গ্রামীণ সংস্কৃতি ও রুচির বিবর্তন || সুমনকুমার দাশ

গ্রামীণ সংস্কৃতি ও রুচির বিবর্তন || সুমনকুমার দাশ

ঈদের ছুটিতে গ্রামে ঘুরতে এসে একটা নতুন সংস্কৃতি চোখে পড়ল। এর আগে বিষয়টি যে একেবারেই উপলব্ধি করিনি, তা কিন্তু নয়। অন্যবারের চেয়ে এবার এটির প্রসার একটু বেশিই মনে হলো। ছেলে-বুড়ো নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ অবসরে নিজের মুঠোফোনটি হাতের ওপর মেলে চোখের সামনে ধরে রাখছেন আর সেখানে বেজে চলছে পুরনো বাংলা ছায়াছবি, যাত্রাগান, পালাগান, মালজোড়াগান, বিচারগান কিংবা সিনেমার গান অথবা হালের জনপ্রিয় ফোক-বাউলগান। বিষয়টি আমার কাছে অভিনব ঠেকে। যেহেতু একদিকে চিরায়ত গ্রামীণ-সংস্কৃতিতে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যবাহী বাউলগান, লোকগান অথবা যাত্রাগানের আসর ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে, অন্যদিকে তথ্য-প্রযুক্তির সুবাদে সেই হারিয়ে-যেতে-বসা ধারাগুলোই পুনর্বার গ্রামীণ শ্রোতা-দর্শকদের কাছে ভিন্ন মেজাজে হাজির হচ্ছে।

গ্রামীণ সংস্কৃতি ও রুচির এই যে বিবর্তন, এ বিষয়টিকে আমরা কোন দৃষ্টিতে দেখব? এটি কি হারানো-সংস্কৃতি কিংবা বিলুপ্ত-হতে-থাকা গ্রামীণ উৎসবগুলোর পুনর্জাগরণ? নাকি চিরতরে মুঠোফোনবন্দী হওয়ার পথে অশুভযাত্রা? শোষোক্ত প্রশ্নটিই আমাকে বারবার ভাবতে বাধ্য করছে। কারণ নতুন করে গ্রামীণ কোনও গীতিকার বা লোকনাট্যকার রচনা করছেন না গান কিংবা লোকনাটক। নতুন করে উঠে আসছেন না উল্লেখ করার মতো কোনও শিল্পী। এতে করে পুরনো শিল্পীদের কণ্ঠের গানই প্রযুক্তির সুবাদে মুঠোফোনের মাধ্যমে গ্রামীণ মানুষের হাতে-হাতে ছড়িয়ে পড়ছে। গ্রামীণ মানুষেরা লোকগান ও সংস্কৃতির স্বাদ এখন মুঠোফোনেই উপভোগ করছেন।

গ্রামীণ সমাজব্যবস্থায় মুঠোফোন-সংস্কৃতির ভয়াবহ বিস্তারে আস্ত যাত্রাগান থেকে শুরু করে শত-সহস্র বাউল ও লোকগান অনায়াসেই একেকজনের মোমোরিকার্ডে স্থান পাচ্ছে। এ কারণে অনেকে এখন আগের মতো রাত জেগে বাউলগান কিংবা যাত্রাগানের আসরে বসে সেসব উপভোগ করার উৎসাহ হারাচ্ছেন। ঘরে বসে-শুয়ে আরাম-আয়েশে বরং মুঠোফোনের বদৌলতে লোকশিল্পীদের গান উপভোগে তাদের উৎসাহটা অনেক বেশি পরিলক্ষিত হয়। এতে করে গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী গানের ধারাগুলো দর্শক-শ্রোতার অভাবে অনেকটাই নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। অবশ্য এ-রকম আরও নানা কারণেই গ্রামীণ বিনোদনের আগেকার ধারাগুলোর বিবর্তন বেশ প্রবলভাবে ঘটছে বলা যায়।

