গান ও কবিতা || জাহেদ আহমদ

গান ও কবিতা || জাহেদ আহমদ

গান লেখেন যিনি, তিনি গীতিকার। কবিতা লেখেন যিনি, তিনি কবি। গান ও কবিতা বিষয়ে আমার দৌড় এ-পর্যন্তই। কিংবা খানিকটা এক্সটেনশন আছে এর আশেপাশে, গান ও কবিতা বিষয়ে, এবং অনেকদিন ধরে শুনে শুনে সেই এক্সটেনশনগুলো জমা হয়েছে ভেতরে আমার। তবে গান ও কবিতা, বা এভাবে উচিত বলা, গান বা কবিতা কোনোটারই ঠিক প্রাইমারি কি সেকন্ডারি কোনোপ্রকারের কোনো শেয়ারহোল্ডার আমি নই। কিন্তু শ্রোতা ছিলাম, ওয়ান্স-আপন-অ্যা-টাইম, ছিলাম হার্ডকোর গানখোর। ছিলাম কবিতারও পাঠক, সভয়ে, অকেশন্যালি কিছু কবিতা পড়তে যেয়ে বেশ প্রীতিকর অভিজ্ঞতাও জুটেছে বলে মনে পড়ে। এবং একসময় আবিষ্কার করি যে, আমার বন্ধুদের মধ্যে বেশ কয়েকজন উঁচুতলার কবি, গীতিকারও কেউ কেউ। ফলে গান ও কবিতা নিয়ে বেশ কথাবার্তা জানা হয়ে যায় তাদের সুবাদে, তাদের আচার-ব্যবহার দেখে, তাদের রঙবাহারী কাজকর্ম  থেকে। এখানে একনাগাড়ে সেইসব গল্প করা যাচ্ছে না, মাঝেসাঝে ভেঙে ভেঙে চেষ্টা করা যাবে, কারণ শীতের রাত্রি দীর্ঘ হলেও হ্রস্ব তার কাঁথা। প্রায়শ সরে যায় কাঁথা গায়ের উপর থেকে এবং আকাশকুসুম ফোটানো হয় ব্যাহত। ফুটানি হয় খুব, অবশ্য, শীতকালে। ছেলেরা ব্লেজার বা স্যুয়েটার আর মেয়েরা কার্ডিগান পরেন, খুব ভালো লাগে দেখতে তাদেরে, স্যুয়েটারে-কার্ডিগানে দেখনশোভা বাড়ে মেয়েদের-ছেলেদের। হালামলে জ্যাকেট ও শালও খুব যায় শীতপোশাক হিশেবে। লেদারজ্যাকেট জিনিশটা আমার দুইচউখের বিষ, ছোটবেলা থেকেই, আমাদের শীতে এইটা মানানসই হয় না বলেই কেন জানি মনে হয় আমার। শালটা অবশ্য খুব যায়, শাড়ির সঙ্গে তো সোহাগা, পাঞ্জাবি আর অন্য সমস্ত পোশাকের সঙ্গেও খুব মানিয়ে যায় আজকাল, দেখতে পাই। তা, যেমন শালই হোক-না-কেন, কাশ্মিরি কি কারওয়ানবাজারি। শীতকাল, টু মি, ক্রীড়ামোদের কাল, টাইম অফ টেস্ট ক্রিকেট, ফুটানিঋতু। কথা সেটা নয়, যা-ই-হোক, কথা নিম্নলিখিত।

