আধিপত্য, সংস্কৃতিস্থিতাবস্থা, ব্যান্ডসংগীতের লড়াই || মাকসুদুল হক

আধিপত্য, সংস্কৃতিস্থিতাবস্থা, ব্যান্ডসংগীতের লড়াই || মাকসুদুল হক

সাধারণ মানুষ সংস্কৃতি বলে যা মনে করে তাকে আমরা শহুরে মধ্যবিত্তরা বলি গেঁয়ো। কিন্তু হার্মোনিয়্যমের পেছনে তবলার গুড়িগুড়ি বোল দিয়ে আমরা যে প্রাগৈতিহাসিক সাংস্কৃতিক কর্মটি সারছি তা নাকি প্রগতিশীল! মধ্যবিত্তের সংস্কৃতি ও জনগণের সংস্কৃতির মধ্যে তাই বিশাল ফাঁক সবসময় থেকেই গেছে।


স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরেও সংস্কৃতি কেবলই ব্যক্তিস্বার্থ, ভারতীয় স্বার্থ, পাকিস্তানি স্বার্থ, মার্কিনি স্বার্থ; অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বার্থটি বাদে সব স্বার্থকে প্রশ্রয় দেয়া, উৎসাহ দেয়া হলো আজ বাংলাদেশের সংস্কৃতি। ধিক!

এর কারণ আমাদের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা। আমাদেরই এই স্বাধীন দেশে মানুষের চরিত্রে যেহেতু পৃথক কোনো রাজনৈতিক চিন্তা আমরা বরদাশত করি না, তাই কোনো পৃথক বা সুস্থ ভাবাদর্শ লালন করতেও আমরা ব্যর্থ।


স্পষ্টতই আমি বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীত আন্দোলনের পক্ষ নিচ্ছি ও দাবি করছি যে, এই উপমহাদেশে আমাদের এই প্রগতিশীল ধারার অন্য কোনো নজির নেই। বাংলাদেশের এই উঁচুমানের সংগীত প্রমাণ করে যে, আমরা আটাশ বছরে এমন শ্রোতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছি, যা বিগত একশ বছরে বাংলা ভাষাভাষীরা বিশ্বের কোথাও সৃষ্টি করতে পারেনি। প্রথম দিককার লড়াকুরা (আমি সহ) আক্ষরিক অর্থে তরুণ নই। আজ ব্যান্ডসংগীত কেবলই পোলাপানের নাচন-কুর্দনের সংগীত নয়। তার কারণ ব্যান্ডসংগীত আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেরই অন্যতম ফসল। তাই বাংলা ভাষার অল্টার্নেটিভ বা বিকল্প ও স্বতন্ত্র তরুণ সংস্কৃতি এই ব্যান্ডসংগীত। আর তা তৈরি করেছি আমরা। পাঠ্যপুস্তকে কোনো-এক আগামীতে হয়তো লেখা হবে — ব্যান্ডসংগীত অপসংস্কৃতি নয়, তা বাংলা সংস্কৃতির চলমান ধারারই এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ও সংগীতের ক্ষেত্রে এক সাংস্কৃতিক বিকল্প।

বিকল্প আমরা তৈরি করেছি নিজে। সব স্বার্থ, সব সরকার বা প্রতিষ্ঠানকে উপেক্ষা করেই। উপেক্ষা করাই রকসংস্কৃতি। যাকে আমরা বলি ব্যান্ডসংস্কৃতি (এরপর থেকে বাংলা রকসংগীতই বলব)। রকসংগীত পরিণত বিশ্বে সাংস্কৃতিক বিপ্লবীদের সংগীত। আমরা মাতৃভাষাকে বিশ্বের দরবারে স্বমর্যাদায় ও সুউচ্চ আসনে তুলতে চাই। কোনো বাধা, স্বার্থ আমরা মানি না, মানবো না। বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা দেয়া খুব ঝামেলার ব্যাপার বলে অনেকে মনে করলেও আমরা মনে করি না। ‘বাংলা গান দিয়ে কি হবে’ — এ-হীনম্মন্যকে আমরা ঘৃণা করি। কারণ আমরা জানি, বাংলা ভাষা ইতিমধ্যেই বিশ্বের সপ্তম বৃহৎ ভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে আমাদের অনেকেরই অজান্তে। বিশ্বের সপ্তম বৃহৎ ভাষা হওয়া সত্ত্বেও আমাদের এই পশ্চাৎমুখিতা, মোড়ল মানসিকতা, সাংস্কৃতিক দায়িত্বহীনতা — এ শুধু সঙ্কীর্ণ চিন্তা বা আদর্শ নয় — এ এক মহাঅপরাধও বটে।

