্ষণের কারণে পড়ালেখায় তাঁর মন বসত না। ফলস্বরূপ মাত্র তৃতীয় শ্রেণিতেই থেমে যায় তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা। বাবার অনেক বকাঝকা খেতে হয় তাঁকে। মৌলভি পিতার সন্তান বলে এলাকার মুরব্বিগণও তাঁকে গানবাজনা থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেন। এতে খোয়াজ মিয়া দুঃখাহত হন, তীব্র মনঃকষ্টে ভোগেন। কিন্তু কখনও তিনি বাবা বা এলাকার মুরব্বিদের সঙ্গে কোনওরকম বেয়াদবি করেননি কিংবা ধর্মকর্মেও কোনওরূপ অবহেলা করেননি। সোজা কথায়, গানকে ধরে রেখে তিনি বাদবাকি সব কাজই চালিয়ে গেছেন।

গানের প্রতি তাঁর এই অদম্য আকর্ষণ দেখে একসময় মানুষ তাঁকে পরামর্শ দেন মুরশিদ ধরার জন্য। ঘটনাক্রমে পরিচয় হয় বিখ্যাত বাউল দুর্বিন শাহের সঙ্গে। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে, ২২ বছর বয়সে বাড়ির কাউকে না-জানিয়ে যাত্রা করেন দুর্বিনটিলার উদ্দেশ্যে। গুরুর আশীর্বাদের ছায়া অবলম্বন করে শুরু হয় তাঁর নতুন পথের যাত্রা। গুরুর আশীর্বাদে সাধনার মহাপথের পথিক হন তিনি। তবে এর মধ্যে পরিবারের চাপে পড়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ২৫ বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় তাঁকে। মূলত গানের উন্মাদনা থেকে তাঁকে ফিরিয়ে এনে সংসারমুখী করার উদ্দেশ্যেই সবার পরামর্শে তাঁর পরিবার এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কিন্তু সংসারের প্রতিবন্ধকতাও তাঁকে হার মানাতে পারেনি। সংগীতচর্চা ছাড়েননি খোয়াজ মিয়া।

এদিকে প্রথম সন্তানের জন্ম দিয়ে তাঁর স্ত্রী কিছুদিন পর মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। ফলে, একসময় তাঁদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। গানপাগল উদাস বাবার নিজ সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলা দেখে তাঁর পরিবার তাঁকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করান; তবে এবারও বিধি বাম। দ্বিতীয় স্ত্রী পাঁচ সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর মারা গেলে বাউল খোয়াজ যেন অকূল পাথারে পড়েন। সংসারের হাল ধরতে এ-সময় গানচর্চার ফাঁকে ফাঁকে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে নানান কাজেকর্মে তাঁকে ব্যস্ত হয়ে যেতে হয়। শেষে আবারও বিয়ে করতে হয়। তৃতীয় স্ত্রীর সঙ্গেই আজ অবধি সংসারযাত্রা চলছে। এই তরফে তাঁর/তাদের আরও চার সন্তানের জন্ম হয়।

২০০৯ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাজ্যে ভ্রমণের সুযোগ হয় তাঁর। গানের আসর মাতিয়ে কিছুদিন সেখানে অবস্থান করেন। অতঃপর তাঁর গুরু দুর্বিন শাহের মতো তিনিও স্বদেশে চলে আসেন। ইউরোপের চাকচিক্য কিংবা যান্ত্রিক জীবন তাঁকে মায়ার জালে বাঁধতে পারেনি। বলা যায় বাংলা-মাটির সন্তান মাতৃভূমির অকৃত্রিম টানে চলে আসেন দেশে। এ-থেকে অনুধাবন করা যায়, খোয়াজ মিয়ার মতো বড় বড় সাধকরা কখনও দুনিয়ার ঠুনকো ভোগবাদে গা ভাসিয়ে দেন না। বরং তাঁরা সত্যিকার অর্থেই নির্মোহ ও সৎ মানুষ, এবং একইসঙ্গে মনে হয় স্রষ্টারও কাছের মানুষ। গান গাওয়া ও গান রচনা সহ সংসার নিয়েই এখন দিনাতিপাত করছেন মরমি সাধক খোয়াজ মিয়া।

খোয়াজ মিয়ার গানে ইসলামি ভাববাদ ছাড়াও রয়েছে অন্যান্য ধর্মের শাস্ত্রীয় ও সাহিত্যকেন্দ্রিক গান। মহাভারত, রামায়ণ  সম্পর্কে তাঁর অনেক জ্ঞান আছে। ধর্মীয় আবহ ছাড়াও তাঁর গানে পাওয়া যায় দেশের সমসাময়িক পরিস্থিতি, দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের বিষয়-আশয় সহ আরও অনেক-কিছুরই উপস্থিতি। স্রষ্টাপ্রেম ও মানবপ্রেম সহ তাঁর গানে থাকে প্রকৃতিপ্রেমেরও অনুবাদ-অনুষঙ্গ। খোয়াজ মিয়া রচিত গানের সংখ্যা এ-যাবৎ চার শতাধিক হলেও তাঁর প্রকাশিত বই মাত্র তিনটি। যথা : ‘প্রেমস্বর্গীয় পল্লীগীতি’ (১ম খণ্ড ১৯৬৯, ২য় খণ্ড ১৯৭২), ‘গীতিবিচিত্রা’, ১৯৯১), ‘পঞ্চরস’ (২০১৪)। বাংলাভাষী অনেক নামিদামি শিল্পীর কণ্ঠে খোয়াজ মিয়ার গান গীত হয়েছে।

তাঁর অনেক অনেক জনপ্রিয় গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো — ‘আমার বন্ধু মহাজাদু জানে’, ‘যাইও না যাইও না কন্যা গো’, ‘শ্যামলারূপী প্রিয়া’, ‘দূর দেশে না যাইও বন্ধু রে’, ‘বন্ধু বনমালি’, ‘তুমি কই রইলায় রে প্রাণনাথ’ ‘বৃন্দাবনে শ্যাম’, ‘আদিযুগের পুরানা, নতুন বয়সের তরুণা’, ‘আল্লাহ তুমি দয়াময়, সৃজিয়াছ সমুদয়’, ‘আমার বাড়ি আয় রে বন্ধু’ ইত্যাদি।

সৎ, সহজ-সরল ও প্রচারবিমুখ মানুষ খোয়াজ মিয়া এখনও গান রচনা করে চলেছেন। সংসারের ভেতরে থাকা মহৎপ্রাণ এই মরমি সাধক জীবনের বাকি সময়টুকুও নির্বিঘ্নতা ও স্বতঃস্ফূর্ততায় যেন সংগীতচর্চা চালিয়ে যেতে পারেন, এই কামনা পরিশেষে।

মোহাম্মদ জায়েদ আলী : লেখক, সম্পাদক, প্রকাশক ও লোকসাহিত্য অনুসন্ধিৎসু


মোহাম্মদ জায়েদ আলী রচনারাশি

COMMENTS

error: