একটা বাংলা ছবি নিয়া লেখার ইচ্ছা বহুদিনের। ছবিটার নাম ‘নিরন্তর’। পরিচালক আবু সাইয়ীদ। সিনেমার চিত্রনাট্য লেখা হইছে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ‘জনম জনম’ থেইকা। ‘জনম জনম’ পড়ি নাই আমি।
ছবিটা দেখছি প্রায় দশবারো বছর আগে। নট শিওর। কিন্তু ছবিটা অনেক দিন ধইরা আমার ভিতর ছিল। এখনো আছে। কথায় কথায় অনেকরেই বলছিলাম, এই ছবিটা নিয়া একটা লেখা লিখতে পারলে দারুণ হইতো। একদম স্পেসিফিকভাবে বললে, ছবিটার একটা দৃশ্য বহুদিন মনের মধ্যে কী এক ভার হইয়া বইসা ছিল। এখনো আছে। একটু একটু।
তিথি বিষণ্ণ মুখে জানালা ধইরা কোথায় যেন চাইয়া রইছে। পিছন থেইকা তার আম্মা আইসা পিঠে হাত বুলাইয়া দিতে চায়। তিথি খুব বিরক্ত হয়। আম্মারে বলে, ‘গায়ে হাত দিও না ত, মা।’ আম্মা আহত হয়। তিথি বলতে থাকে, ‘গায়ে হাত দিলে মনে হয় পুরুষ মানুষের হাত।’
সিনেমাটার মূল ঘটনা তিথি। এমন না যে তিথির আশপাশের অন্য সব চরিত্র ‘তিথি’ ঘটনা জানে না বা বোঝে না, কিন্তু তারা যখন কথা বলে, হাসে, খায়, প্রশ্ন করে, সবখানে তারা খুব স্বাভাবিক থাকে। মনে হয়, তিথি আছে, স্বাভাবিক। কিন্তু ‘তিথি’ নামের ঘটনাটা থাকতে পারে না। এইটা অস্বাভাবিক। অতএব এই হাসি, এই কথা বলা, এই প্রশ্ন করা বা এই মনখারাপের ভিতর এরে উধাও কইরা রাখতেই হইবো।
কোনটা অস্বাভাবিক তাইলে? ‘তিথি’ ঘটনা নাকি অবিরত ভান আর ছদ্মবেশে এইটারে সারাক্ষণ ডিনাই করা?
আপনেরে আর আপনের সোসাইটিরে এইভাবে কে আর এত করুণভাবে করুণা দেখাইতে পারছে?
তিথি চরিত্রে অভিনয় করছেন শাবনূর। এত ভালো অভিনয় আমি জীবনেও দেখি নাই। আমি বাংলা ছবি দেখি না। আমি এইটা নিয়া লেখিও না। এই না-দেখাটা বা দেখতে না-পারাটা আমার উইকনেস না। বরং আমার রুচির কাছে বাংলা সিনেমা খুব গরিব। যে-কোনো ধরনের গরিবি আমার অপছন্দ। আজকে যদি আমি তিনবেলা খাইতে না পারতাম, তাইলে আমি ভিক্ষা করতাম না। শিওর থাকেন। আমি অনেকের খাওয়া বন্ধ কইরা দিতাম।
আবার দেশের ছবি না দেইখা বিদেশি ছবি লইয়া ঢং, এইসব তরল আলাপ যারা করে, এরাও একধরনের মিসকিন। গরিব। প্লেজার বা বিনোদন আমার মৌলিক অধিকার। দেশি প্রোডাক্টের ইমোশনে ভাসাইয়া আপনে আমারে ভেজাল গিলাইতে পারেন না। এই যে আমি দেশের সিনেমারে গরিব বলতেছি, এই বলাটাই হইলো দেশীয় আর্টে আমার কন্ট্রিবিউশন। থ্যাঙ্কস অ্যা লট।
অ্যানিওয়ে, ‘নিরন্তর’ লইয়া কথা বলতেছিলাম। সিনেমাটায় শাবনূর একজন পতিতার অভিনয় করেন। এইখানে আরো একটা কথা বলা দরকার। দেখা যায়, মেয়েদের পতিতা বানাইয়া বা মেয়েদের মুখে বোল্ড সংলাপ বলাইয়া, মেয়েদের শরীর দেখাইয়া অনেকে আর্ট-কালচার করতে চায়। এইসব আর্টকালচার কিছুই হয় না। এমন না যে, মেয়েরা বা তাদের শরীর নাই, কিন্তু এই থাকাটারে যেইভাবে থাকাইতে চায়, এইটা খুবই নিম্নমানের।
