শেষের রবীন্দ্রনাথ || সৈয়দ শামসুল হক

শেষের রবীন্দ্রনাথ || সৈয়দ শামসুল হক

নিঃসঙ্গতাকে শক্তি হিসেবে ব্যবহার করবার পাঠ আমি নতুন করে নিই তাঁর মহাপ্রয়াণের এই মাসটিতে। মনে পড়ে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের শেষ গানটি রচনা করেন আপন জন্মদিন উপলক্ষে – “হে নূতন, দেখা দিক আরবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ” – বাংলা ১৩৪৮ সালের ২৩শে বৈশাখ; নতুন রচনা ঠিক নয়, তাঁরই আগেকার একটি কবিতার কিছু অংশ তিনি সামান্য বদলে নিয়ে সুরের শরীরে স্থাপন করেন। কিন্তু এ কি সত্যি তাঁর নিজের জন্মদিনের কবিতা? নাকি জন্মের অপেক্ষায় যে আছে, – কবি নয়, শিল্পী নয়, কর্মী নয়, নেতা নয়, – নতুন কেউ, নতুন দিনের কেউ, – নতুনের দিকে আমাদের ফেরাবে এমন কেউ, তারই দিকে হয় বটে বাংলার জ্যেষ্ঠ সন্তানের এই প্রার্থনা? রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের জন্মদিনের সার্থকতা দেখতে চান নতুন কারো জন্মগ্রহণের সম্ভাবনার ভেতরে, নইলে ব্যর্থ তাঁর জন্মগ্রহণ।

তুমুল কর্মময় একটি জীবন পেরিয়ে এসে রবীন্দ্রনাথ  – সেই নিঃসঙ্গ মানব, সেই গৃহহীন কিন্তু বিশ্ববাসী সেই পুরস্কারহীন কর্মী – দেখতে পান তাঁর স্বদেশে এখনো কুহেলিকা, রিক্ততা, জীবনের পরাজয় চতুর্দিকে এবং তাঁর নিজের প্রবল অভিধায় পূরিত শব্দ ‘বিস্ময়’-এর অনুপস্থিতি; এখানেই তিনি সনাক্ত করেন তাঁর নিজের গভীর ব্যর্থতা, জীবন শেষে কামনা করেন নতুন কোনো রবীন্দ্রনাথের, যাকে তিনি তাঁরই অসামান্য শব্দপ্রতিভায় বর্ণনা করেন কেবল ‘চিরনূতন’ এবং বলেন – “তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদ্ঘাটন / সূর্যের মতন / সরিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন / ব্যক্ত হোক জীবনের জয়। / ব্যক্ত হোক তোমা’ মাঝে অসীমের চিরবিস্ময়।” তারই অপেক্ষায় আছেন বলে তিনি আপন-সূর্যাস্তের লগ্নে শুনতে পান “উদয় দিগন্তে শঙ্খ বাজে”, আর তাই তিনি পঁচিশে বৈশাখে নিজের ‘চিত্তমাঝে’ নতুনকে এইভাবে স্বাগত করেন – “মোর চিত্তমাঝে / চিরনূতনের দিলো ডাক / পঁচিশে বৈশাখ।”

বাইশে শ্রাবণের দিনে এই পাঠও আমি নিই তাঁর শেষ গান থেকে, যে, ব্যর্থতায় মলিন হয়ে, স্থবির হয়ে নীরব ও নতমুখী হয়ে যাওয়া নয়, বরং ব্যর্থতার প্রসঙ্গগুলো স্পষ্ট নির্ণয় করে যাওয়াটাই হয় আমাদের কর্তব্য। এবং এই পাঠটিও আমি নিই যে, আমাদের জীবন বিছিন্ন নয়, কর্মের একটি ধারাবাহিকতার ভেতরেই আমরা স্থাপিত।

এই গান রচনার মাত্র বাইশ দিন আগেই আরেকটি গানে রবীন্দ্রনাথ গেয়ে উঠেছিলেন, যেনবা তাঁর চারদিকে বিলীয়মান আলোর ভেতর থেকে হঠাৎ জেগে উঠে  – “ওই মহামানব আসে / দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে / মর্ত্যধূলির ঘাসে ঘাসে।” আর তিনি বালকের মতো ঘটনার আগেই ঘটনাটি ঘটে গেছে বলে নির্ণয় করেন – “আজি অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত / ধূলিতলে হয়ে গেলো ভগ্ন।”

