সত্য কাজে কেউ নয় রাজি
সবই দেখি তা না না না
— ফকির লালন শাহ
খুব ছোটবেলার স্মৃতি — ৬০ দশকে দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, বন্যা, বা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটলে সে-সময়কার ‘কালচার ও ফ্যাশন’ ছিল, কে কার আগে কত দ্রুত সাহায্য নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে।
বড় আপা ও ভাইদের দেখতাম বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে চাঁদা তুলত ও পথেঘাটে ‘ভিক্ষা দাও ভিক্ষা দাও’ গান করে সাহায্য চাইত। তারা নিজেরাই গ্রামে গিয়ে টিন ও বাঁশ দিয়ে ঘর তৈরি করে দিত — আহার নিশ্চিত করত, শিশুদের যত্ন নিত — এবং দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় যেত বিশাল সব মেডিক্যাল টিম।
কিন্তু এবার দুর্গাপূজার সময় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপরে হামলা হবার পর ইদানীংকালের কালচার ও ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে ফেইসবুক ফাটিয়ে ‘প্রতিবাদ’ করা, শাহবাগে গিয়ে ‘জাগো জাগো’ স্লোগান তোলা ও ‘মানববন্ধন’ নামের মূর্খ কর্মসূচি দিয়ে ছবি ও সেল্ফি তুলে, মিডিয়াতে ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীর প্রচার করে নিজেদের ‘সেক্যুলার ঈমান’ প্রমাণের ব্যর্থ প্রচেষ্টায় মত্ত থাকা।
এসব হিপোক্রিসি করে কার কি লাভ বা ক্ষতি হচ্ছে তা খুব সহজে অনুমেয়। বাংলাদেশের জনগণকে বোকা মনে করা এক গুরুতর অপরাধ।
কেবল আমাদের ইচ্ছায় দেশ চলবে, আমাদের ইচ্ছায়ই গঠিত হবে সমাজ, রাষ্ট্রচিন্তা, ও ‘সংস্কৃতি’ নামের ভাওতাবাজি, আমরাই সময়কে নিয়ন্ত্রণ করব — এসব অপচেষ্টা বোকামি কেবল নয়, তা মহা-আহাম্মকি।
আবার অদ্ভুতভাবে আমরাই ‘মানবতা’ ও ‘মানবাধিকার’ নিয়ে মুখে ফেনা তুলি!
এ-যাত্রা যে-সকল সনাতন মানুষ প্রাণে বেঁচেছেন, আবালবৃদ্ধবনিতা যারা গৃহহারা, যারা খোলা আকাশের নিচে, গাছের তলায়, অনাহারে, অনিদ্রায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন — তারা কেমন আছেন, কোথায় আছেন — সে-প্রশ্ন কি কেউ করছেন?
তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন, তাদের জন্য সাহায্যের হাত কেউ বাড়িয়েছেন, তাদের বসবাসযোগ্য অবস্থায় ফেরত না আসা অব্দি, সম্ভাব্য হামলা প্রতিরোধ করার জন্য তাদের সাথে সহাবস্থান করছেন — এমন দৃষ্টান্ত চোখে পড়ছে কি?
কিন্তু ২০১৩-র রানা প্লাজার ঘটনা মনে আছে নিশ্চয়?
হাজার হাজার লোক ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সাহায্য করতে, কারণ বেকুব মিডিয়া নামের ভাওতাবাজরা সেখানে ২৪/৭ ‘লাইভ’ প্রচার করছিল, সবাই আমাদের ‘দেখছিল’ — ও তার উপরে মোস্ট ইম্পরট্যান্ট :
‘ইশশ বেচারা গরিব মুসলিমগুলো কীভাবে মোরসে দেখসোস — তাড়াতাড়ি দাফনকাফনের ব্যবস্থা কর — খাওয়া টাওয়া পাঠা — কিছু ‘সাওয়াব’ কামা এই সুযোগে’ — মানসিকতা।
মোদ্দা কথা যেখানে টিভিক্যামেরা নাই — যেখানে ‘মুসলিম’ নাই, সেখানে আমরা প্রগতিশীলরাও নাই — অ্যাজ সিম্পল অ্যাজ দ্যাট!
