ব্যক্তিক নৈবেদ্য || সাদী মহম্মদ

ব্যক্তিক নৈবেদ্য || সাদী মহম্মদ

জীবন ধারণের জন্য মানুষকে অনেক কিছুরই আশ্রয় নিতে হয়। মৌলিক চাহিদার পাশাপাশি সেই আশ্রয় যদি হয় সংগীত, তাহলে একবাক্যে স্বীকার করে নিতে হয় — রবীন্দ্রসংগীত সেই আশ্রয়ের প্রধানতম স্থান। ব্যক্তিগত নৈবেদ্যের জায়গা থেকে তার সংগীত বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই, তার রচিত এবং সুর-করা গানগুলো আমাদের জন্য আয়নাস্বরূপ। সেখানে আমরা নিজেদের দেখতে পাই স্পষ্টভাবে। দিবালোকের মতো প্রতীয়মান হয় আমাদের মনের গভীরে লুকিয়ে-থাকা আনন্দ, দুঃখ, বেদনা, ক্লান্তি, হতাশা, বিষাদ। এক-কথায় মানবমনসংশ্লিষ্ট সবকিছুরই অধিকার যেন তিনি তার সংগীতের মাধ্যমে নিয়েছেন শীতলতার পরশ বুলিয়ে।

রবীন্দ্রনাথের গান তার বিশাল সৃষ্টিশীল জীবনের অনন্য কীর্তি। কবে তিনি প্রথম গান রচনা করেন তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কারো মতে বারো বছর বয়সে, আবার কারো মতে ১৮৭৫ সালে চোদ্দ বছর বয়সে তার গান লেখার সূচনা। এ-সময় তিনি অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সরোজিনী’ নাটকের জন্য ‘জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ’ গানটি রচনা করেন। জীবনের শেষ জন্মদিনের জন্য তিনি রচনা করেন ‘হে নূতন, দেখা দিক আরবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ’ গানটি। তার মোট গানের সংখ্যা দুইহাজার দুইশবত্রিশ (২,২৩২) এবং সেগুলো অখণ্ড ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ তার গানের মধ্যে চেষ্টা করেছেন নিজের আপন অস্তিত্বকে বিকশিত করতে। তার গানে সেসব অশরীরী চেতনা আছে যা মানুষকে পরোক্ষে নৈর্ব্যক্তিক চেতনায় পৌঁছে দেয়, বাস্তবের সীমায় যা মানুষকে কোনোই সাহচর্য দেয় না। রবীন্দ্রনাথ এ-তাৎপর্য স্পষ্ট করার জন্য বলেছেন, “আমি নিজে কতবার মনে করেছি এবং বলেছি বাংলা ভাষাতেও এগুলো ঠিক সাহিত্যের মধ্যে গণ্য হবার যোগ্য নয় … এ কেবল আমার নিজের মনের কথা, আমারই প্রয়োজনে লেখা।” উদাহরণস্বরূপ বলা যায় —

“কখন তুমি আসবে ঘাটের ’পরে
বাঁধনটুকু কেটে দেবার তরে।
অস্তরবির শেষ আলোটির মতো
তরী নিশীথমাঝে যাবে নিরুদ্দেশে।”

এ গানে মানবিক প্রেমের বেদনা যেমন আছে, তেমনই গানের বাণীতে ভগবানের প্রতি প্রেমের আকুতি ধরা পড়ে। কিন্তু যে-বিশ্লেষণই হোক না কেন, রবীন্দ্রনাথ তার অনিশ্চয়তার গহ্বর থেকে বের হতে পারছেন না। অজানা অসীমের প্রতি এ বিষাদগন্ধমাখা আকর্ষণই রবীন্দ্রনাথের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন দেশে যাবেন তা তিনি জানেন না। তিনি শুধু জানেন তার এ-যাত্রা নিরুদ্দেশের পথে।

শুধু একটি গানের মাধ্যমে রবীন্দ্রমহিমা উল্লেখ করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। তার গান আত্মস্থ করতে হয়। জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে আপন মনে সুতায় গাঁথা ফুলের মালার মতো গাঁথতে হয়। তবেই রবীন্দ্রসংগীতের সার্থকতা।

ঋতুর পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে মানবমনের রূপবদলের বিষয়টি রবীন্দ্রসংগীতের মতো আর-কোথাও এত গভীরভাবে দেখা যায় না। “আজি ঝরোঝরো মুখর বাদর দিনে / জানি নে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না।” বর্ষা এক-ধরনের বিষণ্ণতা নিয়ে হাজির হয় রবীন্দ্রনাথের গানে। তা আমাদের চেতনার গহিনে আছড়ে পড়ে। তখন আমরাও বিষণ্ণ হয়ে পড়ি। তবে বিষণ্ণতাই তার বর্ষার গানের শেষ কথা নয়। অন্যরকম সৌন্দর্য অবলোকনেরও অবকাশ রয়েছে সেখানে। শ্রাবণের নীরব-নির্জন সন্ধ্যায় রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে যে বিশ্বপ্রকৃতির ছন্দময় রূপ আমরা অবলোকন করি, তা অন্য কোথাও পাওয়া দুষ্কর।

রবীন্দ্রগানের মধ্যে যেমন রয়েছে মধুর রস তেমনি রয়েছে ব্যাকুলতা ও ট্র্যাজিক অনুভূতি। তার ঋতুভিত্তিক গানে বাংলাদেশের যে-চিত্র তিনি এঁকেছেন তা আমাদের প্রকৃতি ও জীবনের এক অনুপম মিথস্ক্রিয়া। বসন্ত, শরৎ, শীত, হেমন্ত — সব ঋতুরই বৈচিত্র্য ও সান্নিধ্যের সখ্য তিনি দেখেছেন শিল্পীর দৃষ্টিতে। সেখানে রয়েছে রবীন্দ্রদর্শনেরও আলো-আঁধারি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, —