গত দেড় দশক আগেও গ্রামে হিন্দু-মুসলিম প্রায় সবার ঘরেই ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’ লেগে থাকত। এসব উৎসব-পার্বণ উপলক্ষে নানা আনন্দ-আয়োজনের ব্যবস্থা থাকত। ধান তোলা থেকে শুরু করে জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে অর্থাৎ জীবনযাপনের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই নানা ধরনের অনুষ্ঠান হতো। কিন্তু ওই পরম্পরাগত ঐতিহ্য ক্রমশ ফিকে হয়ে এখন ধূসর রূপ লাভ করেছে। মৌলবাদী গোষ্ঠীর নানামুখী ফতোয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সংকট-সংগ্রামে বিপর্যস্ত ঐতিহ্যবাহী গানের ধারাগুলো লোপ পেয়ে এখন অনেকটা তলানিতে ঠেকেছে। তবে অনেক মানুষ তাঁর শেকড় ভুলতে পারেননি। সে-কারণেই পুরনো যেসব গান ও লোকনাট্যের ধারা রেকর্ড-আকারে ভিডিও কিংবা অডিও যে-মাধ্যমেই পাচ্ছেন, সেসব সংগ্রহ করে মুঠোফোনবন্দী করে ফেলছেন। আর সময়-সুযোগে সেসব দেখেই ‘দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছেন’।

ঐতিহ্যপ্রেমী গ্রামীণ মানুষের মুঠোফোনের স্ক্রিনে যাত্রাগান কিংবা বাউলগান দেখা/শোনাকে আমি মোটেই খাটো করছি না। বরং এ প্রযুক্তির সুবাদে এসব ধারাগুলো অনেকটা সংরক্ষণের আওতাভুক্ত হলো — এটা অস্বীকার করি কেমন করে? আমার আক্ষেপ অন্য জায়গায়, সেটা হলো কেবল বাণিজ্যিকভাবে নির্মিত কিছুসংখ্যক যাত্রাগানই ব্লু-টুথের মাধ্যমে ঘুরেফিরে গ্রামীণ মানুষের কাছে হাতবদল হচ্ছে। এর বাইরে মুঠোফোনের আগ্রাসী প্রসারতার কারণে গ্রামগুলোতেও এখন আগের মতো যাত্রা, পালা, মালাজোড়া, কীর্তন কিংবা বাউলগানের আসর হচ্ছে না। সঙ্গত কারণেই এসব ধারা ধীরে-ধীরে বিলুপ্তির দিকে চলে যাচ্ছে।

মুঠোফোনের মাধ্যমে যে কেবল গ্রামীণ সংস্কৃতির নিজস্ব ঐতিহ্য বিনষ্ট হচ্ছে, তা শুধু নয়। বরং এর মাধ্যমে অনায়াসে হিন্দি ও প্রাশ্চাত্য-সংস্কৃতিও দ্রুত গতিতে গ্রামীণ সমাজব্যবস্থা ও জীবনযাপনে ঢুকে পড়ছে। ব্যয়বহুল ও চোখধাঁধানো আয়োজনে নির্মিত বিদেশি সিনেমা ও গানগুলো নিত্যনতুন আঙ্গিকে উপস্থাপিত হওয়ায় গ্রামীণ মানুষের কাছে এসব বিপুল আগ্রহ জন্মাচ্ছে। অচেনা এই বিনোদন ক্রমশ গ্রামের চিরচেনা বিনোদনকে গিলে ফেলছে। রাক্ষুসী এই বিদেশি-সংস্কৃতির হাত থেকে তাহলে গ্রামীণ নিজস্ব সংস্কৃতিকে বাঁচানোর উপায়টাই বা কী? বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির পতন ঠেকাতে যথাশীঘ্র কোনও উপায় বাতলাতে না-পারলে গ্রামীণ সভ্যতায় নতুন বিবর্তন মেনে নেওয়া ছাড়া আমাদের করার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you