আলাপচারিতায় ছত্তার পাগলার অনুসন্ধান। এর আগে এক এবং দুই গেছে, এইটা থার্ড আলাপচারিতা। পারস্পরিক আলাপের ভিত্তিতে এই অনুসন্ধান। কবি সরোজ মোস্তফা বাংলার বৃহত্তর নেত্রকোনা অঞ্চলের অপূর্ব বাগগেয়কার ছত্তার পাগলার পদসংগ্রহ সমেত তাঁর গায়নরীতি, পরিবেশনপদ্ধতি, বাদ্যযোজন ও গায়েনের জীবনকালীন পরিবেশ-প্রতিবেশ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে আসছেন। গবেষণাকাজে একাধিক প্রক্রিয়ায় তিনি গবেষিত প্রতিপাদ্যের উপর বহুমাত্রিক আলোকপাতে সচেষ্ট, এর মধ্যে একটি প্রক্রিয়া হচ্ছে এই চারণপদকারের সাহচর্য গ্রহণ করেছেন অথবা তাঁকে হাটেবাজারে স্টেশনে-দোকানবারান্দায় স্থানে-অস্থানে গাইতে দেখেছেন এমন ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে পদকার ব্যক্তিটির একটি বিশ্বস্ত ও প্রতিকৃতিপ্রতিম অবয়ব বর্ণে-বাক্যে তুলে আনা। ধারাবাহিক এই প্রক্রিয়ায় আজ এখানে পেয়ে যাচ্ছি ছত্তার পাগলার গানের অনুলিখনকার আল মামুন চৌধুরীর সাক্ষাৎকার। আর, বাহুল্য হবে না জানানো, ছত্তার পাগলার গান ও তাঁর জীবনানুষঙ্গ নিয়া কবি ও গবেষক সরোজ মোস্তফার বইটি, যে-বইয়ের ছুঁতায় আলাপচারিতার শেষে একটা বাক্য বলতে শুনব সাক্ষাৎদাতাকে, এই বইয়ের হালফিল দুইহাজারপঁচিশের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, যদ্দুর জানা যায়, যন্ত্রস্থ ও প্রকাশাপেক্ষায়। — গানপার
ছত্তার পাগলার সন্ধানে আল মামুন চৌধুরী ও সরোজ মোস্তফা
ভাটিবাংলার রাজধানী মোহনগঞ্জ বাজারে ১৭-১৮ বছর ধরে দাঁতের ডাক্তারি করেন আল মামুন চৌধুরী। সাধারণের কাছে তিনি ডাক্তার মামুন হিশেবে পরিচিত। ছত্তার পাগলার সঙ্গে তার ছিল অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। ছত্তার পাগলার ‘গানবলা’ অনুসরণপূর্বক যথাসাধ্য হুবহু তিনি লিখে নিতেন খাতায় কলমে, পুনরায় লেখা পড়ে শুনিয়ে ছত্তার পাগলার সায় আদায় করে নিতে হতো। ছত্তার পাগলার সঙ্গে অনেক অনেক দিনের অন্তরঙ্গতায় এবং হস্তলিপি সুন্দর ও সুস্পষ্ট হওয়ায় তিনি নিরলস আনন্দে অনুলিখন করে গেছেন ছত্তার পাগলার গান অনেক দিন পর্যন্ত। ছত্তার বলতেন, গান, মামুন লিখে নিতেন। তাই, ‘গানবলা’ থেকে, কখনোবা পাগলার হাতে লেখা পাতা থেকে স্পষ্ট হস্তলিখন দিতেন তিনি ছত্তার পাগলার গানের ভাব ও বাণীগুলো। পুরো প্রক্রিয়াটি কীভাবে হতো, সবিশদ জানার জন্য আল মামুন চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি, ছত্তার পাগলার গানগুলি কীভাবে অনুলিখন করতেন তিনি ইত্যাদি নিয়ে তো কথা ওঠেই, ছত্তার পাগলা নামের গোটা মানুষটাকে নিয়েই কথা বলি, ধীরে ধীরে একটি অবয়ব যেন গড়ে উঠতে দেখি। ঠিক এইভাবে যারা পথচলতি মানুষ হিশেবেও ছত্তার পাগলাকে দেখতেন বা চিনতেন জানতেন, তাদের সঙ্গেও কথা বলে এই কীর্তি-রেখে-যাওয়া বাউলা মানুষটির প্রতিকৃতিরেখা আরেকটু স্পষ্টগোচর করে নিতে পারব আমরা। আপাতত, ভাটিবাংলার রাজধানী মোহনগঞ্জ বাজারে সতেরো-আঠারো বছর ধরে দাঁতের ডাক্তারি করেন আল মামুন চৌধুরী, সাধারণের কাছে যিনি ডাক্তার মামুন হিশেবে পরিচিত, ছত্তার পাগলার সঙ্গে ছিল যার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক, কথা বলি ছত্তার পাগলার গানকথার/গীতাখ্যকবিতার সেই অনুলিখনকারের সঙ্গে। — সরোজ মোস্তফা
আপনার সাথে ছত্তার পাগলার পরিচয় কীভাবে? কীভাবে চিনলেন তাকে?