“সংগীতশাস্ত্রের মধ্যে সকল ঋতুর জন্যই কিছু কিছু সুরের বরাদ্দ থাকা সম্ভব। কিন্তু সেটা কেবল শাস্ত্রগত। ব্যবহারে দেখিতে পাই বসন্তের জন্য আছে বসন্ত আর বাহার, আর বর্ষার জন্য মেঘমল্লার, দেশ এবং আরও বিস্তর। সংগীতের পাড়ায় ভোট লইলে বর্ষারই হয় জিত। শরৎ-হেমন্তে ভরামাঠ ভরানদীতে মন নাচিয়া ওঠে; তখন উৎসবেরও অন্ত নাই, কিন্তু রাগিণীতে তাহার প্রকাশ রহিল না কেন! তাহার প্রধান কারণ, ঐ ঋতুতে বাস্তব ব্যস্ত হইয়া আসিয়া মাঠঘাট জুড়িয়া বসে। বাস্তবের সভায় সংগীত মুজরা দিতে আসে না — যেখানে অখণ্ড অবকাশ সেখানেই সে সেলাম করিয়া বসিয়া যায়।” [আষাঢ়]

বসন্তের একটি বিখ্যাত গান নিয়ে আরও কিছু বলা যেতে পারে —

“আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে।।
যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে
এই নিরালায় র’ব আপন কোণে
যাব না এই মাতাল সমীরণে।।”

বসন্তের মায়াময় জ্যোৎস্না সবাইকে বাইরে টানে। বসন্তের মাতাল বাতাসে, জ্যোৎস্নার কুহকি টানে সবাই বনে গেছে, বনে জ্যোৎস্নার সৌন্দর্য সবকিছুর চেয়ে আলাদা। কিন্তু কবি যেতে চান না। তিনি ঘরের কোণে নিরালায় বসে আত্মার পরিশুদ্ধি ঘটাতে চান। সেখানে এসে মিলবেন তার আরাধ্য পরমেশ্বর।

গানের ভেতর দিয়ে বাঙালির সৃজনশীলতা বিকাশে যে পাঁচ গীতিকবির অবদান খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই তারা হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন ও অতুলপ্রসাদ সেন। কিন্তু এ পাঁচ মহীরুহের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বকালের, সর্বসময়ের। তিনি আমাদের সর্বস্ব, তিনি আমাদের সর্বনাশ।

বর্তমান সমস্যাগ্রস্ত জীবনযাপনের মধ্যে রবীন্দ্রসংগীত শান্তির বার্তা নিয়ে হাজির হয় — এ কথা যেমন সত্য, তেমনি আমাদের আধুনিক জীবনে তার সংগীত জড়িয়ে আছে ব্যক্তির আপন সত্তাকে বিকাশ এবং আশ্রয় হিসেবে। অনন্তকালের জন্যই যেন তার সংগীত জড়িয়ে আছে আমাদের সবার জীবনের সঙ্গে এবং কালের পরিক্রমায় তা যেন আরও গভীরভাবে গেঁথে যাচ্ছে জীবন থেকে জীবনে, প্রাণ থেকে প্রাণে।

গানপারটীকা
বাংলাদেশের সংগীতজগতে যে-কয়জন কণ্ঠশিল্পী বিশেষত পুরাতনী বাংলা গান, পঞ্চকবির গান, সবিশেষ রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে খ্যাতি লভেছেন সাদী সাদী মহম্মদমহম্মদ তাদের মধ্যে একজন। রবীন্দ্রসংগীতের সংরক্ষণ, অনুশীলন ও সম্প্রসারণেও তিনি নিরলস কাজ করে চলেছেন গত চার-চারটি দশক ধরে। রয়েছেন সক্রিয় সাংগঠনিকভাবেও, রবীন্দ্রসংগীত প্রসারের সাংগঠনিকতায় সাদী মহম্মদ অনস্বীকার্য একজন। বেতারে-টেলিভিশনে নিয়মিত অনুষ্ঠানে গেয়ে থাকেন, প্রতিষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীত শেখাচ্ছেন, রয়েছে সাদীর-কাছে-রবীন্দ্রসংগীতে-তালিমপ্রাপ্ত প্রচুর শিক্ষার্থী দেশজুড়ে। অ্যালবামও রয়েছে সাদীর একাধিক, স্টুডিয়োঅ্যালবাম, জনপ্রিয়ও হয়েছে অ্যালবামগুলো। রবীন্দ্রনাথকেন্দ্রী লিখনচর্চায় সাদীকে সেভাবে পাওয়া না-গেলেও বক্তৃতা-ভাষণ ইত্যাদি দিতে দেখা যায় টেলিভিশনের কথানুষ্ঠানগুলোতে। এই লেখাটা সেইসব বিবেচনায় সাদীর বিরল একটা কাজ বলতে হয়। এইটা ছাপা হয়েছিল দৈনিক সমকাল পত্রিকার শুক্রবাসরীয় সম্পূরক ম্যাগাজিন ‘কালের খেয়া’ ০৪ মে ২০১২ সংখ্যায়। লেখাটা আন্দাজ করি কাগুজে মুদ্রণের বাইরেকার ওয়েবক্ষেত্রে অ্যাভেইলেবল নাই। পঁচিশে বৈশাখের লগ্নে এইখানে লেখাটা গানপার কর্তৃক পুনর্মুদ্রিত হলো ও কাগুজে মুদ্রণের বাইরে নবতর ক্ষেত্রে সংরক্ষিত রইল।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you