কিন্তু অমারাত্রির দুর্গতোরণ কি সত্যি সত্যি ভেঙেছে? অশুভ তোরণ কি আরো বরং ওঠেনি এই বাংলায়? যে-জন্মের জন্যে আমরা প্রতীক্ষা করছিলাম, শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে যা আমরা একদা প্রত্যক্ষ করেছিলাম বাংলাদেশে এবং যাঁরও মহাপ্রয়াণের মাস এই শ্রাবণ – কী আশ্চর্য সমপাতন – তিনিও রবীন্দ্রনাথের মতোই ব্যর্থ হয়ে বিদায় নেন পৃথিবী থেকে, এবং তাঁর বিদায় রবীন্দ্রনাথের মতো পরিণত বয়সে নয়, শরীর প্রকৃত অর্থে অশক্ত বলে নয়, জীবনের পরিপূর্ণ মুহূর্তে সহিংসতার ভেতর দিয়ে ছেদন করা হয়েছিল তাঁকে, তারপর তো অমারাত্রি আরো ঘন হয়েছে আমাদের চারদিকে।

রবীন্দ্রনাথের শেষ রচনায় যে-জন্মের কথা এসেছে, – কবিতায়, গানে, – বিশেষ করে গানে, – একটি বিদায়কালে অন্য এক আবির্ভাবের কথা বারবার ব্যক্ত হয়েছে, এটি আকস্মিক নয়; এক দীর্ঘ জীবনের আহরিত অভিজ্ঞতা ও ইতিহাসবোধ থেকেই তা উৎসারিত।

 

[গানপারটীকা : সৈয়দ শামসুল হক গল্প-উপন্যাস-কবিতা-নাটক-ম্যুভিচিত্রনাট্য-কথাগীতি লিখলেও প্রবন্ধ ওই অর্থে লেখেন নাই। কিন্তু প্রচুর লিখেছেন জার্নাল। বলতে কি, নিবন্ধ-প্রবন্ধ নয়, জার্নালধাঁচের রচনায় সৈয়দ হক মুক্তকণ্ঠ স্বতোৎসার এক বিশেষ কথনকৌশল আবিষ্কার করেছেন এবং একাধিক জার্নালগ্রন্থে সেই বিদ্যুচ্চমকভরা রচনা হাজির রেখে গেছেন আমাদের জন্যে।

সৈয়দ শামসুল হকএইখানে যে-রচনাটা আমরা হাজির করেছি, ‘শেষের রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক, সৈয়দ হকের রচনাবলিতে এ-নামাঙ্কিত কোনো রচনা পাওয়া যাবে না তা বলা বাঞ্ছনীয়। তবে, ওই-যে বলছিলাম জার্নাল লিখেছেন তিনি প্রচুর পরিমাণে, তাঁর বিখ্যাত সেই ‘হৃৎকলমের টানে’ জার্নালে একাধিক ভুক্তিতে রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গ হয়েছেন অন্তরঙ্গ উপায়ে। সেই রকম ভুক্তির একটা থেকে মধ্যাংশ চয়ন করে এই শিরোনাম জুড়ে দিয়ে রবীন্দ্রপ্রয়াণমাসে গানপারের এই নিবেদন।

‘হৃৎকলমের টানে’ বইয়ের অন্তর্ভূত রবীন্দ্রনাথপ্রাসঙ্গিক ভুক্তিগুলো খুঁজে খুঁজে একত্র জড়ো করে একটা আলাদা রচনায় হাজির করেছেন সৈয়দ তাঁর জীবদ্দশার শেষের দিকে, সেই দীর্ঘ কলেবর রচনার নাম তিনি রেখেছেন ‘স্বাদিত রবীন্দ্রনাথ : হৃৎকলমের টানে’ এবং তা ‘স্বাদিত রবীন্দ্রনাথ’ নামের বইয়ের আওতায় একমলাটবদ্ধ।

পুনঃপ্রকাশিত রচনাটা ‘স্বাদিত রবীন্দ্রনাথ’ বই থেকে নেয়া হয়েছে। এইখানে রিপ্রিন্টকালে বেশ কতিপয় বানানসাম্যের ব্যাপার ছাড়া করা হয় নাই কিচ্ছুটি রদবদল বা সম্পাদনা। আঠাশ-ঊনত্রিশ-তিরিশ অঙ্কের পৃষ্ঠায় ব্যাপ্ত রচনার শেষাংশ শুধুই গৃহীত হয়েছে, পূর্বাংশ বর্তমান ভার্শনে নেয়া হয় নাই। কিছু যতিচিহ্ন যোজিত হয়েছে নয়া পাঠ উপস্থাপনকালে, এই কথাটাও উচিত উল্লেখ করা।

স্বাদিত রবীন্দ্রনাথ, সৈয়দ শামসুল হক; প্রথম প্রকাশ শুদ্ধস্বর প্রকাশনী থেকে, ২০১৩, ঢাকা। – গানপার]

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you