পারস্পরিক আলাপের ভিত্তিতে এই অনুসন্ধান। কবি সরোজ মোস্তফা বাংলার বৃহত্তর নেত্রকোনা অঞ্চলের অপূর্ব বাগগেয়কার ছত্তার পাগলার পদসংগ্রহ সমেত তাঁর গায়নরীতি, পরিবেশনপদ্ধতি, বাদ্যযোজন ও গায়েনের জীবনকালীন পরিবেশ-প্রতিবেশ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে আসছেন। গবেষণাকাজে একাধিক প্রক্রিয়ায় তিনি গবেষিত প্রতিপাদ্যের উপর বহুমাত্রিক আলোকপাতে সচেষ্ট, এর মধ্যে একটি প্রক্রিয়া হচ্ছে এই চারণপদকারের সাহচর্য গ্রহণ করেছেন অথবা তাঁকে হাটেবাজারে স্টেশনে-দোকানবারান্দায় স্থানে-অস্থানে গাইতে দেখেছেন এমন ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে পদকার ব্যক্তিটির একটি বিশ্বস্ত ও প্রতিকৃতিপ্রতিম অবয়ব বর্ণে-বাক্যে তুলে আনা। ধারাবাহিক এই প্রক্রিয়ায় আজ এখানে পেয়ে যাচ্ছি নব্বইয়ের দশকের কবিদলের অন্তর্ভূত গুরুত্বপূর্ণ কবি আহমেদ স্বপন মাহমুদের সাক্ষাৎকার। আহমেদ স্বপন মাহমুদ, প্রসঙ্গত উল্লেখ করব, নিজে একজন গাননির্মাতাও, রয়েছে ‘আসমা পাগল’ নাম ধারণপূর্বক রচিত তাঁর গীতিসংকলনও। আরও উল্লেখ্য, ছত্তার পাগলা নিয়া গানপারে এর আগে প্রকাশিত হয়েছে একই লেখকের অর্থাৎ সরোজ মোস্তফা কর্তৃক গৃহীত কবি ও সংস্কৃতিকর্মক রইস মনরমের ছত্তার পাগলার অনুসন্ধানমূলক আলাপচারিতা। আর, বাহুল্য হবে না জানানো, ছত্তার পাগলার গান ও তাঁর জীবনানুষঙ্গ নিয়া কবি ও গবেষক সরোজ মোস্তফার বইটি দুইহাজারপঁচিশের জানুয়ারি পর্যন্ত, যদ্দুর জানা যায়, যন্ত্রস্থ ও প্রকাশাপেক্ষায়। — গানপার
ছত্তার পাগলার সন্ধানে : আহমেদ স্বপন মাহমুদের সঙ্গে আলাপচারিতায় সরোজ মোস্তফা
সরোজ মোস্তফা : স্বপনভাই, আপনি কি ছত্তার পাগলারে দেখছেন? সে তো ট্রেনে, মজমায়, বাজারে, স্টেশনে গানটান করত।
আহমেদ স্বপন মাহমুদ : আমার যতটুকু স্মৃতিতে মনে পড়ে, আমি সম্ভবত হিরনপুরেই তারে দেখছি। মোহনগঞ্জে দেখছি কি না আমার স্পষ্ট কোনো স্মৃতি নাই। কিন্তু মনে হয় যে দেখছি। এটা অনেক-সময় হয় কি দেখাগুলোও বিভিন্ন আখ্যানে হাজির হয়। রইসকাকার কাছে (রইস মনরম) গল্প শুনছি। শুনতে শুনতে সেটাকে অনেক পরে একটা সময়ে বাস্তব মনে হয়। আমাদের সময়টায় এমন হতো যে ধরেন, দুপুরের ছুটি হলো, ট্রেন আসতেছে, ট্র্রেনে করে নেত্রকোনায় চলে আসতাম। আবার ফেরার সময় হিরনপুর এসে নেমে পড়তাম। তো আসাযাওয়ার পথে অনেক অনেক শিল্পী, অন্ধ শিল্পী