ব্যাপারটা ইন্ট্রেস্টিং যে, যিনি কেবলি গান লেখেন তারে লোকে কবি বলে ডাকে, কিন্তু যিনি কেবলি কবিতা লেখেন তারে কেউ গীতিকার বলে ডাকছে এমনটা আমি শুনিনি। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, দেশের বরেণ্য কয়েকজন গীতিকারকে গ্রামের লোকজন কবি বলে সম্বোধনপূর্বক গঞ্জের চাদোকানে বসে পরস্পর কথা বলছে। কিন্তু উল্টোটা ঘটে না, মানে একজন কবিকে গীতিকার বলে ডাকতে সেইভাবে শোনা যায় না। এর থেকে এই সিদ্ধান্ত কি টানা যাইতে পারে যে, লোকে চায় সুর থাকুক কবিতায়! কিন্তু কবিতায় কি সুর থাকে না তবে! যত বেসুরো হোক, খটখটে গদ্যস্পন্দ কবিতা হোক, সুর তো থাকেই। ডিটেক্ট করার ক্ষেত্রে পাঠক ভেদে তরিতম হতে পারে। অ্যানিওয়ে।

কেন একজন কবিকে আলাদাভাবে লিখতে হয় গান! কবির কবিতাই কি গান নয় একেকটা! তা-ই তো হবার কথা। তা যদি না হয়, তবে তো সেই জিনিশগুলো কবিতা হয়েছে বলবার আগে দুইবার ভাবা উচিত। ঘটনাটা হলো, সুরবোধ সকলের তো সমান হয় না। যার ফলে কবিতায় সুর থাকলেও খুঁজে পান না এমন শ্রোতাপাঠক দুনিয়া শাসন করেন। আমি এমন মানুষজনকেও মিট করেছি, আমার দুর্ভাগ্য, পঁয়ষট্টি বছর বয়সের প্রৌঢ়কালে যিনি হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের সমুজদার ব্যক্তি হিশেবে একটা ক্যামোফ্ল্যাজ ধারণ করে দিনেদুপুরে চলাফেরা করেন, কিন্তু সংগীতের দন্ত্যস বর্ণের সঙ্গেও তার ন্যূনতম আত্মিক যোগ নাই ইনফ্যাক্ট। মুখস্থ কয়েকটা রাগঠাট আর কয়েকজন মশহুর গাইয়ের নাম ঠোঁটে ঝুলিয়ে রেখে তিনি জিন্দেগি গুজরাইয়া যাইলেন। এহেন ফেইক শুনিয়া-মুসলমান সমুজদারদের সঙ্গে আপনি তিনদিন চলাফেরা করলেই পঁয়ষট্টি বছরের পয়্মালি ধরে ফেলবেন এবং পরবর্তী তিরিশ বছর ওই সমুজদারের সঙ্গে হেঁটে বেড়ালেও উস্তাদজির শানশওকতের কিছু স্থূল বর্ণনাই ফিরে ফিরে শুনতে থাকবেন, নাথিং এল্স, নট অ্যা সিঙ্গল লাইন এল্স, বিলিভ মি। বিকজ, ইনি তো লিভিং লিসেনার নন। ইনি ছিলেন না কোনোকালেই লিসেনার, বস্তুত। বলা যায়, ধাপ্পাবাজ সমুজদার। তেমনি ধাপ্পাবাজ কবিতাবোদ্ধা, ধাপ্পাবাজ চিত্রবোদ্ধা, ধাপ্পাবাজ শিল্পবোদ্ধায় দেশকালপাত্র আবিল হয়ে রয়েছে। ইয়া মাবুদ!

গান থেকে দূরে যেয়ে কবিতা কতটুকু কবিতা থাকে, এবং ভাইস-ভার্সা, কিংবা কতটুকু দূরত্ব একটা গান আর একটা কবিতার মধ্যে থাকলে সেইটা স্বাভাবিক সাব্যস্ত হয়! এইটা নিয়া ডিবেইট হতে পারে। এইটা নিয়া ডিবেইট হচ্ছেও; গত শতাব্দীর বৃহদাংশ থেকে সূচিত হয়ে আজও স্তিমিত পর্যায়ে এই ডিবেইট সচল। তবে সেইসব বিষয়াদি নিয়া আমার কোনো ডক্টোরাল থিসিস নাই। এই দেশে যার অন্তত একটা সাকুল্যে পিয়েচডিথিসিসও নাই, সে ডেফিনিটলি ডেইঞ্জারাস। পিয়েচডিহীন লোকেরা এ-দেশে পতিত ও অতীব অল্পবিদ্বান। কারণ অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্কর — এই বাক্য জানে সর্বজনে। সেসব ফায়্শা বাতচিত, অন্যত্র কহতব্য উহা, আপাতত ছাড়ছি।