তাঁকে ছোটবেলা থেকেই চিনি। স্টেশনে-ট্রেনে-হাটে-স্টেজে তাঁর গান শুনেছি। কিন্তু তাঁর সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি হয় সম্ভবত ২০০৬ সালে। আমার মনে হয় ২০০৬ সালের শুরু থেকেই তিনি আমার চেম্বারে নিয়মিত এসেছেন। এমন কোনও দিন ছিল না যেদিন ছত্তারভাই আমার এখানে আসেননি। আমাদের মধ্যে বয়সের ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও একটা বন্ধুত্ব হয়েছে। লম্বা সময় তিনি বসে থেকেছেন। আমার কাছে রোগী এসেছে, আমি কাজ করছি কিন্তু তিনি বসে থেকেছেন। তার সঙ্গ, কথা আমি খুব পছন্দ করতাম। খুবই জ্ঞানী মানুষ। আধ্যাত্মিক মানুষ। কথা খুব বেশি বলতেন না। শুনতেনই বেশি।
আপনার সাথে ছত্তার পাগলার সখ্য কীভাবে গড়ে উঠল? শুরুতেই তো একজন মানুষ এসে বলতে শুরু করলেন না যে ভাই, আমার গানগুলো লিখে দেন। মানে আপনাকে তিনি দায়িত্ব কীভাবে দিলেন? বা কোন প্রেক্ষিতে আপনি গানগুলো লেখার দায়িত্ব নিলেন।
আমি ডেন্টালে ডিপ্লোমা। মোহনগঞ্জের লোকজন আমাকে দাঁতের ডাক্তার বলে। তো তিনি আমার কাছে দাঁতের চিকিৎসা করাতে এসেছিলেন। উনার উপরের দিকের চারটি দাঁত পড়ে গিয়েছিল। বাঁশি বাজাতে পারতেন না। কথাও ভালো বোঝা যেত না। গানও বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। তো এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্য তিনি আমার কাছে এসেছিলেন। রিমুভাল ডেনচার তৈরি করে দিয়েছিলাম। কবি রইস মনরম স্যার আমার এখানে পাঠিয়েছিলেন।
দাঁতের কৃত্রিম সংযোগে কি কাজ হয়েছিল? মানুষটা তো খুবই স্মার্ট ছিলেন। কৃত্রিম দাঁত সংযোগ করে বাঁশি বাজাচ্ছেন, গান গাচ্ছেন ভাবতেই একটা অন্যরকম রোমাঞ্চ লাগছে।
অবশ্যই স্মার্ট ছিলেন। ছত্তারভাই আমাদের মতো ছিলেন না। মুক্ত মনে তিনি যা ভাবতেন, তা-ই করতেন। তাঁর পোশাক দেখলেই আপনি তাঁকে বুঝতে পারবেন। কোনো কৃত্রিমতা নেই। গানের মানুষ, ভাবের মানুষ। রস দিয়ে কথা বলতেন। এই জনপদের খাঁটি মানুষ। নিজের বাড়িতে, নিজের ভুবনে কাটিয়ে দিয়েছেন। তো, আমার মনে হয় তিনি বাঁশি বাজাতে পারছেন না কিংবা কথা জড়িয়ে যাচ্ছে — এই অসুবিধা থেকে মুক্তির জন্য রইসস্যার তাঁকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন। তিনিও বলেছেন রইসস্যার তাঁকে দাঁত বাঁধাই করার জন্য বলেছেন। দাঁত বাঁধাই করলে সুর প্রকাশে সুবিধা হবে।
তাঁর গানগুলো লেখার ব্যাপারে রইসস্যার কি আপনাকে কিছু বলেছিলেন?
স্যার আমাকে কিছু বলেননি। ছত্তারভাইকে কিছু বলেছিলেন কি না এ-বিষয়ে আমি বলতে পারব না। ছত্তারভাই ভালো বলতে পারতেন। আসলে বিষয়টা শুরু হয়েছিল অন্যরকম ভাবে। বিভিন্ন গান নিয়ে তো তাঁর সাথে কথা হতোই। তিনি তার গানগুলো বিভিন্ন টুকরো কাগজে, সিগারেটের প্যাকেটে, ঠোঙার কাগজে লিখে রাখতেন। বাচ্চাদের ছোট খাতাও ছিল দুয়েকটা। তো একদিন উনার এমন একটি গান পড়তে শুরু করলাম কিংবা তিনিই হয়তো পড়তে দিয়েছিলেন। এমন হাতের লেখা কিছুই বোঝা যায় না তবু কষ্ট করে পড়লাম। পড়তে চেষ্টা করলাম। তিনি সহায়তা করলেন। শেষে এই গানটা আমি একটা পৃষ্ঠায় লিখলাম। দেখলাম তিনি খুব খুশি হলেন। শুরু হলো গান লেখার কাজ।
তিনি কি তাঁর সব গান নিজের হাতে লিখেছিলেন? মানে তার সবগুলো গানকে কি তিনি খাতায় উঠিয়ে রেখেছিলেন?