ছিল যারা, ট্রেনে ট্রেনে গান করত। অনেক শিল্পীর মাঝে নারীরাও ছিল। আমি হয়তো হিরনপুর থেকে মোহনগঞ্জ যাচ্ছি বা মোহনগঞ্জ থেকে হিরনপুর আসছি, তো এই সময়টায় আমরা মূলত দুইটা বগির মাঝখানে বসে থাকতাম বা কখনো হাতল ধরে ঝুলে থাকতাম। মনে হয়, আমি হিরনপুর স্টেশনেই ছত্তার পাগলার গান শুনেছি, একেবারে ছোট, তখন হয়তো সিক্স-সেভেনে পড়ি। পরবর্তীতে যখন আমি ছত্তার পাগলাকে জানছি তখন আমার কাছে মনে হয়েছে যে, হ্যাঁ, আমি ছোটবেলায় দেখছি।
সরোজ মোস্তফা : ছত্তার পাগলা কিন্তু এক-ধরনের রক। ‘রক’ বলতে আমরা নাগরিক পরিমণ্ডলের যে একটা তথাকথিত বিষয় বুঝি ছত্তার পাগলা ঠিক সেটা না। আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, ফকিরি গানটা যেটা ফকিরি, যে-ধারাটা সাধুসন্তরা গান কিংবা ধারণ করেন ছত্তার পাগলা সে-জীবনটাকে এক ধরনের রকের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। ‘রক’ বলতে যেটা বুঝাচ্ছি তা হচ্ছে দ্রোহ। আভিজাত্যের যে-সমাজ সেই অভিজাত সমাজকে আমি তুচ্ছ জ্ঞান করি, এমন।
আহমেদ স্বপন মাহমুদ : আমি বোধহয় একবার বলছিলাম আপনাকে ছত্তার পাগলাকে নিয়ে। নেত্রকোনায় ’৭২ সাল থেকে ’৭৪ সাল — এই সময়টায় একটা প্রতিযোগিতা হয়েছিল, সেখানে ছত্তার পাগলা প্রথম হয়েছিল সুরের কারণে। জাতীয় পর্যায়ে কি না এই মুহূর্তে আমার ঠিক মনে নাই। তো উনার সুর এতই ভালো ছিল আর-কি যে একটা প্রতিযোগিতায় উনি শ্রেষ্ঠ হয়েছিলেন। এখন তো কর্পোরেটযুগে এসে শিল্পীদের মাঝে একটা আপোসের মনোভাব চলে এসেছে। এখন তো স্বার্থ, দল, আপোস ইত্যাদি চলে এসেছে। একটা সময় কিন্তু ছিল না এসব। এটাই তো ধরেন আশির দশকের আগেও ছিল না, ব্যতিক্রম বাদ দিলে ম্যাসিভ আকারে ছিলই না। তো তারা আসলে প্রত্যেকে সাধু, প্রত্যেকে শিল্পী, প্রকৃত অর্থে, প্রেমিক ও বিদ্রোহীও। এবং ছত্তার পাগলা ছিল ওই যে দ্রোহের কথাটা বললেন না, একজন বিপ্লবী, একেবারে খাস বিপ্লবী। ‘একটা বল বাইশজন লাইত্থায়, তোর ঠ্যাংডা হুশিয়ার।’ ওইখানেই কিন্তু একটা চরণ আছে, এই যে ‘খেলা হইল শুরু, আউট হইলে আবার করে থ্রু, প্লান্টিক শট হইলে পরে, একলা গোলিডা বলডা ধরে, না জানি বল কইবান পড়ে, মরিলে সবই অন্ধকার’ … এটার মাঝে আমি একটা বড় রকমের আধ্যাত্ম্যবাদ খুঁজে পাই এবং আমি বারবার শিহরিত হই। সে তো খুব বাস্তবধর্মী গান লিখত, বাস্তবধর্মী গানেও সে আধ্যাত্মিক মোচড়টা যা দিত না!