সংস্কৃতির প্রশ্নে কোনো আপোস নেই — এ-কথাটাও ভুল। আগেই বলেছি, সংস্কৃতি গতিশীল বা ডায়নামিক। এ কোনোভাবেই স্ট্যাগ্ন্যান্ট বা স্থির নয়। প্রচলিত ফতোয়াগতিশীল সংস্কৃতির অন্য নাম অপসংস্কৃতি। এ এক বাজে ফতোয়া। আমার ধারণা, গত আঠাশ বছরে আমরা এমনই এক ফ্যাসিবাদী সমাজ সৃষ্টি করেছি, যেখানে যুক্তিতর্কের চেয়ে পেশীর জোরকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি ও তাতে মুষ্টিমেয় কিছু তথাকথিত সংস্কৃতিসেবীর প্ররোচনা আর প্রচারণাকে জাতীয় সংস্কৃতি বলে গায়ের জোরে জায়েজ করার তাগিদ বলেই মনে করি। তাই ফ্যাসিবাদ এই দেশের গ্রামীণ সাংস্কৃতিক অঙ্গনকেও রেহাই দেয়নি। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ক্রমেই আমাদের এই কথিত প্রগতিশীল সংস্কৃতিসেবীদের আচরণের কারণে আমাদের সংস্কৃতির কোনো দিকনির্দেশনা আমরা এ-অবধি দিতে ব্যর্থ এবং কেবলই মুষ্টিমেয় কিছু সংস্কৃতিকারবারীর নির্লজ্জ আস্ফালনকে, ধান্দাবাজিকে, হাসিমুখে আমরা মেনে নিচ্ছি ও বলছি — বাহ্, বাঙালি সংস্কৃতি!

মূল্যবোধের অবক্ষয় ও সংস্কৃতিতে ধস নামার অভিযোগ সবার মুখে মুখে। সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে এ নিয়ে চলছে অহরহ অভিযোগ। ক্রমেই আমাদের এই ব্যর্থতা সুস্পষ্ট হচ্ছে ও ভেসে আসছে কেবলই একটি ঘৃণার আভাস। আমাদের ঘৃণাও এক-ধরনের ফ্যাসিবাদ। তাও অকপটে স্বীকার করে নিলাম। তবে যারা ওই গলাবাজি করছেন, তারা সবসময় যে-কোনো ক্ষমতাসীন দলের চামচা সংস্কৃতিসেবী ছাড়া আর অন্য কেউ নয়। … যে-সরকারই আসুক, নিজের ও আত্মীয়দের স্বার্থ, প্রচারণা সংস্থার স্বার্থ, বহুজাতিকদের স্বার্থ সমুজ্জ্বল রেখেই তারা সংস্কৃতির সবচেয়ে বেশি বড় ক্ষতি করেছেন, সব জেনে ও বুঝে। সাধারণ জনগণ ওই সাংস্কৃতিক দানবদের দ্বারা প্রতারিত হচ্ছেন।


