শ্রীনীরদচন্দ্র চৌধুরী প্রণীত দুইটা আর্টিকলের অংশত পুনর্পাঠ

শ্রীনীরদচন্দ্র চৌধুরী প্রণীত দুইটা আর্টিকলের অংশত পুনর্পাঠ

লেখকের সাফাই

এই জাতীয় লেখা সম্বন্ধে একটা পুরাতন বাংলা পদ প্রয়োগ করা যায়, উহা ‘বেনো-জল’। বানের জল যখন আসে তখনই চারিদিক ভাসাইয়া দেয়; কিন্তু উহা তেমনই তাড়াতাড়ি নামিয়া যায়; উহার দ্বারা কোনো স্থায়ী হ্রদ বা জলাশয় সৃষ্ট হয় না। সাময়িক লেখাকেও এইরূপ ক্ষণস্থায়ী প্লাবন বলা চলে।

।।।
আমি কিন্তু লেখকবৃত্তিতে সাময়িক ঘটনা ও ব্যাপার সম্বন্ধে নির্লিপ্ত হইতে কখনোই পারি নাই। ইহা শুধু আমারই অভ্যাস বলা যায় না। যুগ যুগ ধরিয়া শক্তিশালী লেখকেরা দুইটা বিরোধী রূপ দেখাইয়াছেন। উহাদের এক শ্রেণী সাময়িক ব্যাপার সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন হইয়া ‘বিশুদ্ধ সাহিত্যিক’ হইয়াছেন। আর এক শ্রেণী ‘বিশুদ্ধ’ সাহিত্য সৃষ্টি করিলেও সঙ্গে সঙ্গে সাময়িক ঘটনা ও ব্যাপারের সহিত জড়িত হইয়া উহার আলোচনা করিয়াছেন, এমনকি দল-দলীয় উত্তেজনা এবং কলহপ্রবণতা দেখাইয়াছেন। এই শ্রেণীর লেখকদের ইউরোপীয় ভাষায় ‘engges’ বলিয়া বিশিষ্ট করা হয়।

।।।
তবে সাময়িক ব্যাপার সম্বন্ধে লিখিতে গিয়া আমি কখনোই নিজেকে কেবলমাত্র সাময়িক মতামত বা ধ্যান-ধারণার মধ্যে আবদ্ধ রাখি নাই। মানবজাতির মানসিক জীবনে যাহা আবহমান কাল ধরিয়া চিরন্তন সত্য বলিয়া স্বীকৃত ও প্রচারিত হইয়াছে, আমার সাময়িক আলোচনাকে উহার সহিত যুক্ত রাখিয়াছি। আমি অশাশ্বতের সহিত শাশ্বতের যোগ যে আছে, তাহা সর্বদাই দেখাইয়াছি। আমার সাময়িক লেখার মধ্যে যদি নিজস্ব বিশিষ্টতা কিছু থাকে উহা এই যোগস্থাপনে।

।।।
আমার লেখার মূল্য-বিচারের ভার আমি পাঠকদের হাতেই সমর্পণ করিলাম, কালিদাসের একটি উক্তি স্মরণ করিয়া। তিনি লিখিয়াছিলেন, “শক্তিমান লেখকেরা জ্ঞানী হইলেও একমাত্র নিজের উপরই আস্থা রাখেন না। তাঁহারা মনে করেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাঁহাদের রচনা বিদ্বান ব্যক্তিদের পরিতোষ না জন্মায় ততক্ষণ তাঁহাদের ‘প্রয়োগবিজ্ঞান’ সাধু নয়।”

শ্রীনীরদচন্দ্র চৌধুরী । নির্বাচিত প্রবন্ধ । আনন্দ পাব্লিশার্স প্রা. লি., কলকাতা ১৯৯৭ । বইয়ের ‘লেখকের সাফাই’ পরিচ্ছেদ থেকে অংশবিশেষ উৎকলিত।

 

ডমিন্যান্ট মাইনরিটির অর্থপরায়ণতা

আমরা সুপ্রাচীন কাল হইতে আধ্যাত্মিক জাতি বলিয়া খ্যাত। ঐহিক সম্পদ আমাদের নিকট তুচ্ছ। নির্বেদ আমাদের অস্থি-মজ্জায় মিশিয়া আছে বলিয়াই সকলে বলে। … অর্থ ও পরমার্থের যে অনিরসনীয় দ্বন্দ্বের উপর হিন্দুর ধর্মসাধনা প্রতিষ্ঠিত আজও কি তাহা বর্তমান? না, আমরা অর্থকেই সমস্ত মানবীয় চিন্তা ও কর্মের চরম নিয়ন্তা বলিয়া মানিয়া লইয়াছি?