সবগুলো গান মনে হয় লিখতে পারেননি। দুই/একটি খাতা আর কিছু বিচ্ছিন্ন পৃষ্ঠা ছাড়া আমি কিছু দেখিনি। তাঁর লেখাগুলো ছিল প্রাচীন পুঁথি লেখার মতো। লেখাও একত্রে চটকানো। তিনি ছাড়া আর কেউ সহজে পড়তে পারবেন না। প্রথম গানটা লিখে দেওয়ার পর তিনি একেক দিন একেকটা পৃষ্ঠা নিয়ে হাজির হতেন। স্মৃতি থেকে বলতেন। দীর্ঘ কাহিনি বলতেন। মুখস্থ বলতেন। অবাক করার মতো ব্যাপার। উনি বলছেন আমি লিখছি। শেষে লেখাটা আবার তাকে পড়ে শুনাচ্ছি। কোথাও উঠাতে ভুল হলে তিনি বলে দিতেন। উনার নিজের লেখা পাণ্ডুলিপি এবং আমার লেখাগুলোকে একটা কথা বলে তিনি তুলনা করেছিলেন। বলেছিলেন : আমি রুয়া লাগাইছিলাম, এখন সেই রুয়া (লেখাগুলো) চারাগাছ হয়ে ঝকঝক করতাছে।
আমি খুব অবাক হচ্ছি গানগুলো যে লিখে যেতে হবে এটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এবং নিজের গান নিজেই লিখে রেখে যাচ্ছিলেন। শেষে আপনার সহায়তা নিলেন। কিছু গান রইসস্যারকে দিয়েও তিনি লিখিয়েছেন।
হ্যাঁ, নিজের হাতে তিনি পাণ্ডুলিপি গুছিয়ে রেখে যেতে চেয়েছিলেন। একটা বই হোক এটাও হয়তো চাইছিলেন। সময় যে শেষ হয়ে যাচ্ছিল এটা মনে হয় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তাঁর গানগুলো গুছিয়ে রেখে যেতে চেয়েছিলেন।
আপনি গানগুলো খাতায় তুলে দেয়ার পরে তার অভিব্যক্তি কি ছিল?
তিনি খুবই খুশি ছিলেন। তিনি কিন্তু লিখতে পারতেন। আমার লেখাগুলো পড়তেন। তাঁর শব্দগুলো ঠিকমতো এসেছে কি না সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন। জিজ্ঞাসা করতেন। শব্দের ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলেন। তিনি তাঁর শব্দের বাইরে আমি নিজস্ব কোনো শব্দ নিয়ে এসেছি কি না সেটা খুব খেয়াল করতেন। যেমন : ‘ফারভেইছ্যারে বল খেলাডা তওবা কইরা ছাড় / আমি তরে না করতাছি পাগলও ছত্তার’ — এই শব্দগুলো তার নিজস্ব। এর বাইরে কোনো শব্দ তিনি ব্যবহার করতে চাইতেন না। আমি যদি প্রমিত শব্দ ব্যবহার করতাম তিনি নিতেন না। একটা একটা করে তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন।
ছত্তার পাগলার গানগুলো নিয়ে আপনার মূল্যায়ন শুনতে চাই।
আমি তো গানের মানুষ না। তাঁর গান মূল্যায়নের সাহস আমার নাই। তবে আমি এটা বলতে পারি, তাঁর মতো করে এইভাবে আর কেউ গান লেখেন নাই। গাইতেও পারেন নাই। আমাদের অঞ্চলটাকে তাঁর গানে পাওয়া যায়। তাঁর গানে এমন এমন চরিত্র আছে যে চরিত্র অন্য কোনও অঞ্চলে নাই। সেই চরিত্রগুলোকে অবলম্বন করে এমন কিছু কথা, এমন কিছু চিন্তা বলা হয়েছে যা অন্য কেউ বলতে পারেননি। এমন একজন মানুষের সাথে আমি সাত-আট বছর সঙ্গ করেছি এটা আমার জীবনের পরম পাওয়া।
আপনি ভালো থাকবেন। অনেক অনেক ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ। ছত্তার পাগলার গান ও জীবন নিয়া আপনার বইটি দ্রুত বের হোক।
সরোজ মোস্তফা রচনারাশি
ছত্তার পাগলার গান
আলাপচারিতায় ছত্তার পাগলার অনুসন্ধান
ছত্তার পাগলা, গানপারে
- আলাপচারিতায় ছত্তার পাগলার অনুসন্ধান ৩ : ছত্তার পাগলার গীতাখ্যকবিতার অনুলিখনকার || সরোজ মোস্তফা - February 26, 2025
- ভরা চান্নির উপত্যকায় কাব্য ও কথকতা || সরোজ মোস্তফা - October 30, 2024
- নূরুল হকের দুটো অপ্রকাশিত কবিতা || সংগ্রহ ও ভূমিকা : সরোজ মোস্তফা - July 28, 2021
COMMENTS