সংস্কৃতি এক আজব ও অপার্থিব বস্তু। সাধারণ মানুষ কিছু গান, কিছু নৃত্য, কিছু কবিতা আবৃত্তি, কিছু নাটক, কিছু লেখালেখিকে সংস্কৃতি বলে মনে করে। সংস্কৃতি একটি জাতির মেরুদণ্ড বা স্নায়ুযন্ত্র — এই ইম্পোর্ট্যান্ট কথাটা আমরা কিন্তু কেউ বলছি না। একটি জাতির সাংস্কৃতিক ধস নেমে যাওয়া যে সরকার বা অর্থনীতির ধস নামার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তা আমরা কজনই-বা মানতে চাই? মেরুদণ্ডহীন এক জাতি তাই বেছে নিয়েছে প্লাস্টিকের মেরুদণ্ড। … সেই প্লাস্টিক বিবেক তাই নিজ স্বার্থ বাদে অন্য সংস্কৃতিকেই প্রাধান্য দেয়। নিজেদের উন্নয়ন ও পরিবর্তিত বিশ্বের কথা মাথায় রেখে সেই সুবিশাল ও গর্বের চিন্তা লালন করা নাকি উন্মত্ততা! এ-রকমই প্রচার পাচ্ছে বাংলাদেশের ছাপা-মিডিয়ার কল্যাণে।

ছাপা-মিডিয়ার দায়িত্বহীনতা, মোড়ল মানসিকতা, মূর্খতা ও সাংস্কৃতিক অসচেতনতার কারণে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির কোনো স্থায়ীরূপ এই পর্যন্ত চোখে দেখা যায় না। আঠাশটি বছর ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে। সেই আজম খানের প্রথম বিদ্রোহের আগুনের ফলে বাংলাদেশের তারুণ্যের হৃৎপিণ্ডে-যে কত বড় পরিবর্তন এসেছে তার সরকারি স্বীকৃতির তোয়াক্কা আমরা কোনোকালেই করিনি। কারণ আমরা ভিক্ষার চেয়ে স্বেচ্ছাশ্রমকে বিশ্বাস করেছি। তাই সরকারি ও বিভিন্ন স্বার্থের যোগানদাতা মুষ্টিমেয় কিছু সংস্কৃতিটাউট যেভাবে উঠে-পড়ে আমাদের ধ্বংস করতে নিষিদ্ধ করতে চাচ্ছে, তার মোকাবিলা আমরা অবশ্য-অবশ্যই করব।

যে-কোনো সাংস্কৃতিক স্বার্থের প্রথম শর্ত হলো বৈধতা। অবৈধ সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করে যে-যাঁতাকলে আমরা পিষ্ট করছি নিজেদেরই সংস্কৃতি সেদিকে কারো নজর আছে বলে মনে হয় না। এ এক সাংস্কৃতিক ভণ্ডামি।

বাংলাদেশের সংস্কৃতির কিছু ব্যাপারে আমরা রক্ষণশীল। ধরা যাক, ছায়াছবি ও শাড়ি। এই দু-ক্ষেত্রে আমরা আজ-অবধি ভারত বা পাকিস্তানকে প্রশ্রয় দিইনি। দেশের সিনেমাহলগুলোতে এই দু-দেশের ছবি প্রদর্শিত হয় না। আইন আছে, দেশীয় সুতি শাড়ির স্বার্থ রক্ষার্থে ভারতীয় শাড়ি আমদানি আমাদের দেশে নিষিদ্ধ। কলকাতা থেকে ফিরলে কাস্টম্স শুধু একটি প্রশ্ন করে, সুতি শাড়ি কয়ডা আনছেন?

ছায়াছবি ও শাড়িকে আমরা সংস্কৃতি মনে করি। কিন্তু গানকে নয় কেন? তাই লতা মুঙ্গেশকর হোক, জগজিৎ সিং হোক আর সুমন-নচিকেতা-অঞ্জন হোক — এরা সবাই বাংলাদেশে বৈধ শিল্পী। অথচ এদের গান আমাদের কাছে প্রথম পৌঁছয় চোরাপথে। তারা তাদের গান বাংলাদেশের বাজারের জন্য তৈরি করেনি এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে এই বিশাল কোম্প্যানিগুলোর দপ্তর বা মনোনীত অ্যাজেন্ট থাকলেও বাংলাদেশে তা নেই।

তবে কি আমি বিদেশী শিল্পীদের বাংলাদেশে আসা নিষিদ্ধ করার কথা বলছি? না, কেনই-বা আসবে না! একশবার আসবে। আমরাও যাব।