অবশ্য এইটা ঠিক যে, একটা সময়পার্টে এসে যদি দেখা যায় কবিতা অতিগীতল হতে হতে মানবজাতির মনোটোনির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন ওই অতিগীতলতার আপদ থেকে আপাত উদ্ধারের জন্য কবিতাকে সরে আসতে হয় গান থেকে সচেতনভাবেই। তেমন হয়েছেও বটে দুনিয়াজোড়া কবিতার ইতিহাসে। রীতিমতো ইশতিহার দিয়ে বর্জন করা হয়েছে কবিতার শরীর থেকে গান ও গীতলতা। তারপরও, ওইসব সুরবর্জিত কবিতাবলিতে, এখন যখন পড়ি সেইসব এতকাল পরে, গান কি পাই না আমরা লাইনে লাইনে খুঁজে! সেই-সমস্ত ইশতিহার-আওতায় রচিত ভালো ভালো ও প্রতিনিধিস্থানীয় কবিতাবলিতে গান কি অনুপস্থিত তবু!

ধরা যাক, শুরু হলো কবিতার নামে ক্যাকোফ্যানি বা কাকস্য কৃৎকৌশল চৌদিকে। এবং দুর্ঘটনাটা কালকে থেকেই ঘটা আরম্ভ হলো। ঘনঘটায়, দামামা বাজায়ে। ইন দ্যাট কেইস, উচিত নয় কি তখন কবিতাকে ফেরায়ে নেয়া গানে ও গীতলতায়! অতিগীতলতা সর্বদাই এবং সর্বত্র বর্জনীয় বটে। লেকিন, পরিমিত ও যথোপযুক্ত সুর-গান ও গীতিময়তা কবিতার কাণ্ডেমূলে থাকা জরুরি বিবেচনা করে থাকেন মহাজন ও খুচরো বণিক অনেকেই, ডিলার ও রিটেইলার নির্বিশেষে।

একটা মাথাব্যথার ব্যাপার উল্লেখ করে এ-যাত্রা টা টা জানাই। একই অনুভূতি দুই ফর্মে — গানে ও কবিতায় — দেবার যৌক্তিকতা আদৌ রয়েছে কি না, ভাববার মতো বটে। এমনিতে একটা কথা আমরা সকলেই জানি যে যা-কিছু উৎকৃষ্ট গদ্যে বলা হয়ে গিয়েছে তা যেন কবিতায় রিমেইক করবার মতো মহাভুলটা না করি। ইংরেজি লিট্রেচারে এজরা পাউন্ডের বরাতে এই জিনিশটা আমরা জেনেছি ইতোমধ্যে। টেন ডোন্টস্। দশটা বারণবার্তা পাউন্ড দিয়েছেন নতুন-লিখতে-আসা কবিদেরে অ্যাড্রেস করে। সেই দশটা বারণের একটা হচ্ছে, উৎকৃষ্ট গদ্যে যে-কথাটা আগে বলা হয়ে গেছে সেইটা কাব্যে এস্তেমাল করাটা ব্যাপক বোকামো।