সরোজ মোস্তফা : ছত্তার পাগলার সুরের ভিত্তি হচ্ছে মাজারসংস্কৃতি আর চেতনে-অবচেতনে ময়মনসিংহের যে-পালাগান সেই পালাগানকেই ধারণ করছেন উনি। বাস্তবতায় তিনি হচ্ছেন একেবারেই কনটেম্পোরারি। একেবারেই সময়টাকে তিনি উপস্থিত করেছেন। চৈতন্যে তিনি হচ্ছেন সুফি আর প্রেজেন্টেশনে তিনি কাহিনিকাব্যের ধারক। কাহিনিকাব্য বলতেছি কারণ তার গানের মূল ব্যাপাটাই হচ্ছে কাহিনি, গল্প। আবার পরিবেশনটা হচ্ছে সুফি এবং একটা রক স্টাইল আছে। এবং ছত্তার পাগলা একেবারেই ডিফারেন্ট এক ধরনের আর্টিস্ট। আর ছত্তার পাগলাকে ধরেন কেউ আপনার ওই যে পালাগান, মালজোড়া গান, কীর্তন গান, বৈষ্ণব গান, মনসামঙ্গলের গান, কৃষ্ণের গান — কোনো গানের ফর্ম ও প্রাচুর্যে তাঁকে আটকানো যাচ্ছে না। কোনো ফ্রেমে তাঁকে নিয়ে আসতে পারবেন না। এই মাটিতে জন্ম নিয়ে এই মাটির গানই গেয়েছেন, কিন্তু এমনভাবে গেয়েছেন যেমন করে আগে কেউই গাননি।
আহমেদ স্বপন মাহমুদ : আসলেই তিনি ফ্র্রেমলেস। হি ক্রিয়েটেড হিজ ঔন ফ্র্রেম অ্যান্ড ফর্ম। বাউলও না। কিন্তু তিনি নিজেই একটা জাত। আমি মনে করি ছত্তার পাগলা ছিলেন এমন এক ব্যতিক্রমী শিল্পী, দুনিয়ায় খুব রেয়ার টাইপের শিল্পী আর কি। তাঁর পরিবেশনের ধরনটাই আলাদা। বলতে পারেন তিনি একজন মহৎ শিল্পী।
সরোজ মোস্তফা : আচ্ছা, আমি যে তার ঈদ মোবারকের গানটা ছাপাইছি দেখছেন তো! অদ্ভুত একেবারে। ঐ যে কাহিনিকাব্য মহুয়া-মলুয়ার মতো। মানে, ঈদ মোবারক গানে সে বলতেছে তার বেয়াই এসেছে বাড়িতে, কিন্তু তার তো সেমাই কেনার টাকা নাই। অদ্ভুত, সে গল্পটা বলছে এমনভাবে, বেসিক্যালি তিনি একজন আখ্যানশিল্পী। এবং ধনু নদীর পারে মাটিকাটার গল্প নিয়ে গান। আরও কত বৈচিত্র্যময় বিষয়-আশয়!
আহমেদ স্বপন মাহমুদ : ‘শাপলা বানু শাপলা বানু ওই দেখ কামধেনু দুধের গাই’ — কী অসাধারণ গান, ‘পারভেইচ্চারে তওবা কইরা বল খেলাডা ছাড়’ — এইগুলো অসাধারণ গল্প, একেবারে জীবনের বাস্তবতা থেকে তুলে নেওয়া। অর্থাৎ সে কনটেম্পোরারির জায়গাটা ধরে গানগুলো করত। অর্থাৎ সে একেবারেই ডিফারেন্ট একটা আর্টিস্ট। খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। সে নিজেই একটা ফর্ম ও ফ্রেম। তার উপরে গবেষণা হওয়া উচিত। ছত্তার পাগলাকে নিয়ে আপনার লেখা বইটা কি প্রকাশ হয়েছে, না হয় নাই?
সরোজ মোস্তফা : শেষের দিকে।
আহমেদ স্বপন মাহমুদ : ওকে। করে ফেলেন। এটা শেষ করেন। এটা হওয়া দরকার। আমাদের জায়গা থেকে আপনি করতেছেন এজন্য আপনার প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা। আপনি করেন, আমরা পড়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি।
ছত্তার পাগলার গান
আলাপচারিতায় ছত্তার পাগলার অনুসন্ধান ১
গানপারে আহমেদ স্বপন মাহমুদ
সরোজ মোস্তফা রচনারাশি
- ছত্তার পাগলার সন্ধানে আহমেদ স্বপন মাহমুদ ও সরোজ মোস্তফা - January 28, 2025
- সপ্তপদীর দুপুরবেলায় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় || ইলিয়াস কমল - January 27, 2025
- স্বরচিত কবিতার অন্তর্গত অনুপ্রেরণা || হাসান শাহরিয়ার - January 24, 2025
COMMENTS