ভারতীয় শিল্পী তো দূরের কথা, বিশ্বের কোনো শিল্পীকেই আমি বাংলাদেশের শিল্পীদের চেয়ে বড় মনে করি না। তাই বিদেশী শিল্পীরা বাংলাদেশে এলে ঘাবড়ে যাওয়া, ভয় পাওয়া বা ঈর্ষাকাতর হওয়ার মতো ইনফিরিয়োরিটি কমপ্লেক্সে আক্রান্ত হওয়ার কিছুই নেই। কিন্তু আমরা কি বৈধতার প্রশ্নটিও উত্থাপন করতে পারব না? কেন এই শিল্পীদের আমরা প্রশ্রয় দেবো, যখন তাদের দেশে আমাদের কোনো শিল্পীকে প্রশ্রয় দেয়া হয় না! প্রচার বা বাজার কোনোকিছুই দেয়া হয় না। মাঝে সানন্দার বদৌলতে কিছু আগডমবাগডম প্রচার বাংলাদেশের শিল্পীরা পেয়েছিল। তা অবশ্য এরই মধ্যে এক অজানা কারণে বন্ধ হয়ে গেছে।


মনে পড়ে ১৯৯৪ সালে সুমন চাটুজ্জের এক লেখা কলকাতার পত্রিকায় পড়েছিলাম। একশ বছরের বাংলা সংগীত — এ-জাতীয় শিরোনামের একটি কলাম, যেখানে বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের শিল্পী বা তাদের গান নিয়ে টুঁ-শব্দও ছিল না। তার কাছে লিখিত প্রতিবাদ দেয়ার পরও এ নিয়ে তিনি একেবারেই নিশ্চুপ।


এসো সীমান্ত পার হয়ে এসো / যেমন করে আমিও আসি বারবার — এসো, যত খুশি এসো, তবে এসো বৈধ হয়ে!

বাংলাদেশের শিল্পীরা যখন ভারতে যান তারা কি একই রকম খাতির-যত্ন পান, যা আমরা সবসময় তাদের দিয়ে এসেছি? নিজেদের শিল্পীদের উপেক্ষা করে, ছোট করে? ভারতের কোনো শিল্পী এলে, হোক সে পরিচিত বা অপরিচিত, আমাদের প্রচারমাধ্যমে বিশেষ করে ছাপা-মিডিয়া যে উৎসাহ-উদ্দীপনায় পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রচার চালায়, সে-রকম কিছু তো বাংলাদেশের শিল্পীদের ক্ষেত্রে দেখি না! … মমতা কুলকার্নির মতো নিম্নগ্রেডের স্ট্রিপটিজ ক্যাবারে শিল্পী দু-দুবার শো করে গেলেন। একশ লোকও সেই অনুষ্ঠান দেখার জন্য টিকেট কেনেনি। তবু ছাপা-মিডিয়া প্রথম থেকে শেষ পৃষ্ঠা অবধি যে কাভারেজ দিলো, তখন আমাদের সংস্কৃতিসেবীরা অপসংস্কৃতি বা অশ্লীলতার হুঙ্কার তোলেনি।

অন্যদিকে আমাদের রক কন্সার্টগুলোতে হাতেগোনা কিছু ছেলেমেয়ে হাত-ধরাধরি করে হাঁটল বা আবেগতাড়িত হয়ে আলিঙ্গন করল বা বড়জোর শালীনভাবেই প্রকাশ্য দিবালোকে — ব্যস! পরদিনই ছাপা-মিডিয়া হলো চড়াও! বন্ধ করো এই অশ্লীল ব্যান্ডবাজি!