নীরবে নিভৃতে অনেকে নিশ্চয়ই ভালো কাজ করছেন — তাই আমার উপরের কথাগুলো ঢালাওভাবে সবাইকে দোষারোপ করছি — তেমনটা না। বাংলাদেশে ভালো মানুষের সংখ্যাও নিতান্ত কম না।
আমরা অব্যশই প্রতিবাদ ও অভিযোগপ্রিয় জাতি — ও তা আমরা করব। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমরা সমাধানপ্রিয় জাতি নই। ওই একই গালাগালি, একই প্রতিবাদ, ওই একই কথা যুগযুগ ধরে ঘুরে ফিরে আসছে — কিন্তু এর সম্ভাব্য প্রতিকার কি — তা নিয়ে বলিষ্ঠ কোনো চিন্তা নেই — নেই কারো কাছ থেকে কোনো স্পষ্ট দিকনির্দেশিকা। সবই মানুষ-দেখানো তামাশা, সবাই আমরা নিজেদেরই আত্মপ্রচার ও আত্মপ্রসাদে মত্ত।
সরকার মদতপুষ্ট ‘সাংস্কৃতিক শকুন’-দের ভাষ্য ও ‘প্রতিবাদ’-এ খেয়াল করা যায় — এক নির্দিষ্ট গৎবাঁধা ছকে আবদ্ধ।
‘বেচারা সরকার’-কে সজোরে বাঁশ দেয়া যাবে না এবং উগ্রবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী, ‘সাম্প্রদায়িক অপশক্তি’ বা ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিপক্ষের শক্তি’-দের বাঁশ দিলেও — হালকা মোলায়েম মলম মেখে দিতে হবে।
‘আফ্টার অল আমরাও মুসলিম’।
এই ভয়াল সময়েও নিজেদের ‘ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্বের’ বুলি আমরা আউড়ে যাচ্ছি।
‘ওয়াও — দেখো দেখো কি সুন্দর — হুজুররাই এখন মন্দির পাহারা দিচ্ছে — আলহামদুল্লিলাহ’।
আর সবকিছুই ‘ষড়যন্ত্র’ — আরে মশাই, ষড়যন্ত্র যে হচ্ছে তা আগে টের পান নাই? প্রতিটি পূজার আগে কয়েক লেয়ার-এর ‘নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার বেষ্টনী নিশ্চিত’ করার ঢালাও প্রচার করা হয় — কিন্তু দুর্বৃত্তরা ঠিকই ‘ফাঁকটুকু কোথায়’ ছিদ্র নিশ্চিত হয়ে বেজায়গায় আছিলা বাম্বু হান্দায় কোন সাহসে — কে দেয় সেই সাহস?
তাহলে জনগণের টাকায় সৃষ্ট গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কি নাকে ভেজাল সয়াবিন তৈল ঢুকিয়ে আরাম ফরমান — নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে এসব ঘটনা ঘটতে দেন?
সবসময় আমাদের ‘চোর গেলে বুদ্ধি বাড়ে’ — কিন্তু সেই বুদ্ধিতেও কোনো কাজ হয় না, কারণ — এর পরে ডাকাত আসে, খুনি আসে, দানব সৃষ্টি হয় যার রূপ প্রকৃত অর্থেই আমাদেরই ‘স্বরূপ’ — কারণ আমরাই সবকিছু দ্রুততম সময়ে ‘কুইক ফিক্স’ চাই, আমাদের সবকিছুর নেপথ্যে দলীয় রাজনীতির অ্যাজেন্ডা, সবকিছুই আমাদের অত্যন্ত দুর্বল, নাজুক ও ভঙ্গুর ‘ধর্মীয় অনুভূতি’ পোক্ত করার ধান্দা।
আর বেয়াদবদের শায়েস্তা করার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তো আছেই — আর কি কিছু দরকার?
আমরা ‘সাম্প্রদায়িকতামুক্ত’, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বাংলাদেশের স্বপ্ন লালন করি ও এ নিয়ে বিস্তর প্রতিবাদ ও গলাবাজি করি — কিন্তু ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ প্রাণপুরুষ ফকির লালন সাঁইজির ১৩১তম তিরোভাব বার্ষিকীতে সাধুসঙ্গ সরকার বাতিল করলে আমাদের ‘সেক্যুলার ও প্রগতিশীল’ শক্তি হঠাৎ মূক ও বধির হয়ে যায় — চোখ থাকিতে অন্ধ হয়ে যায়।
কোনো মিছিল মিটিং প্রতিবাদ ফ্রতিবাদ শাহবাগ তাহবাগ আগরুমবাগরুম কোনোকিছুই হয় না।
আমাদের দয়ালু সাধুগুরুদের কুষ্টিয়ার ‘নতুন’ ডিসি মহোদয় মুখের উপরে ‘না’ বলার ক্ষমতাও রাখেন — বাবা রে বাবা — রাষ্ট্রের চাকরের কী দাপট! তাতেও সবাই চুপ।
এসবের কারণ কী ভাই?
ফকির লালন সাঁইজি ৯০ শতাংশ বাংলাদেশের হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর ‘আত্মার প্রতিনিধিত্ব’ করার কারণেই কি আমরা এসব পাপে লিপ্ত হই? গরিবের ভাগ্য নিয়ে আমাদের কোনো দুশ্চিন্তা নেই — অথচ আমরাই আবার ‘সংখ্যালঘু’ নিয়ে — আহা — কী সিজনাল মায়াকান্নাটাই করি, তাই না?