মূলত এইসব হইলো এদের একধরনের আত্মমৈথুন৷ বা বলা যাক, আধুনিক বোদলেয়ার বুঝতে না-পারা অথবা মডার্ন ইওরোপের মিসইন্টারপ্রিটেশন। নদীতে এখন কাঠের নৌকা চলবে না, চলবে ইঞ্জিনের নৌকা। পেট্রোলের নৌকা। অতএব নদী আজ থেইকা শুধু দূষিতই হইবো, এইটা স্বীকার কইরা নেওয়াটা কিন্তু মূল বিষয় না। বরং এই ‘স্বীকার’ করাটা যে-কারণটারে সামনে নিয়া আসতেছে, সেইটা বিষয়। আপনের নজর ওইখানে দেওয়া দরকার। একদা নদীর পানি বিশুদ্ধ ছিল। আজ নদীর পানি দেখলে গা শিরশির করে। অথচ নদী হইলো রুহ। আধুনিক শিল্পায়ন এই রুহের খেয়াল করে নাই।
বাণিজ্যের একচেটিয়া একরৈখিক কারসাজিতে প্রকৃতি নৃশংসভাবে আহত। আমরাও। সোনা, রূপা, জহরতে শুইয়া থাকা বা মেয়েদের প্রেমিকা থেইকা পতিতা বানাইয়া দেওয়াটাও ওই বণিক চিন্তার একধরনের ভাওতাবাজি। [এইখানে বইলা রাখা ভালো যে, আত্মঘোষিত-ধর্মরক্ষকদের তৈরি করা আধিপত্যবাদী-পুরুষ ইমেইজও একধরনের শয়তানি। জ্ঞান আর প্রজ্ঞাশূন্য, চিৎকারে পারদর্শী, উগ্রতায় ঠাসা মগজের ওইসব বাক-সর্দারদের তৈরি করা পুরুষ সোসাইটি মূলত স্যাডিস্ট এবং সামন্তীয়-গোত্রভিত্তিক দৈন্যে বেসামাল। পুরুষনেতৃত্বের নামে এরা মূলত এমন এক পৌত্তলিকতার প্র্যাক্টিস করে যেইখানে নারী হইলো সেকেন্ড-জেন্ডার, অবদমিত, অস্তিত্বহীন, উৎপাদন-কারখানা, যার উপর সিদ্ধান্ত জোর করা যায়।]
যা-ই হোক, এন্ডিংটা বাদ দিলে ‘নিরন্তর’ একটা অসাধারণ ছবি। আজকে যে এইটা নিয়া দুইটা কথা লিখতে পারলাম, ভালো লাগতেছে। মানে এন্ডিংটা জোর কইরা শেষ করা হইছে। যেইভাবে হুমায়ূনের ওইসব তুলতুলে উপন্যাসের এন্ডিং টানা হয়। ‘জনম জনম’ উপন্যাস থেইকা ‘নিরন্তর’ সিনেমার যাত্রায় এই ব্যপারটারে আরো সৃষ্টিশীলতা দিয়া ক্যামেরাবন্দী করা যাইতো। তিথি-পরিবারের সার্ভাইবাল, সিনেমার শেষে তিথি-পরিবারের উন্নয়ন মূলত আধুনিক বণিকসমাজের ভাব ধইরা থাকা ওই মুখোশটারে সামনে নিয়া আসে যার অন্তঃস্থে জ্বালানী হিসাবে পুইড়া ছারখার হইতেছে তিথি-ঘটনার মতো অগুনতি আত্ম-কোরবানি বা ইনজাস্টিস।
মে ২০২০
হাসান শাহরিয়ার রচনারাশি
গানপার ম্যুভিরিভিয়্যু
- নিরন্তর, বাংলা ছবি, মেয়েরা, আধুনিক আর্ট-কালচার, বিদেশি মুভি আর আমার বেহায়া রুচি || হাসান শাহরিয়ার - June 5, 2025
- ব্ল্যাক রিইউনিয়ন কন্সার্ট : ভোরের বৃষ্টি, বিউটিফুল স্টর্ম - June 5, 2025
- ক্লাইটেমনেস্ত্রা, এস্কাইলাস-অ্যাগামেমনন, আরগোস, বিচারব্যবস্থা আর গ্রিক বিষাদসিন্ধু || হাসান শাহরিয়ার - May 31, 2025
COMMENTS