আবাহনী-মোহামেডানের ফুটবল খেলায় মানুষ মারা গেলে, রাজনৈতিক মিটিঙে মানুষ খুন হলে, কখনোই শুনবেন না ফুটবল খেলা বা রাজনীতি বন্ধ করা হোক। ওগুলো নাকি বিচ্ছিন্ন ঘটনা! তাই ওগুলো জায়েজ। অন্যদিকে মিরপুর স্টেডিয়ামের রক কন্সার্টে দুই তরুণ খুন হলে ছাপা-মিডিয়া বলে, তা কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়! আর ইত্তেফাক-এর মতো দৈনিকে পড়তে হয় বিরাট শিরোনামে ছাপা এক নিবন্ধ : ব্যান্ড (রক) সংগীতের আদৌ কি কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে?  বাংলাদেশের স্বার্থের জন্য যারা লড়াই করছে তাদের টুঁটি চেপে ধরো, বন্ধ করো, হটাও। এই হলো ছাপা-কারবারীদের মানসিকতা।

ভারত কোনোদিনও বাংলাদেশকে ফেয়ার সুযোগ দেয়নি এবং দেবেও না। আমরা বাংলাদেশের মানুষ কোনো দয়া বা খাতির চাই না। একাত্তরের দয়ার খেসারত আজ-অবধি দিচ্ছি। তবে সিম্পলি একটা ফেয়ার সুযোগ চাওয়া, কম্পিট বা প্রতিযোগিতা করা, তাও আমরা পাচ্ছি না। … এতটাই ভয়াবহ তাদের সংস্কৃতিগত আইন। তারা নিজেদের স্বার্থ নিয়ে এতটাই রক্ষণশীল। ভারত তাদের ছাপা-মিডিয়াতে আমাদের এই একই প্রচার দিক, চালাক ভারতীয় চ্যানেল অনবরত আমাদের মিউজিক ভিডিও, আমি বিশ্বাস করি সমগ্র উপমহাদেশের সংগীতের চেহারা আমরা বাংলাদেশের শিল্পীরা পাল্টে ফেলার ক্ষমতা রাখি। তারা খুব ভালো জানে ও বোঝে এবং ভয় পায় বাংলাদেশের শিল্পীদের, বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে।


সেই ফিডব্যাকে থাকাকালীন দু-বছরের উর্ধ্বে লড়াই করে, কলকাতার এইচএমভি   স্টুডিওতে রেকর্ড করে, জোয়ার   নামের একখানা ফিতা এইচএমভিকে দিয়ে বের করিয়ে ১৯৯২ সালে প্রয়াত ও শ্রদ্ধেয় সলিল চৌধুরীকে দিয়ে তা উদ্বোধন করিয়ে একশ ভাগ হালাল বা বৈধভাবে কলকাতায় তথা ভারতবর্ষে আমি শিল্পীর মর্যাদা পেয়েছি। আমি কলকাতা বা ভারতবর্ষে পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকিনি। সরাসরি লড়াই করে, সামনের পথ দিয়ে, বৈধভাবেই ঢুকেছি। বলা বাহুল্য, আমার আগে সেই সম্মান কুড়াতে পেরেছেন রুনা লায়লা, ফিরোজা বেগম ও সাবিনা ইয়াসমিন। আমাদের পরে এইচএমভি   বা ভারতীয় কোনো কোম্প্যানি বাংলাদেশের শিল্পীদের রেকর্ড বাজারজাত করেনি। কলকাতায় বসে শুনেছিলাম, আমাদের প্রতিহত করতে আসছেন সুমন চাটুজ্জে। এইচএমভিকর্মকর্তা সুমনের গান শুনিয়ে বললেন, আওয়ার আন্সার টু বাংলাদেশি ব্যান্ড মিউজিক। আমি বললাম, ওয়েলকাম!

এখানে বলে নেয়ার প্রয়োজন বোধ করছি, ফিডব্যাকের জোয়ার  বের করার কয়েক মাস বাদে সুমনের প্রথম ফিতা প্রকাশিত হয়। সুমনের ক্যাসেট বের হলো, আর অমনি ফিডব্যাকের ক্যাসেট খুব ভালো বাজার পাবার পরও কলকাতার সব দোকান থেকে প্রত্যাহার করা হলো। ১৯৯৪ সালে কলকাতার যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে আমরা কন্সার্ট করতে গিয়ে শুনলাম, জোয়ার   আর পাওয়া যাচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, আসলেই এইচএমভি   বাজারে ফিতা দিচ্ছে না। সেই কন্সার্টে ৬/৭ হাজার তরুণ-তরুণীকে বলেছিলাম, জোয়ার   বাজারে নেই, সে-তো এইচএমভির ব্যাপার। আমি এদেশে থাকি না। আপনারা তাই দয়া করে এইচএমভির কাছেই খোঁজ নিন, তা কেন পাওয়া যাচ্ছে না। তা-ই হলো, কন্সার্টের সাফল্যের পরপরই কলকাতার তারুণ্যের দাবিতে এইচএমভি   বাধ্য হলো জোয়ার   আবার কলকাতার বাজারে ছাড়তে।


