পরাধীনতার সিলসিলা বাঙালির তো মোটামুটি দীর্ঘ। মনে হয় এখন ঘুচে গেছে, নাকি ঘুচে নাই, এইসব তর্কাতর্কে না যাই। কথা হচ্ছে, এই জাতির দীর্ঘ পরাধীনতাটাইমের একটা নগদানগদি ফল হলো যে এর ফোকলোরে-গানে-ছড়ায়, সমস্ত প্রকরণের ওরাল লিট্রেচারে, ব্যাপক শস্য উঠেছে গোলায় হাজার হারানোর পরেও। পরম্পরাটা বায়ান্ন-একাত্তর হয়ে এই সেদিন পর্যন্তও বজায় ছিল। অথবা আছে।
এই ধরনের গান নিয়া বাংলাদেশে লেখাপত্রে দেখতে পাই একাত্তর ঘিরেই ঘূর্ণাবর্তন, বড়জোর ঊনসত্তর-বায়ান্ন তথা ষাটের দশকের কলকাতা অব্দি যাওয়া। আবদুশ শাকুর একটা বই লিখেছেন সেইম থিম এবং কন্টেক্সটে এবং সেইখানে একটা সামগ্রিকতার নাগাল পাওয়া যায়। ফ্রিডম বা মুক্তি বা লিবার্টি জিনিশটাকে বেশ দূর অব্দি গিয়ে দেখেছেন লেখক।
বইটার নাম ‘বাঙালির মুক্তির গান’। বইনাম থেকে তারেক মাসুদের ম্যুভির ব্যাপারটা মাথায় এসে যায়। একাত্তর মনে পড়ে। এবং কিছু বছর আগে একটা বাণিজ্যিক টেলিকম্যুনিকেশন কোম্প্যানি সিডি বের করেছিল গানের, রিমেইক গানের, ওই টাইমের গান নিয়া তা-ও মনে পড়ে। এই বইটার বিস্তার অবশ্য অনেক ব্যাপক।
তো, বলছিলাম যে, বাংলায় দেশাত্মবোধজাত সংগীত/গান, সোজা বাংলায় মুক্তির গান, ইত্যাদির মূল উৎস ছিল জাতির পরাধীনতা থেকে উদ্ভূত বিপর্যস্তবোধ। যদিও উনিশশতকের গোড়ায় দেশাত্মবোধ তো গরহাজির ছিলই, ছিল উল্টা স্বদেশ নিয়া উদাসীনতা। আরও ছিল ইংরেজপ্রীতি। জিনিশটা বা জিনিশগুলা আজও উবে গেছে এমন তো বলা যাবে না ফস করে। অ্যানিওয়ে।
এরপরে সেই দ্বিতীয়ার্ধ উনিশশতকে এসে দেখা যায় দেশাত্মবোধক গানে কেবল হতাশা, দারিদ্র্য, বঞ্চনা আর আক্ষেপের প্রকাশ। বড়জোর মুক্তির জন্য অব্যক্ত কামনাবাসনাই ছিল ওইগুলার মুখ্য। পট বদলায় বিশশতকের গোড়ায়। এই শতকের প্রথম দশকে বঙ্গভঙ্গ ম্যুভমেন্টটাকে কেন্দ্র করে এল আবেগময় দেশাত্মবোধ। তবে এই বইয়ের পাঠ ফলো করে গেলে দেখব যে লেখক যেইটাকে প্রকৃত দেশাত্মবোধ বলছেন সেইটা আসতে শুরু করে এর পরের দশকে।
হ্যাঁ, যথার্থ মুক্তির গান জন্ম নেয় বিশশতকের দ্বিতীয় দশকে। কাজী নজরুল ইসলামের অবিসংবাদিত নেতৃত্বে যে-গানগুচ্ছ জন্মায়, পরাধীনতার শেকল ভাঙার গান থেকে সর্বশ্রেণিবর্ণগোত্রের মুক্তির গান, সামাজিক অসাম্য ও সাম্প্রদায়িক হানাহানি-বিষবাষ্প থেকে মুক্ত হবার গান, এইগুলা আবদুশ শাকুরের লেখায় প্রণিধান পেয়েছে।
এই যে সোচ্চার হয়েছিল কবিনেতৃত্বে গানকণ্ঠ, অবিকল এই জিনিশটা আরও জোরদার হয় চল্লিশের গণনাট্যান্দোলনে, বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনে, এবং একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে। এই মুক্তির গানটাই অভিপ্রেত, অবিনাশী, বহমান চিরকালের দুনিয়ায়।
প্রতিবেদন / আতোয়ার কারিম
… …
- মধ্যনগরে বঙ্গাব্দবরণ ১৪৩২ || বিমান তালুকদার - April 18, 2025
- অতি সাধারণ ঋণ বা ন্যানো ক্রেডিট || হুমায়ূন আকাশ - April 17, 2025
- গাজায় মৃত শিশুর ভর্ৎসনা || মোহাম্মদ জায়েদ আলী - April 12, 2025
COMMENTS