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি নামের দুর্বৃত্তায়িত প্রতিষ্ঠানটি আবার সাঁইজির সাথে এত বড় বেয়াদবি করার পর — ঢাকা শহরে বসে অতি পরিচিত গুটিকয়েক সরকারি চামচা শ্রেণীর ‘বাউল’ ও পণ্ডিত সংগ্রহ করো শ্বেতপাথরের এসি কক্ষে ‘সাধুসঙ্গ’ নামের গর্হিত কর্মটি করে, বিশাল ফলাও করে প্রচার করে — তখন আমরাই আবার বাহ্ বাহ্ দিয়ে বলি — ‘দেখো দেখো কী সেক্যুলার আমাদের কালচার’ — বুলশিট!
ছেউড়িয়া লালন ধামে আগত লক্ষ-ঊর্ধ্বে সাধুগুরু, ফকির, বাউল, ফকিরানি, বৈষ্ণব, সহজিয়াদের করোনার ভয় দেখিয়ে, ছেছে করে দমিয়ে রাখেন, অথচ ওয়াজ মাহফিল, খেলা, মাজার, দলীয় সভাসমাবেশ, নাচগানের অনুষ্ঠান ইত্যাদি — এমনকি হাজারো মানুষ যারা সনাতনের মন্দির, পূজামণ্ডপ ও ঘরবাড়ি ধ্বংস করে, মানুষ হত্যা করে — তখন আপনাদের করোনাদেবীর মৃত্যু-আতঙ্কের জুজুর প্রয়োজন পড়ে না, ফ্রড করোনাকে ‘পূজা’ করা প্রয়োজন পড়ে — তাই তো? এই অব্দি ক-জন বাউল ফকির এই করোনাতে মৃত্যুবরণ করেছেন তার কি কোনো পরিসংখ্যান আছে?
পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হলে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে সেক্যুলার ফতোয়া দেন। সনাতন মরলেও বিচ্ছিন্ন ঘটনা — গরিব মরলেও বিচ্ছিন্ন ঘটনা কিন্তু আমরা মরলে ‘খুবই সিরিয়াস ঘটনা’ — বিষয়টা কিন্তু খুবই কিউট তাই না?
আর লালন সাঁইজির তিরোভাবকে আপনারা বলেন ‘লালন মেলা’। সাঁইজি কি ‘মেলেছেন’ তার কি বিন্দুমাত্র জ্ঞান রাখেন? রাখলে সাঁইজির ধামকে ‘পর্যটনকেন্দ্র’ বলতেন না — সাঁইজির বিশ্বাস, জীবনবোধ ও মানুষতত্ত্ব উপেক্ষা করে তাকে নিয়ে বাজারি কাজকারবার করতেন না।
আপনাদের গরিবের প্রতি অবজ্ঞা, অভক্তি, সাঁইজির প্রতি চরম বেয়াদবির মূল্য এখন থেকে অবশ্যই হাড়েহাড়ে টের পাবেন, যতই গণ্ডারের মতো চর্ম আমাদের থাকুক।
এই অভিশাপ আমাদের আত্মা যে ছেদ ইতোমধ্যে করেছে — আমাদেরকে আগামী নিয়ে দিকভ্রান্ত করছে — ‘এর পর কি হবে’ চিন্তা ও টেনশন বাড়িয়েছে তা কি এই অভিশাপ যে কার্যকর হচ্ছে — তার যথেষ্ট আলামত নয়?
শেষ কথা : আগেও বলেছি, এখনো বলব, মৃত্যুর আগ অব্দি বলতেই থাকব — বলতে পারেন অন্ধবিশ্বাস, বলতে পারেন আমার মনগড়া কথা — তবে লালন সাঁইজির সাথে বেয়াদবি করে, অসম্মান করে, তুচ্ছ করে কেউ পার পেয়েছেন — তেমন মানুষের সন্ধান অন্তত আমি পাই নাই।
তাই সাধু সাবধান!
‘মানুষ গুরুর নিষ্ঠা যার ভবে মানুষ গুরুর নিষ্ঠা যার’
জয়গুরু আলেক সাঁই!
২১ অক্টোবর ২০২১ / সিটাডেল বাউলিয়ানা / পল্লবী, মিরপুর, ঢাকা
- Take a break folks and read this book - April 7, 2025
- Muchkund Dubey and Hindi translation of Fakir Lalon Shah’s work || Mac Haque - March 30, 2025
- Are we ready for Khilafa E Bangal? || Mac Haque - September 5, 2024
COMMENTS