সে-যাক। সাংস্কৃতিক বৈধতার প্রশ্নে অনেকেই আমার সঙ্গে একমত হবেন না। পাল্টা অনেক যুক্তিও দেবেন হয়তো। তা আমি জানি।


আমাদের মানসিকতা — বাংলাদেশের কোনোকিছুই ভালো লাগে না। কিন্তু আমাদের পছন্দ নিচ-মানসিকতার (পশ্চিমবঙ্গজ) কবি-লেখকদের বই পড়া ও শিল্পীদের গান শোনা। পরিত্যক্ত বুদ্ধিদাতা ছাড়াও ওনাদের অনেককেই আমরা জাতীয় কবি, জাতীয় সাহিত্যিক বা জাতীয় বিবেকের সম্মান দিয়ে থাকি। কারণ এও আমাদের এক গুরুতর জাতীয় দায়িত্ব! ওনাদের ভেতর কলকাতার বিরুদ্ধে লড়াই করে, লেখালেখি করে ফাটিয়ে ফেলার জেহাদি জোশ থাকলেও ওনারা-যে প্রতিনিয়ত কেবল ধরাই খাচ্ছেন — এটাই আমাদের দুঃখ। … অন্যদিকে প্রাণপ্রিয় কলকাতার বিরুদ্ধে যে-বদমাইশগুলো কথা বলে ও লেখালেখি করে তাদের রেগ্যুলার্লি মুর্তাদ, সাম্প্রদায়িক ও ইদানীং সবচেয়ে চালু শব্দ মৌলবাদী বলে গালিগালাজও করি। এরা জানে না কলকাতার বিরুদ্ধে কথা বলা এক-ধরনের গোনাহ্! কলকাতার লোক, হোক সে কবি, গায়ক, নায়ক, অভিনেতা, অভিনেত্রী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিদাতা, ব্যবসায়ী, ডাক্তার — ওনারা তো সরাসরি মক্কা-মনোয়ারা থেকে এসেছেন আমাদের উদ্ধার করতে। তাই সব-ধরনের খাতির করা চাই, করাটাই ফরজ। যারা করে না, তারা নালায়েক।