প্রসারিত অর্থে এই কথাটা, পাউন্ডের বারণবার্তাটা, গান ও কবিতার বেলায় কি প্রযোজ্য হতে পারে? হ্যাঁ, আইডিয়্যালি। এবং না, প্র্যাক্টিক্যালি। ইন প্র্যাক্টিস আমরা দেখতে পাই বাণীপ্রধান বাংলা গান সবসময় কবিতার পশ্চাদ্ধাবিত। দুইহাতে দেদারসে কেবল কবিতা থেকেই ইশারাগুলো খসিয়ে ফ্ল্যাট একটা স্ট্রাকচারের প্লেটে ফেলে সেইটা গান বানায়ে যেতেছে লোকে যুগে যুগে। কেবল আধুনিক বাংলা গানেই নয়, একই চিত্র দেখি ইংরেজি গানে। যে-কোনো ইংরেজি বাণীগীতাখ্য হাতে নিলে দেখব যে সেই রিটেন টেক্সটটা প্রাণপণ কবিতা হতে চাইছে। টেন্ডেন্সিটা গানের জন্য অত মর্তবার কিছু নয়। গানের স্বাধীন উড়ান তাতে ব্যাহত হয়।

লেনার্ড কোহেন আর বব ডিলানের লেখা লিরিকগুলারে আমরা তারিফ করি কবিতা বলে। হ্যাঁ, ঠিক আছে। এইটা আর-কিছু না, গাওগেরামে এমন একটা করে লোক প্রত্যেক গাঁয়েই থাকে যারে গোটা গ্রামবাসী মামু বলিয়া আদুরে সম্বোধন করে। যেমন কবীর সুমনের লেখা লিরিকগুলারেও কবিতা নামে ডেকে বেজায় আরাম পান অনেকে। এইগুলা আদুরে সম্বোধন। বাস্তবিক বর্ণিত তিন মিউজিশিয়্যানের কারোরই লিরিক কনভেনশন্যাল কবিতা না। বাংলা কবিতা যদি কবীর সুমন অনুসরণ করে তাইলে সেই বিদঘুটে দশাটার নাম হয় শ্রীজাত। ইংরেজি কবিতা যদি ডিলান বা কোহেন অনুসরণ করে তাইলে সেই বিচ্ছিরি পিসের নামটাও ওই শ্রীজাত বা অনুপম রায় বা ধারকাছের কিছু হবে। এখন বব ডিলান সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন বলিয়া লাফানির কিছু নাই। বরং ভাবা যেতে পারে লালন বা আরও যত লোকপদাবলির মহাজনেরা কাব্যিকতার বাইরে থেকে কবিতার-তোয়াক্কা-না-করা যে-বেপরোয়া বাংলা গানের দুর্ধর্ষ জমিন তৈয়ার করে রেখে গেছেন, সেইটা নিয়া।

ভাবা যায় নিশ্চয়, ভাবা তো যায়ই বিস্তর জিনিশ নিয়া, কিন্তু অত ভাবাভাবির কি দরকার? বানাইতে থাকো বরং কবিতার-পশ্চাদ্ধাবন-করা বাংলা গান। তর্ক করো কবীর সুমনের কাব্যমূল্য বেশি, নাকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। বাংলাদেশের ব্যান্ডগানগুলার হাবাগোবা কাব্যহীনতা নিয়াও ট্রল করতে ভুলিও না। তারপরও সত্যিকার অর্থে আধুনিক বাংলা গানের উড্ডয়ন যে এই নিষ্কাব্য পথে, এই সত্য কথাটা হাজার বোমা মারলেও গোবরমগজে ঢুকবে না তোমার। কবিতার করুণ অনুকরণ-অনুসরণ ছেড়ে বেতোয়াক্কা বেপরোয়া বাংলা গানের বোধন সমকালে বেশি লোকে চেয়েছে এহেন নজির কোনোকালেই গণ্ডায় গণ্ডায় পাওয়া যায় না। পাওয়া যাইত যদি, বাংলায় লালন-রাধারমণ-হাসন-করিম শতকে শতকে দু-দশজন তো কম-স্যে-কম মিলত।

রচনাকাল  / উইন্টার ২০১৪

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you