।।।
বাঙালির অর্থপরায়ণতা আমেরিকান অর্থপরায়ণতা নয়; এমনকি মাড়োয়ারীর অর্থপরায়ণতাও নয়; উহার প্রাণ অনেক ক্ষুদ্র, পরিধি অনেক সঙ্কীর্ণ। আজিকার দিনে [১৯৩৭ সনে] বাঙালি ভদ্রসমাজের অর্থপরায়ণতাকে বিশ্লেষণ করিলে উহার দুইটি রূপ চোখে পড়ে। ইহাদের একটি সরকারি চাকুরিজীবীর মধ্যেই বিশেষভাবে বিকশিত হইয়া উঠিয়াছে বলিয়া ‘সরকারি টাইপ’ বলিয়া আখ্যাত হইবার যোগ্য; অপরটি নব্য বাঙালি ব্যবসায়ীর মধ্যে বেশি দেখা যায়, সেজন্য ‘ব্যবসায়ী টাইপ’ বলিয়া বর্ণিত হইতে পারে।

।।।
সরকারি অর্থপরায়ণতার বিবেকবুদ্ধি আছে, কিন্তু উহা উদারতা পর্যন্ত পৌঁছে নাই। তাই সঞ্চিত অর্থকে নিরাপদ স্থানে লইয়া গিয়া যক্ষের মতো আগলাইয়া থাকিবার কল্পনাই এই শ্রেণীর অর্থসাধকের একমাত্র স্বপ্ন। কাহাকেও এই ধনের অংশ না দিয়া, নিষ্প্রয়োজনে ব্যয় না করিয়া কিভাবে অর্থকে বাঁচাইয়া রাখা যাইতে পারে এই ধ্যান করিতে করিতে ইহাদের মনে এমন একটা স্থানের ছবি জাগিয়া ওঠে যেখানে দস্যু-তস্করের ভয় নাই, লোকাবাস আছে, অথচ সামাজিক কর্তব্য নাই, অর্থব্যয় করিবার দায়িত্ব নাই।

।।।
‘ব্যবসায়ী টাইপ’-এর প্রকৃতি ইহার সম্পূর্ণ বিপরীত। উহার উদারতা আছে, কিন্তু বিবেকবুদ্ধি নাই। তাই এই শ্রেণীর অর্থসাধক একটি পয়সাকে একটি রক্তবিন্দুর মতো জ্ঞান করেন না, তেমনই আবার একটি পয়সার জন্য কাহারও গলায় ছুরি দিয়া একবিন্দুর বেশি রক্তপাত করিতেও খুব বেশি সঙ্কোচ বোধ করেন না।

।।।
‘সরকারি টাইপ’-এর অর্থসাধকগণ সাধু প্রকৃতির হইলেও অপরের সততা সম্বন্ধে সর্বদাই সন্দেহপরায়ণ। ‘ব্যবসায়ী টাইপ’-এর সাধকের এই অবিশ্বাসপ্রবণতা নাই। তাহারা গোপনে পরস্পরকে চোর নামে অভিহিত করিলেও সম্মুখে কখনও ভদ্রতার ত্রুটি করেন না।

।।।
ইহারা দুই দলে মিলিয়া বাঙালি ভদ্রসমাজের প্রায় সবটুকু ব্যাপিয়া আছেন। এই সমাজের যেখানেই গিয়াছি, তা সে সভা-সমিতিতেই হউক কিংবা মাঠে-ময়দানেই হউক, আপিসে ও কর্মস্থলেই হউক আর রাস্তায় ও বাজারেই হউক — সর্বত্রই হয় ইহাদের একটি শ্রেণীর গম্ভীর ও আত্মতৃপ্ত মুখ, নয় আর-একটি শ্রেণীর সহাস্য ও আত্মতৃপ্ত মুখ দেখিতে পাইয়াছি। দেখিতে দেখিতে আমাদের সমাজের পরিণতি সম্বন্ধে বহু কথা মনে হইয়াছে; আমাদের সংস্কৃতির কথাও ভাবিয়াছি।

‘ডমিন্যান্ট মাইনরিটির অর্থপরায়ণতা’ সম্বন্ধে শ্রীনীরদচন্দ্র চৌধুরী, জুলাই ১৯৩৭ ‘শনিবারের চিঠি’। নির্বাচিত প্রবন্ধ, প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৫১-৫৪, আনন্দ পাব্লিশার্স প্রা. লি., কলকাতা ১৯৯৭

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you