ধরা যাক আমাদের প্রজন্ম, যাদের জন্ম পঞ্চাশ দশকের শেষের দিকে, আমরা তো ৬৩/৬৪ সাল থেকে এই ঢাকায় বসে টেলিভিশনবাকশো প্রথম দেখি। তখন কলকাতা তো দূরের কথা তামাম ভারতবর্ষেও সেই বাকশো কোথাও কেউ দেখেনি। টেলিভিশনের আবির্ভাবের কারণে কলকাতাইয়া বাংলা-সংস্কৃতির ভাটা পড়ে এ-বাংলায়। প্রথমবারের মতো আমরা বাংলা গান শোনা ছাড়াও দেখা শুরু করলাম, যা একান্ত আমাদের নিজেদের এ-বাংলার। আমরা দেখলাম ও শুনলাম বিদেশী পপ ও রক মিউজিক। ডেঞ্জারম্যান, ইনভিজিবলম্যান, দ্য ম্যান ফ্রম অ্যাঙ্কল, টু আই লাইক জন, ফিউজিটিভ, আয়রন সাইডের মতো দুর্ধর্ষ বিলাতি ও মার্কিনি প্রোগ্র্যামের কাছ থেকে পেলাম অনুপ্রেরণার শত শত উৎস। পাশাপাশি কার্টুন, কৌতুক আরো কত-কী! এল একাত্তর ও টেলিভিশনই দিলো বিদ্রোহের প্রথম ইঙ্গিত। টেলিভিশন এত ব্যাপকভাবে একটি মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র হিশেবে ব্যবহৃত হতে পারে, এর আগে জানতাম না। গর্বের ব্যাপার হচ্ছে, তা করলেন আমাদেরই এ-বাংলার বড়ভাইরা। এ-ধারা অপরিবর্তিতভাবে চলল ৮০-র শেষ অবধি। এর আগ পর্যন্ত কলকাতায় বিটিভি   দেখার হিড়িক ছিল লক্ষণীয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশের কেউই ভারতীয় দূররদর্শন  দেখতেন না। তবে তারা দেখা শুরু করলেন সেই এরশাদীয় জুলুমের সময় থেকে। বদনা, থুতুর চিলি, অ্যাল্যুমিনিয়্যমের হাঁড়ি, থালা ও বাসন — এই প্রয়োজনীয় বস্তুগুলোর উপযোগিতা দ্বিগুণ বেড়ে গেল। মিনি ডিশ-অ্যান্টেনায় এগুলো ব্যবহার হতে দেখা গেল বাড়িতে বাড়িতে। এত কষ্ট করে সাধারণ বুদ্ধি খরচ করে দূরদর্শন  দেখার হিড়িক শুরু হলো — দিল্লি ও মুম্বইয়ের অনুষ্ঠান দেখার জন্য, কলকাতার অনুষ্ঠানের জন্য নয়। তারপর এল ক্যাবলটিভি মহাপ্লাবন। এতেও কলকাতা যথারীতি পিছিয়ে থাকল। এখনও তারা বাংলাদেশের ৬০-দশকের অবস্থার নিচে ঘুরঘুর করছে বলে আমার ধারণা। … এ-কথাগুলো বলছি কেন? কলকাতার সঙ্গে যদি আমাদের লড়াই করতেই হয়, তাহলে প্রথমেই আমাদের প্রমাণ করতে হবে যে, আমরা একটি স্বাধীন জাতি ও স্বাধীন জাতির মতো আচরণ করার অভ্যাস আমরা রপ্ত করে ফেলেছি। … এ-কথা বলার সাহস বুকের ভেতর রাখতে হবে। আমাদের ইদানীংকালের আচরণ, অন্তত কলকাতার ক্ষেত্রে, যার নমুনা আমি আগেই পেশ করেছি, সম্পূর্ণ পরাধীনতার। কোনো স্বাধীন জাতি এমন আচরণ করে না। আমাদের অনেক অপূর্ণতার পাশাপাশি একটি মহান গর্ব আছে যে, আমরা বাংলাদেশ নামের একটি দেশ সৃষ্টি করতে পেরেছি লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে, যা কলকাতা জীবনেও পারবে না। অবাক হয়ে লক্ষ করি, আমাদের দেশটাকে যেন ওরা নদী-টদী ধরনের কিছু ঠাওরাচ্ছে! নদীর একূল-ওকূল থাকে জানি, কিন্তু দেশের আবার একূল-ওকূল কী? অথচ কলকাতাবাসীরা আমাদের বাংলাদেশ বলে না, বলে ‘ওপার বাংলা’।


রকসংগীত বাংলাদেশের তারুণ্যের সৃষ্ট একটি বিকল্প সাংস্কৃতিক ধারা, যাদের সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় আগেই করিয়ে দিয়েছি। অন্য কোনো জাতির ক্ষেত্রে এমনটি ঘটলে এই বিকল্প ধারা নিয়ে গর্ব করত। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা যারা রকসংগীত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, তারা সবাই ঘৃণিত।

মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে এসে রকসংগীত পুরো বাংলাদেশে এক দারুণ ঝাঁকি দিতে সক্ষম হয়েছে। ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত রকসংগীত ছিল কেবলই লাইভ বা মঞ্চস্থ পরিবেশনা। ক্যাসেট শিল্প তখনো সৃষ্টি হয়নি এই দেশে। হাজার হাজার তরুণ-তরুণী রকসংগীতে উদ্বুদ্ধ হলো সরাসরি প্রেক্ষাগৃহে পরিবেশনা দেখে এবং বিটিভির কিছু অনুষ্ঠানের কারণে।

নির্দ্বিধায় বলা যায়, রকসংগীত যেভাবে সারা বাংলাদেশ জয় করেছিল সেই তখন, তা আজ পর্যন্ত শুধু বেড়েই চলেছে। একে দমিয়ে রাখার হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও।

সরাসরি লড়াই করছি বলে অপসংস্কৃতি থেকে শুরু করে নেশাখোরদের সংগীত — এ-ধরনের কম গালমন্দ আমাদের হজম করতে হয়নি। ঠিক আছে — উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, উস্কানিমূলক — এসব গালি শোনার জন্য আমরা প্রস্তুত। কারণ রকসংগীত কারো খাতির চায় না এবং কাউকে খাতির করে না। এটাই রক-ঐতিহ্য।


আমাদের মাথা মাছের মতো পচনশীল, তার মানে আজকের প্রজন্মও কি পচবে? আমার তা মনে হয় না। আগামী বিপ্লব কোনোভাবেই হবে না রাজনৈতিক বা গদি-বদলানোর বিপ্লব, তা হবে সম্পূর্ণ এক সাংস্কৃতিক বিপ্লব, যার আভাস আমরা ইতিমধ্যে পাচ্ছি।

তবে বিপ্লব শব্দটা আগামীতে রাজনৈতিকভাবে শুদ্ধ থাকবে কি না, তা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে বিপ্লবের কোন দিকটা আমরা বেছে নেব — যুক্তির নাকি অস্ত্রের? বিপ্লব শব্দটা খুব পছন্দ করে বাঙালি। কারণ আমরা জাতিগতভাবে রেভোল্যুশনারি রোম্যান্টিসিজমের ব্যামোতে আক্রান্ত।

গর্ববোধ-করা এই ‘বিপ্লব’ শব্দের অন্তরালে লুকিয়ে আছে ব্যর্থতা, দুঃখ, মারামারি ও রক্তক্ষরণ। আজকের প্রজন্ম একাত্তরের চেতনায় সম্পূর্ণভাবে উদ্বুদ্ধ হলেও রক্তক্ষয় আর চায় না। তারপরও নীরব একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব-যে ঘটবে, সে-ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আমি আনন্দিত, আজকের প্রজন্মকে যে অপসংস্কৃতির গাল শুনতে হচ্ছে, তার একটা ইতিবাচক দিকও রয়েছে। বহির্বিশ্বের ষাট-সত্তর দশকে রকসংস্কৃতির ইতিহাসে দেখা গেছে, অপসংস্কৃতিই একদিন মূল সংস্কৃতির মসনদ দখল করে। এ-ঘটনা ঘটেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন সহ য়্যুরোপের বহু দেশে।

এই প্রজন্মের বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে বাংলাদেশে। মুরুব্বিরা কি সবাই প্রস্তুত?


লেখাটা  ‘লাল জীপের ডায়েরী’ পত্রিকার গানসংখ্যায় ছাপা হয়েছিল ২০১৪-র দিকটায়। সেই সংখ্যার ভূমিকায় জানা যায় এইটা ম্যাক ওর্ফে মাকসুদুল হকের একক কোনো লেখা নয়, বিভিন্ন রচনা থেকে চয়িত।  ‘চলতিপত্র’  শীর্ষক একটা সাপ্তাহিকে ম্যাক পাক্ষিক কলাম লিখতেন  ‘নিষিদ্ধ এই সময়ে’  শিরোনামের আওতায়, ১৯৯৮ থেকে ২০০০ পর্যন্ত কলামটা চালু ছিল। পরে চলতিপত্র বন্ধ হয়ে যায়। তার আগে ম্যাক নিষিদ্ধই হয়ে যান বলতে গেলে ভক্তিসিদ্ধ বাংলার সংস্কৃতির মঞ্চে। এর আগে ও পরে ঢের কাহিনি ক্রিয়েট হয়ে গিয়েছে। অ্যানিওয়ে। এই লেখাটা আমরা আবারও পড়তে চাইলাম।  — গানপার

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you